বহুদিন পর চিঠি লিখছি। সেই যে কলেজের দিনগুলোয় তোমাকে লিখতাম, আর হয়ে ওঠেনি তারপর। তারপর তো এই ফোন এল, আর এখন তো চিঠির কাজও মেলেই সারে লোকে।
পৃথিবীটা কত এগিয়ে গেল তাই না? আমরা কেমন বড় হলাম, বুড়ো হলাম!
হ্যাঁ গো, এখনো রাগ করে আছো? কেজানে! এই যে সারাজীবন সংসার করলে না, ছন্নছাড়ার মতো জীবন কাটালে, সব আমার উপর রাগ করে? নাকি সবাইকে যা বলো, সেটাই সত্যি? সত্যিই তোমার সময় হয়নি? জানিনা! কিন্তু বড্ড ইচ্ছে করে জানতে জানো! বড্ড ইচ্ছে করে! পঞ্চাশ বছর একটানা সংসার করেছি। না না, স্বামীকে ভালো না বেসে শুধু তোমাকেই মনে রেখেছি তা কিন্তু একদম নয়। ওকে ভালোবেসেছি প্রাণ দিয়ে। কিন্তু স্বামী ছিলো আমার ঘরের মানুষ, তুমি ছিলে আমার দেবতা! যাকে না পারি ছুঁতে, না পারি পেতে, শুধু মনে মনে সমর্পণ করেই সুখ।
তোমার কিন্তু সেদিন দোষ ছিলো না। আমি যে তোমার কাছে একেবারেই থাকতে পারতাম না তাও নয়! কিন্তু জানো তো, সেদিন যদি তোমার কথা শুনে তোমার সঙ্গে পালাতাম বাড়ি থেকে, আজ হয়তো এভাবে তোমাকে চিঠি লেখা হতো না। পারতাম আমি, ইচ্ছেও ছিলো খুব! জীবনটা তো তোমার সঙ্গেই কাটাতে চেয়েছিলাম আমিও! কিন্তু বলো তো, সত্যি করে ভেবে বলো, ঠিক কতদিন তুমি নিতে পারতে সংসারের বোঝা? আমাকে নিয়ে পালালে তোমার কপালে জুটতো অপমান, লাঞ্ছনা। তোমার বাবা তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করতেও দু’বার ভাবতেন না! হাতের টাকা ফুরিয়ে এলে হয়তো আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো তুমিও কেরানীর চাকরি খুঁজে নিতে। দশটা-পাঁচটার চাকরি, সংসার, বউ, বাচ্চা- সবই হতো! শুধু হতো না তোমার কবি হওয়া! তুমি যে দায়িত্ব নিতে পারো না বেশ বুঝেছিলাম। জোর করে দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে হয়তো তোমার এই পাগল পাগল কবি হওয়া হতো না।
তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও তোমার সব খবরই পেতাম কাগজে। কিছুদিন স্কুল মাষ্টারি করলে, তারপর পুলিশেও জয়েন করলে, সব শেষে কেরানী হতেও ছাড়লে না, তারপর পাঁচ বছরে তিনটে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে শুধুই কবিতা লেখায় মন দিলে। অবশ্য তার মধ্যেই বেশ নাম ছড়িয়ে গেছে তোমার। তোমার সব বই আমি পড়তাম জানো তো! স্বার্থপরের মতো একটা কথা বলি? এখন আর স্বীকার করতে অসুবিধে নেই, আমার একটা মন সবসময় চাইতো, তুমি ভালো থাকো। তোমারও একজন বউ হোক, একটা সংসার হোক, একটা শান্তির পরিবার হোক, পরিবারের মধ্যে কি মানুষ কবি হয় না? কিন্তু আরেকদিকে অন্য একটা মন চাইতো, তুমি যেমন আছো তেমনি থাকো! এই যে তোমার কবিতার ছত্রে ছত্রে আমি আমার পুরোনো আমিকে খুঁজে পাই, এ জায়গা যেন কেউ কক্ষণো কেড়ে না নিতে পারে! তুমি যেন এমনিই থাকো, এমনিই পাগল, এতটাই সুন্দর!
ভাবতে পারিনি এতদিন পর আবার দেখা হবে।
অথচ হয়ে গেল! লোকে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে অনেক খারাপ কথা বলে। আমি কিন্তু ভালো থাকার জন্যই এখানে এসেছি। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি, নিজের নিজের কাজের জগতে ব্যস্ত তারা। এই সময় আমার বয়সী আর পাঁচজনের সাথে বেশ সময় কাটবে বলেই আমার এখানে আসা। ভালোই কাটে জানো তো! সকালে উঠে হাঁটি আমরা, কথা বলি, গান শুনি। মাঝে মাঝেই কাছের স্কুলটায় গিয়ে চকলেট, বিস্কুট দিয়ে আসি। আর সবকিছুর শেষে রাত্রে যখন একলা হই, তখন সঙ্গী থাকে তোমার কবিতার বই। একটুও খারাপ নেই আমি। অথচ কাল যখন তোমাকে দেখলাম স্কুলের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে ষ্টেজে বসে থাকতে, পারিনি বেশীক্ষণ দেখতে। বারবার জল আসছিলো চোখ ভরে। অনেক বুড়ো হয়ে গেছো তুমি। শরীর ভেঙে গেছে। চুলেও পাক ধরেছে অনেক। শুধু চোখের পাগল পাগল দৃষ্টিটা একইরকম আছে। হঠাৎ আমাকে দেখে চিনতে পারবে ভাবিনি! কী করে পারলে গো? আমি না হয় তোমার ছবি দেখি প্রায়ই, তুমি তো দেখোনি আমাকে! তাও কী করে চিনলে? নাকি সত্যিই ভোলা যায় না? ওভাবে হঠাৎ সিট ছেড়ে এগিয়ে আসবে ভাবতে পারিনি। সেই কলেজবেলার মতো বুক কাঁপছিলো আমার। সেই ছোটবেলার মতো ভয় করছিলো, তুমি এসে সবার সামনে হাত ধরে ফেলবে না তো! কই, কিছুই তো করলে না! এসে কেমন বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে বললে, -“কেমন আছো?”
তোমার ওই হাসি দেখে কী করে যে চোখের জল আটকেছি কী বলবো! ফিরে এসে অনেকক্ষণ কেঁদেছি। আসার সময় বলেও আসিনি তোমাকে। ভয় করছিলো খুব, যদি কেঁদে ফেলি সবার সামনে!
যাক, অনেক বড় হলো চিঠিটা। বহুদিন পর চিঠি লিখলাম আবার। উত্তর পাবো জানি। অপেক্ষায় থাকলাম। ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো। আমি ভালো আছি।
মন,
বহুদিন পর, বহুউউউদিন পর তোমার চিঠি পেলাম। কেমন যে মনে হচ্ছে, ঠিক কী যে ইচ্ছে করছে বলতে পারবো না। আমি আসলে নিজেও জানি না! খুশিটা বড্ড বেশী হয়ে গেলে যা হয়! একটা বাচ্চা অনেকদিন একটা লাল টেডির জন্য ঘ্যানঘ্যান করার পর হঠাৎ একটা সকালে যদি পেয়ে যায় বিছানার পাশে, তাহলে ঠিক যেমন আনন্দ হবে, তেমনি আনন্দ হচ্ছে এখন আমার।
প্রশ্ন করেছো কেমন আছি! প্রশ্ন করার আগে তার উত্তরও তুমিই দিয়ে দিয়েছো। মনে আছে, তোমাকে লেখা শেষ চিঠিটায় লিখেছিলাম…তুমি ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি!
প্রথম প্রথম কিন্তু ভালো ছিলাম না জানো! একেবারেই ভালো ছিলাম না! তুমি তো হুট করে বিয়ে করে নিলে! আমার প্রথমে তোমার উপর খুব রাগ হলো, এমনকি তখন আমার এমনও মনে হতো, তুমি হয়তো হঠাৎ একদিন বর ঘর সব ছেড়ে সামনে এসে বলবে, “পারলাম না থাকতে!”
আমি তখন খুব রাগ দেখাবো, খুব! তারপর যখন তোমার চোখে জল আসবে, গাল, নাক লাল করে তুমি কেঁদে ফেলবে ঠিক তখনি ফিক করে হেসে দিয়ে বলবো, “বেশ! এবারে আর রাগ করছি না! কিন্তু আর কখনো যেও না আমাকে ছেড়ে!”
তারপর একসময় বুঝলাম এসব শুধুই মিথ্যে আশা! তখন রাগটা গিয়ে পড়লো বাবার উপর। বাবা কেন তোমাকে মানলো না! তুমি ব্রাহ্মণ নও শুধু এই দোষে বাবার তোমাকে মানতে এত সমস্যা!
এবারে ছাড়লাম বাড়ি। স্কুলে চাকরি নিলাম দূরের গ্রামে। বইপত্র বিক্রি হতে শুরু করেছে তখন। যা পেতাম চলে যেত ভালোই।
কিন্তু তাও ভালো লাগলো না কিছুদিন পর। প্রথম প্রথম গাছপালা দেখে যে রোম্যাণ্টিসিজম আসতো, ভাবনা আসতো, কিছুদিন পর সেসব গাছপালাই হয়ে উঠলো একঘেয়ে। নিঝুম নিস্তব্ধ পৃথিবী বিরক্তিকর লাগতো বড্ড। তুমি তো জানোই তারপরের কথা। অনেক জায়গায় ঘুরেছি জীবনে, লিখেছি অনেক। ভালোবেসেছি জীবনকে। সেই যেবার পাহাড় থেকে পড়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ঘুরে এলাম, সেবারে ভালোবাসতে শিখেছি মৃত্যুকেও। তবে হ্যাঁ, প্রেমিকা আমার একজনই! তোমার জায়গায় আজও কাউকে বসাতে পারিনি। এই যে তুমি অবলীলায় বলে দিলে, তুমি স্বামীকে ভালোবাসতে, তুমি কিন্তু জানো আমার খারাপ লাগবে, লেগেওছে, কিন্তু জানো তো, ভালোও লেগেছে খুব! আমি যে তোমাকে শ্রদ্ধা করি খুব। কাউকে ভালো না বেসেই তাকে মিথ্যে বলে গেলে সারাজীবন, এ আমি তোমার ব্যাপারে কিছুতেই মানতে পারতাম না।
যাক, জীবনে অনেক কিছুই চলে গেছে। আমরাও চলে যাবো হয়তো আর কিছুদিন পর। খুব আফসোস হয় মাঝে মাঝে, যদি পরের জন্ম হয়, আমার যেন মনে থাকে এ জন্মের কথা! ও জন্মে আগেভাগেই তোমাকে বলে রাখবো, “আমি কিন্তু সারাজীবন গতবারের মতো কাটাতে পারবো না। তোমার বরের সাথে সাত জন্মের বাঁধন অন্য কখনো বেঁধো! এ জন্মটা আমার সাথে থাকো!”
চাইলেই তোমার ফোন নম্বর চাইতে পারি। চাইলেই তুমি দেবে জানি! এই যে জীবনের শেষ দরজায় দাঁড়িয়ে এখনো বন্ধুত্ব স্বীকার করা, এ কী কম মূল্যবান যে ফিরিয়ে দিতে পারবে!
কিন্তু তবু চাইবো না! ওই যে চাইলেই তোমার গলা শুনতে পারবো, চাইলেই দেখা করতে পারবো, অতটা সহজলভ্য তুমি নও, ছিলে না কোনোদিন। তবু ইচ্ছে করে কথা বলতে, দেখা করতে। ইচ্ছে করে সেই পুরোনো অভ্যেসটা ফিরিয়ে আনতে, সেই যে আমার কবিতা তোমাকে না পড়িয়ে কাউকে পড়তে দিতাম না!
বয়স হয়েছে। আসতে বোধহয় কষ্ট হবে। তবু বলি, ছাব্বিশ তারিখে যাবে শান্তিনিকেতন? সেই মনে আছে, আমরা যখন আশ্রমে থাকতাম, ছাব্বিশ তারিখে গান গেয়ে বেড়াতাম দুজনে। তুমি কেমন বলতে, “কালকেই এ রাস্তায় কত গান ছিলো, কত মানুষ ছিলো, আজ কেমন ফাঁকা লাগছে, চলো গান করি!”
যাবে আরেকবার? আম্রকুঞ্জে অপেক্ষা করবো। না এলেও ক্ষতি নেই। আমার আর অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না!
ভালো থেকো তুমি। যদি আসো, তবে লুকিয়ে এসো না। তাতে আমাদের বন্ধুত্বকে ছোট করা হবে। বলে এসো সবাইকে। কেউ সঙ্গে আসতে চাইলে নিয়েও এসো, শুধু দেখো এই ফাঁকে কেউ যেন আমার সাক্ষাৎকার নিতে না বসে। ভালো লাগে না ওসব আর! তুমি এসো, তোমাকে গোটাকয়েক কবিতা শোনাবো, তোমার সংসারের গল্প শুনবো একটু, ব্যস! আর কী চাই!
চিঠিটা এখানেই শেষ! তারপরে আর চিঠি আদানপ্রদান হয়েছিলো কিনা জানা নেই আমার। তবে ছাব্বিশ তারিখে আম্রকুঞ্জের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়লো, দুজন চিরনবীন মানুষ ভরাট গলায় রবিঠাকুরের গান গাইছেন…”জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে…। ”
ভালো লেগেছে খুব। খুউব! কিছু প্রেম বেঁচে থাকে এভাবেই, হয়তো রবিঠাকুরের গান ছাড়া আর কোথাও তাদের ছোঁয়া পাওয়া যায় না।
এগিয়ে গেলাম পায়ে পায়ে। কানে তখনো বাজছে…”বন্ধু হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে…”