দেয়ালের ওইপাশে

দেয়ালের ওইপাশে

“আমার নাভীর ঠিক এক ইঞ্চি নিচে যে একটা তিল আছে এটার দিকে তুই এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলিস কেনো নাফি?” বিকালে যখন বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম সায়মা আপু যে কখন এসে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো আমি খেয়াল’ই করিনি। আমি যখন পিছন ফিরে চলে যাবো ভাবছিলাম এমন সময় সায়মা আপুর সাথে আমার ধাক্কা লাগলো। আমি আমতা-আমতা করে বললাম আপু সরি, আমি খেয়াল করিনি আপনাকে। আপু তখন কিছুটা সময় নিয়ে আমাকে ঝাড়ি দিলো কয়েকটা তারপর হঠাৎ উপরের প্রশ্নটা করে বসলেন। সায়মা আপুর এমন অদ্ভুত প্রশ্নে আমি অনেকটা ভড়কে গেলাম! অনেকটা মানে অনেকটা! কি বলে এইগুলা! আমি চোখ দুই’টা লিচুর মতো করে বড় বড় করে সায়মা আপুর দিকে একবার তাকালাম।

সায়মা আপুর চোখের ঝলসানো অগ্নিশিখা দেখে আমি সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেললাম। মাথা নিচু করে আছি দেখে সায়মা আপু আবার জিজ্ঞেস করলেন, এর আগে কখনো কোনো মেয়ের তিল দেখিস’নি? সায়মা আপুর এমন প্রশ্নে মনে হচ্ছে এখুনি মাটি খুঁড়ে ভিতরে চলে যাই। আমি কি বলবো বা কি বলা উচিত কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার হাটু কাঁপছে, লজ্জায় না ভয়ে সেটা’ই বুঝতে পারছি না। আমি আবার আমতা-আমতা করছি দেখে সায়মা আপু নিজ থেকে’ই বললেন, কারো রুমে আসার আগে তার পারমিশন নেওয়া লাগে সেটা জানিস না তুই? এই বলে তিনি আমাকে ডান গালে কষে একটা থাপ্পর মারলেন!

আসলে আজকে সকালে আম্মুকে বাসায় না পেয়ে সায়মা আপুদের ফ্লাটে গিয়েছিলাম আম্মুর খোঁজ করতে। সায়মা আপুর আম্মু আর আমার আম্মুর খুব ভালো সখ্যতা হয়েছে। প্রায় সময় দুজনে সব কিছু ভুলে গিয়ে গল্পে মেতে উঠেন। আমি যখন আম্মুকে খুঁজতে সায়মা আপুদের ফ্লাটে আসলাম তখন ড্রয়িংরুম হয়ে যখন ভুল করে সায়মা আপুর রুমে ডুকে যাচ্ছিলাম এমন সময় আমার চোখ গিয়ে পড়লো সায়মা আপুর দিকে। সায়মা আপু তখন কাপড় পালটাচ্ছিল। তখন আমার কি হয়েছিলো জানি না, আমি সায়মা আপুর দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ সায়মা আপু দরজার দিকে তাকাতে’ই আমাকে আবিষ্কার করলো আমি উনার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। আমি তখনও সায়মা আপুর দিকে তাকিয়েই আছি। যখন বুঝতে পারলাম কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে আমি সাথে সাথে সায়মা আপুদের বাসা থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।

সায়মা আপুরা আর আমরা এক’ই বিল্ডিংয়ে থাকি। আমরা ৩য় তলাতে আর আপুরা ২য় তলায়। সামিয়া আপুরা এই বাসায় উঁঠেছে ১বছর হবে হয়তো। সেদিন আমি বাসার সামনের ছোট টং দোকানে বসে চা রুটি খাচ্ছিলাম। চা খেয়ে যখন দোকানের ছোট টুল থেকে উঠলাম এমন সময় এক ভদ্রলোক এসে বললেন, আমরা এই কলোনিতে নতুন এসেছি। হাত দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে বললেন এই যে সামনের বিল্ডিংয়ে উঠেছি। আমি একটু হেসে নিয়ে বললাম আংকেল আমিও এই বাসাতে’ই ৩য় তলায় থাকি। ভদ্রলোক তখন কপালের ঘাম মুছে আমার কাধে হাত রেখে বললেন, তাহলে তো ভালোই হলো বাবা। আসলে বাবা আমরা তো নতুন এসেছি আসবাবপত্র সব গাড়িতে রাখা আছে। এইগুলা উপরে উঠানোর জন্য কাউকে খোঁজে পাচ্ছি না। তুমি কি একটু দেখবে, কাউকে যদি খোঁজে দিতে বাবা খুব উপকার হবে। আমি বললাম আরে আংকেল এই ভাবে কেনো বলছেন, আমি দেখছি কি করা যায়। সেদিন এলাকার কয়েকটা ছেলেপেলে কে নিয়ে সবগুলো আসবাবপত্র উপরে তুলে দিয়েছিলাম। ওই দিন সন্ধ্যায় যখন ছাদে বসে ইয়ারফোন কানে গুজে গানশুনছিলাম এমন সময় কেউ আমার মাথায় কিছু একটা দিয়ে একটু বড়সড় ভাবে আগাত করলো।

আমি মুখে ‘উঁহু’ শব্দ করে মাথায় হাত দিয়ে যখন পিছনে তাকালাম দেখলাম একটা মেয়ে কড়া লাল রঙের একটা সুতি জামা আর কালো রঙের একটা ওড়নামাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভূত দেখার মতো করে চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। এই বিল্ডিংয়ে বাড়িয়ালার একটা ছোট মেয়ে ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই।এই মেয়ে আসলো কোথা থেকে? আমি কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগে’ই মেয়েটা ছাদের রেলিংয়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, আজকে অনেক গরম তাই নারে? আমি মেয়েটার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলাম, চেনা নেই জানা নেই হুট করে তুইতোকারি করছেন কেনো? আর আপনি কে? এইখানে কি করেন? মেয়েটা আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ছাদে রাখা একটা ছোট গোলাপ ফুলের গাছে হাত দিয়ে বললো, এই গাছে পানি দেওয়া হয় না অনেকদিন। কেউ যত্ন নেয় না। এই ভাবে চলতে থাললে তো গাছটা মরে যাবে।

মেয়েটার কথা শুনে বরাবরের মতো আমার রাগ উঠলো। আমি একটু রাগি ভাব এনে বললাম মরে যাক! তাতে আপনার কি? আর আপনি কে বলুন তো? মেয়েটা গোলাপ গাছ থেকে সরে এসে একদম আমার কাছাকাছি চলে আসলো। আমি মেয়েটার এমন আচরণে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে পিছনে চলে গেলাম। কিরে বাবা পাগল-টাগল নাকি! প্রথমে তো ভূত ভেবেছিলাম এখন তো দেখি আস্ত একটা পাগল উঁহু পাগল না পাগলি! মেয়েটা সরে গিয়ে ছাদের রেলিংয়ে বসে আমার দিকে না তাকিয়ে’ই প্রশ্ন করলো, তুই যে চকলেট চুরি করেছিস জানিস না কারো কোনো জিনিস না বলে নেওয়া ঠিক না।

এইরে কি বলে, এই মেয়ে কি করে জানলো যে আমি চকলেট চুরি করেছি! সন্ধ্যায় যখন ২য় তলায় নতুন আসা আংকেলদের সব আসবাবপত্র এনে দিয়ে আংকেলের সাথে বসে চা খাচ্ছিলাম এমন সময় দেখি সোফায় একটা ডেইরী মিল্ক চকলেট রাখা। চকলেট দেখে হুশ ছিলো না আংকেলের সাথে কথা বলার এক ফাঁকে চকলেট টা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে কে বললো হু? মেয়েটা রেলিং থেকে উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমি এইবার আর পিছনে সরে গেলাম না। মেয়েটা আবার আমার খুব কাছাকাছি চলে এসে বললো, চুরি করেছিস ভালো কথা, আবার মিথ্যা বলিস কেনো? আমি এইবার সত্যি সত্যি লজ্জা পেলাম। লজ্জায় যখন মাথা নিচু করে হাত পকেটে দিয়ে চুলকাচ্ছিলাম এমন সময় মেয়েটা হুট করে ছাদ থেকে চলে গেলো! আমি মেয়েটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম শুধু!

একদিন বিকালে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বাজারের ওইদিকে যাচ্ছিলাম। বাসা থেকে বের হয়ে অল্প কিছুক্ষণ হাটার পর হঠাৎ কেউ আমার নাম ধরে ডাক দিলো। আমি এদিক সেদিক খোঁজছিলাম এমন সময় আমার চোখ পড়লো রাস্তার পাশের ফুচকার দোকানে। সেখানে সায়মা নামের সেই মেয়েটাসহ আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা আমাকে হাত দিয়ে ইশারায় উনার কাছে আসতে বললো। আমি মনে মনে যখন ঠিক করলাম যাবো না। যে করে’ই হোক পালাতে হবে, এমন মেয়েটা হুট করে এসে আমার হাত ধরে বললো তোকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না? চল আমার সাথে। আমি কিছু না বলে মেয়েটার পিছনে পিছনে চললাম। ফুচকার দোকানের সামনে এনে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে উনার সাথে যে মেয়েগুলো ছিলো উনাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, এই’যে সবা’ই এই পিচ্চিটা’কে চিনে রাখ। এর নাম নাফি। আমরা এক’ই বিল্ডিংয়ে থাকি। এখানে প্রায় ৬-৭ জন ছিলো, সবাই একবার করে এসে আমার গাল টিপে দিয়ে গেলো। এর মধ্যে একজন তো একেবারে আমার গালে ছোট করে একটা কিস বসিয়ে দিয়ে গেলো। আমাকে মাঝখানে রেখে সবাই আমার চারপাশে গোল করে দাঁড়িয়ে আমাকে নিয়ে সেদিন কি মজাটাই না নিয়েছিলো। এইটা ভাবতেও এখন আমার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে!

সায়মা আপু আমার থেকে মাত্র দুই বছরের সিনিয়র। আমি ইন্টারমিডিয়েট ১বর্ষে আর সায়মা আপু অনার্সে সবে উঠেছে। দুই বছর আর এমন কি পার্থক্য! কিন্তু উনি আমাকে সেই প্রথম থেকে তুই করে’ই সম্মোধন করে। আমি উনাকে প্রথম প্রথম শুধু আপনি আপনি করে বলতাম কিন্তু একদিন বিকালে যখন বাসার ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছিলাম। ঘুড়ি উড়ানোর এক পর্যায়ে আমি লাটাই’টা একটা ছোট লোহার সাথে আটকিয়ে যখন পানি খাচ্ছিলাম এমন সময় সায়মা আপু কোথা থেকে হুট করে এসে আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়িটা লাটাই থেকে সুতা কেটে আকাশে ছেড়ে দিলো! আমি তখন পানি খাচ্ছিলাম তাড়াহুড়ো করতে যেয়ে আমার গলায় পানি আটকে গেলো! যখন হাহুতাশ করছিলাম এমন সময় সায়মা আপু এসে আমার মাথায় ছোট করে দুই-তিনটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলাম।

আমি চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমার ঘুড়িটা ছেড়ে দিলেন কেনো? উনি মুখ বাকিয়ে একটা ভেঙ্গচি কেটে বললেন, আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি করেছি তোর কোনো সমস্যা?
রাগে আমার তলপেটে চাপ দিয়ে উঠলো! তলপেটে প্রেশার উঠেছে! আমি উনাকে “এইখানে দাঁড়ায় থাকেন নড়বেন না” বলে নিচে গিয়ে কাজ শেষ করে ছাদে উঠে উনাকে বললাম, আপনার সমস্যাটা কি বলুন তো! আপনি সেই প্রথম থেকে আমাকে তুইতোকারি করছেন। যেখানে পারছেন, যখন পারছেন আমাকে অপদস্ত করে’ই যাচ্ছেন। আমার এমন প্রশ্ন শুনে মনে হলো উনি বেশ মজা পেলেন।

উনি আমার সামনে এসে আমার কানের উপরের অংশে অাঙ্গুল দিয়ে একটা ঘষা দিয়ে বললেন, কিরে তোর কানের পাশে এতো ময়লা কেনো? গোসল করিস না ঠিক মতো খাটাশ কোথাকার! আমি বললাম,আমি দিনে তিনবার করে গোসল করি। দুইবার সাবান দিয়ে আর একবার শ্যাম্পু দিয়ে। উনি ছাদের রেলিংয়ে হাত দিয়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন, তুই তো আমার থেকে ছোট তাইনা? আমি বললাম হু, আপনি আমার থেকে মাত্র দুই বছরের সিনিয়র। উনি আবার বললেন, “হ্যাঁ” তুই আমাকে আপনি আপনি করে বলবি না, আপু ডাকবি বুঝলি? তুই আমার থেকে ছোট তো তাই। আমি বললাম আচ্ছা আপু।

সায়মা আপুর সাথে আমার ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে সেই অনেক আগে’ই। আমরা রোজ বিকেলে ছাদে বসে আড্ডা দেই। আমি যখন কলেজে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসি সায়মা আপু আমার জন্য রোজ রোজ রিকশা নিয়ে বসে থাকেন। আমি আর সায়মা আপু এক সাথে’ই কলেজে যাই। যদিও উনার ভার্সিটি আর আমার কলেজের রাস্তা ভিন্ন। উনি আগে আমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে তারপর উনি উনার ভার্সিটিতে যায়।

সায়মা আপুকে আমার অনেক ভালো লাগে। হ্যাঁ একটু বেশি’ই ভালোলাগে। সায়মা আপুকে নিয়ে এমন একটা মিনিট নেই যে আমি ভাবিনি। খেতে বসে, পড়তে বসে,এমনকি পরিক্ষায় বসেও সায়মা আপুকে নিয়ে ভাবতে বসতাম।
একদিন রিকশা করে কলেজে যাওয়ার পথে আমি সায়মা আপুর দিকে না তাকিয়েই বললাম, আপু একটা কথা বলার ছিলো। সায়মা আপু আমার দিকে একবার ফিরে আবার সামনের দিকে ফিরে বললেন, হুম বল কি বলবি। আমিও তখন আর কিছু না ভেবে বলেদিলাম আপু আমি তোমাকে ভালোবাসি।

আপু ফিক করে হেসে দিয়ে আমার নাক টিপে বললেন, হ্যাঁ রে আমিও এই পিচ্চি নাফি’টাকে ভালোবাসি অনেক। আমি বললাম আপু আমি সিরিয়াস! আমি তোমাকে সত্যি সত্যি অনেক ভালোবাসি। আমি তোমাকে ওই ভাবে না রিয়েলি ভালোবাসি। আমার কথা শুনে আপু একবার আমার দিকে তাকিয়ে রিকশাওয়ালা’কে রিকশা থামাতে বললেন, রিকশা থেকে নেমে আমাকে রাস্তার একপাশে দাড় করিয়েয়ে জিজ্ঞেস করলেন তুই কি বলছিস এইগুলা নাফি? তুই জানিস তুই কি বলছিস? ভেবেচিন্তে বলছিস? শুন তুই এখনও ছোট । মাত্র কলেজে উঠেছিস। এখন এইগুলা নিয়ে ভাবা ঠিক না নাফি। আমি বললাম আপু আমি সত্যি তোমাকে তো অনে! আপু আমার কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে নাফি চল। আমার রাগ হলো অনেক। রাগ করে সায়মা আপুকে ওইখানে রেখে’ই কলেজে না গিয়ে বাসায় চলে আসলাম।

ওইদিন যখন সন্ধ্যায় ছাদে একা একা বসে আকাশে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা “তারা”গুনছিলাম এমন সময় সায়মা আপু আমার পাশে এসে বসলেন। আমি সায়মা আপুকে দেখে যখন তাড়াহুড়ো করে উঠে চলে যাচ্ছিলাম এমন সময় সায়মা আপু আমার হাত ধরে বললেন, চুপচাপ এখানে বস। আমিও কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলাম। দুজনে’ই চুপ করে আছি। হঠাৎ উনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, খেলার চলে ভেঙ্গে যায় হাজারো মানুষের মন। ভালোবাসা তাদের মধ্যে ঠিকে থাকে অল্প কিছুক্ষণ। কিছু সময়, এ যেনো খানিক সময়ের ভালোবাসা। কেউ বা আসল ভালোবাসা পায়,কেউ বা আবার সব কিছু মিলে মরভূমি হয়ে যায়।

কেউ বা আবার প্রেমের সাগরে ডুব দিয়ে হৃদয়টাকে ভেঙ্গে দেয়। অতীতের কিছু কান্না কিছু সুখ সব কিছু জড়িয়ে আছে এই ভাঙ্গা মনে। মনটা হয়তো ভেঙ্গে যায় কিন্তু স্মৃতিগুলো তাজা রক্তের মতো ভেসে উঠে। প্রতিটা চোখের পলকে প্রতিটা মূহুর্তের স্মৃতিচারণ হয়। আমার বিরক্ত লাগছিলো উনার এমন কথা শুনে। আমি উনাকে রেখে’ই ছাদ থেকে নেমে নিজের রুমে চলে আসি। সকালে চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভাঙলো। রুম থেকে বের হয়ে নিচে গিয়ে যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি বিন্দুমাত্রও প্রস্তুত ছিলাম না। সায়মা আপু গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। উনার দেহ ফ্যানের সাথে দড়ি দিয়ে ঝুলানো! উনি কেনো যে এমনটা করেছিলেন তা আজও রহস্য হয়ে থাকলো আমার কাছে।

সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে রং চা খাচ্ছি। আসলে খাচ্ছি না, দুই হাতে দুই কাপ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ছোট বোন নাদিয়া’র জন্য অপেক্ষা করছি। ও আমার জন্য কি একটা আনবে বলে দৌড়ে ওর রুমের দিকে গেলো! সন্ধ্যেবেলার এই সময়টায় দুই ভাই বোন মিলে চা না খেলে চলে’ই না আমাদের। অভ্যাস হয়ে গেছে। আজ অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। সায়মা আপুর কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। কিছু কিছু স্মৃতি কখনো নষ্ট হয় না। সায়মা আপুকে এখনো আমি ভুলতে পারিনি। আসলে আমি ভুলতে চাইও না। কিছু কিছু মানুষ হৃদয়ে এমন ভাবে দাগ টেনে যায় যে, সেই দাগ মুছে ফেলার মতো আর কোনো রাস্তা থাকে না।

নাদিয়া এসে একটা ছোট বক্স এনে আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বললাম, কিরে কি আছে এতে? নাদিয়া আমার ডান হাত থেকে চা’য়ের কাপ নিয়ে ওর হাতের বক্সটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো, খুলে দেখো না কি আছে! আমি চা’য়ে একটা চুমুক দিয়ে চায়ের কাপ বারান্দার গ্রিলের পাশে রেখে বক্স খুলে দেখি একটা ঘড়ি! আমি নাদিয়ার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, কিরে ঘড়ি এনেছিস যে? আর এইটা তো মনে হচ্ছে এনেক দামি হবে? টাকা কোথায় পেয়েছিস? নাদিয়া চা’য়ের কাপে পরপর দুইটা চুমুক দিয়ে বললো, আরে না ভাইয়া, এইটা আমি কিনিনি। আমি তো জাস্ট তোমার হাতে পৌঁছে দিয়েছি মাত্র!

আমি কিছুটা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি বলিস? তুই কিনিস নি? তাহলে কে দিয়েছে তোকে? রোকাইয়া আপু দিয়েছে। আজকে বিকেলে যখন আমাকে পড়াতে আসলো তখন আমার হাতে এই বক্সটা দিয়ে বললো নাদিয়া শুনো, এই বক্সটা তোমার ভাইয়াকে দিয়ে দিও আর আমার পক্ষ থেকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে দিও। আমি তখন আপুকে জিজ্ঞেস করালাম কি আছে এতে? আপু তখন বললো তোমার ভাইয়াকে যখন দিবে তখন দেখে নিও। কিন্তু ভাইয়া হয়েছে কি তুমি তো জানো’ই আমি কেমন! আমি দেখে নিয়েছিলাম বক্সে কি আছে। সরি.. ভাইয়া..!
আমি নাদিয়া’কে কিছু’ই বললাম না। এক চুমুকে বাকি অর্ধেক চা খেয়ে বাসার বাহিরে চলে আসলাম।

রোকাইয়া হচ্ছে নাদিয়ার টিউটর। সেদিন নাদিয়া এসে বললো, ওর পড়াশুনার চাপ বাড়ছে টিউটর লাগবে। আজকাল যা অবস্থা! আমি কোনো ছেলে টিউটরে ভরসা পাচ্ছিলাম না। আমার এক বন্ধু’কে বলেছিলাম, কোনো মেয়ে টিউটর যেনো খুঁজে দেয়। এর কিছুদিন পরে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসলো। আমি তখন অফিসে কাজ করছি। দুইবার ফোন আসলো। আমি কাজের চাপে ফোন রিসিভ করিনি। অফিস থেকে বের হয়ে তখন রিকশা খুঁজছি, এমন সময় আবার ফোন আসলো। আমি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি সেই আননোন নাম্বার থেকে’ই কল আসছে। আমি ফোন রিসিভ করতে’ই ওইপাশ থেকে কেউ একজন সালাম দিলো…

– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসলাম।
– আপনি কি নাফি ?
– হ্যাঁ আমি নাফি। আপনি কে?
– জ্বী, আমি রোকাইয়া। আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি ফাহিম ভাইয়াদের এলাকাতে’ই থাকি। ফাহিম ভাইয়া বলছিলো তার এক বন্ধু নাকি টিউটর খোঁজছে। আমাকে আপনার নাম্বার দিয়ে বললনে, আপনার সাথে যেনো যোগাযোগ করি।
– হ্যাঁ, আমি ফাহিম’কে বলেছিলাম। আমার ছোট বোন এইবার এসএসসি দিবে। বাসায় এসে পড়াতে হবে পারবেন?
আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করা মাত্র’ই মেয়েটা হুট করে হ্যাঁ বলে দিলো।
বললো,

– হ্যাঁ পারবো। আসলে টিউশনি’টা আমার অনেক দরকার।
– আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে সময় করে একদিন এসে দেখে যাবেন আপনার ছাত্রীকে।
– আমি কালকেই আসবো। কাল থেকে’ই শুরু করবো। যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।
– না, না, আমার আপত্তি থাকবে কেনো! আপনি কালকে আসুন আপনার ছাত্রীর সাথে দেখা করুন, কথা বলুন। দেখুন আপনার ছাত্রী কি বলে।
– জ্বী, আচ্ছা।

সেদিন’ই প্রথম এবং শেষবার মেয়েটার সাথে আমার কথা হলো। ঠিক ভালো করে কেউ কাউকে জানিনা, চিনিনা পর্যন্ত। অবশ্য মেয়েটা আমার সম্পর্কে কতোটুকু জানে, জানি না। কিন্তু আমি মেয়েটার নাম ছাড়া আর কিছু’ই জানি না। আজ হঠাৎ আমার জন্য ঘড়ি গিফট করলো তাও অনেক দামি! মাথায় আসছে না কিছু।

রাতে অফিসের কিছু কাজ করছিলাম। বস আমাকে অনেক ভালোবাসে আর এই ভালোবাসার টানে রাতেও বাসায় বসে অফিসের কাজ করতে হয়! কাজ শেষ করে যখন বিছানায় শুলাম এমন সময় তিন্নির ফোন আসলো। তিন্নি হলো আমার অফিস কলিগ। আমরা এক’ই বিভাগে কাজ করি।

– হ্যালো নাফি সাহেব।
– হ্যাঁ তিন্নি বলেন। কি জন্য ফোন দিয়েছেন? জরুরী কিছু?
– জরুরী ছাড়া কি ফোন দেওয়া যাবে না নাকি?
– না, আসলে সেটা না!
– হুম, কি করেন? রাতে খেয়েছেন?
– অফিসের কিছু কাজ ছিলো, সেগুলা শেষ করে শুলাম মাত্র! খেয়েছি।
– ও আচ্ছা। আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না খেয়েছি কিনা?
– হুম, খেয়েছেন?
– হ্যাঁ।

তিন্নি মেয়েটার সাথে আমার অফিসের সেই প্রথম দিন থেকে’ই ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। সেদিন যখন আমি তাড়াহুড়ো’তে ভুলে দুপুরের খাবার আনতে ভুলে গিয়েছিলাম তিন্নি ওইদিন তার জন্য আনা খাবার থেকে আমাকে খাইয়েছিলো। আমি খেতে চাইনি একপ্রকার জোরজবরদস্তি করে খাইয়েছে। এমন আরো অনেক কিছু’ই আছে। এই যেমন গত সপ্তাহে অফিস থেকে বের হয়ে যখন রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম তিন্নি কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ‘ভাউ’ করে উঠলো। আমি ভয় পেয়ে “আল্লাহ গো” বলে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। মেয়েটা আমার এমন কান্ড দেখে সে কি হাসি!

আমি কিছুটা রাগি রাগি ভাব এনে বললাম এটা কি হলো? তিন্নি ওর দুই ঠোঁট এক পাশে এনে ভেঙ্গচি দিয়ে বললো এখনো কিছু হয়নি মশা’ই তবে হবে। এই বলে আমাকে টানতে টানতে অফিসের কাছে’ই একটা শপিংমলের দিকে নিয়ে গেলো। এই দোকান ওই দোকান করে শেষ পর্যন্ত একটা দোকানের সামনে এসে বললো এই ভিতরে চলেন। ভিতরে গিয়ে একটা কালো রঙের পাঞ্জাবি নিয়ে আমাকে দেখিয়ে বললো, দেখেন তো কেমন? আমি বললাম হ্যাঁ ভালো’ই তো! কার জন্য নিচ্ছেন? তিন্নি আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে’ই দোকানদার’কে পাঞ্জাবিটা প্যাক করে দিতে বললো।

শপিংমল থেকে বের হয়ে একটা কফি হাউজে এসে বসলাম। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সেই কখন থেকে মাথা ব্যথা করছে।গরম গরম কফি না হলে চলবে না। যদিও আমি কফি তেমন একটা খাইনা। আমি টেবিলে দুই হাতে ভর করে বসে আছি। তিন্নি আমার সামনের চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা আমি সেই কখন থেকে’ই আড়চোখে খেয়াল করছি। আমি একটু কেঁশে নিয়ে তিন্নিকে বললাম, কফি খেতে খেতে তো অনেকটা সময় চলে গেলো! চলেন এবার উঠি। তিন্নি আচমকা নড়েচড়ে উঠে বললো হ্যাঁ চলেন..। রিকশা করে যখন তিন্নির বাসার সামনে আসলাম ও রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে দিচ্ছিলো। আমি “এই কি করছেন কি করছেন” বলে রিকশা থেকে নেমে পরলাম। তিন্নি তখন চোখমুখ লাল করে বললো,

– কি করছি মানে! ভাড়া দিচ্ছি।
– আপনি ভাড়া দিতে যাবেন কেনো?
– কেনো দেওয়া যাবে না নাকি? এতো কথা বলবেন না তো!

তিন্নি আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে’ই ভাড়া দিয়ে গেটের ভিতরে ঢুকে গেলো। আমি রিকশায় উঠে রিকসাওয়ালা মামাকে যখন বললাম চলো মামা, তিন্নি তখন হুট করে গেটের ভিতর থেকে দৌড়ে এসে রিকশার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমি তিন্নির দিকে চোখ বড়বড় করে জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকালাম। তিন্নি হাপিয়ে উঠেছে এই অল্পতে’ই। আমি রিকশা থেকে নেমে তিন্নিকে বললাম, কি হয়েছে, এইভাবে দৌড়ে আসলেন যে? তিন্নি তার হাতের শপিং ব্যাগটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো, এই যে ধরেন এইটা আপনার জন্য। এই বলে আবার এক দৌড়ে গেটের ভিতরে চলে গেলো! মেয়েটার কান্ডকারখানা মোটেও সুবিধার ঠেকছে না। মেয়েটা যে আমাকে পছন্দ করে এটা আমি সেই অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছি।

কিন্তু এইদিকে, আমাদের অফিসের আরেক কলিগ রবিন সাহেব ও তিন্নিকে অনেক পছন্দ করে। আমি প্রায় সময় খেয়াল করেছি যে, রবিন সাহেব তিন্নির দিকে সবসময়’ই আড়চোখে তাকিয়ে থাকে, মুচকি মুচকি হাসে। তিন্নির যে কোনো কাজে হেল্প করেতে চাই বেচারা! কিন্তু তিন্নি রবিন সাহেবকে দুচোখ দেখতে পারে না। আমি এই অফিসে আসার পর একবারের জন্য তিন্নি আর রবিনকে কথা বলতে দেখিনি। মাঝে মাঝে অফিসিয়াল কাজে দুইএকটা কথা বলে শুধু। তিন্নি কেনো এমন করে এটা আমি কিছুতে’ই বুঝতে পারিনা।

আজকে বিকালে যখন অফিস থেকে একটু তারাতাড়ি বাসায় ফিরলাম। বাসায় ঢুকে বসার রুমে একটা মেয়েকে দেখলাম জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আমি কাধের ব্যাগটা সোফায় রাখতে রাখতে নাদিয়াকে এক গ্লাস পান দিতে বলে আমি আমার রুমে ঢুকে গেলাম। যখন পড়নের শার্ট’টা খুলে বিছনার উপরে ফেললাম এমন সময় দরজার পাশে কেউ একজন একটু কাঁশি দিয়ে বললো, আপনার পানি! আমি বিছানা থেকে শার্ট গায়ে দিয়ে বোতাম গুলা লাগাতে লাগাতে বললাম, আপনি পানি আনলেন যে নাদিয়া কোথায়? বাসায় কেউ নেই?

আর আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না। মেয়েটা আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বললো, নাদিয়া ছাদে গেছে কাপড় নিয়ে আসার জন্য। আর আন্টিও বাসায় নেই। আমি নাদিয়ার টিউটর। নাদিয়াকে আমি’ই পড়া’ই। আমি এক চুমুকে গ্লাসের সবটুকু পানি খেয়ে মেয়েটার উদ্দ্যেশ্যে বললাম, ও আপনি’ই কি তাহলে মিস রোকাইয়া? মেয়েটা হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিতে নিতে বললো, জ্বী আমি রোকাইয়া। আমি বললাম, আসলে আপনার সাথে তো এর আগে আমার কখনো দেখা হয় নি। তাই চিনতে পারিনি, আমি দুঃখিত। মেয়েটা মুখের কোনায় এক চিলতে হাসি এনে বললো, আমাদের কিন্তু কথা হয়েছে একবার! আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ালাম।

অফিসে যাওয়া হয়না আজ তিনদিন হতে চললো। ছুটি নিয়েছি। অবশ্য ছুটি’টা আমার জন্য নেই’নি। নিয়েছি তিন্নির জন্য। তিন্নির সাথে আমি ওর গ্রামের বাড়িতে আসলাম। সেদিন যখন অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম এমন সময় তিন্নি আমাকে ফোন দিয়ে বললো,

– নাফি আপনি কি অফিসে?
– না, মাত্র অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছি। আজকে আপনি অফিসে আসলেন না কেনো? শরীর খারাপ?
– তিন্নি আমার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে বললো আপনি কি এখুনি আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবেন?
– কেনো কি হয়েছে?
– আগে দেখা করুন। দেখা হলে বলবো। আমিও আর কিছু না বলে কোথায় আসতে হবে জিজ্ঞেস করে ফোন রেখে দিলাম।

তিন্নির সাথে ওর গ্রামের বাড়িতে আসার কারণ হলো, ওর বাবা মা ওর বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক করেছিলো। আমরা যেদিন তিন্নিদের গ্রামে আসি সেদিন’ই তিন্নির সাথে প্রবাসী এক ছেলের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তিন্নি কিছুতে’ই এই বিয়েতে রাজি ছিলো না।সেজন্য তিন্নি আমাকে তার বয়ফ্রেন্ড হিসেবে তিন্নির বাবা মা’র কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। যদিও আমি প্রথমে রাজি ছিলাম না কিন্তু তিন্নির মুখের দিকে চেয়ে আর না করতে পারিনি আর সবচেয়ে বড় কথা এইটা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় ছিলো না। কিন্তু এখন মহা বিপদে পড়েছি। তিন্নির বাবা মা তিন্নির সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। বলেছে আগামি কালকে’ই আমাদের বিয়ে করিয়ে দিবে। তিন্নিদের বাড়িতে আসার পর থেকে তিন্নির সাথে আমার তেমন ভাবে কথা হচ্ছে না। সুযোগ পাচ্ছি না কথা বলার।

আমি খুব ভালো করে’ই জানি তিন্নির সাথে আমার বিয়েটা হোক এটা তিন্নি নিজে’ই চাচ্ছে। তিন্নি আমাকে ভালোবাসে এটা আমি সেই অনেক আগে থেকে’ই জানি। তিন্নি হাসিখুশি সারা বাড়ি পায়চারি করছে। কিন্তু আমার আমি ঠিক নেই। এখন মনে হচ্ছে তিন্নির সাথে এখানে এসে অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। তিন্নির সাথে যে করে’ই হোক কথা বলতে’ই হবে আমার।

তিন্নির সাথে আমার দেখা হলো পরদিন সকাল বেলা অর্থাৎ যেদিন আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। সবার মধ্য থেকে তিন্নিকে এক সাইডে নিয়ে বললাম, তিন্নি আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। তিন্নি একটা হাসি দিয়ে বললো হ্যাঁ বলুন কি বলবেন। আমি বললাম না এখানে না, অন্য কোথাও চলুন। তিন্নি আমাকে বাড়ির পিছনের ছোট আম গাছটার নিচে এনে বললো, এইবার বলুন কি বলবেন। আমি পকেটে হাত দিয়ে চুলকাতে-চুলকাতে বললাম, দেখুন তিন্নি, আমি জানি আপনি আমাকে অনেক পছন্দ করেন। হয়তো ভালোবাসেন। কিন্তু তিন্নি আমি আপনাকে কখনো সে ভাবে দেখিনি। আমি আপনাকে সবসময় আমার একজন ভালো বন্ধু হিসেবে’ই দেখে এসেছি। আমি এটাও জানি আপনার সাথে আমার বিয়ে হলে আপনার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হবে না। কিন্তু তিন্নি আপনাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না। আমি যখন কথাগুলো বলছিলাম আমি স্পষ্ট তিন্নির চোখে পানি দেখতে পাচ্ছিলাম। তিন্নি কিছুটা সময় নিয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বললো,

যখন মনটা ভেঙ্গে যায়, ভেঙ্গে যায় হাজারো স্বপ্ন। অন্ধ হয়ে যায় স্বপ্নের সেই চোখ। খানিকটা সময়ের জন্য মনে হয় সব হারালাম। জানেন? আমার স্বপ্নগুলো আগের মতোই থাকবে। আমার স্বপ্নগুলো সেই রঙিন স্বপ্ন’ই থাকবে। থাকবে না সেই রঙিন স্বপ্নের রাজকুমার! নাফি সাহেব আপনি যান আপনাকে আমি আটকাবো না। আপনাকে আঁটকে রাখার মতো যোগ্যতা আমার এখনো হয়নি। ওইযে রাস্তাটা দেখছেন এই পথ ধরে সোজা হেটে গেলে বড় রাস্তা পাবেন। সেখান থেকে বাসে করে সোজা চলে যান।

অফিসে হাতে ফাইল নিয়ে বসে আছি। হাতে প্রচুর কাজ থাকা শর্তেও একদম কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। বারবার তিন্নির কথা মনে পড়ছে। তিন্নি এখন আর অফিসে আসে না। ওর সাথে দেখা বা কথা কোনোটা’ই হয় না আমার। কাজে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না কিছুতে’ই, বারবার শুধু তিন্নির কান্না মাখা মুখটা’ই ভেসে উঠছে।

গত মাসের শেষ দিকে আমি বিয়ে করে নিয়েছি। সেদিন রাতের খাবার শেষ করে যখন ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম এমন সময় আম্মা আর নাদিয়া এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমি আম্মাকে বসতে বলে ল্যাপটপ বিছানার পাশে রাখলাম। আম্মা একবার নাদিয়া’র দিকে তাকায় তো নাদিয়া একবার আম্মার দিকে তাকায়। উনাদের কান্ডকারখানা দেখে আমি হেসে দিয়ে বললাম, কি হলো কিছু বলবে নাকি তোমরা? আম্মা একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, নাফি অনেক তো হলো, করবি করবি বলে তো অনেক সময় হয়ে গেলো! আমি আম্মার কথা বুঝতে না পেরে বললাম, তোমার কথা বুঝতে পারছি না আম্মা, কি করবো? আম্মা বললেন, বিয়ে’টা এবার করে নে না! বয়স তো আর কম হলো না, ভালো চাকরি করছিস, বেতন ও ভালো। বিয়েটা এবার করে নে। আচ্ছা তোর কোনো পছন্দের মেয়ে আছে? তুই কি কাউকে পছন্দ করিস? আমি বিছানা থেকে ল্যাপটপ হাতে নিয়ে আম্মাকে বললাম, না আম্মা আমি কাউকে পছন্দ করি না।তোমরা মেয়ে দেখো আমার জন্য।

তখন আম্মা আর নাদিয়া হেসে দিয়ে বললো, আমাদের মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। আমি ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে আম্মার দিকে আর নাদিয়ার দিয়ে তাকালাম। আম্মা বললো, রোকাইয়া’কে তোর কেমন লাগে? আমার আর তোর বোনের অনেক পছন্দ মেয়েটাকে। তুই যদি বলিস তো রোকাইয়ার আব্বা আম্মার সাথে কথা বলি?
আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ালাম।

রোকাইয়া’কে নিয়ে বাসে বসে আছি।সেই কখন থেকে জ্যাম লেগে আছে রাস্তায়। বাস এক বিন্দু ও সামনে এগোচ্ছে না। রোকাইয়া’কে নিয়ে তিন্নিদের গ্রামে যাচ্ছি। আজকে তিন্নির বিয়ে! হ্যাঁ তিন্নির বিয়ে! তিন্নির বিয়েটা আর কারো সাথে না আমার অফিস কলিগ রবিন সাহেবের সাথে’ই হচ্ছে! যাকে তিন্নি দুইচোখে দেখতে পারতো না! উনাদের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে যে এতো দূর পর্যন্ত এলো এটা জানার জন্য আমার আর তর সইছে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত