এক.
সাদা-কালো রঙটা আমাদের ভালবাসার চোখবোজা জগতটা জুড়ে খুবই চরমভাবে বিরাজ করে।
মিল-অমিলের একখানা ছক তৈরী করলে যেকোন স্বামী স্ত্রীর ক্ষেত্রেই সে ছকের দুটো কলামই হয়তো অপূর্ণ থাকেনা, তাই যেখানে মিল আমাদের ক্ষেত্রে সাদা-কালো রঙে ভালো লাগার একক সূত্রে মন আকাশে ভোকাট্টা ঘুড়ির সূতোর মত জড়িয়ে প্যাঁচিয়ে ছিল সেখানে আমাদের সম্প্রীতির গভীরতা আরও গভীরতর হবে সেটা আমরা বুঝেছিলাম বিয়ের আগের প্রেম পর্বেই। সাদা-কালো কেবল রঙ পছন্দের বিষয় বলে আমার মনে হয়না, এই সাদা-কালো সম্প্রীতি যাদের মনে প্রবল তাদের মাঝে মুক্ত চিন্তা একটা সরলতার বায়ু প্রবাহের মত বহমান বলেই আমার মনের একক গবেষনায় ধরা পড়েছিল।
আমাদের ফ্ল্যাটটা ছোট পরিসরের হওয়ায় আমার ধারনা আমাদের ভালবাসার নব সংসার একটা গুচ্ছের আকার পেয়েছে। গুচ্ছাকারে থাকা জিনিস বেশি গাঢ় হয়, ঘন হয়। সেই ঘন এবং গাঢ় প্রেমের সংসারটাকে আমরা সাদার আবরণে জড়িয়েছি। আমাদের বেডরুমের প্রতিটি জিনিস ধবধবে সাদা। বিছানা, দেয়াল, ফার্নিচার সবই।এক মায়াময় আবহ। অবশ্য বিশাল আকারের এলইডি টিভি আর একটা কালো রঙের অ্যাক্রলিক পেন্টিং ব্যতিক্রম। তাছাড়া ইমন আর আমিও প্রায়শঃই কালো পোষাকা পরতে পছন্দ করি। আমরা দু’জন মানব মানবী কালো গোলাপ হয়ে ফুটে থাকি আমাদের সাদা সজ্জা গৃহে।
গতকাল থেকে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে এই সাদা স্বর্গে।সাদা ড্রেসিং টেবিলটার কোনায় ব্ক্কৃাকার আকৃতির চিনামাটির ট্রের উপর ওটার অবস্থান। খুব বেশি হলে ফুট খানেক উচ্চতার একটা ঝাঁকড়া গাছ। ছোট ছোট পাতা। সবুজ, খুব ঘন সবুজ।আড়াআড়ি বড়জোড় দেড় ফুট তার অবস্থান। সাদা ঘরে সবুজ বাতি হয়ে জ্বলছে। ওটা একটা বনসাই। ইমন বলেছে বৃক্ষমেলা হতে তার কতিপয় স্টুডেন্ট কিনে উপহার দিয়েছে।
ধবধবে সাদা একটা পরিবেশে সবুজের সে দ্যুতি বাসার কাজের ছেলেটাকেও আকৃষ্ট করেছে। তেরো কি চৌদ্দ বছর বয়সের শাহীন নামের এই কাজের ছেলেটির সরলতা প্রতিনিয়ত আমাদের স্বামী স্ত্রী দু’জনকেই ভাবনায় ডুবায়,কখনও ভাবনার হাবুডুবু খাওয়া জল আনন্দ কৌতূকের কিংবা কখনও খুবই হতাশার।
‘আফা,এই খেলনাডা না খুব দারুন হেছৈ,সাদা ঘরে খুব ফুইটা উঠছে। আফা জানেন, আমাগো গাঁওয়ে য়ূই যে হাটের
কাছে এইরাম একটা বটগাছ আছে। কত্ত বড়!এইডা কী কী দিয়া বানাইছে?’
‘আরে বোকা এইটাও তো জীবন্ত গাছ,একটা বনসাই…’ থেমে যাই, বনসাইয়ের ব্যাখা এর কাছে করা সম্ভব হবেনা। শাহীন অবশ্য তখনও বলেই চলেছে,‘আফা,এই খেলনা গাছডা একটু ছুঁইয়া দেহি,ভাইজান রাগ করবোনা তো? হেইদিন ভাইজানরে শুধু কইছিলাম,দুনিয়া এহন রঙিন হৈছে, আপনার সেই আগের লাহান সাদা কালো রঙ দিয়া ঘরগুলান সব সাজাইছেন ক্যান? ভাইয়া উত্তর দেয় নাই, রাইগা গেছিলো। আফা আপনে কন্না, ক্যান পুরান দুনিয়ার মত সাদাকালো বানাইছেন। আচ্ছা আমাগো মানে মানুষগুলানরে, নাইলে এই গাছগুলান কি আগের মতো সাদা করান যাইব?’
আমি বনসাই বটের কষ্টে একটু গলাবধি ডুব দিয়েছিলাম। শাহীন এসব কি বলছে, মাথামুন্ডু বুঝা যাচ্ছেনা। কাকতালীয় ভাবে ঠিক সে সময় টিভিতে ইন্ডিয়ান একটি চ্যানেলে নিসান গাড়ীর একটা অ্যাড দেখাচ্ছিল। আবহটা অতীত কালের-সাদাকালো পরিবেশ, রনবীর কাপুর নামের উঠতি নায়ক গাড়ী চালাচ্ছে, কেউ একটা বড় পর্দা সরিয়ে দিতেই পেছনের সাদা-কালো দুনিয়া মূহূর্তে বর্তমানে পাল্টে রঙিন হয়ে গেলো। শাহীনের কণ্ঠ আবার চালু হয়ে গেলো, ‘আফা,এইডা,এই যে এইডা কেমনে করল, এইডা কনতো? ’
‘মানে,এতো খুব সহজ টেকনোলজি। কম্পিউটারে…’
‘না,আফা, বুঝেন নাই,আগে পৃথিবী যহন সাদা কালো আছিল,হেইডা তো হেই যুদ্ধের আগে, এহন আবার সাদাকালো কেমনে দেখাইলো।’
‘সাদা-কালো ছিল মানে!’
‘আফা আগের সব সিনেমায় দেখেন না, তহনের দুনিয়ার সব কিছু সাদা-কালো, মানুষ গাছপালা সব কিছু,হেইডা তো শেষ হৈছে, যুদ্ধ কইরা সাদাকালোরে মানুষে রঙিন বানাইছে , এখন আবার সাদা-কালো কেমনে দেখায়…’
বুঝলাম। হতাশ হলাম। কিন্তু কি বুঝাব তারে ঠিক বুঝলাম না।বললাম,‘টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে আয়।’
সে আনল। আমি ছবি তোলার মুড ব্লাক এন্ড হোয়াইট করে দিয়ে বললাম,‘ছবি তুলতে তো শিখছোস। এই নে ছবি তোল।’
সে তুলল এবং আমি বললাম,‘বুঝেছিস, ছবিতে বটগাছের বনসাইটা কালো দেখাচ্ছে।মানে ইচ্ছা করলে সাদা কালো কিংবা রঙিন ছবি আমরাই তুলতে পারি। ’
‘কিন্তু আফা আগের সব সিনেমা তাইলে কালো আর সাদা কেন?’
‘লেখাপড়া করেছিস?’
‘গেছিলাম স্কুলে কয়েকদিন,হেরপর বা’পে হাটে দোকানে কাম লইয়্যা দিলো, খালি মাল বইতে হইতো গোআপা, মাল তুলতে তুলেতে বাইটটা হৈয়া গেছি।’
‘তাইলে আর কি বুঝবি। বনসাইটা একটু সরিয়ে রাখ, ইরা গেলে তোর ভাইজান আবার…’
‘বনসাই মানে,এইটা কি এই খেলনাডার নাম?’
‘নারে শাহীন, এইডা খেলনা না, একটা বট গাছ, একটা জীবন্ত বট গাছ, এটার উপর নানা ক্রিয়া কলাপ করে, কেটে ছেটে এটাকেও ঐ কি যেন বললি ‘বাইট্টা’ না কি যেন ঐ ওমন করা হয়েছে।’
‘আফা,আমি হুনছি গাছের নাকি জীবন আছে, এইডা তাইলে কষ্ট পাইতাছেনা?’
এ কথায় শাহীনের উপর পতিত আমার দৃষ্টিটি কিঞ্চিৎ বিস্ময়ে ভরে গেলো।
দুই.
চারদিকে সবুজ আর সবুজ। চলমান সবুজ। সরু গাছ,মোটা গাছ,লতানো গাছ কিংবা টানাটানা পাতার ঘাস -কেউ কেউ হেঁটে চলেছে, কেউ গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে আড্ডা দিচ্ছে। মাত্র ঘুমটা লেগেছিল চোখে, হঠাৎ টকটকে লাল গোলাপফুল গাছটাকে কে যেন ডাকল। টকটকে লাল ফোটা গোলাপ ফুল সহ ডালটা ঘুরিয়ে তাকাতেই কাটার আঘাতটা এসে গায়ে লাগল ইভার। চোখ খুলে বন্দী খাঁচার গরাদে বাম হাতের পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে ধরে বসতেই আবার একটা কাটার আঘাত, এবার গোলাপ গাছটাও রেগে গেলো, একটা পাপড়ি একটু ছিড়ে গেলো গোলাপের। খাঁচাটা ঝুলানো ছিল একটা বড় আকারের বাদাম গাছে, কাঠ বাদাম। গোলাপ গাছটা বাদাম গাছকে ডেকে বলল, ‘বাদামদা আপনার ঐ পানি নারীর হাতে খোঁচা লেগে আমার দেখোতো এই পাঁপড়িটার কি করুন অবস্থা …কি দরকার ওটার ওই হাতটা রাখার। শুরুতেই ওটার গ্রোথের দিকে নজর না দিলেই পারতে, তোমার আবার বাদাম ভেঙে দেয়ার শখ যে কেনো হলো! বের কর, ওটাকে বল একটু পানি এনে আমার উপর ঢেলে দিতে, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে , যা রোদ পড়ছেগো দাদা।’
‘রেগো না গোলাপবালা, ওর ঐ হাতটা দিয়ে যখন আমার বাদামের খোসার স্পর্শ করে, বেশ লাগে কিন্তু।…এই ইভা মণী, লক্ষ্মী মানবসাই যাওতো গোলাপবালাকে একটু পানি দিয়ে এস।’
অতীব বিস্ময় নিয়ে উদ্ভিদ জগতের এই সকল কথা আমার কানে আসছিল। খাঁচার ডালাটা বাদাম গাছের একটা ডাল নুয়ে এসে খুলে দিতেই নিচে নেমে এলাম।নিজের খর্বাকৃতির দেহ দেখে এইবার বিস্মিত নয় সাথে ভীমড়িও খেলাম। বাম হাতটা ঠিক আছে।শরীরে মাঝের অংশ প্রায় নেই বললেই হয়। অপরূপ সেই রমনীয় দেহ আমার। ইমনতো বুকের ঐ স্বর্গীয় সৌন্দর্যে হাত বাড়াত বিয়ের আগে থেকেই। চক্ষু ছানাবাড়া হবার জোগাড় আমার। লম্বা দুখানা পা কেবল যেন গলা থেকে নেমে গেছে। ডান হাতটাই নেই, সেখানে গাছে পানি দেয়ার ঝাঝড়ির মত একটা পাত্রের আকার। বিস্ময় মনে লুকিয়ে ঠিকই তবুও চলে যাচ্ছি কাছেই একটা ছোট স্বচ্ছ জলাধারের ধারে। হাতটা দিয়ে মাটি আঁকড়ে ডান হাতের পাত্রাকার অংশ নিচে নামিয়ে পানি ভরে নিয়েও এলাম গোলাপের কাছে।
কাছ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল একটা বিশাল বটগাছ। তার বিশাল বিশাল লতানো মূলে অনকগুলা খাঁচা ঝুলছে, সেখানে অনেকগুলো বন্দী মানুষ। নানান বিকৃতি দেহের আকারে তাদের। তবে সবারই ডান হাতটা পাত্রাকার। কারও যেন দুটো হাতই। একদম গা ঘেঁষে একটা লম্বামূল চলে গেলো। একটু ছুয়েও গেলো। বলে গেলো বটগাছের কণ্ঠ,‘কিরে তোর দেখি মানবসাই হওয়া পূর্ন হয়নি, একটা হাত অকারনে রয়েই গেছে।’
বাদাম গাছ ক্ষেপে উঠল সে কথায়।‘বট দাদা তাতে তোমার কি? ওটা আমার ইচ্ছেয় আমি রেখেছি।’
‘না,তা বুঝেছি,মানবসাই ঠিক মত করতে পারনি। বুঝবে ঐ হাত যখন পাতা ছিঁড়বে।’
আমার ঠিক ঠিক তখনই চোখ গেলো বটগাছের গোড়ার দিকে পানি নিয়ে আগাচ্ছে অতি চেনা মুখটা। ঐ তো…ঐ তো ইমন। ‘ইমন, আমার ইমন’ চিৎকার করে উঠলাম। ছুটে গেলাম। বাম হাতটা দিয়ে ছুঁয়ে দিলাম বিকৃত ইমনের মুখটা।একটা কানও নেই। শরীরের মাঝের অংশ ঠিক আমারই মতই খুবই সংকীর্ণ। পা গুলো লম্বা লম্বা।বামহাতের জায়গায় আরেকটা পানির পাত্রের মত। আর ডান হাতটাও তো দু’জনার একই রূপে বদলেছে। চোখ দিয়ে দু’জনের পানি ঝরছে । ইমন একটু ছুঁয়েও দেখবে তেমন আঙ্গুলই নেই তার। একি অভিশপ্ত মানবসাই !হঠাৎ একটা লতানোমূল এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল বাদাম গাছের গোড়ায় আমাকে…পড়ে গেলাম। একটা গড়ান দিলাম…বাদামের পাতা এসে যেন ডাকছে, এই ওঠ, এই ওঠ ইভামণি, লক্ষ্মী মানবসাই আমার…
‘ইভা, আই ইভা…এ অসময়ে ঘুমাচ্ছ কেনো? ’চোখ মেলে তাকালাম। একবার কচলিয়ে লাভ হলোনা। আবার কচলাতে হলো দু’হাতে। ‘ওমা আমার দু হাতই দেখি ঠিকাছে।’ মনে মনে কথাটা ভাবতে ভাবতেই ইমনের হাতদুটো কাছে টেনে নিয়ে দুগালে ছুঁয়ে নিলাম। ঠোঁটের উপর দিয়ে মিহি করে গড়িয়ে নিলাম ইমনের কয়েকটা আঙ্গুল। এই তো এইতো সব ঠিক আছে।
‘ইমন,উফ! কি ভয়াবহ, তোমার দুটো হাতই পাল্টে গিয়েছিল স্বপ্নে। আমার কিন্তু পাল্টেছিল একটা। এই দেখো বুকের ভেতর এখনও ধুকধুক করেছে।’ বলেই একটা হাত টেনে বুকের বামপাশে স্তনের উপর নিয়ে হার্ট বিট শোনাতে চাইলাম। এক ফাঁকে দেখে নিলাম ড্রেসিং টেবিলের উপর বটের বনসাইটাকে। সবুজ দ্যুতি ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে সাদা দেয়ালে। কিছুটা ভয় এসে আমাকে গিলে নিল আবার।
‘কি করছ।দরজা খোলা। শাহীন আসছে। ’
হাতটা সরিয়ে নিতে নিতে আমাকে ধরে উঠে বসতে সাহায্য করল ইমন। সেই সময় ঘরে ঢুকল শাহীন।
‘জানো, শাহীনের কথা শুনে আজ আমি হাসবো নৎনা কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ও কি বলে জান- পৃথিবী নকি আগে সাদা-কালো ছিল। আগের সিনেমাগুলো সাদাকালো না, তাই ও ভেবেছে…।’
‘দূর!ওর কথা বাদ দাও। মাথায় এক ফোটা বিদ্যা আছে নাকি ওর। পুরাই গোবর। পার যদি একটু উর্বর করে নাও। আমাদেরই লাভ হবে।’
‘আর তোমার বুঝি খুব জ্ঞান। বলতো ঐ ছোট বামন বটটাকে কেনো ঘরে রাখলে? এত করে বললাম বারান্দায় ক’টা গাছ লাগাই। সবুজ না হলে কি বারান্দা ভাল লাগে। না, তোমার এক কথা পোকা হবে, মশা হবে। ভাব যেন মশা আর হচ্ছেনা। ’
‘দূর! গাছ কি বারান্দায় লাগানোর জিনিস। গাছ থাকবে গাছের জায়গায়। বারান্দা থাকবে নিট এন্ড ক্লীন। ’
‘তাহলে বেডরুমের ভেতর! ওটাকে ঘরে এনে ঢুকিয়েছ কেনো? ’
‘ওটা তো বনসাই, ওটা একটা অন্য জিনিস, বলতে পার একটা সো পিশ।’
‘কেনো? সুন্দরী ছাত্রীগুলো দিয়েছে বলে! শাহীনও কিন্তু ওটাকে খেলনাই ভাবছিল। দেখোতো তোমাদের জ্ঞানে কত মিল।’
শাহীন পাশে এস দাঁড়ানোয় সে কথা আর বেশি দূর এগালোনা। বরং শাহীনই প্রশ্ন করে বসল,‘ ভাইজান আফায় কইছে ঐটা বলে একটা গাছ, সত্যি? কেমনে করল এইটারে এত ছোট? গাছের বলে জান আছে, কষ্ট হৈতাছেনা ভাইজান ওইডার। ওরে কি পানি দিমু?’
একটু আগের আমার অভিমান আর শাহীনের কথায় ইমন বোধহয় রেগেই গেলো, বলল ‘চুপ! এত কথা বলিস কেনো? ওটা যে তি সে তুই বুঝবিনা। যা এক কাপ চা দে, এখনই বসতে হবে সেমিনারের জন্য লেকচার তৈরী করতে। ইভা, কালকে বুঝলে আমাদের ভার্সিটিতে পরিবেশ দিবসের উপর একটা সেমিনার আছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় – সবুজ অর্থনীতি। আপনি কি অন্তর্ভূক্ত?-এর উপর ভিসি স্যার আমাকেই সূচনা স্পিচ দেয়ার জন্য মনোনীত করেছেন। অনেক বড় দায়িত্ব না বলো?’
তিন.
ইমনের ডান হাতাটা আবার টেনে বুকের উপর নিলাম। বারবার চোখটা বট বনসাইটার দিকে চলে যাচ্ছে। একটা ভয় জড়িয়ে আছে এখনও। ‘ইমন দেখো এখনও বুক কাঁপছে। একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তোমার ছাত্রীরা দিয়েছে বলে যে কথা বলে ফেলেছি, রাগ করোনা জান। ওটা এমনে বলে ফেলেছি। খুব ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখলাম তো। সরি। কিন্তু তুমি এই বট বনসাইটা সরাও। আমার খুব ভয় ভয় লাগছে। ’
‘ভয়! কেনো? দূর! তুমি কি বলছ। বট গাছের ভয় বরং আমার ছিল এক সময়। এই এখানে এর আগে এখানে আমাদের টিনচালা ঘর ছিল। তখনও তো ঢাকা শহরের বাইরেই ছিল এই এলাকা। আামাদের উঠানের চারপাশ জুড়ে গাছ আর গাছ ছিল। কোন ফল আমাদের কিনে খেতে হতোনা। ঐ গাছ দেখে দেখেই সবুজের মাঝে তো বড় হয়েছি। আমি গাছকে তোমার চেয়ে কোন অংশে কম ভাবলবাসি না। কিন্তু বারান্দায় গাছ আমার পছন্দ না। কি দরকার অসুখ বিষুখ নিয়ে আসার। ঐ যে জানালা দিকে দেখো, ঐতো ওপাশের প্লটটা, ওটাই ছিল বাবার এক চাচাত ভাইয়ের বাড়ী। ওটার ওপাশে এক চিলতে ধানি জমি ছিল, তারপর ছিল একটা বড় বটগাছ। আমাদের বিকেলের খেলার আসর ছিল। ঐ চাচার মেজে মেয়েটা গলায় দড়ি দিয়েছিল বটের ডালে। সেই স্মৃতি কতকাল ভুগিয়েছে। আর কখনও বিকেলের খেলার আসর হয়ে ওঠেনি ও বট তলা। বট বনসাই দেখেতো আমার ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু জীবন কী নষ্টালজিকতা দিয়ে চলে, সেই পুরাতন স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকলে হয়, দেখো আশেপাশে এখন ঝকমকে শহর গড়ে উঠছে। সে বট আর বন বাঁদাড় কোথায় হারিয়ে গেছে আজ! প্রতিটা জমিতে প্লট-এপার্টমেন্ট। যে জমিতে আগে একটা বাড়ি ছিল, একটা ফ্যামিলি ছিল, সেখানে এখন দশ বিশটা ফ্যামিলি বাস করছে, জায়গার অপচয় হচ্ছেনা। একটা সিম্পল শো পিস এতো ভয় পাচ্ছ কেনো? কি স্বপ্ন দেখেছো আসলে বলো তো।’
‘স্বপ্ন থাক। ওটা শো পিস নয়। ওটা অবশ্যই গাছ। শাহীনও জানে ওটার প্রাণ আছে, আর তুমি। ছিঃ । মানুষ কেনো গাছগুলো বামন বানায় কে জানে। আবার কেউ টাকা দিয়ে সেটা কেনেও। ওদিকে দেখো এই এত এত গাছ কেটে তোমাদের এই সব এপার্টমেন্ট হয়েছে এর বদলে কয়টা গাছ তোমরা লাগিয়েছে? তুমি আবার বলে কাল গ্রীণ ইকোনমি আলোচনা করবে। তবে কি গ্রীণ ইকোনমি মানে গাছ কেটে সবুজ উজাড় করে টাকা কামানো?’
‘ইভা, তুমি এসব কি বলছ। হঠাৎ কি হলো তোমার। মানুষ এত বেড়েছে এ দেশে, কি উপায় ..গাছতো লাগাতেই হবে,প্রতিটা এপার্টমেন্টের সামনে রাস্তার ধারে গাছ লাগাও। কে মানা করেছে।’
‘না! আমি বার›াদা দুটো ভরে তুলব গাছে গাছে। ঘর থেকেই সবুজের আন্দোলন শুরু করতে হবে। আর বনসাইটা ড্রইং রুমে নিয়ে রাখ না প্লিজ। ওটার দিকে তাকাচ্ছি আর …, আমার সাদা ঘরে সব সাদাই থাকনা, রঙিন তুমি অন্য কোথায় গড়ে তোল …’
‘আরে কি…দূর! তুমি না এইসব কুসংস্কার বিশ্বাসই করোনা। হঠাৎ কি হলো। ওঠ। চা খাও। শাহীনের সাদা-কালো আর তোমার এই কথা তো একই রকম হয়ে গেলো না। আমার অনেক স্টাডি করতে হবে। তোমার সাথে এখন তর্ক করে লাভ নেই। গ্রীণ ইকোনমি নিয়ে তুমি যা বললে তা হাস্যকর। এ অনেক বড় একটা বিষয়। জানি বলেই নিশ্চয় লেকচার দেয়ার জন্য মনোনীত হয়েছি। পেপার টেপারতো পড়োনা। জ্ঞান বাড়বে কি করে?’
আমার কিঞ্চিৎ রাগ হতে লাগলো বলে বলেই ফেলাম, ‘ইমন, তুমি ঝগড়া করছো কেনো? গাছ কেটে কোন গ্রীণ ইকোনমি হতেই পারেনা। তাই তুমি যতই লেকচার দাও। আমি বনসাই সরালাম। শাহীন শাহীন, এই টাকে সরাতো ও ঘরে। …থাক তোমার গ্রীণ ইকোনমি নিয়ে।’
হাতটা টেনে ধরে বলল, ‘আরে খামাখা রাগছ। গ্রীণ ইকোনমি মানে কি জানতে চাও। শোনা – ইন সিম্পিলিস্ট এক্সপ্রেশন এ গ্রীন ইকোনমি ক্যান বি থট অফ এজ অন হুইচ ইস লো কার্বন, রিসোর্স এফিসিয়েন্ট এন্ড সোশ্যালি ইনক্লুসিভ। কি বুঝলা, মূল বিষয়টা হচ্ছে কার্বন নিঃসরণ কম করতে হবে। রিসোর্সের যথাপুযুক্ত ব্যবগহার করতে হবে। কল কারখানা ঠিকঠাকমত স্থাপন করতে হবে। এই বনসাইটাও সম্পদের একটা এফিসিয়েন্ট ব্যবহার কি তোমার মনে হচ্ছেনা। জায়গা কমে আসছে, গাছও ছোট হয়ে আসছে…’
‘মানুষগুলোকেও ছোট করে ফেললে কেমন হয়। বুকটা বাদ, লম্বা পা, একটা হাত…’
‘ওটা তো সম্ভব নয়, তবে কিছু মানুষ কমিয়ে ফেললে ভালো হতো। তাহলে আর সাদা-কালো পৃথিবীর কিম্ভুত থিউরী কারও মুখে শুনতে হতোনা। কি আশ্চর্য অশিক্ষিত মানুষগুলোর চিন্তা ভাবনা সিনেমার জগতের মাঝে সীমাব্ধ হয়ে পড়েছে। এসব অশিক্ষিত লোকগুলোই দেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে আসলে। ’
‘ওই ওরাই কিন্তু গ্রামে কাদামাটি মেখে সবুজ ধানের শীষ ফলায়, আম-কাঠালের চাষ করে। না হলে তুমি এই সাদা স্বপ্নের ঘর সাজিয়ে টেবিলে পরিষ্কার ভাত খেতে পারতেনা। টেবিলে সাজাতে পারতেনা সবুজ হলুদ ফলের রঙিন ঝুরি।’
‘কিন্তু ভাব যদি শিক্ষিত হতো ঐ কৃষকরা তাহলে উৎপাদন বাড়ত। কলকারাখানায় শ্রমিকরা পরিবেশ বান্ধব উপায়ে কাজ করতে পারত। সবুজ অর্থনীতির জন্য তাই মূলত শিক্ষা দরকার। এই পয়েন্টটা কাল আলোচনায় ঢুকাতে হবে। ধন্যবাদ ইভা।’
‘তারমানে বলতে চাইছ শিক্ষিত লোকেরা পরিবেশ ধ্বংস করছেনা। ..তুমি আমিই তো উদাহরণ, এই এ জায়গাগুলোতে তোমার শৈশবেই বললে প্রচুর গাছ ছিল। এখন ধূ ধূ মাঠ, না হয় দালান বা দালানের কাঠামো কংকাল…গাছ গুলো কাটল কে। সবুজকে উজাড় করল কে?’
‘কি বল, মানুষের বসবাসের স্থান লাগবেনা। তবে সুন্দরবনে গুপ্ত কাঠুরিরর বা দল বনদস্যুরা নিয়মিত বন উজাড় করছে বিনা অনুমতিতে। একই কাজ পাহাড়ী বনগুলোতেও। ’
মনে হচ্ছে আমরা অকারনে কথা বাড়াচ্ছি। ঠিক এই কাজটাই আমাদের দেশের একদল বিজ্ঞ বাগ্মী অহরহ করে থাকে। আমি থামতে চাইলাম বলেই বললাম, ‘ইমন তুমি না এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারীং পড়াও…তোমার এই চিন্তা ভাবনা! ..তুমি থাক তোমা জ্ঞান নিয়ে, আমরা কেনো তর্ক করছি….তোমার সাথে তর্ক করা বৃথা। আমি এই এখনই বৃক্ষ মেলায় যাব। বারান্দায় গাছ লাগাবোই। থাক তোমার গ্রীন সবুজ ইকোনমি নিয়ে। আর একটু ভেবে দেখো..কলকারকাখানাই কিন্তু সকল সিএফসি আর দূষনের জণ্য দায়ী, কলকারখানা অশিক্ষিত গরীবের অধিকারে নয়, বিত্তবানদের কাছেই সব।’
চার.
রাগের মাথায় মোট ছয়টা গাছ কিনে সন্ধ্যার পর ফিরে এসেছি। বারান্দায় গাছগুলা সাজাতে ব্যস্ত আমি। ঘরে ঢোকার সময় দেখলাম ইমন ড্রইং রুমে ল্যাপটপ নিয়ে গভীর নিমগ্ন।
একটু পরে কানে এল ইমন চ্যাচাচ্ছে-‘শাহীন, শাহীন, তোর আপা কই?’
‘আফায়তো অনেকগুলা গাছ কিনা আনছে। হেইডি নিয়া বারন্দাতে কামে ব্যস্ত। কি সুন্দর ফুল ফুইটটা রইছে ভাইজান। ’
‘ইভা না কোন কথাই শোনে না। একবার জিদ চাপলে…এই সন্ধ্যায় কেউ গাছ লাগায়।’
‘ভাইজান কিছু কইলেন।’
‘হুম…না। শোন তুই বলে কইছোস পৃথিবী আগে সাদা-কালো ছিল?’
‘কেনো, সিনেমায় তো দেখায়। ’
‘গ্রামে ধান লাগাইছোস কখনও। ধানের পাতার কিংবা শীষের কি রঙ কতো? কিংবা তোর মাঠের ঘাস।’
‘কি আবার-সবুজ।’
‘তাইলে বল, এই সব সবুজ কি আগে সাদাকালো ছিল, কি মনে হয়। ভাবতে থাক। আগে কি মানুষ সাদাকালো চা খাইতরে। বানাতে পারবি সাদাকালো চা। ’
ভাইজান, মনে হয় আমি বুঝবার পারছি। আফায় একটু বুঝাইছিল ক্যামরায় সাদা-কালো করন যায়। আর লজ্জা দিয়েন না। তয় আফা একটু আগে কইছে আগে বলে মানুষের মন সাদা-কালো আছিল। মানুষ ভালা আছিল। আজকাল বলে রঙিন হৈছে। বটগাছরে বাইট্টা বানাইছে। মানুষ সব খারাপ হৈয়া যাইতাছে।’
রেলিংয়ে গেটফুলের লতাটা প্যাঁচিয়ে দিতে দিতে মুখ টিপে হাসলাম। আমি জানি ইমনের মনটা কত পরিষ্কার। সাদা-কালো ভালোবাসে তার মন। ওর মন নষ্ট বৃদ্ধিজীবীদের মত তথাকথিত স্বার্থময় হবার নয়।
আকাশে আধফালি চাঁদ উঠেছে। চাঁদের বুকে কালো ছায়া ফেলে কয়েক গুচ্ছ মেঘ উড়ে যাচেছ। শীতল বাতাস। বৃষ্টি হতে পারে। হঠাৎ আমার সাদা মনে ইমনের জন্য একটা আলাদা গর্ব এসে ঢেউ হয়ে ফুলে ওঠে।
ইমন একটা নামীদামী প্রাইভেট ভার্সিটিতে এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারীং বিভাগে লেকচারার। সাথে এক বাল্যবন্ধুর ডেভেলোপিং ব্যবসায় সে একজন ডিরেক্টও হয়েছে। পৈত্রিক এই সম্পত্তিতে বেশ ভালো একটা এপার্টমেন্ট বিল্ডীং তৈরী করে নিতে কষ্ট হয়নি। নিজের নামে চারটে ফ্ল্যাট এখানে তার। ভালোই চলে যাচ্ছে সব। আমি জানি বনসাইটা সে নিজেই কিনেছে। বলার সাহস নেই। মেলায় দেখে এসেছি , কম হলেও ওটার দাম আট হাজার টাকা। ওর কি দোষ, বছর পাঁচকে আগে একবার কঠির ডেঙ্গুতে ভুগল, তারপর থেকেই তো ঘরের বারান্দায় গাছগাছালি লাগানোর প্রতি এত এলার্জি ওর।
পরিশিষ্ট.
অনলাইনে এক তথ্যে ইমন দেখল বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা শহরের তালিকায় বাংলাদেশের নাম দ্বিতীয়। দূষণের মাত্রাও এই শহরে সহনশীল পর্যায় ছাড়িয়ে অনেক অনেক আগেই। হঠাৎ যেন নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হতে লাগল ইমনের। গোবর মাথার শাহীনের কথাও এখন তার মাথায় ঘুরছে।
আসলেইতো- আগের পৃথিবীর মানুষগুলো সাদা-কালোই ছিল। সবুজের এত অফুরন্ত সমারোহ ছিল যে তাদের এই নিয়ে ভাবতেই হয়নি। ইচ্ছে মত কাঠ কেটেছে, কেউ ইচ্ছেমত গাছও লাগিয়েছে, অফুরন্ত জায়গা। এত কলকারখানা ছিলনা। গাছ কে কাটবে। ইটের ভাটায় চুরি করে আগুন কে জ্বালাবে দামী কাঠ দিয়ে। রঙিন হয়ে উঠেছে আধুনিক মানুষের মন বড্ড। রঙিন রঙিন টাকার বন্যায় ভাসতে চায়, তাই উজাড় করছে গাছ গাছালি, কেমিক্যাল উড়িয়ে ধ্বংস করেেছ বিশুদ্ধ বাতাস। রঙিন মনের স্বপ্নে বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভরাতে হচ্ছে বসবাসের একমাত্র এই আবাসস্থল পৃথিবী। সে কী গাছ লাগানোর বিরুদ্ধে নাকি? গাছ না লাগালে পরিবেশ ঠিক থাকেনা। সে জানে। কিন্তু মানুষের বসবাসের বিষয়টাও তার মাথায় কাজ করে। দুটোর একটা সামাঞ্জস্যতা ঘটাতে হবে। কে ঘটাবে এ দেশে?
আসলে কাল লেকচারে তার এগুলোই তুলে ধরা উচিৎ। গ্রীণ ইকোনমির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা, অনেক বিদ্যার ভারে ভারাক্রান্ত হলেই সচেতনতা আসেনা। সচেতনতা এক অন্য শিক্ষা। ভাল থাকার শিক্ষা বোঝার বিষয়।
ইমনের সাদা কালো মনটা সাঁঝের আধারে একাত্ম হয়ে নড়ে ওঠে। ইভার সাথে ওমনটা ব্যবহার ঠিক হয়নি। সে ছুটে যায় বারান্দার দিকে। ইভার কাঁধে হাত রেখে বলে ‘আমি কি তোমার গাছে একটু পানি দিতে পারি?’
ইভার চোখের কোন বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। বলে, ‘ভেবোনা আমি জানি তোমার মশা ভীতি, আমি নিয়মিত গাছ পরিষ্কার করে রাখব।’
‘আমি বিশ্বাস করি, তুমি পারবে। আমাদের সাদাকালো স্বর্গে গাছগুলো সবুজ বন্ধন হবে নিশ্চয়। দেশের কর্তা ব্যক্তিরা যদি পরিবেশটাকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার বানিয়ে ক্রামগত ধর্ষন না করে সেটার সবুজ সতেজ রাখার প্রতি যত্নবান হতো…কত ভালো হতো। আমি কিন্তু এই কথাগুলোই কাল সেমিনারে বলব।
ইভা বলে, ‘একটু সাবধানে, মনে রেখো এটা কিন্তু বাংলাদেশ। এখনে ‘গ্রীণ ইকোনমি’ টার্মটা কে কি স্বার্থে ব্যবহার করবে কে জানে?’
‘কিন্তু এভাবে আর কত বলোতো, বই পুস্তকেই কি কেবল রয়ে যাবে সবুজ, সুফলা, শষ্য শ্যামলা। আর বাস্তবে উল্টো!’
‘সে জানি না ইমন, তবে বনসাইটা অনেক দাম দিয়ে তুমিই কিনেছো, তাইনা? আমি ওটাকে খুব যত্ন করব, দেখো যত্নে যত্নে বট গাছ তার বাইট্টা হওয়ার কষ্ট ভুলে যাবে।’