আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে এ অঞ্চলে কোথায় ছিল পাকাবাড়ি? কোথায় ছিল পাকা রাস্তা? আর কোথায়ই বা ছিল বিদ্যুৎ? আধুনিকতা আর উন্নয়নের হাত ধরে নি তখনও এই গ্রাম। সবুজ মাঠে ঘাটে চাষ আবাদ করা সরল মনের মানুষগুলো দুবেলা দুমুঠো জল ঢালা ভাত হলেও, খেয়ে শান্তিতে বাঁচত এখানে। আর এখন এই উন্নয়নকে কেন্দ্র করে এসেছে তার ধারক। হয়েছে ভাগাভাগি, অশান্তি, ক্ষমতার লড়াই। তারই ফল ভোগ করছে আজ ক্ষুদ্র পড়ুয়ারা। এ আমাদের লজ্জা যে, আমরা নিজেদের দাপট দেখাতে জ্ঞান, শিক্ষা, আর মানবিকতাকেও ভাগাভাগি করছি। … কথাগুলোকে মনে মনে গুছিয়ে নিতে নিতে এগোতে থাকেন পঞ্চাশোর্ধ অতনু বসু। তিনি আজ দেখা করবেন জেলার সদর দপ্তরের কর্তার সাথে।
পেশায় শিক্ষক এই মানুষটি তিন দশক আগে যখন এই অঞ্চলে জ্ঞান বিতরণের জন্য বটতলা বালিকা অবৈতনিক বিদ্যালয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নিযুক্ত হয়ে এসেছিলেন, তখন আদতেই এখানে পড়াশুনা করার মতো কোনো পরিকাঠামো ছিল না। পুরানো দু তিনটে বেড়ার ঘরের উপর ছিল টালির ছাউনি দেওয়া স্কুল নামক কঙ্কালটি। যেটি যেকোনো প্রকৃতিক বিপর্যয়ে ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল মাত্র। এদিকে স্কুলের যেমন হাল, তেমনই হাল ছিল গ্রামের পড়ুয়াদেরও। তারা তেমনভাবে কেউই বই খাতা পড়াশুনা শব্দগুলোর প্রতি পরিচিত বা আগ্রহী ছিল না। আগেও নাকি এই স্কুলে কয়েকজন শিক্ষক এসে কয়েকমাস ঘুরে ফিরে থেকে বদলি নিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু সবার মেরুদন্ডের কাঠামো সমান হয় না। অতনু বাবু ছোটো থেকে তার স্বাধীনতা সংগ্রামী দাদুর আদর্শে মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আর সেই শিক্ষাই ওর মনে একটা সুপ্ত দেশপ্রেমের চারাগাছকে জ্ঞান, চেতনা আর শিক্ষার প্রশ্রয়ে বড় মহীরুহ করে তুলেছিল। তাই বাকিরা হাল ছেড়ে চলে গেলেও, অতনু বাবু ওর লক্ষ্যে শুরু থেকেই স্থির ছিলেন।
এখানে আসার পর থেকে নিজ উদ্যোগে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ুয়া জোগাড় করা থেকে শুরু করে, বিদ্যালয়ের কাঠামো বদলানো সব করেছিলেন একার উৎসাহে। ওর বক্তব্য বিদ্যালয় তখনই সম্পূর্ণতা পায়, যখন সেখানে বিদ্যাদান হয়। তখন অনেকেই বলেছিল ওকে, ভষ্মে ঘি ঢালছো। অতনু মেরুদণ্ড টানটান করে দাঁড়িয়ে বলেছিল সেদিন, ‘আমি দাদুর মুখে শুনেছিলাম, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’
আজ সেই বিদ্যালয়ে প্রায় ১৩৬ জন ছাত্রছাত্রী পড়ে। এতোগুলো বছরে গ্রামের প্রায় সব ঘরেই অতনু বাবু একজন করে স্বাক্ষর মানুষ গড়ে তুলতে পেরেছেন। তাতে করেই বিপদের সূত্রপাত হয়েছে। ধনী মহাজনরা যা কিছু একটা বুঝিয়ে সুদের নামে গরীবদের জমি দখল করতে পারছে না। আর এই মহাজনদের জোটের মাথা হলেন গ্রামের নব উন্নয়নের ধারক। এদের সবার স্বার্থেই একটু একটু করে ছিটে ফেলেছে অতনু বাবুর নিস্বার্থ কাজের প্রচেষ্টা। স্বার্থপরেরা তাতে সমবেত হয়ে ক্ষেপে উঠেছে। তাদের কাল নজরে পড়েছে বিশাল বটতলা কেন্দ্রিক ইঁটের গাথনি তোলা এসবেসটসের ছাউনি দেওয়া অবৈতনিক বিদ্যালয়টি। ক্ষমতার লড়াই সুদৃঢ় হয়েছে স্বার্থের খাতিরে। আর তারই ফলাফলে গতকাল গভীর রাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্কুলঘরটিতে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আতঙ্কে ছুটে এসেছিল গ্রামের লোকজনেরা। ছোটো ছোটো হাতে বালতি নিয়ে পুকুর, কুয়ো থেকে জল তুলে আনছিল বিদ্যালয়ের ক্ষুদে পড়ুয়ারা। আর অতনু বাবু পাগলের মতো দুহাত দিয়ে বাঁচাতে চাইছিলেন তার সাধের জ্ঞানভাণ্ডারকে। যেখানে ছিল রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের বই, ছিল শরৎ সাহিত্য, ছিল সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায় … ছিল শিশুদের গল্পাকারে শিক্ষা দেওয়ার আয়োজন। ভোরের দিকে অতনু বাবুর পোড়া হাতদুটোকে ঘিরে বসেছিল পড়ুয়ার দল। সামনে দাঁড়িয়েছিল ধোঁয়াঘেরা বিদ্যালয়ের আধপোড়া ঝাপসা কাঠামো। সেদিকে চেয়ে অতনু বাবুর দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল নোনা জলের ধারা। আর ওকে কেন্দ্র করে অনেক জোড়া ব্যাথাতুর চোখ দিয়ে নোনা জলের প্লাবন হচ্ছিল মাস্টার মশাইয়ের দুটো জ্ঞান বিতরণ করা হাতের দিকে চেয়ে। এটাই অতনু মাস্টারের প্রাপ্তি। অত:পর ধীরে ধীরে নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ান অতনু বাবু। মনে পড়ে যায় দাদুর বলা কথাটা। না, উনি হারতে শেখেন নি। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করাটা ওর অনভ্যাস।
তাই এবার যেতেই হবে জেলা সদর দপ্তরে। এতোদিনের সব কথা বিস্তারে জানানো প্রয়োজন। পথে যেতে যেতে তাই কথাগুলোকে একবার নিজের মতো করে ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন অতনু মাস্টার। দুটো পোড়া হাতের অসহ্য যন্ত্রণা ওকে যেন আরও তাগিদ দিচ্ছিল, আগামীর অন্যায়ের আগুনকে নেভানোর জন্য। সারা রাতের ক্লান্তিকর লড়াইয়ে নুয়ে আসছিল শরীর। একা চলতে চলতে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল। এমন সময় অতনু বাবু দেখলেন, বিভিন্ন বয়সী গ্রাম্য পড়ুয়ার দল এগিয়ে আসছে তার দিকে। তাদের সাথে গ্রামের ডাক্তার বাবু এসে অতনু মাস্টার মশাইয়ের পোড়া হাতদুটোতে ওষুধ লাগিয়ে পট্টি করে দিয়ে চলে গেলেন। তারপর সমবেত স্বরে বাকিরা বলে উঠল, তাদের মাস্টারমশাইয়ের শেখানো বুলি ‘চলুন আমরাও সাথে যাবো। আপনিই যে একদিন আমাদের শিখিয়েছিলেন, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’
অতনু বাবু উপলব্ধি করলেন উনি একা নন, ন্যায়ের মুষ্ঠি সুদৃঢ় ও সংঘবদ্ধ হয়েছে।
(সমাপ্ত)