প্রকৃতির প্রতিশোধ

প্রকৃতির প্রতিশোধ

-মেয়েটা বিষ খেলো কেন?

আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো ডাক্তার শুভ। প্রশ্নটা আমাকে খুব ভাবিয়ে তুললো, কারণ আমার বাড়িতে তাকে যতদিন নিয়ে এসেছি ততদিন কোনো প্রকার সমস্যা হয় নি।তাহলে বিষ খেতে যাবে কেন? শান্তর দিকে তাকিয়ে দেখি সে মোবাইল টিপাতে ব্যস্ত।বাড়ির কাজের মেয়ে বিষ খেয়েছে এটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নাই। আমি ডাক্তারকে বললাম,

-সুমাইয়ার জ্ঞান ফিরলেই বরং শোনা যাবে কেন সে এই কাজ করলো?

-হ্যাঁ , সেটাই ভালো হবে।

আমি শান্তকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম।হাসপাতালে থেকে ওর কাজ নেই। সুমাইয়ার জ্ঞান ফিরলো একবারে সন্ধ্যার দিকে।আমি কাছে গিয়ে বসতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো।আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

-এই পাগলী,কোনো সমস্যা হয়েছে কি?কেউ বকা দিছে নাকি?তুই বিষ খেতে গেলি কেন?,

-আমি বিষ খাবো কেন আপা?আপনে আমারে আজ সকালে যেই ভাত দিলেন ওইটা খাওয়ার পরেই তো আমার এরকম অবস্থা হয়েছে।আমার গলা শুকিয়ে আসছিলো।দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।আপনে আমারে কি খাওয়ালেন আপা! আমি মরে গেলে আমার মা আর ছোটবোনকে কে দেখতো?

সুমাইয়ার কাছে কিছুক্ষণ বসে থেকে হাসপাতালের ছাদে গেলাম।আমার মাথা কাজ করছিলো না।আমি সুমাইয়াকে বিষ কেন খাওয়াতে যাবো?না আমি ভুলে কাজটা করেছি?আর কেনই বা করবো?

ঠিক তখনি আমার মনে পড়লো, আমি সকালে যে ভাত সুমাইয়াকে দিয়েছিলাম আসলে সেটা আমার জন্য স্পেশালি রান্না করেছিলো শান্ত।তবে কি শান্ত খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল?না, না, শান্ত এটা করবে কেন?মাথাটা মারাত্মক যন্ত্রণা দিচ্ছিলো, তাই ভাবলাম বাড়ি গিয়ে গোসল করে আসি।

সুমাইয়ার অবস্থা কিছুটা ভালো হওয়ায় তাকে ১ ঘন্টার জন্য রেখে বাড়িতে আসলাম।বাড়িতে আসার আগে শান্তকে ফোন দেয়া হয়নি।রুমে ঢুকে বেডরুমের দিকে পা বাড়ালাম।বাইরে থেকেই শুনতে পেলাম শান্ত কারো সাথে ফোনে কথাবলছে। কথাগুলো আমার কানে খুব ভালোভাবেই আসলো,

-তোমার আপা একটা কৈ মাছ,বুঝছো?আর ওই কাজের মেয়েটার জন্যই প্ল্যানটা ভেস্তে গেলো।নাইলে আজকেই তোমার আপাকে পরপারের টিকিট ধরিয়ে দিতাম। সারাদিনে কোথায় ছিলে?এতবার কল করেছি,তোমাকে পাইনি!

শান্তর কথা বলার ধরণ দেখেই আমি বুঝতে পারলাম সে কথা বলছে আমার বোনের সাথে।আমার একমাত্র জমজ বোন শোভার সাথে শান্তর অবৈধ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো।কিন্তু সেটা তো আরো অনেক আগেই দুজনকে সামনে ধরে বলেছিলাম।তারা বলেছিল তাদের ভুল হয়ে গেছে এমনটা আর করবে না!

আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল।আমি এতদিন ভুল ভাবতাম।আমার নানী একটা কথা বলতো, যে গরু গু খায়,মুখে টুঙা বেধে দিলেও খায়। কথাটা যে ১০০% সত্য তা বুঝতে আমার বাকি রইলো না।বেডরুমে না ঢুকে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।মাথায় প্রচুর পানিঢালা সত্ত্বেও মাথা ঠান্ডা করতে পারছিলাম না। শুধু আমার অতীত আমার সামনে এসে নাড়া দিচ্ছিলো।

এক বছর প্রেম করে আমরা দুজন বিয়ে করেছিলাম।আমার একটা জমজ বোন আছে।একদম অবিকল আমার মতো দেখতে। অনেকে আমাদের দুজনকে চিনতে পারে না, কে কোনটা? আমার বাবাও অনেক সময় ভুল করে বসতো।ওর নাম শোভা।শোভার ভুলের কারনে কতবার যে আমি বাবার হাতে মাইর খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। বিয়ের কিছুদিন পর একদিন ওয়াশরুম থেকে এসে দেখি শান্ত শোভাকে জড়িয়ে ধরে আছে।আমি সেটা দেখামাত্রই শান্তকে বললাম,

-শান্ত আমি এখানে।ওটা শোভা।

শান্ত সরি বলতে বলতে ছেড়ে দিয়েছিলো সেদিন।আমিও বিষয়টা নরমালি নিয়েছিলাম।কিন্তু এরপরেও বহুবার এমনটা করেছে শান্ত।মাঝে মাঝে ঝগড়াও করেছি দুজন।শান্তকে বলতাম, কেমন ভালোবাসো আমায় যে চিনতে পারো না। কিন্তু আমার চিন্তাভাবনা যে ভুল ছিলো তা একদিন অফিস থেকে ফিরে এসেই বুঝেছিলাম।আদিম খেলায় মত্ত শান্ত

-শোভার নগ্ন জুটি দেখে সেদিন শুধু হাতে তালিই দিয়েছিলাম।শোভাকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম সেদিন।আর শান্তকে আমার মাথায় হাত রেখে শপথ করিয়েছিলাম,যেন এমনটা আর না করে।
তারপর থেকে শোভার আমাদের বাড়িতে আসার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।বিষয়টা বাইরে জানাজানি হলে মানসম্মানের সমস্যা হতে পারে বিধায় আমার মা কেও বলেছিলাম না।শোভা আসতোও না,আমিও শান্তকে বিশ্বাস করে সংসার করতে থাকি।

কিন্তু সেটা না। গাই-বাছুরে মিল থাকলে কখন যে গাই বাছুরকে দুধ খাওয়াবে সেটা মালিক বুঝতে পারে না।শান্ত-শোভার অবস্থাও সেটা। দুজনের তলে তলে মিল আছে, আমি এটা বুঝতে পারিনি।

আমার ভেতরে যে অন্য একটা অস্তিত্ব তৈরি হচ্ছে সেটা শান্তকে বলেছি দু’দিন আগে। তবুও শান্ত আমাকে খুন করতে চাচ্ছিলো এটা কোনোভাবেই আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মনে অনেক সাহস সঞ্চয় করে শান্তর সামনে গিয়ে সোজা প্রশ্ন করলাম,

-আমাকে খুন করলে কি খুব সুখে থাকতে পারতে?এই কি তোমার ভালোবাসার নমুনা? আমার করা প্রশ্ন দেখে শান্ত চোখ বড় করে, তোতলাতে তোতলাতে বললো,

-তুমি জানলে কিভাবে?আমি কাউকে মারতে চাই নি।

একটা কষিয়ে থাপ্পড় দিলাম।যেটা দেয়ার জন্য আমার বিবেক আমাকে বারবার দংশন করছিলো। থাপ্পড় দিতেই শান্তর মুখের বুলি ফুটে উঠলো।

-তোমার মতো মেয়ের সাথে প্রেম করা যায়।বিয়ে করে ভুল করেছিলাম।তাইতো এখন পথের কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছো।তোমাকে সরালেই আমি সাকসেস। বাট তুমি অনেক ভাগ্যবান।এবারের ঝড়টা কাজের মেয়ের উপর দিয়ে গেছে।

-তোমার সন্তান আমার পেটে শান্ত?

-আমি বেঁচে থাকলে ওরকম সন্তান বছরে একটা করে হবে!

কথাগুলো বলেই শান্ত রুম থেকে বের হয়ে গেলো।আমি অন্য একটা রুমে ঢুকে দরজা আটকিয়ে কান্না করতে থাকলাম।যদি একটু হাল্কা হতে পারি। মা কে ফোন দিয়ে সব বললাম।মা কোনো মতেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না।বললো তোর কোথাও ভুল হচ্ছে!আর শোভার উপর আমার নজরদারি আছে।তুই দেখেশুনে থাক।

আমার মা যেখানে এটা সামান্য বিষয় ভেবে এড়িয়ে যায় সেখানে থেকেই কি লাভ।এখানে থাকলে আমি এবং আমার সন্তান দুজনেই মারা যাবে।আমাকে আমার সন্তানের জন্য হলেও বাঁচতে হবে।সেই রাতেই পালিয়ে চলে আসলাম।দিনাজপুর শহরে চলে গেলাম।ভার্সিটির এক বান্ধবীর বাসায়।তার সাথে আমার কোনো পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো না।তাই কেউ বুঝবেও না আমি এখানে আছি।

আজ ২০ বছর পর বাড়িতে আসলাম।আমার ছেলেকে নিয়ে।বাড়িতে ঢুকতেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকলো।আমি এতোদিন কোথায় ছিলাম?আরো অনেক কিছু?বাবার কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললো,বাবা ৫ বছর আগে মারা গিয়েছে। আমাদের কথাবার্তা শুনে পাশের ঘর থেকে আমার জমজ বোন শোভা তার স্বামীকে নিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে ক্ষমা চাইতে লাগলো। আপু আমাকে মাফ করে দে,আমি অনেক বড় ভুল করেছিলাম। সেই অপরাধের সাজা আমাকে এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

পা থেকে ছাড়িয়ে তার স্বামীর কাছে গেলাম।তিনি আর কেউ নন,শান্ত। আমার চলে যাওয়ার ১ মাসের মাথায় তারা বিয়ে করে।আর তার কিছুদিনের মাথায় শান্ত বাইক এক্সিডেন্ট করে। এতে তার মাজা থেকে শুরু করে নিচের সব অংশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে।বাকশক্তিও আল্লাহ কেড়ে নিছে।শুধু আছে দেহ।যেটা টেনে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

শান্তর কানের কাছে গিয়ে বললাম, প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে জানে শান্ত।এক আল্লাহ বলে কেউ আমাদের মাথার উপরে আছে।তিনি দেখেন সবকিছু।এই দেখো সেই সন্তান। যাকে সহ তুমি আমাকে মারতে চেয়েছিলে। শান্তর হাতে ডিভোর্স লেটার তুলে দিয়ে চলে আসলাম।মা অনেকবার পিছন থেকে ডেকে না আসতে অনুরোধ করেছিলো।কিন্তু আমি থামিনি। শুধু একটা জিনিস ভেবে আমার হাসি পাচ্ছিলো যে,

-আল্লাহ কি না করতে পারে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত