বাসায় জরুরি সভা বসেছে। যথারীতি বড় আন্টি সভার সভাপতি। আমি সিংগেল সোফায় মাথা নীচু করে বসে আছি। আমাকে নিয়েই সভা। আমার বিয়ের কপাল খুলছে না। নয়টা মেয়ে দেখা হয়েছে। আটটা সরাসরি না করে দিয়েছে শুধুমাত্র একটা মোটামুটি ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল। এনগেজমেন্ট এর ডেইট ঠিক করার জন্য রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছিল। মেয়ে বড় আন্টিকে লেডিস ওয়াশরুমে ঢেকে নিয়ে পা ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। আন্টি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলে আন্টি সাধারণত “ধ্যাৎ” শব্দটা বলেন। এইবারো বললেন।
– ধ্যাৎ! কি হয়েছে? পা ধরে কান্নাকাটি শুরু করলা কেন? কি মুশকিল! মেয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল, আন্টি আপনি বিয়েটা ভেংগে দেন।
– বিয়ে ভেংগে দিব কেন? কি বলছো এসব। ছেলে পছন্দ হয় নি তোমার? এত ভাল ছেলে। আমার বোনের ছেলে বলে বলছি না। ভাল চাকরী করে, ব্যবহার কত ভাল। শুধু একটা সমস্যা বলতে পারো বয়স চল্লিশ এর কোঠায় চলে গেছে। অই ক্যারিয়ার করে করে বয়সের এই বারোটা বাজিয়েছে।
– সব ঠিক আছে আন্টি কিন্তু আমারতো বিএফ আছে।
– বিএফ আছে মানে? এইটা কি রোগ মা? আন্টি চোখ কপালে তুলে ফেললেন।
– এইটা কোন রোগ না আন্টি। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। আমি ওকে ছাড়া বাঁঁচবো না। প্লিজ আন্টি আপনি আমার মায়ের মত। আমাকে বাচান। আন্টি এইবার চরম বিরক্ত হলেন। আবারও “ধ্যাৎ ” বলে মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর আবার কথা বলতে শুরু করলেন।
– বি এফ, ফি এফ আছে এতদিন বলো নাই কেন? শুধু শুধু আমরা এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিলা। যাও, ঠিক আছে। তোমার বিয়ে করতে হবে না। তুমি বিএফ নিয়া ঘুরে বেড়াও। বনবাদাড়ে যাও, সমুদ্রের পাড়ে যাও। যত্তসব। আজকালের মেয়েদের কথা আর কি বলবো।
আমি সবে ফ্রাইড চিকেনে সজোরে কামড় বসিয়েছি আন্টি হনহন করে এসে বলল, চল সবাই। এই বিয়ে হবে না মেয়ের বিএফ আছে। বিয়ে হবে কি হবে কি হবে না সেটা নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ ছিল না কিন্তু ফ্রাইড চিকেনটা না খেয়েই উঠে যেতে হবে ভেবে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। একবার ভেবেছিলাম বলি যে আন্টি এসেছি যখন খেয়ে যাই ভদ্রতা বলে একটা ব্যাপার আছে তাছাড়া বিলটাতো আমরাই দিব কিন্তু আন্টির রুদ্রমূর্তি দেখে বলার সাহস পেলাম না। সেদিনের পর আন্টি জরুরি সভা কল করেছেন। উনার কথা হচ্ছে পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি ছেলে, গায়ের রং মানানসই, ভাল চাকরী করে তারপরো কেন মেয়ে পক্ষ পছন্দ করবে না। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর কি মনে হয়? কেন তোকে মেয়ে পক্ষ পছন্দ করছে না?
আমি মিনমিনে গলায় বললাম, আমি কি করে বলবো। হয়ত বয়সটা ফ্যাক্টর। আন্টি টি টেবিল চাপড়ে বললেন, ফালতু কথা বলবি না। কিসের বয়স ফ্যাক্টর! চল্লিশ বছর বয়সে পুরুষদের বিয়ে হয় না? আরে বাংলাদেশে যে সব মেয়েরা ক্যারিয়ার করে বিয়ে করতে চায় তাদের বয়সও তো ত্রিশ পঁয়ত্রিশ পার হয়ে যায়। আমি সিউর তোর উপর খারাপ কিছুর আছর পড়েছে। আমি ব্যাবস্থা নিচ্ছি। এইভাবে হবে না। খামোখা টাকা নষ্ট। রেস্টুরেন্টের বিল দিয়ে ফেলছি পঞ্চাশ হাজার টাকার উপরে। আমি মাথা নিচু করে বললাম, আন্টি তোমার জানাশুনা ভাল কোন হুজুরের পানি পড়া খেলে কাজ হতে পারে।
আন্টি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, ফাইজলামি করবি না। দোয়া দরুদ পড়। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি কর। আমি এইবার আন্টির দিকে তাকালাম। আস্তে করে বললাম, বিয়ের জন্য আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করবো? এই বয়সে। কি বলেন আন্টি এসব। আন্টি আম্মার দিকে তাকিয়ে বলে, তোর ছেলে কি বলে শুন। এই বয়সে কান্নাকাটি করবি না তো কি আশি বছরের বুড়া হওয়ার পর করবি। আমি আর কিছু বলি নাই। তারপর সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে আছি। আন্টি আবার বলে উঠলেন, আচ্ছা যাই হোক আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমার খুব পরিচিত একজন জ্যোতিষী আছেন। শুক্রবারে কোন কাজ রাখবি না। আমরা উনার কাছে যাব। উনি গ্রহ নক্ষত্র দেখে ভাল কোন সাজেশন দিতে পারবে। আমার যেহেতু না বলার কোন সুযোগ নাই তাই মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
ভদ্রলোকের ধবধবে সাদা গোফ আর কুচকুচে কালো চুল। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন এর মধ্যে হবে। বড় মগভর্তি চা নিয়ে অদ্ভুত ভংগিমায় আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। শুক্রবার তাই আমরা ভদ্রলোকের বাসার অফিসে এসেছি। আমার এক পাশে আন্টি আর একপাশে আম্মা বসে আছেন। ভদ্রলোকের তাকিয়ে থাকা দেখে বুঝতে পারছি আন্টি সব কিছু আগে থেকে উনাকে ইনফর্ম করে রেখেছেন।
– হাতি কিভাবে পোষ মানায় জানেন?
কাকে উদ্দেশ্য করে উনি প্রশ্ন করেছেন বুঝতে না পেরে আমরা সবাই চুপ করে আছি। উনি আমার দিকে আংগুলের ইশারা দিয়ে বললেন, আপনাকে বলছি। হাতি কিভাবে পোষ মানায় জানেন? আমি বললাম, জ্বী না। জানি না। আমি জীবনে মোটে দুই থেকে তিনবার হাতি দেখেছি। আন্টি আমার হাত চেপে ফিসফিস করে বললেন, বেশি কথা বলিস না। যা জানতে চায় তাই বল।
আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। জ্যোতিষ সাহেব বলতে শুরু করলেন,হাতিকে খুব ছোটবেলায় শিকল দিয়ে গাছের সাথে বেধে রাখা হয়। হাতি সেই শিকল খুলতে চেষ্টা করে কিন্তু খুলতে পারে না। অনেক সময় হাতির পা কেটে যায় শিকলে। এইভাবে অনেক দিন চেষ্টা করার পর যখন খুলতে পারে না তখন হাতি ধরেই নেয় যে তার পক্ষে এই বাধন খোলা সম্ভব না। তাই সে আর চেষ্টাও করে না। একটা পরিপূর্ণ হাতি চাইলে এক ঝটকায় গাছ উপড়ে চেইন খুলে ফেলতে পারে কিন্তু সে চেষ্টা ও করেনা আর তাকে বেধে রাখারও প্রয়োজন পড়ে না। সে পোষ মেনে যায়। কি বুঝলেন? আমি বললাম, হাতিকে পোষ মানানো অনেক সহজ।
জ্যোতিষ সাহেবের আমার জবাব বোধহয় পছন্দ হয় নি। কিছুটা বিরক্তির সুরে আন্টিকে বললেন, বয়স বাড়লেই মানুষের বুদ্ধি হয় না, বুদ্ধি অন্য জিনিস। আপনার বোনের ছেলের বুদ্ধি শুদ্ধি কম। আমার বুদ্ধি শুদ্ধি কম শুনে আন্টিকে মনে হল খুব খুশি হয়েছেন। আনন্দিত গলায় বললেন, আর বইলেন না ভাই। আমাদের এই ছেলেটার বুদ্ধি শুদ্ধি আসলেই কম। তা না হলে এত দিনে একটা মেয়ে পটাতে পারলো না বিয়ে করার জন্য। আপনি একটু হাতটা দেখে বলেন না আমরা কি করতে পারি। আমরা খুব টেনশানে আছি ওকে নিয়ে। আমার বোনের একটা মাত্র ছেলে। স্বামীকে হারিয়ে আজকে বাইশ বছর এই ছেলেকে নিয়ে আছে।
কথা বার্তা যখন চলছিল তখন আমাদের সামনে নাস্তার ট্রে আসল। বুঝতে পারলাম জ্যোতিষ সাহেব আন্টিকে আলাদা খাতির করে। আন্টির বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ কিছু লোক আছে এই যেমন যখন তখন ট্রেনের টিকেট কাটার লোক, ফ্রেশ টাটকা পাবদা মাছ বাজারে আসলে বাসায় পৌছে দেওয়ার লোক এই টাইপের। উনিও সেই টাইপের কেউ তা নাস্তার বহর দেখে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সমস্যা বাধলো অন্য জায়গায়। নাস্তা নিয়ে এসেছে জ্যোতিষ সাহেবের মেয়ে বোধহয়। অসম্ভব রূপবতী একজন মেয়ে। আমি চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে নিয়েছি কিন্তু সেই দুই তিন সেকেন্ড সময়েই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার আগে কখনও এমন হয় নি। আন্টির দিকে তাকালাম আন্টিও আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যপূর্ণ লুক দিল। আমি আন্টির কানে কানে বললাম, আমি যা ভাবছি আপনিও কি তাই ভাবছেন আন্টি? আন্টি আবার আমার হাত চাপড়ে বললেন, এই বিষয়ে পরে কথা হবে।
জ্যোতিষ সাহেবের চেম্বারে ঘন্টা দেড়েক থেকে আমরা বের হলাম। উনি খুব ভাল করে আমার হাত দেখলেন, বই খুলে কি যেন মেলালেন। কিছু পাথর টাথর নিতে হবে বললেন। আন্টি আবার আসার এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বের হয়ে আসলেন। তবে খেয়াল করলাম আন্টি উনার অফিসের চেয়ে বাসায় আসার ব্যাপারে বেশি সিরিয়াস ছিলেন।
বুঝতে পারলাম জ্যোতিষ সাহেবের মেয়েকে দেখে আমি যা ভেবেছি আন্টিও তাই-ই ভাবছে!