মিমাংসা

মিমাংসা

– এসেছো নাস্তা পানি খাও তারপর আর কোন প্রকারের কথা না বাড়িয়ে বিদেয় হও।
– তোর সাহস দেখে আমি রীতিমতো চমকে উঠছি! এই সেদিনও আমার সামনে ফ্রক পরে হাটতি? তিন আঙুলের মেয়ে আমায় চোখ রাঙিয়ে কথা বলিস?
-বলতে তো তুমিই বাধ্য করছো,আমি যদি চোখ রাঙিয়ে কথা বলি তুমি কি খুব ভদ্রভাবে কথা বলছো?
-তোর সাথে আবার কি ভদ্র ভাষায় কথা বলবোরে?দেখ! ভালয় ভালয় বলছি কথা শোন, তা না হলে এমন অবস্থা করবো যে আম ছালা দুটোই হারাবি।
-ঘর থেকে বের হও!!!বের হও এক্ষুনি!!!

চিৎকার করে রজনী যখন সায়নকে বসার ঘর থেকে বের হতে বলছিল তখন ভেতরের ঘর থেকে সাজেদা বলে উঠলো -“ওরে থাম,, থাম, শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি দেখে মরবো,দাদাভাই ও দাদাভাই!! আমার কাছে আসো, আসো দাদাভাই, এই বুড়ির কাছে একটু বসো।

সায়ন তার ভেতরে প্রচণ্ডরকমের অপমানের ভাংচুর টের পায়,ফর্সা সুন্দর মুখটায় তা রক্তাভাব মত ফুটে উঠেছে যেন। মেয়েদের যথেষ্ট এড়িয়ে চলে বিধায় ঠিক কোন কথাটা কিভাবে বললে এরা আহত হয় সে সম্পর্কে ওর ধারনা কম। সামনে দাড়িয়ে থাকা রজনীর সাথে শৈশবের অধিকাংশ সময় পার করেছে সায়ন। চাচাত বোন হয় রজনী, না ভুল হল বলাটা বোনতো নয়? এ বাড়ির আশ্রিতা।ছোট চাচা চাচীর যখন সন্তান হবেনা জানা গেল তখন দত্তক নেয়া হয় রজনীকে আর তাই সে অর্থে বোন সে নয়।

ছোট চাচাটা ছিল বরাবরি বাউণ্ডুলে, আর সাজেদা বেগমের ন্যাওটা, তাই হিন্দু একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলার আগে একবারও ভাবল না।দাদু বেচেঁ থাকতে এ বাড়িতে ঢুকতে পারেনি সে।সাজেদা বেগম তার আদরের ছোট ছেলেকে যখন বাড়িতে এনে তুলল তখন আরো কিছু লোকজনের তা অপছন্দের ছিল,সায়নের মা আর বাবার, তবে তারা প্রতিবাদ করলোনা। কিন্তু খুব বেশিদিন নয়,একেতো ছোট চাচিকে বিয়ের পরেও ধর্মান্তরিত না করা তার ওপর একটা অনাথ বাচ্চাকে দত্তক নেয়া যার সাথে সায়ন দিনের পুরোটা সময় কাটায়। ধীরেধীরে বাড়ীতে একটা অশান্তির আগুন দিন দিন বাড়তে লাগল, এবং একসময় তা লাভার আকারে ফুটতে লাগলে বড় ছেলে আলাদা সংসার পাতল।একি শহরে বসবাস করলেও মুখ দেখাদেখি বন্ধ, এবং একসময় সায়নকে পাঠিয়ে দেয়া হল বিদেশে যাতে চাইলেও কারো সাথে দেখা করতে না পারে।

হঠাৎ করেই রোড এক্সিডেন্টে মারা যায় চাচা চাচি আর তাই সম্পর্কটা হয়ত বড় বেশি হাল্কা হয়ে যায়। এ বাড়িটা বেশ পুরনো, এর কংক্রিটে আজ পোকামাকড়ের বসতি,তবু সাজেদা আর শমসের জাহানের বড় আদর আর লালিত সপ্নের বুননে এর ভীত দাড়িয়ে আছে।ছোট ভাই মারা যাবার পর থেকে শরীফ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কিভাবে এটাকে বিল্ডার্সের কাছে দিয়ে দেয়া যায়, শেষমেষ তাই হল,একটা কোম্পানির সাথে বেশ ভাল দরদামে সব ঠিক হয়েছে। নিজে এসে কয়েকবার বুজিয়েছে সাজেদা বেগমকে কোন লাভ হয়নি তাই সায়নের আগমন। যদি ওর মুখ দেখে বরফ গলে।সায়ন পড়াশোনা শেষ করেই ফিরে এসে বেশ ভাল একটা চাকরী করছে। মুখের আদলে অদ্ভুত মিল সায়নের ওর চাচার সাথে আর শরীফ সেটাই কাজে লাগাতে চাচ্ছে।

-কিরে দাদাভাই তুই বুড়া বয়সে আমারে ঘর ছাড়া, ভিটা ছাড়া করবি?
-কে বলল তোমায় এসব ফালতু কথা তোমার দেমাগি নাতনি?
-ওর আর কি দোষ? তোরা আমাগো কলিজা ধরে টান দিছোস রাগ করবোনা।
-আমরা কি তোমাদের পথে বের করে দিচ্ছি নাকি? বললামতো এপার্টমেন্ট রেডি হয়ে গেলে তোমরা একটা পেয়ে যাচ্ছ আর ততদিন আমাদের সাথে থাকলে নয়ত একটা বাসা ভাড়া করে দিলাম।
-হ্যা রে দাদাভাই এই বাড়িটায় যখন ভাংগনের যন্ত্র লাগব তখন তোর বুড়ি দাদিটার বুকটাও ভাইঙ্গা যাইব তা তুই বুঝস না?
-ফালতু সেন্টিমেন্ট রাখতো।
-আমারতো মনে হয় বুঝস কিন্তু না বোজার ভান করোস।

রজনী চা নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল- দাদি তুমি গাছের সাথে কথা বলছো, উনি কিছুই বুঝেনা। সায়ন চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল- তোর কিন্তু বড় বার বেড়েছে রজনী। সাজেদা বেগম দুজনকেই ধমক দিয়ে বলল- থাম দাদাভাই, আর রজু তুই চুপ কর হারামজাদি,খালি চ্যাটাং কইরা উঠে আমি কথা কইতাছিনা তুই চুপ থাক। আলমারির সাথে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে চা খেতে লাগল চুপ করে রজনি তবে চোখে বিষদৃষ্টি তার,সায়নের বেশ ক্ষিদে পেয়েছিল, অফিস থেকে সোজা এ বাড়িতে এসেছে। রজনি ওর দিকে চেয়ে থেকেই বলল- কি হল খাচ্ছনা কেন? চিন্তা করনা বিষ দেইনি।খেয়ে নাও চটপট।

-বিশ্বাস কি? তোর পক্ষে সব সম্ভব।
-খাস না দাদাভাই মুখটাতো শুকনা লাগতাছে। কতদিন পর আইলি।
-জোর করনাতো বাসায় গিয়ে ভাত খাব।
-ভাত খাবি তাই কবিতো, রজু যা,,তরকারি গরম কর গিয়া দাদাভাই ভাত খাইব।
-তুমি এত অস্থির হলে কেন বলত আমি গোসল না করে ফ্রেশ না হয়ে খেতে পারিনা।
-কেন এই বাসায় একবেলা ভাত খাইলে বুজি তোর পাপ হইব ছোটবেলাতে তো দাদির হাতে ছাড়া খাইতিনা।

দাদি নাতির কথার মাঝেই রজনী দৌড়ে গিয়ে সব জানালা বন্ধ করতে গেল।বিকেল থেকেই আকাশ ডাকছিল এখন রীতিমত ঝড় শুরু হয়ে গেছে। সায়ন রাগান্বিত স্বরে বলল

-ধুর! ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল,আজকের দিনটাই কুফা।
-দাদাভাই কেমনে তুই এত পর হয়ে গেলি বলত এমনতো তুই ছিলিনা।

সায়ন কঠিন একটা জবাব দেবার জন্য মুখটা খুলতেই কারেন্ট চলে গেল। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ধরতেই সাজেদা বেগম মিনতির সূরে বললেন – ড্রয়ারে মোম আর ম্যাচ আছে যা দাদাভাই ধরাইয়া নিয়া রজুর কাছে যা, ওয় অন্ধকারে ডরায়।

সায়ন বসে থাকে কিছুক্ষণ তারপর অনিচ্ছা সত্তেও উঠে যায়। অন্য ঘরগুলো খুলে দেখতে দেখতে রজনীর নাম ধরে ডাকতে লাগল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালে আলোর ঝলকানিতে দেখতে পেল ছাদে যাবার সিড়ির কাছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে সাদা ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে আছে রজনী। ওর কাছে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল – এই রজু এই,,, কি হয়েছে তোর।
ভয়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে গেলে রজনী সায়নের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে – বা,,সায় কেউ ঢুকেছে!

– কে ঢুকেছে? রজনী ফিসফিস করে বলল- চোর ঢুকেছে, চো,,,চোর।
– তোর মাথা ঢুকেছে, আমি নিজের হাতে নিচের গেট লক করে ঢুকেছি।
– আরে না,,, চোর কি আর গেট দিয়ে ঢুকবে,ছাদের দরজা খোলা ওখান দিয়ে ঢুকেছে।
– ছাদে উঠবে কোনখান দিয়ে, কি যে বলিস কোন কিছুর ঠিক নেই অন্ধকারে কি দেখতে কি দেখেছিস, ভীতুর ডিম একটা।

একথায় চটে যায় রজনী, সায়নের মাথায় সেই ছোটবেলার মত চাটি মেরে বলে- আরে হাদারাম, এই একতলা বাড়ির ছাদেতো আমি উঠেছি কতবার ভুলে গেছো আমাদের বাড়ির পেছনের পেয়ারা গাছটা দিয়ে।
– হুম মনে পরেছে, কি ডেঞ্জারাস মেয়ে ছিলিরে বাবা, এখনও আছিস অবশ্য। তবু আমার মনে হয় তুই ভুল দেখেছিস।
রাগী চোখে চেয়ে থেকে রজনী বলল- আমি তোমার সাথে ইয়ার্কি করছিনা।

– দিদুন ঘরে একা আর আমরা দুজন এখানে কাজটা ঠিক হচ্ছেনা, আচ্ছা ঠিক আছে কারেন্ট আসলে দেখবনে তোর চোরকে।
– আমি এই ভেজা শরীরে কিভাবে থাকব। সায়ন দেখল রজনী পুরোই ভিজে গেছে ছাদে কাপড় আনতে গিয়ে।
– এই নে মোমবাতি তুই জামা পাল্টিয়ে আয় আমি দিদুনের কাছে যাই। রজনী তাড়াতাড়ি বলে উঠলো – না না না,,,,আমাকে একা ফেলে যেওনা আমি ভয়েই মরে যাবো।
– সন্ধ্যা থেকে যে আমার সাথে গলাবাজি করে ঝগড়া করলি সেই সাহস কোথায় গেল।
– তুমি কি নিষ্ঠুর সায়নদা,আমি একটু বিপদে পড়েছি আর ওমনি তুমি শোধ নেয়ার সুযোগ খুজছো।
– ইস্ ঢং করা লাগবেনা, আচ্ছা যা! দু’মিনিট এর বেশি সময় লাগালে কাপড় চেঞ্জ করতে, ফেলে রেখে চলে যাব।
– একদম,, তুমি দেখো দু’মিনিট এর আগেই হয়ে যাবে।

রজনীর ঘরে ঢুকল ওরা দুজন। মোমবাতিটা টেবিলের ওপর রেখে জানালার কাছে দাড়ায় সায়ন,পাল্লা দুটো খুলে দিয়ে নিজের লাগানো কামিনী গাছটাকে দেখে, ঝেকে ফুল ফুটেঁছে,বৃষ্টি পেয়ে কেমন ঘ্রান ছড়িয়েছে চারাপাশটা, একটা সিগারেট জ্বালাতে গিয়েও হাতটা থেমে গেলো।এত পাগল করা ঘ্রাণটা নষ্ট করতে মন চাইলনা।

এই বাসার চারদিকেই অনেক গাছে ঘেরা, এই ঘরটা ওর ছিল,দখিনা বাতাসের ঘর, কত স্মৃতি,কত ভালবাসা, আদর,অভিমান, ঝগড়াঝাটি এই ঘরে,রজনীকে প্রথম ছোয়া সেই কিশোর বয়সের শিহরণ, কিশোরী রজনীর ভয়ার্ত মুখটাকে আজও মনে আছে ওর। সামনের দেয়ালে মেয়েটার জামা পালটানোর ছায়া কাপঁছে, সায়ন সেখান থেকে সরে গেলো জানালার আরও কাছে,বৃষ্টির ছাট এসে ওকে ভিজিয়ে দিতে লাগলো। রজনী আলনার পেছন থেকে তেড়ে এসে বলল- করছো কি আমার ঘরটা ভিজিয়ে ফেলবে নাকি?

– ভুলে যাসনা এই ঘরটা কোনসময় আমার ছিল
– কি করে ভুলি?দিদুনের পিছনে, মা,বাবাই সবার পেছনে কতদিন ঘুরেছিলাম এই ঘরটার জন্য,কিন্তু না তারা কেউ পাত্তাই দিলনা কারণ তাদের আদরের লালটুর এই ঘরটাই পছন্দ।

– তুইতো একটা হিংসুটে, আমার সবকিছুই তোর নজর ছিল,আমার সাইকেল, রংপেন্সিল এর বাক্সটা, এই বিছানা, পড়ার টেবিল,কলমদানি এমন কি আমার আলমারিতে লুকিয়ে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটাতেও।

– বেশ করেছি, কেন তুমি হতে পারো এই বাড়ির আসল সন্তান আমি দত্তক, তো? আমি কি তাই বলে ফেলনা,সব ভালো জিনিসটা তোমার, এমনকি আমার মা বাবাই তোমাকে বেশি আদর করত,এত কি আর সহ্য করা যায়

– আমি তোকে আমার সবকিছুর ভাগ দিতামনা বল?
– তোমার হাতের মারওতো কম খাইনি?
– আর তুই যে ঝাপিয়ে পরতি, আচড়ে কামড়ে কিছু রাখতিস।
– করবো না তুমি জোর করে চুমো খেয়েছি,,,

হঠাৎ করেই কেমন জানি মূহুর্তের মধ্যে পরিবেশটা থমকে যায় রজনীর অর্ধেক থেমে যাওয়া কথার সাথে। সায়ন তাড়াতাড়ি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বলে- এখনতো সব তোর দখলে, আমার চলে যাওয়ায় তোরতো বেশ সুবিধাই হয়েছিল।

– কি জানি?
– এটা আবার কেমন উত্তর?
– কি বলব তাহলে? এই বিশাল পৃথিবীতে একা হয়ে যাবার আনন্দ কত প্রকার ও কি কি
– মানে?
– মানে তোমরা চলে গেলে বাড়িটা সারাক্ষণ যেন আমায় হা করে গিলতো,সব ঘরগুলো, বারান্দা, ছাদ,ফুলের গাছগুলো, পেছনের বাগানটা, সামনের মাঠটা, আর আর,,,, আরও কতকিছু। তারপর বাবাই মা একসাথে চলে গেলো হঠাৎ দুম করে। এক বৃদ্ধা আর এক কিশোরী যখন হাজারটা লড়াই করে কোনমতে এই প্রাচীন বাড়িটাকে আকড়ে ধরে বেচেঁ থাকতে চাইলো তখন উড়ে এসে জুড়ে বসলে কিছু টাকার জন্যে এত নিষ্ঠুর তোমারা কিভাবে হও বলোতো সায়নদা? সায়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল- তখন আমি দেশে ছিলাম না।।

– তো তাতে কি?
– আমি বাবাকে বলেছিলাম কাকাকে দেখতে আসতে চাই,বাবা রাজি হয়নি আর ওইসময় আমার বয়স,টাকা বা সামর্থ্য কিছুই ছিলনা তুই জানিস রজু। কাকা আমার হিরো ছিল,সবকিছু করত আমায় নিয়ে, তোর মনে নেই কতবার আমি আর কাকা বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম।

– হুম,

জানো বাবাই যে দুদিন হাসপাতালে বেচে ছিল শুধু তোমাকে খুজঁতো,আমি হাত ধরলে ভাবতো তুমি ধরেছো,সেদিন আমি বুঝেছি আমি যতই তার ভালবাসার নিংড়ে ওঠা মেয়ে হইনা কেন,আত্না ছিলে তুমি,অস্তিত্ব জুড়ে শুধু তুমি আমি শুধু ছিটেফোঁটা মাত্র। সায়ন বিষাদ মাখানো একটু হাসি দিয়ে বলে – তুই বরাবরই একটু হিংসুটে বেশি রজনী। রজনী জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সায়নের দিকে চেয়ে বলল- হ্যা আমি হিংসুটে তাতে তোমার কি? সব ভালবাসা, সব মায়া,সব মানুষগুলো,ঘরদুয়ার তোমার আর আমি চেচালেই হিংসুটে। সায়ন সিগারেটে একটা জোরে টান দিয়ে বলে- কি জানি সব যদি আমারই হয় তাহলে চাইতে গেলে দিসনা কেন?আমিতো দেখি কিছুই আমার নয়। এই সময় সাজেদা ডেকে উঠলো – কিরে বুড়িটাকে একা ফেলে কই গেলি তোরা? ওরা আর কথা বাড়ালো না,নিঃশব্দে ঢুকলো সাজেদার ঘরে।

– আমি এখন যাই, রাত অনেক হলো।
– কই যাবি এই ঝড় তুফানের রাইতে, বারবার এক কথা কেন বলোস,তুই গোসল কইরা ভাত খাইতে আয়, একসাথে কতদিন খাইনা। সায়ন বুজতে পারে এখন আর জোর করে লাভ নেই বরং বুড়িটা কাদঁবে।

– ঠিক আছে তোমার নাতনিকে তাড়াতাড়ি খাবার দিতে বলো আমার মারাত্মক খিদে লেগেছে।

রজনী রান্নাঘরে খাবার গরম করতে যাবার সময় ফিসফিস করে বলল- একটু তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো আমার ভয় লাগছে। সায়ন বিদ্রুপ মাখানো হাসি দিয়ে চলে গেলো পাশের রুমে। সাজেদা বেগম প্যারালাইজড মানুষ, বিছানায় থাকে বেশি,হুইলচেয়ার করে চলাফেরা করে আর তাই রজনীর সব একাই করতে হয়,ভয় পায়না ও কিন্তু আজ স্পষ্ট দেখল কে জানি ছাদের ওপর ছিল,বারবার ঘুরেফিরে সেটাই চোখে ভাসছে,তবু দোয়া দুরূদ পড়তে পড়তে খাবার গরম করতে লাগলো, সায়ন কথা রাখলো তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে এসে পড়লো একটা আপেল খেতে খেতে,গোসল করে এসেছে। রজনী একপলক দেখে নিয়ে আবার কাজ করতে লাগলো। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আপেলটায় কামড় দিয়ে বলল- তুই বিয়ে কইছিস না কেন?যতদূর জানি সেকেন্ড ইয়ারের এক্সাম দিয়েছিস, তোর ভার্সিটির এক টিচার নাকি বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে।

– বাবা! বেশ খবর রাখো দেখছি আমার, কে বলল এতসব।
– যেটা জানতে চাইছি তার জবাব দে, আমার তো মনে হয় তোর বিয়ের জন্যই দিদুন বাড়ির মায়াটা ছাড়তে পারেনা।
– আমারতো মনে হয় আমার বিয়ে হলে তোমার খুব সুবিধে হয়, বাড়িটা হাতে পেয়ে যাও।
– হয়ইতো,

দিদুনের কানে আমাদের নামে যত কুমন্ত্র তো তুই লাগাস, তোকেতো আমি হাড়ে হাড়ে চিনি,হিংসুটে একটা। রজনী চিৎকার করে বলল- এই তুমি যাওতো এখান থেকে বের হও এক্ষুণি। সায়নের কোন ভাবান্তর হলোনা এই ধমকে বলল- সত্যিই চাস বের হই,তাহলে ভূতের ভয়ে আবার গলায় ঝুলে পরবিনাতো। রজনী চুলো অফ করে সায়নের মুখোমুখি দাঁড়ায়, সরাসরি চোখের দিকে চেয়ে বলে- আমি কারও গলায় ঝুলে পরিনা,ভুল করেছিলাম ভয় পেয়েছিলাম, এখন মনে হচ্ছে তোমার থেকে ভূতের সাথে থাকাই বেশি ভাল।

– তাই?
– হুম, তুমি যেতে পারো।

এসময় জানালার কবাটে বারি লাগে বাতাসের ঝাপটায়,রজনী কেপেঁ উঠে তবু কঠিন চোখ করে চেয়ে থাকে সায়নের দিকে।পুরোনো একটা আটপৌরে সবুজ রঙের সুতির শাড়ী পড়া,শ্যমলা,টানা টানা চোখ আর পাতলা ঠোঁটের রজনী, যার বৃষ্টি ভেজা চুলগুলো পিঠময় ছড়ানো, সেই রজনীকে একদম কিশোর বয়সের মত সায়ন হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরে বুকে, জোরে, শক্ত করে,একেবারে পিষে ফেলে যেন,রজনী ছটফট করতে করতে বলে – ছাড়ো,,,,, ছাড়ো আমাকে। চোখের নোনাজলে ভিজে যাচ্ছিল সায়নের বুকের কাছটা।

– কেন ছাড়ব, তুইকি ভয় পাচ্ছিস আমায় রজনী।
– না তোমাকে ভয় আমি পাইনা,কোনদিন পাইওনি,প্রথম যেদিন আমাকে ছুয়েছিলে সেদিনওনা, ভয়তো নিজেকে নিয়ে।
– মানে?
– যদি আমি দূর্বল হয়ে পরি,তোমার কাছে যে ধরা পরে যাব, আর তখন তুমি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে। সায়ন রজনীর মুখটা দু’হাতের মধ্যে ধরে বলে- তুই আমাকে ভালবাসিস?
– না! একটুও না
– সত্যি
– সত্যি, এবার ছাড়ো আমাকে। ব্যথা লাগছে
– লাগুক

সায়ন রজনীর ঠোঁটে চুমু খায় জড়িয়ে ধরে, রজনী হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলে দুহাত দেয়ালে চেপে ধরে আরো গভীরভাবে চুমু খায়, আদর করে পাগলের মতো, যেন সব শুষে নেবে একদম, রজনী হাপিঁয়া উঠে, চাপাস্বরে বলে- আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা, ছাড়ো আমাকে সায়নদা ব্যথা পাচ্ছি উহ্!! – আমি পারছিনা, পারছিনা ছাড়তে তোকে, কতো চেষ্টা করলাম, কতদিন এপথ মাড়াইনি,কতদিন দেখিনি তোকে তবু ছাড়তে পারলামনা, আমি,, আমি ভালবাসার চেষ্টা করেছি, প্রেমে পড়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু চোখে চোখ রাখলেই ধরা পরে যাই, সেই কিশোরী যেন চেয়ে থাকে, হিংসুটে, ঝগড়াটে এক কিশোরীর মুখ, অন্যকাউকে ছুতে আমার ঘিন্না করে, আমি চেষ্টা করেছি পারিনি, তুই কেন আমাকে ভালবাসিস না বল?আমি একা কেন কষ্ট পাবো তোকেও পেতে হবে,৷ আমার,, আমার,,,তোকেই চাই, চাইইই চাই। ।

রজনী কান্না জড়ানো গলায় বলল- তুমি আমাকে নষ্ট করবে সায়নদা? একথায় মূহুর্তের মধ্যে কাজ হলো।বিধ্বস্ত সায়ন বিধ্বস্ত রজনী কে ছেড়ে দিল,দিশেহারা কামের উন্মুক্ত আগুন যেন ওর চোখমুখে, দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। খাবার টেবিলে ওরা যখন দুজনেই নির্বাক হয়ে সাজেদা বেগম এর কথায় হু, হা করছিল তারমধ্যে হঠাৎ দুম করে সায়ন বলে উঠলো – দিদুন আমি রজুকে বিয়ে করব। সাজেদা বেগমের এমন নাকেমুখে উঠলো তবু কাশঁতে কাশতেঁ বলল- কি বললি দাদাভাই? সায়ন নির্বিকারভাবে জবাব দিল- আজ রাতের মধ্যে ব্যবস্থা করা যায় নাকি দেখো তো? রজনী চিৎকার করে বলল- কে তোমাকে বিয়ে করছে?

– তুই করছিস।

তারপর সাজেদা বেগমের দিকে চেয়ে বলল- সামনের বাসার ফরহাদ আংকেল না বিয়ে পড়ায় মানে বিয়ের কাজী,ওনাকে খবর দিলে আসবেনা? সাজেদা বেগম দ্বীগুন উত্তেজনা নিয়ে বলে- আসবেনা মানে অবশ্যই আসবে,কিন্তু দাদাভাই তোমার মা বাবা।

– সেটা আমি বুজব।

রজনী দুজনের দিকে তাকিয়ে আবার চেচিঁয়ে বলল- এসব হচ্ছে কি!,,,ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিৎ।
সাজেদা বেগম হাসি হাসি মুখ করে বলল- দেখ রজু তোদের বিয়া হইলে আমার লাভ সবচেয়ে বেশি, তোগো দুইটারেই আমি কাছে পামু আর বাড়িতো থাকলই। সায়নও তার সাথে সুর মিলিয়ে বলল- হ্যা আমিও তাহলে বাড়ির ব্যপারটি আপাতত ভুলে যাব।আর তা না হলে দিদুনকে নিয়ে আমি এক্ষুনি চলে যাব। আশ্চর্যের ব্যাপার সাজেদা যখন সত্যি সত্যি ব্যাগ গুছাতে লাগলো তখন রজনী হাত ধরে কাদঁতে কাদঁতে বলল- ও দিদুন,,,,, তুমি কি পাগল হলে।

– না,, বল দাদাভাইরে বিয়া করবি?

মূহুর্তের মধ্যে আবার চেচিয়ে বলল- বুড়ি তুই সবচেয়ে খারাপ, বেঈমান, নিষ্ঠুর,তোকে আমি পাললাম আর সেই তুই দাদাভাই পেয়ে পল্টি মারছিস।

– বল বিয়া করবি,
– ও একটা জানোয়ার, এতদিন আমাদের একটুও খোঁজ নেয়নি তুমি সব ভুলে গেলে,কতরাত আমার বুকে মাথা রেখে কাদঁছো সেই হিসেব রেখেছে বলো?
– তুইও তো কানতি, আমি জানতাম তুই ওর লাইগাই অপেক্ষায় ছিলি,
– না না আমি ওরমত বেঈমান এর জন্য কখনও অপেক্ষা করিনি।
– অতকিছু জানি না বিয়ে না করলে আমি চলে যাব।

তারপর সেই রাতেই ওদের বিয়ে হয়ে যায়,খাতায় সই করার সময় রজনী চিবিয়ে চিবিয়ে বলল – তোমার অংগ জ্বালা জুরোবার জন্যই বিয়েটা করলে তাইনা? সায়ন হাসছিল মৃদু মৃদু,কোন জবাব দিলনা। সায়নের প্রাক্তন আর রজনীর বর্তমান ঘরেই হলো ওদের বাসর।সাজেদা বেগম আর ফরহাদ সাহেব পান চিবুচ্ছিলেন যখন ঘর সাজিয়ে ছেলেমেয়েরা টাকা নেবার জন্য আসলো।

– ঘরের কোথাও এমন কিছু নেইতো যা দিয়ে মারামারি হতে পারে।
– না দিদুন শুধু খাট আর ফুল ছাড়া ঘরে কিছুই রাখিনি সরিয়ে ফেলেছি।
– যা দরজাল মাইয়া আর ডাকাত পোলা দেখা যাইব দুইজন দুইজনারে মাইরা মাথা ফাটায়ে ফেলছে। ফরহাদ সাহেব হাসতে হাসতে বলল- ভাবি আপনার নাতি নাতনি তো এরকম হবেই।

– টিটকারি করলা ফরহাদ। জীবনে মিমাংসা এমন করেই করতে হয়।

ফরহাদ সাহেব জীব কেটে বলল- আরে না না সেই দুঃসাহস কি আর আছে আপনার বুদ্ধির তারিফ করলাম। যেই প্লানিং করছেন একদম খাসা কাম হইছে। হা হা হা সাজেদাও হেসে উঠল, তারপর সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের দিকে ফিরে বললেন – ছাদে কে ছিল, তারে দিব সবচেয়ে বেশি বকশিস। আর এভাবেই হলো সব ভাগ বাটোয়ারা,এবং অতঃপর মিমাংসা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত