দূরে কোথাও

দূরে কোথাও

বিয়ের প্রথম রাতেই তপতী বলেছিলো, “আমি হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রান পাচ্ছি, আপনিও কি পাচ্ছেন ?” তপতীর কথা শুনে এক গাল হেঁসে বলেছিলাম, দরজার ওপাশে আমার একটা হাসনাহেনা ফুলের গাছ আছে।তুমি যদি চাও তোমাকে এখন দেখাতে পারি।বাহিরে অজস্র জোৎস্না, আমি নিশ্চিত তোমার ভালো লাগবে!” আমার কথা শুনে তপতী অবাক হয়ে বললো, “আপনি কি জানেন না হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণে সাপ আছে?” আমার হাসনাহেনা গাছের বদনাম শুনে আমি মুখ ভেংচি কেটে বলেছিলাম, ” সবাই বলে কিন্তু কখনো সাপ দেখিনি।” ছেলে হয়েও আমাকে এমন মুখ ভেংচি কাটতে দেখে তপতী সেদিন খুব হেঁসেছিলো। কে জানতো তখন,সেই সাপের কামড়ে একদিন তপতীর মৃত্যু হবে! দীর্ঘ সংসার জীবনের প্রায় ৫০ বছরের মায়া কাটিয়ে একদিন সাঁঝের বেলা তপতী এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যায়। সেদিন বারবার হৃদয়ে বেঁজে উঠেছিলো অনেক বছর আগের সেই কথাটি।

তপতী বলেছিলো, “আপনি জানেন না হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণে সাপ আসে?” আজো মনে পড়ে সেদিনের কথা!  তপতী এক রাশ লজ্জা নিয়ে পা রেখেছিলো এই বাড়িতে। যে লজ্জা কাটিয়ে  এক পর্যায়ে সেও পা রেখেছিলো বৃদ্ধাদের কাতারে। কিন্তু তাতে কি! বয়সে ভারে  তার শরীরে চামড়ার ভাঁজ , নড়বড়ে দাঁত আর তার হারানো যৌবন মোটেও আমায় ব্যাথিত করতে পারেনি। বরং এই বয়সেও তপতীকে আমার একটু বেশীই ভালো লাগতো। সেই তপতী ও আমাকে ছেড়ে গেছে প্রায় বছর পাঁচেক হলো।

এখন আর কেউ খাওয়া-দাওয়া,গোসলের খোঁজ রাখেনা।এমনকি কাশি দিতে দিতে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও কেউ বলেনা, “আমি বড্ড রেগে আছি আজ কারণ তুমি আজো জ্বর আর কাশি বাঁধিয়ে বসে আছো।” মা গত হলেন তা-ও প্রায় ১৫ বছর। বয়সের বৃদ্ধিতে মায়ের কাঁচা চুলগুলোও একদিন সাদা রঙে রুপান্তরিত হয়েছিলো। মা তখন আর আমাদের জন্য সরষে ইলিশ,ঝাল গরুর মাংস এমনকি বিভিন্ন ধরনের পিঠা বানাতে পারতো না।

এগুলোর দায়িত্ব পরতো তপতীর উপর।মা এই বৃদ্ধ বয়সেও মাঝেমাঝে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। ছোটো খাটো ভুল করলে বকাঝকা করতেন পরক্ষণে আবার বুকে টেনে নিয়ে আমার ভুলগুলো শুধরিয়ে দিতেন। আমার সেই মা হঠাৎ একদিন গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন।সুস্থ হয়ে আর তার সাজানো গোছানো সংসারে ফেরা হয়নি।এমনকি শেষবারের মতো তাকে ঘরেও তোলা হয়নি। অথচ একসময় এই ঘরটাই ছিলো তার এক টুকরো অবকাশের নীড়। বাবা মারা গেছেন মায়ের মৃত্যুর বছর খানেক পর।সবাই বলতো মায়ের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। কিভাবে এতো সহসাই শোক কাটিয়ে উঠবেন তিনি ? কারণ আমার বাবা মা তাদের জীবনকালে কখনো আলাদা রুমে ঘুমায়নি।

বাবাকে শেষবারের মতো দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম। এই বাবা টা আমাদের ভালো রাখার জন্য এক জীবনে কতোটাই না কষ্ট করে গেলেন। বাবার হাতটা ছাড়তে বড্ড কষ্ট হয়েছিলো কারন এই হাতটাই একদিন আমাকে “হাঁটি-হাঁটি-পা-পা “করে বড় করে তুলে বাস্তবতাকে খুব সুন্দর করে বুঁঝিয়ে দিয়েছিলেন। সবাই তখন আমাকে এক কথা বলে স্বান্তনা দিতো আর তা হলো, “কারো বাবা-মা চিরদিন বেঁচে থাকে না”। এরপর আরো কতো মানুষ এক এক করে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেলো। এই বাড়ি আর এই শহরের অলিগলির সমস্ত ধুলি কনা  আমার গল্পগুলো জানে। ছোটবেলা এই বাড়ির দেয়ালেই শুরু হয়েছিলো আমার প্রথম হাতেখড়ি।

প্রত্যেকটা রুমে আছে তপতী,বাবা আর মায়ের হাতের ছোঁয়া। এই বাড়ির জানালাগুলো স্বাক্ষী আছে আমি প্রতিদিন এখান থেকেই সকালের সূর্য ওঠা দেখতাম, বাহিরের বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতিতে আচ্ছন্ন হতাম এবং দিনশেষে তারা গোনার মতো বোকা বোকা কাজে মত্ত থাকতাম। পাশের ঘর থেকে ছেলে বউ আর তার ছোট ছেলে তামিমের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। তারাই হবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের শীর্ষে এই পৃথিবীর সঙ্গী। আজকাল আমারও বয়স বেড়ে গেছে।দাঁত ও কয়েকটা পরে গেছে।শরীরে আগের মতো আর শক্তি নেই,রোগ ব্যাধি আজকাল আমায় কাবু করে ফলেছে। জানি এই পৃথিবীতে বেশীদিন আর বাঁচব না। কিন্তু স্বাক্ষীস্বরুপ থাকবে এই বাড়ির দেয়াল,কিছু কিছু জিনিস এবং এই পৃথিবীর ধুলি কনা।

একদিন  আমার এই বাড়িতে বিচরণ করবে অন্য কেউ,হয়তো এই বাড়ি চিরকাল থাকবেনা কিন্তু  জায়গাটা এখানে ঠিকই থাকবে।তখন কেউ জানবে না এখানে একটা টিনের চালের বাড়ি ছিলো।যেখানে বৃষ্টিরদিনে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শোনা যেতো। এই বাড়িতে একটা রাজা আর একটা রানী আর তাদের কয়েকটা সন্তান বাস করতো।তাদের প্রত্যেকটা গল্প সেই বাড়ির দেয়ালজুড়ে লিখা ছিলো!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত