অনেকদিন পর ল্যাপটপে ৪ বছর আগের ছবিগুলা বের করে দেখছে মুন্না। দেখছে না আসলে, স্মৃতিচারণ করছে। চোখ দিয়ে ফোটায় ফোটায় জল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার গাঢ় নীল টিশার্ট। এমন একাকিত্ব তো সে চায় নি। চেয়েছিল লিমা শুধু একটু কাজের হোক, নিজের পরিচয় বানাক, আমার পাশে দাঁড়াক।
৪ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল ওদের, প্রেম ছিল ৫ বছর। ভার্সিটির দিনগুলোতে লিমা ওর হাত ধরে বলতো, “দেখ মুন্না, কোন জব টব আমাকে দিয়ে হবেনা। তুই একটা বন্দোবস্ত করে নে। ওতেই চলে যাবে দুজনের, আমাকে তবু বাইরে কাজ করতে বলিস না। আমি রাজত্ব করবো, তোর ছোট রাজ্যে।” বলেই হি হি করে হেসে উঠতো। মুন্না মুখে কিছু না বললেও বিরক্ত হতো, এযুগে ব্যাকডেটেড শিক্ষিত মেয়ে পাওয়া দুস্কর। বিয়ের সময়টা ভালোই ছিল, মুন্নার ৯-৫ টা জব, ভালো স্যালারি, শেয়ার বাজারে ইনভেস্ট ও কম ছিলোনা তার।
সেই দিনগুলোতে লিমা প্রজাপতির মত ছিল!! শখ করে আটপৌড়ে করে শাড়ি পড়তো, কোমড়ে আঁচল গুজে ছুটোছুটি করে ঘর গুছাতো, মুন্নার পছন্দ মত রাঁধতো আর জোর করে মুন্নার পেট থেকে রান্নার তারিফ বের করতো, কখনো একুরিয়ামের মাছ কখনোবা রান্না ঘরে আসা বিড়ালটার সাথে গল্প করতো লিমা। মুন্নার অফিসে যাবার পরের সময়টা কাটতোইনা লিমার, একটু পর পর কল মেসেজে অতিষ্ঠ করে ফেলতো। মুন্না আপন মনেই হাসে। বহুদিন ও আবেগমাখা মেসেজ মুন্না পায়না। ইশ, তখন যদি বিরক্ত না হতো!!!
তারপর হুট করে একদিন অফিসের প্রোজেক্ট বন্ধ হয়ে গেল, বেতন আটকে গেল, বসের সাথে মনোমালিন্যে জব ও চলে গেল, শেয়ার মার্কেটে ধ্বস তার উপর বাড়িতে ছোট বোনের বিয়ের খরচা। ধার, দেনা, লোন কিছু কম হলোনা। সেই দিনগুলোতে লিমাকে আরো বেশি করে বিরক্ত লাগতো। লিমার পাশে থাকা, ভালো ভালো কথা, কেয়ার, সান্ত্বনা সব কিছুকেই দেখানো ভালো মানুষী লাগতো।
শিক্ষিত মেয়ে হয়ে লিমা যেন মুন্নার উপর বোঝা হয়ে আছে। হঠাৎ করেই মুন্নার লিমার সব কিছুই অসহ্য লাগতো।
সে কি পারতোনা এই দুর্দিনে মুন্নার পাশে দাঁড়াতে? পারতোনা অন্তত ফ্ল্যাটের ভাড়া অথবা আনুষঙ্গিক খরচ তার আয় থেকে মিটাতে? কিন্তু সে রানী হতে চেয়েছে, খেটে মরা মুন্নার রানী। আবার ২০ বার ফোন, হাজারবার মেসেজে ভালোবাসা প্রদর্শনের নমুনা দেখে গা জ্বলে যেত মুন্নার।
আলতাফ ভাইয়ের সাথে সেদিন পথে দেখা হলো, বোনের বিয়ের ধারের টাকা নিয়ে বাক বিতন্ডাও হয়ে গেল। প্রচন্ড অপমানবোধ নিয়ে ঘরে ফিরে দেখে লিমা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। “আজ বেশি দেরি করে ফেলেছিস মুন্না, কোন সমস্যা?” ভালো লাগছিলোনা মুন্নার এই খবরদারি। “বল কিছু, তোকে অস্থির লাগছে। আমি তোর পর কেউ? বল না?” মুন্নার বাঁধ ভেঙে গেল ধৈর্যের।
চিৎকার করে উঠলো, কি জানতে চাস লিমা? তুই কি কখনো আমাকে বুঝতে চেষ্টা করেছিস? আমার পাশে বসেই খাস, এক ই খাটে ঘুমাস, তাও কি আমার কষ্ট দেখিস? আমি শুধু তোর আরামসে বসে বসে খাবার মত নিরাপদ আশ্রয়। আমার অভাবি চোখ তুই দেখিস না লিমা? আমি চেয়েছিলাম তুই আমার পাশে দাঁড়া, আমাকে সাপোর্ট দে। কিন্তু তুই তো সব জেনেও তোর দেখানো সিম্প্যাথি টা দিয়ে বিরক্ত ছাড়া আর কিছু করিস নি।”
মুন্না সেদিন লিমার চোখে পানি দেখেনি। ছিঁচকাঁদুনে আহ্লাদী মেয়েটা সেদিন কাঁদেনি। শুধু বলেছিল- “আমি সরি মুন্না, আসলেই বউ হয়ে তোর জন্য কিছুই করা হয়ে উঠেনি। তুই আমার জন্য দোয়া কর, দেখিস আমি পারবো।” পরদিন থেকেই লিমার কাজ খোঁজার নেশায় পেল। পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইনে পাওয়া সকল জব সার্কুলারে ট্রায়াল দিতে থাকলো যোগ্যতানুযায়ি। মুন্না হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, মেয়েটা রাগ-অভিমান করেনি। বরং প্যাশোনেট হয়েছে। একটা জব ও পেয়ে গেল লিমা অল্পদিনেই, বড় নয় ছোটই। তবু যে লিমা কাজ করছে মুন্নার এতে সুখের সীমা নাই।
ধীরে ধীরে লিমার কর্মক্ষেত্রে উন্নতি হচ্ছিল, সাথে বাড়ছিল ব্যাস্ততা। আগের মত লিমা ৪ টা পদ করে মুন্নার জন্য বসে থাকেনা খাবার নিয়ে। যা হোক একটা পদ রেঁধে টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে ক্লান্ত লিমা ঘুমিয়ে যায়। যাবেই তো, মেয়েটা একা সংসারের কাজ ও তো করে। এখন আর মাইগ্রেনের ব্যাথায় লিমার নরম হাতটা কপালে পায়না মুন্না। খেতে ইচ্ছে না করলে জোর করে ঘাড়ে ধরে খাইয়ে দেয়না লিমা।
এখন শুধু মাস শেষে বড় একটা এমাউন্ট মুন্নার হাতে দেয় কাজ পাগল লিমা। লিমার আরো চাই, স্বামীকে অস্থিরতা থেকে কষ্ট থেকে রিলাক্স দিতেই কাজ কে ভালোবেসেছে লিমা। মুন্নাকে ভালোবেসে পড়ে থেকে কি লাভ, এতে তো আর মুন্না শান্তি পায়না।
এখন লিমার ছুটিছাটা প্রায় নেই। নিজের উদ্যোগে হস্তশীল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছে, পিছিয়ে পড়া মেয়েদেরকে নিয়ে তার ছোট ওয়ার্কশপ। কেউ কাঁচামাল যোগান দিচ্ছে, কেউ পন্য বানাচ্ছে, কেউ মার্কেটিং করছে, কেউ পন্য পৌঁছে দিচ্ছে মার্কেটগুলোতে। ভীষণ একা হয়ে গেছে মুন্না। চাইলেই হুটহাট লিমাকে জড়িয়ে ধরার সুযোগটা যেন এখন রূপকথা। রাতে বিছানায় শুয়েও লিমার কাজের গল্প, কি কি করছে, করবে সেসব আলোচনা। সবশেষে “তুই দোয়া করিস” বলা। মুন্না এই লিমাকে চায়নি। কাজ করেও কি সংসার করা যায়না? নাহ, সংসার তো লিমা করছেই। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা রেডি করে চিরকুট রেখে যায় “খেয়ে নিস মুন্না”
দুপুরের খাবার টা অফিসে পৌঁছে দেয় কাউকে না কাউকে দিয়ে। রাতে নিজ হাতে মুন্নার জন্য রাঁধে, পাশে বসে খাওয়ায় ও। হাতে শুধু মোবাইল বা ল্যাপ্টপ টা থাকে। ওকে তো মেইল চেক করতে হয়, কাজ কিভাবে এগোবে তার প্ল্যান করতে হয়, ওয়ার্কারসদের কাজের লাইন আপ তৈরি করতে হয়। এটুকুই তো সময় ওর। স্বামী স্ত্রীর মুহুর্তগুলোও এখন যেন একটা ফরম্যালিটি মাত্র। সেই ছটফটে, লাজুক আর বউ বউ লিমা হারিয়ে গেছে।
পরশু অফিসে ছিলো মুন্না, মিটিং চলছিলো। বসের বউ ঋতু ভাবি ঢুকলো অফিসে। বসের কাছে ১ ঘন্টা চায় এই চল্লিশোর্ধ মহিলা, শপিং এ যাবেন। বস সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বেড়িয়ে গেলেন, বাকি এজেন্ডা সবাইকে রাতে মেইল করে দেবেন। গত কাল বসের দাওয়াত পেল অফিসের সবাই, উনার মেয়েদের জন্মদিন আজ (জমজ মেয়ে), এজন্যই শপিং র গেছিলেন এই দম্পতি সেদিন। স্বস্ত্রীক আমন্ত্রণ।
আজ লিমাকে সাথে করেই গিয়েছিল মুন্না। শুনে এল বসের স্ত্রী এর গুণের কথা, বসের এই জায়গায় উঠে আসার গল্পের নায়িকা উনার স্ত্রী এর কথা। অল্পশিক্ষিতা বসপত্নি নিজেদের না খেয়ে থাকার দিনগুলিতে স্বামীর পাশে বিনা অভিযোগে পরে থাকার কথা। মেয়েদের খাবার জুটাতে বাবার বাড়ির বালাগুলাও বেচে দেবার কথা। দুজন মিলে শুধু আলু ভর্তা বা মরিচ ভর্তায় কাটিয়ে দেয়া লম্বা ৪ মাসের কথা।
মুন্না লিমার চোখে আজ জল দেখেছে। হাতে আলতো চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল- “আমাকে ভালোবাসিস লিমা?” লিমা বলেছিল “দুজনকে একসাথে ভালোবাসা যায়না মুন্না। একদিকে ভালোবাসা আরেকদিকে দায়িত্ব পালন হয় বড়জোর। ভালো একজনকেই বাসি মুন্না, সেটা কাজ। তুই ই শিখিয়েছিস।”
মুন্না আজ জানে, সত্যিই দুজনকে ভালোবাসা যায়না। যাকে ভালোবাসার তাকে ভালোই বাসতে হয়, কাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করলেও চলে, কিন্তু জীবন সঙ্গিকে ভালো না বাসলে চলেনা। আজ এটাও জানে, পাশে থাকা-সাপোর্ট করার মানে শুধু বৈষয়িক নয়। অক্লান্ত ভালোবেসে যাওয়া ও পাশে থাকা। হাতটা ধরে রেখে ছিটকে না যেতে দেওয়া ও সাপোর্ট করা।
আজ লিমার কাছে মুন্না শুধু স্বামী, ভালোবাসা নয়। লিমার সেই রাগ-অভিমান-আহ্লাদ, সেই টিপিক্যাল আটপৌড়ে শাড়ির ভাজ, রান্নাঘর থেকে খিলিখিলিয়ে হাসির শব্দ, কখনো খুন্তি বা বেলন নিয়ে ছুটে মারতে আসা লিমা আর বেঁচে নেই। একটা ছটফটে প্রজাপতিকে খুন করেছে মুন্না।