কালরাত্রি

কালরাত্রি

ঘর থেকে বাইরে বের হব, ঠিক তখনি সানজিদা পাশের রুম থেকে বলছে, “তুই ফকির, ফকিরের বাচ্চা ফকির। ”
এটা নতুন কিছুনা, কয়েক বছর থেকেই সানজিদার মুখে আমাকে এই কথা শুনতে হচ্ছে। সানজিদা আমার প্রথম স্ত্রী। দ্বিতীয় বিয়েটাও সানজিদার জন্যই আমাকে করতে হলো।

বাবা মায়ের পছন্দ করা মেয়ে সানজিদা, সাথে আমারও পছন্দ হয়েছিল। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বউ করে এনেছি। যাকে বলে বিয়ের পরে প্রেম, আমিও আস্তে আস্তে সানজিদার প্রেমে পড়ে গেলাম। সেও আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে, আমার চেয়েও আমাকে বেশি ভালোবাসে। আমি বাড়িতে না আসা পর্যন্ত বা আমাকে রেখে একবেলা সে খেয়েছে কিনা আমার মনে পড়েনা। তার সব স্বপ্নও যেন আমাকে ঘিরেই। তার তেমন কিছু চাওয়ারও ছিলনা, একটাই চাওয়া আমি যেন তাকে সবসময় এমনি করে ভালোবাসি। কিন্তু এখনো তাকে আমি আগের মতোই ভালোবাসি, তবে তাকে আমি বুঝাতে পারিনা। কোথায় হারিয়ে গেল সানজিদার সেই ভালোবাসা আমি জানিনা। আমি এখনো সানজিদার ভালোবাসাকে খুঁজে বেড়াই।

একই বাড়িতে আমার দুই বউ থাকে। দুইজনের আলাদা করে দুইটা ঘর। তবে সানজিদার ঘরে আমার যেতে মানা, যেতেই পারিনা। গেলেই সানজিদা শুরু করে দেয়, “এই ফকির, ফকিরের বাচ্চা ফকির বের হয়ে যা আমার ঘর থেকে। সানজিদা কিন্তু এখনো প্লেটে ভাত নিয়ে অপেক্ষা করে। তবে আমার জন্য না, আমার জন্য অপেক্ষা করলে নিশ্চয় আমি যাওয়ার সাথে সাথে বের করে দিতনা।

আমাদের এলাকার মোটামোটি ছোট বড় সবাই সানজিদার এই ব্যবহার সম্পর্কে জানে। তবে আমাকে ছাড়া আর কাউকে কোনোদিন ফকিরও বলেনি বা সানজিদার ঘরে গেলে তাড়িয়েও দেয়নি। তবে আমার নতুন বউ যদি সানজিদার ঘরে যায়, তাহলে বলতে শুরু করে, “আমার ধন সম্পত্তি নিতে আসছে। আমার সব শেষ করে দিল, আমার টাকা পয়সা নিতে আসছে। ” এসব শুনেও রুমা কখনো রাগ করেনি। রুমা আমার দ্বিতীয় বউ। রুমা সানজিদাকে আপা বলে ডাকলেও সানজিদা সারাদিনই উঠানে বলতে থাকে,” রবিনের মা আমার সব কেড়ে নিল, টাকা পয়সা বিষয় সম্পত্তি দখল করেছে। আমার ছেলের নামই রবিন। আর সানজিদা রুমাকে রবিনের মা বলেই ডাকে।

সানজিদাকে কেউ পাগল বলেনি আজ পর্যন্ত, আর আমি যাকে এখনো ভালোবাসি সেই মানুষটাকে পাগল বলি কি করে? আর সবদিক থেকে সানজিদা স্বাভাবিক।অন্য কারও সাথে অস্বাভাবিক আচরণ করেনা। তবে আমাদের বাড়িতে কেউ আসলে তার সাথে বলা শুরু করবে, “রবিনের মা আমাদের সব বিষয় সম্পত্তি দখল করেছে। “খাওয়া, গোসল, ঘুম, চলাফেরা সব স্বাভাবিক। শুধু আমি ওর ঘরে গেলেই বলে ফকির। আর ওর গায়ে হাত দিতে গেলেই বলে, ” আমাকে ছুঁইবিনা, আমি তোর বউনা, তুই ফকির।” বছর দুয়েক আগে যখন হঠাৎ করে একদিন ঘুম থেকে উঠে সানজিদা বলছে, “এই ফকির, তুই এখানে কি করছিস? উঠ এখান থেকে, আমি তোর বউ না। ”

প্রথমে ভাবছি হয়তো দুষ্টুমি করছে। পরে যখন দেখি সারাদিন ওর মুখে একটাই কথা তখন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে চুপ করে থাকত, আবার বাড়িতে আসলেই শুরু করত। রাতে পাশে শুইতে দিতনা, ঘর থেকে বের করতে চাইত। প্রথমে কেউ না জানলেও পরবর্তীতে বাবা মা সহ এলাকার অনেকেই বিষয়টা জেনে গেল। গ্রাম থেকে খবর দিয়ে সানজিদার বাবা মা’কে আনা হল। সবকিছু বলার পর সানজিদার বাবা মা বলেছিল, ” আমাদের মেয়ে যেহেতু এমনই করে তাহলে আমাদের মেয়ে দিয়ে দিন, আমরা নিয়ে যাই।” আমি না করেছি, বলেছি সানজিদা সারাজীবন আমার বাড়িতেই থাকবে।

বাবা মা আমাকে অনেক বুঝিয়ে বলত, ” বাবা অন্তত একটা বিয়ে কর, আমাদের আর ছেলে মেয়ে নেই যে নাতি নাতনীর মুখ দেখব। তুই আমাদের একমাত্র ছেলে, বিয়েটা করে নে বাবা। এলাকারও অনেকে বুঝাইত, নতুন একটা বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করো, এভাবে জীবন যাবেনা। সানজিদা মাঝে মাঝে বলত, “আমি তোর বউ না, তুই বিয়ে কর” ফকির তুই বিয়ে কর” ঐ দিকে বাবা মা বলত, বিয়ে কর। সানজিদাও আমাদের বাড়িতে পুত্রবধূর মতই থাকবে। এলাকার মানুষেরও একই কথা।

অবশেষে পরের বছরই আমি গ্রাম থেকে রুমা’কে বিয়ে করে নিয়ে আসলাম। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমাদের ঘর আলো করে এল রবিন। তবে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও সানজিদার তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। সে মনে হয় বড় বাঁচা বেঁচে গেল আমি বিয়ে করাতে।

যতবারই সানজিকে দেখি ততবারই খুব কষ্ট লাগে আমার। নিজের উপর খুব ঘৃনা জন্মে, অপরাধী মনে হয় নিজেকে।
হ্যাঁ, আমি অপরাধ করেছি, যে অপরাধের কারনেই সানজিদার আজ এই অবস্থা। সেই রাত্রির কথা মনে হলেই ভাবি, যদি আবার ফিরে পেতাম সেই রাত্রিটা। তাহলে আমি হয়তো সেই ভুলটা আর করতামনা। বিয়ের চার মাস পরের কথা। রাত আনুমানিক সাড়ে নয়টার মত হবে। শীতের রাত থাকায় আগেই খেয়ে শোয়ে পড়েছি। সানজি তখন আমার বুকে মাথা রেখে আছে, আমি তার কপালে চুমো দিলাম। সুখ খোঁজার চেষ্টা করছি একটু একটু করে। হঠাৎ বাইরে থেকে আওয়াজ ভেসে আসল।

— ঘরে কেউ আছেন? বাড়িতে কি কেউ আছেন?

রাগে কি যে করতে ইচ্ছে হচ্ছিল তখন। সানজি দরজা খুলে দিল, আমি উঁকি দিয়ে দেখি বারান্দার লাইটের আলোতে একটা লোক দেখা যাচ্ছে। পরনে একটা লুঙ্গি, একটা বললে ভুল হবে অর্ধেকটা। কারন হাটু অবধি দেখা যাচ্ছিল। আরেকটা ছেঁড়া গেঞ্জি। চুলে জট, দাড়ি গোঁফে খুব বিশ্রী একটা চেহারা। লোকটা বলছে, মা’রে খুব ক্ষিধে পেয়েছে, কিছু খেতে দিবি??? সানজি বলছে আপনি দাড়ান, আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।

আমি মনে মনে বলে উঠলাম, “ফকিরের বাচ্চা ফকির, আসার আর সময় পেলিনা। আনন্দের সময়টাই নষ্ট করে দিলি। ” আমার এই মনে মনে কথাটুকুই অভিশাপ হয়ে ফিরে এল আমার ঘরে। সেদিন সানজি খাবার নিয়ে গিয়ে ঐ লোকটিকে আর খুঁজে পায়নি। এর পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠেই সানজি বলছে, “তুই এখানে কি করিস? ফকিরের বাচ্চা ফকির। আমার ঘর থেকে বের হ, আমি তোর বউ না।” সেই থেকে আমার সুখের সংসারটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হল।

রাত নয়টার উপরে হবে, আমি ঘরে শোয়ে আছি। রুমা ঘুমিয়ে পড়েছে আগেই, রবিনও ঘুমে। আমারই কেবল ঘুম আসছেনা। বিছানায় বসে পুরোনো স্মৃতিগুলো হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ জানালা দিয়ে আমার আগের ঘরের দিকে চোখ গেল। আমি আর সানজি যে ঘরে থাকতাম। সানজি কাকে যেন খাওয়াচ্ছে বারান্দায়। না, আমি চিনতে পেরেছি। এই সেই চার বছর আগের ফকির বাবা। না আমি বাইরে বের হবনা, কিছু বলবওনা। আজ যদি উনি রাজি খুশি থাকেন, তাহলে আল্লাহর রহমতে নিশ্চয় আমার সানজি আবার ভালো হতে পারে। আমি তাকিয়ে আছি জানালা দিয়ে। খাওয়া শেষে যাওয়ার সময় সানজির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে লোকটি, মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত