শৌভিক বাস থেকে নেমে বুঝলো, শীতটা এখানে খুব বেশি। তার আরও মোটা গরমকাপড় গায়ে দিয়ে আসা উচিত ছিল। শহরের মতো এখানে শীতের কোনো লাজুকস্বভাব নাই। এখানকার শীত খুবই বেপরোয়া। শীত এখানে বিনা-নোটিশে সরাসরি নাজিল হয়ে যায়। আর এখন, এই পড়ন্ত বিকালে হচ্ছেও তা-ই। অনেকদিন পরে গ্রামে এসে শৌভিকের গা-টা শীতে যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো। তবে শীতে সে যতোটা না কাবু হচ্ছে-তারচেয়ে বেশি সে ভাবনায় পড়ে গেল-ঢাকা থেকে তার আরও আগে রওনা হওয়া উচিত ছিল। এখন যে বেলা ডোবার সময় হয়ে যাচ্ছে!
মনে বড় একটা স্বপ্ন নিয়ে বহুকাল পরে আজ গ্রামে যাচ্ছে শৌভিক। সঙ্গে অবশ্য তাদের বাড়ির জমিজমাসংক্রান্ত কিছু কাজকর্মও রয়েছে। তবে তার মনের ভিতরে লুকায়িত এই স্বপ্নটিই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
সে, দেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে ঢাকায় ভালো একটি চাকরি করছে। কিন্তু চাকরিটা সে ছেড়ে দিতে চায়। দেশের বিপথগামী-মানুষগুলোকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য সে নিজেদের গ্রামে মানুষগড়ার একটি কারখানা গড়ে তুলতে চায়। দেশে প্রায় সবাই এখন শুধু নিজেদেরে লাভের জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কারখানা কিংবা এনজিও খুলে বসেছে। এরই মাঝে সে মনে মনে হাতেম তায়ীর মতো বিরাট এক উদারনীতিগ্রহণ করেছে।
সে শহরের ছেলে। তার জন্মও শহরে। সে মানুষও হয়েছে শহরে। তবে সে গ্রামে কিছুদিন ছিল। কিন্তু সেই সময়কার কোনোকিছুই তার এখন তেমন আর মনে নাই। এক হিসাবে এসব তার কাছে এখন অনেককাল আগের শুধুই স্মৃতিকথা মাত্র।
বাসস্ট্যান্ডে নেমে সে একেবারে হতভম্ব। এখানকার রাস্তাঘাট সব একেবারে ফাঁকা! একটা গাড়ি বা রিক্সা-ভ্যানের কোনো ছায়া পর্যন্ত নাই! তাই, শেষবিকালে বাস থেকে নেমে সে একেবারে থমকে গেল। ঠিকানা মোতাবেক সে যথাস্থানেই নেমেছে। সে চারপাশটা ভালোভাবে দেখেশুনে জায়গার নামটা পড়ে দেখলো-কয়েকটি দোকানের সাইনবোর্ডে স্পষ্টতঃ লেখা রয়েছে-কাজী শরীফপুর। কিন্তু এখানে কোনো ছোটখাটো বাস-টেম্পু বা নিদেনপক্ষে কোনো রিক্সাও নাই! কী আশ্চর্য ঘটনা! সে ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে থাকে।
শেষমেশ সে একবার ভাবলো-তার মাকে ফোন করে এসবকিছু জানাবে। পরক্ষনেই তার মনে পড়লো-তার মা এমনিতেই পেশারের মানুষ। তাকে এসব জানানো মানে-তার বিরাট ক্ষতি করা। তাই, সে নিজেনিজেই সবকিছু সমাধানের পথ খুঁজতে লাগলো।
মানুষের মন তো-বারবার সেখানে সংশয় দোলা দেয়! তাই, সে বুকপকেট থেকে ঠিকানাটা বের করে আবার পড়লো। নাহ, ঠিক আছে তো। সব ঠিক আছে।
সে সঠিক জায়গায় সঠিকস্থানেই নেমেছে। আর এখানেই তার নামার কথা ছিল। সে নিজের উপর একটু-একটু করে আবার আস্থা ফিরে পেতে শুরু করে।
চারপাশে এখানে মানুষজনও চোখে পড়ছে না। সে কাউকে কিছু যে জিজ্ঞাসা করবে-তারও জো নাই। তবুও সে লোকজন খুঁজতে থাকে। কিন্তু দশ মিনিট যাবৎ খুঁজে সে কোনো লোকজন বা কাউকেই দেখতে পেলো না। এখানে, এইমুহুর্তে কোনো গোরু-ছাগলও নাই! তার মনে বিরাট একটা খটকা লাগে। সে ভুল করলো নাতো!
সে বুকপকেট থেকে ঠিকানাটা বের করে আবার পড়তে থাকে। এবার সে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত হলো যে, তার ঠিকানা ঠিক আছে এবং তার নামার জাযগাটাও সঠিক। কিন্তু আজ এখানকার মানুষজন সব গেল কোথায়? মীমাহীন একটা দুর্ভাবনা তাকে বারেবারে কুরে-কুরে খেতে থাকে।
‘আজকে শীতটাও মনে হয় পড়েছে একটু বেশি। গ্রামের লোকজন হয়তো তাই রাস্থাঘাটে চলাফেরা করছে কম।’ হতাশমনে সে তা-ই ভাবলো। তবে, সে এই ভাবনার উপর দীর্ঘক্ষণ নিজের বিশ্বাস ধরে রাখতে পারলো না। তার মনে বারবার অজানা-আশংকার একটা সংশয়-সন্দেহ শুধু দোলা দিতে থাকে।
জায়গাটা যে ছোটখাটো একটা বাসস্ট্যান্ড তাতেও কোনো সন্দেহ নাই। কারন, এখানে বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। এমনকি একটু দুরে এরই আশেপাশে আরও অনেক দোকানপাট আছে। কাছের একটা হোটেলের মতো কিছু মনে হচ্ছে। তবে এসবই এখন একেবারে বন্ধ! সে বিরক্ত হয়ে ভাবলো-একটা তো খোলা থাকবে!
প্রচন্ড হতাশায় সে আবার ভাবনায় পড়ে গেল। আর সে কেবলই ভাবতে লাগলো-লোকজন গেল কোথায়? আজ আবার স্থানীয় হরতালটরতাল নাকি? নাহ, সে-রকম তো কিছু মনে হচ্ছে না!
ঘোলো-বছর আগে শেষবারের মতো নিজের গ্রাম ছেড়ে বাবা-মা’র সঙ্গে শহরে এসেছিলো রুবায়েত হাসান শৌভিক। এর আগেও সে শহরে ছিল। মাঝকানে কিছুদিনের জন্য তার বাবার চাকরিটা নিয়ে একটা সংকট কেটে যেতেই তারা স্থায়ীভাবে শহরমুখী হয়। আর গ্রামের আসেনি। এমনকি তার বাবাও না! আজ এতোবছর পরে সে গ্রামে যাচ্ছে-নিজেদের পৈতৃকসম্পত্তি দেখানোনা করার জন্য। আসলে, দীর্ঘদিন তাদের জমিজমার কোনো খাজনা দেওয়া হয় না। আগে যে-লোকটির কাছে টাকা পাঠিয়ে তাদের জমিজমার খাজনা দেওয়াতো-সেই লোকটি অনেক আগে মারা গেছে। তাও বছর আষ্টেক হবে। এখন তাদের জমিজমার খাজনা দেওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য কোনো লোক নাই।
তার বাবা আগের মতো এখনও গ্রামে আসতে মোটেও রাজী নয়! তাই, শৌভিকের ইচ্ছায় সম্মতি জানিয়ে তার মা তাকে উৎসাহ দিয়েই এতোদিন পরে গ্রামে পাঠিয়েছেন। গ্রামে নিজেদের এতোদিনের অনেক জমিজমা রয়েছে। এগুলো তো বেহাল হতে দেওয়া যায় না।
শৌভিক খুব হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ যাবৎ একটা বন্ধ টং-দোকানের আধাভাঙ্গা বেঞ্চে বসে ছিল। এদিকে বেলা আরও পড়ে এসেছে। সন্ধ্যা হতে আর বেশি বাকী নাই! এখনও যে কারও ছায়াটুকু তার চোখে পড়ছে না!
এমন সময় সে একটা মোটরসাইকেলের আওয়াজ শুনে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। আর শব্দের উৎসটা খুঁজে পাওয়ার জন্য একেবারে মরীয়া হয়ে ওঠে। সে এদিক-ওদিক তাকাতেই তার পিছনদিক থেকে হঠাৎ তার প্রায় গা-ঘেঁষে একটা মোটরসাইকেল দাঁড়ালো। কিন্তু সে চটজলদি পিছনঘুরে হতাশ হলো। আর খুব অবাকও হলো। একজন মহিলা মোটরসাইকেল-চালক!
মেয়েটিকে দেখে সে প্রথমে কোনো কথা বলতে পারলো না। শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
কিন্তু মেয়েটি ধীরেসুস্থে তার হেলমেটটি মাথা থেকে খুলে শৌভিকের দিকে চেয়ে সামান্য হেসে বললো, “কোথায় যাবেন?”
সে মনখারাপ করে বললো, “শিবপুরে।”
মেয়েটি বললো, “চিনেছি। আমি যে গ্রামে থাকি-এটা তার পাশের গ্রাম। তবে দুটো গ্রামই একদন কাছাকাছি আর খুব পাশাপাশি।”
“এসেছেন কোথা থেকে?”-মেয়েটি তার কাছে আপনজনের মতো আগ্রহভবে আবার জানতে চাইলো।
সে আগের মতো নিরসকন্ঠে বললো, “ঢাকা থেকে।”
মেয়েটি এবার তাড়াতাড়ি তার মাথার হেলমেটটি পরে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি জলদি আমার বাইকের পিছনদিকে বসেন। এখানে, আজ কোনো গাড়ি পাবেন না। এমনকি ঢাকায় ফিরে যাওয়ার গাড়িও না। এখানে, আজ সকালে বিরাট একটা ঝামেলা হয়েছে। এমনকি আবার যেকোনোমুহুর্তে তা শুরু হয়ে যেতে পারে!
শৌভিক আর বিলম্ব করলো না। সে দ্রুত মেয়েটির বাইকের পিছনে চড়ে বসলো।
এমন সময় বেশ খানিকটা দূরে তাদের পিছনদিকে থেকে বহুলোকের ধর-ধর চিৎকার ও চেঁচামেচি শোনা গেল। বোঝা যাচ্ছে, লোকগুলো কারও উপর ভয়ানক ক্ষিপ্ত।
মেয়েটি এবার শৌভিককে তার পিছনের সিটে বসিয়ে দ্রুত মোটরসাইকেল চালাতে শুরু করেছে। তাকে এখনই এদের নাগালের বাইরে চলে যেতে হবে। গ্রামের এই মানুষগুলো এখনও খুব মারমুখী হয়ে আছে। এদের কাছে যুক্তিতর্ক, বুদ্ধি, বিবেক-কোনোকিছুই খাটবে না।
অনেকদুর আসার পর শৌভিক বুঝতে পারলো, মেয়েটি বাইক চালানোর কাজে যথেষ্ট পারদর্শী। মেয়েটির পিছনে প্রায় তার গা-ঘেঁষে বসে শৌভিকের বড় অদ্ভুত লাগছিলো। কিন্ত সে এইমুহুর্তে মেয়েটিকে কোনোকিছু জিজ্ঞাসা করতেও পারছে না। যতি তার সঙ্গে কোনো কথা বলতে গিয়ে মেয়েটি বাইক চালাতে-চালাতে কোনো অ্যাকসিডেন্ট করে বলে! তার মনের প্রশ্নগুলো চেপে সে চুপচাপ বসে রইলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দেখতে পেলো, তারা পাকারাস্তা শেষ করে গ্রামের কাঁচারাস্তায় এসে পড়েছে। আর তখনই দিনের সূর্যটা ডুবতে বসেছে। এই মুহুর্তে গ্রামের চারপাশটা দেখতে শৌভিকের কাছে ভয়ংকর ভালো লাগছিলো আর অদ্ভুত সুন্দর মনে হচ্ছিলো। গোধূলিলগ্নে বাংলার প্রকৃতি যে এতো সুন্দর হতে পারে-তা শৌভিকের আগে জানা ছিল না। শৈশবের কথা সে প্রায় ভুলেই গেছে। আজ আবার কতদিন পরে সে নিজেদের গ্রামে ফিরছে! তার কেবলই মনে হচ্ছিলো-এখন বসে যদি এই মায়াময়-স্নেহময় শোভাটুকু মনভরে দেখা যেতো! তারা এখন একটা বিলের পার ঘেঁষে যাচ্ছে। শীতকাল বলে বিলটা প্রায় শুষ্ক। তবুও এর তলায় খানিকটা জল আছে। সূর্যডোবার সময় তার গাঢ় লালবর্ণের আভায় বিলের অবশিষ্ট জলটুকু মোহময় রূপধারণ করে যেন কোনো-এক সোনালি স্বপ্নের হাতছানি দিচ্ছে।
এই জায়গাটা শৌভিকের খুব ভালো লাগলো। আর তার মনে হলো-সে যেন এইখানে হাজারবছর বসে থাকতে পারবে। এইখানে তার নামতে খুব ইচ্ছে করছিলো।
মেয়েটি একটু পরেই বাইক থামালো। তারপর সে খুব ধীরেসুস্থে নামলো বাইক থেকে। তার সঙ্গে শৌভিকও নামলো-তার বুকের ভিতরে অনেক আনন্দ ছড়িয়ে।
এখানে, নামার জন্য সে মেয়েটিকে মনে মনে অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানাতে ভুল করলো না। কিন্ত কী-একটা সংকোচের কারণে সে মেয়েটিকে প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারলো না।
মেয়েটি শৌভিকের পাশে দাঁড়িয়ে খুব আপনজনের মতো বলতে লাগলো, “আমরা, আমাদের গন্তব্যস্থলের একেবারে কাছাকাছি এসে পড়েছি।”
তারপর সে হাততুলে দেখিয়ে বললো-বিলের ওপাশেই আপনার-আমার গ্রাম।
শৌভিক শুধু হাসলো। তার চোখেমুখে এখনও বিস্ময়। সে শুধু ভাবছে-কে এই মেয়েছি?
মেয়েটি হঠাৎ হেসে শৌভিকের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি বুঝি কথা একটু কম বলেন!”
শৌভিক এবার সুযোগ পেয়ে ঝটপট বলে উঠলো, “এখন বলুন তো-আপনি কে? আর কেনই বা এই বিপদে আমাকে এভাবে সাহায্য করতে ছুটে এলেন? আর ওই লোকগুলোই বা কারা?”
মেয়েটি মাথার হেলমেটটি খুলে বেশ মিষ্টি করে হেসে বলতে লাগলো, “আমার নাম রেজওয়ানা হক হৈম। পেশায় একজন ডাক্তার। এই তো আপনাদের গ্রামেরই ডিসপেনচারিতে বসি। অবশ্য এখানকার লোকজন এখন এটাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বলতে শিখেছে। আমার বাড়ি দিনাজপুরে। সরকারি-চাকরি-তাই আপনাদের পাবনায় পোস্টিং হয়েছে। আমি একজন মানুষ হিসাবে আপনাকে আজ সাহায্য করেছি। কারণ, আপনাকে আমার একজন ভদ্রলোক মনে হয়েছে। আর রিক্সা না পেয়ে আপনি চুপচাপ বসে ছিলেন। তাছাড়া, আমাদের এই এলাকায় কিছুক্ষণ আগে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তারপরও আপনি ওখানে এভাবে একাকী বসে থাকলে আপনার যেকোনো-একটা ভয়ানক বিপদ হতে পারতো। আমি বুঝে নিয়েছিলাম, আপনি আজ এখানে নতুন। আমি আরেকটা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। দুর থেকে হঠাৎ আপনাকে দেখলাম। এ অবস্থায় আপনাকে ফেলে রেখে যেতে আমার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিলো না। গত কয়েক ঘন্টা আগে আজ এখানে দু’দল গ্রামবাসীর মধ্যে একটা সরকারি-খালে মাছধরাকে কেন্দ্র করে ভয়ানক একটা সংঘর্ষ হয়েছিলো। আর এতে ঘটনাস্থলেই সকালে একজন মারা গিয়েছে। আহত হয়েছে আরও কয়েকজন। খানিকটা আগে পুলিশও এসেছিলো। মামলাটামলা হবে হয়তো। সেই ভয়ে এলাকার লোকজন এখন গা-ঢাকা দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে আমরা একদল লোককে রাস্তায় জঙ্গিমিছিল করতে দেখেছিলাম, ওরা নিহত মানুষটির পক্ষের এই গ্রামেরই লোক। ওরা এখন পশুর মতো উন্মত্ত। সামনে পেলে যাকেতাকে মারতে পারে। আর সেইজন্য আমি আপনার কাছে একজন অচেনা-নারী হয়েও অচেনা আপনাকে আমার মোটরবাইকের পিছনে বসিয়ে আনতে কারবিলম্ব করিনি। আসলে, মানুষ তো মানুষেরই জন্য।”
কথা বলা শেষ করেও হৈম হাসতে লাগলো। তার হাসির সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়লো দিগন্তব্যাপী। শৌভিক এতোক্ষণ যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেয়েটির কথা শুনছিলো। মেয়েটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মনটি ভরে উঠলো। তার তখনই হঠাৎ তার মন আচমকা বলে উঠলো-এতো ভালো মেয়ে এখনও আমাদের দেশে আছে!
শৌভিক যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সে মোহাচ্ছন্ন হয়ে শুধু হৈম’র মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। শৌভিক কোনো কথা বলছে না দেখে হৈম একটু হেসে বললো, “এবার আপনারসম্পর্কে কিছু বলুন শুনি। তারপর আমরা আবার পথ চলতে শুরু করবো।”
শৌভিক এতোক্ষণ একদৃষ্টিতে শুধু হৈম’র মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কী সুন্দর মায়াভরা মুখখানি তার! এমন একটি মায়ামাখা, মায়াঝরা, মায়াজাগানো, আর সাহসিকা রমনীই তো তার মা খুঁজছেন। আর এই মেয়ে কিনা তাদেরই গ্রামে বসে আছে!
হৈম’র কথায় শৌভিক এবার যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলতে লাগলো, “প্রথমেই আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আপনাকে আমার অভিনন্দন। তারপর, আমি রুবায়েত হাসান শৌভিক। বাবার নাম সাফায়েত হাসান। মায়ের নাম রেহনুমা আক্তার জলি। আর একমাত্র ছোটবোনটির নাম রুবানা আক্তার মলি। আমরা স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকি। গ্রামে এসেছি নিজেদের জমিজমা দেখাশোনা করতে। অনেকদিনের খাজনা বাকী পড়ে রয়েছে। সেগুলো এখন আমাকে দিতে হবে। কিন্তু এটা আমার কাছে গৌণকর্ম। আমার একটি আসল কাজ আছে। এটি আমার কাছে মুখ্যকর্ম। আর এজন্যই আমি এতোকাল পরে গ্রামে এসেছি। ঢাকায় আমি একটি প্রাইভেট-ফার্মে ভালো বেতনের কাজ করছি। কিন্তু তাতে আমি কোনো আনন্দ খুঁজে পাচ্ছি না। এই দশটা-পাঁচটা অফিস। আর অফিসছুটির পরে বাসায় ফিলতে-ফিরতে তিন-চার ঘন্টা লেগে যাওয়া। মাস গেলে কিছু টাকা বেতন হিসাবে পাওয়া। এসব আমার কিছুদিন ভালো লেগেছিলো। কিন্তু এখন, এসব আর লাগে না। এখন আমার নিজে কিছু করতে ইচ্ছে করে। এই দেশ আর মানুষের জন্য আমি কিছু করতে চাই। আমি গ্রামে এসেছি একটি মানুষগড়ার কারখানা গড়ে তুলবো বলে। আসলে, আমার খাওয়াপরার কোনো চিন্তা নাই। তাই, আমি কেন এতো পড়ালেখা শিখে একটা প্রাইভেট-ফার্মে ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিস্বার্থের গোলামি করবো! তারচেয়ে এবার থেকে আমি দেশের জন্য কাজ করবো।”
এমন সময় হৈম একটু হেসে বলে উঠলো, “স্কুল করবেন?”
শৌভিক হেসে বললো, “না, সেরকম কিছু না। তবে এটি একটি আদর্শ শিক্ষালয়ের মতোই হবে। এখানে এসে মানুষজন শুদ্ধ হবে, আর তারা মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে। আমাদের দেশে এখন এইজাতীয় মানুষের বড়ই অভাব। আমি আমাদের এই দেশ, জাতি, মানুষ ও মানবতার প্রধান শত্রু সর্বপ্রকার ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও সাম্পদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে চাই। এই লড়াইকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যেই আমি একটি মানুষগড়ার কারখানা গড়ে তুলতে চাই। এর নাম হবে- আধকুসাবি।”
হৈম একটু বিস্মিত হয়ে হেসে বললো, “আধকুসাবি’র মানে ঠিক বুঝলাম না! যদি একটু বুঝিয়ে বলতন!”
শৌভিক হেসে বললো, “এর অর্থ হলো-আমরা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। আর সংক্ষেপে ‘আধকুসাবি’।”
হৈম আগের মতো সুন্দর করে হেসে বললো, “এবার বুঝতে পেরেছি। খুব সুন্দর ভাবনা আপনার। এসব তো মহৎলোকের চিন্তাভাবনা। সব শুনে আপনার এখানে কাজ করার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার।
কিন্তু, আমি যে…..।”
শৌভিক বললো, “কোনো কিন্তু নয়। আপনি তো আমার সঙ্গে থাকবেনই। আর আপনার মতো আরও কিছুসংখ্যক সুন্দরমনের মানুষ আমরা খুঁজে বের করবো। তারপর আমরা নতুন এক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করবো। আপনাকে আমার সঙ্গে থাকতেই হবে। তাছাড়া, আপনি হচ্ছেন এই এলাকায় আমার প্রথম বন্ধু। আপনাকে তো আমার সঙ্গে থাকতেই হবে। জীবন গেলেও আমি আপনাকে হাতছাড়া করতে পারবো না। আপনার মতো ভালোমানুষ হয় না। আপনার মতো পরোপকারী-বন্ধুও আর হয় না। আপনি আজ-এখন আমার জীবনে বিরাট এক আশার প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছেন। এখন এই প্রদীপ চিরদিন প্রজ্জ্বলিত রাখতে হবে। আজ যেকোনোকিছুর বিনিময়ে আমি আপনাকে আমার পাশে চাই। আমার মন বলছে-আপনাকে ছাড়া আমি দাঁড়াতে পারবো না। আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন নাতো?”
ওর কথা শুনে হৈম কিছুক্ষণ কী যেন ভাবতে লাগলো। আর সে ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে লাগলো। শৌভিককে তার খুব ভালোমানুষ মনে হচ্ছে। এরকম একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্য সে যেন কত যুগ ধরে অপেক্ষায় ছিল। লোকটার মধ্যে কোনো পাপবোধ, ছলচাতুরি কিংবা সহজ কামনাবাসনার কোনো লক্ষণ নাই। এরকম একজন ভালোমানুষের সহজ-সরল একটা নিবেদন তাকে মুহুর্তের মধ্যে দারুণভাবে আন্দোলিত করতে লাগলো।
শৌভিক কিছুক্ষণ নীরব থেকে তাকে আরও ভাবার সুযোগ করে দিলো। আর এই অবসরে শৌভিক তার মাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো যে, সে নিরাপদেই গ্রামে পৌঁছে গেছে। ওপাশ থেকে তার মায়ের প্রশিান্তিময়-কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।
আরও কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে শেষে হৈম বললো, “কিন্তু আমি যে এখানে থেকে বদলি হয়ে অন্য কোথাও-মানে, এই শহরের দিকে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছি।”
কথাটা শেষ করে সে আবার হাসতে লাগলো।
শৌভিক কোনোরকম ভনিতা না করে হৈম’র মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, “সেটি হচ্ছে না। আপনাকে আমি যেতে দেবো না। আজ যেমন আমাকে সেফ করেছেন। এভাবে সারাজীবন আমাকে সেফ করে রাখতে হবে। নইলে আমি এখানে একা-একা কী করবো? আপনাকে আজ থেকে সারাজীবন এমন একজন চিরবিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে আমার পাশে থাকতে হবে।”
শেষের কথাটা ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলে সে যেন একটু লজ্জাও পেলো। এর অর্থ আবার অন্যরকম হয়ে গেল নাতো! কিন্ত শেষে সে আবার ভাবলো, যা হয় হোক গে। কিন্তু এরকম একজন পবিত্র ও সুন্দর মনের মেয়েকে সে কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারবে না। তার মনে হলো-বিধাতার অপূর্ব আশীর্বাদ না হলে ভাগ্যে এমন একজন মেয়ের দেখা মেলে না।
হৈম আরও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। তারপর সে সরাসরি শৌভিকের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বললো, “আমাকে ছাড়াও তো আপনি আপনার কাজ গোছাতে পারবেন। আর এখানে, মন্দলোকও যেমন আছে-ভালোমানুষও তেমন আছে। আপনি নিজেই ভালোমানুষ খুঁজে নিতে পারবেন। কারণ, আমার মন বলছে-আপনি খুব ভালোমানুষ।”
শৌভিক এবার শিশুর মতো হয়ে উঠলো। আর সে বায়নাধরার মতো করে বলে উঠলো, “না, তা হবে না। আর তা চলবেও না। আপনাকে ছাড়া আমার কিছুতেই চলবে না। আপনাকে আমার পাশে থাকতেই হবে। নইলে আমাকে এখনই আগের জায়গায় নামিয়ে দিয়ে আসুন। আমি এবার ঢাকায় ফিরে যাই।”
ওর কথা শুনে হৈম খুব হাসলো। আর বারবার ওর চোখের দিকে তাকালো। শেষে সে একটুখানি স্বাভাবিক হয়ে বললো, “সে সুযোগ আপনি পাবেন না। আজ আপনি কিছুতেই ঢাকা যাওয়ার আর কোনো বাসও পাবেন না।”
শৌভিক এবার খুব আবেগতাড়িত হয়ে বললো, “আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন না?”
শৌভিকের একথা শুনে হৈম হাসতে লাগলো। তারপর সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে আলো-আঁধারের মাঝে ডুবন্ত গ্রামটাকে দেখিয়ে বললো, “সুন্দর না?”
শৌভিক সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে-দেখে বললো, “সুন্দর! কিন্তু আমার চোখে আপনি এর চেয়ে আরও অনেক বেশি সুন্দর। আমার যে এখন শুধু আপনাকে ভালো লাগে!”
হৈম আবারও হাসলো। আর সে মোটরসাইকেলটায় স্টার্ট দিয়ে বললো, “এবার উঠুন তো। আর কাল সকালে অফিসে গিয়েই আমার বদলির কাগজপত্র সব ক্যানসেল করে দেবো। দেখি, আপনার স্বপ্নপূরণ করতে পারি কিনা!”
শৌভিক এতে উল্লখিত হয়ে বললো, “শুধু আমার বলছেন কেন? বলুন, আমাদের স্বপ্ন।”
ওর একথা শুনে হৈম এতো সুন্দর করে হাসলো যে, শৌভিকের মনে আর আনন্দ ধরে না। সে যেন নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না-তার ভাগ্যটা আজ এতো সুপ্রসন্ন!
শৌভিক অত্যন্ত খুশি মনে এবার হৈম’র পিছনে বসলো। আর বাকী পথটুকু তারা আগামীদিনের সোনালি-স্বপ্নের বীজবপন করে এভাবেই চলতে লাগলো।
হৈমকে এখন শৌভিকের খুব আপন আর খুব কাছের একজন মানুষ মনে হচ্ছে। আর তার কেবলই মনে হচ্ছে-হৈম ছাড়া তার জীবন চলবে না। হৈম তার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা।