তোমায় নিয়ে গল্প হোক

তোমায় নিয়ে গল্প হোক

শ্রীতমা ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে নীচে যাওয়ার সময় হঠাৎ ই বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সদ্য সদ্য পুজো কেটেছে। অক্টোবর এখনো শেষ হয়নি। উমা বাপের বাড়ি ফিরে গেছে। কিন্তু বাতাসে যেন এখনও উৎসবের আমেজ লেগে আছে। শরৎের মেঘ আকাশে পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। এসব দেখতে দেখতে শ্রীতমার ছোটোবেলার সেই গল্পটার কথা মনে পড়ে যায় যেখানে শরৎের আকাশে ঐ পেঁজা তুলোর মতো মেঘ কে রবি ঠাকুরের দাঁড়ির সাথে তুলনা করা হয়েছিল। খানিকটা নিজের মনেই হেসে ওঠে শ্রীতমা। হঠাৎ করে অতীতের কিছু ধূলো পড়ে যাওয়া স্মৃতি চোখের সামনে পুনরায় ভেসে ওঠে। ছোটোবেলায় কত আম কুড়িয়েছি আম বনে, গাছে চড়ে দস্যিপনা করেছি আবার মায়ের কাছে বকা ও খেয়েছি। সে সবই এখন অতীত।

বর্তমানে শ্রীতমা বছর সাতচল্লিশের গৃহবধূ। শুধু গৃহবধূ নয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৃহবধূ তাই কাঁধে হাজার একটা দায়িত্ব ও রয়েছে। যদিও সেসব দায়িত্ব আজ দীর্ঘ বত্রিশ বছর ধরে শ্রীতমা পালন করে আসছে। প্রথম দিকে অনেক প্রতিকূলতা ছিল সেসব শ্রীতমা অনেক আগেই কাটিয়ে উঠেছে। বাড়িতে শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী আর দুই ছেলেকে নিয়ে ভরা সংসার। আপাত দৃষ্টিতে এক সুখী গৃহবধূ।

স্বামী অনিমেষ বসু নিজের ব্যাবসা আছে। অনেক খেঁটে বানানো। এখনও সিংহভাগ সময় ব্যাবসার পিছনেই দেন। শ্বশুর মহীতোষ বসু আগে একটি ছোটো বেসরকারি চাকরি করতেন। কোনোরকমে সংসার চালাতেন। খুব কম বয়স থেকেই অনিমেষকে সংসারের হাল ধরেন। মহীতোষবাবু ভীষণ পাংচুয়াল। ঠিক সকাল সাড়ে ছটায় মর্নিংওয়াকে বেরোন। আর ঠিক সাড়ে সাতটায় ফিরে এসে চা আর পেপার নিয়ে বেরোন। নটায় ব্রেকফাস্ট। একটায় লাঞ্চ আর রাত নটায় ডিনার। এর অন্যথা কোনোদিন হয় না আর হলে সেদিন শ্রীতমার কপালে দুঃখ আছে। পৃথিবী এদিক থেকে ওদিকে হয়ে গেলেও ওনার সময়ের কাজ সময়ে হওয়া চাই।

শাশুড়ি মনোরমা বসু। একসময় ডাকসাইটে মহিলা ছিলেন। এখন অবশ্য বেশ শান্ত শিষ্ট। নিজের গোপাল ঠাকুর কে নিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দেন।

বড়ো ছেলে স্বরূপ বসু। পড়াশোনা শেষ করে বাবার সাথে ব্যাবসায় যোগ দিয়েছে।

ছোটো ছেলে অরূপ বসু। এখনও পড়াশোনা করছে। কলেজে পড়ে। সাহিত্যের প্রতি একটু অনুরাগী। অনিমেষ বসুর ছেলের এই গুণ মোটেও পছন্দ নয়। তাঁর মতে মায়ের আস্কারাতেই ছেলে এরকম হয়েছে তাছাড়া ঐ শখের লেখালেখি করে তো আর টাকা রোজগার হবে না। উনি চান স্বরূপের মতো অরূপ ও পড়া শেষ করে ব্যবসায় যোগ দিক এবং অরূপের তাতে একদমই মত নেই। তাঁর স্বপ্নগুলো একটু আলাদা স্তরের।

শ্রীতমা এখনও রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবনার সাগরে এতটাই ডুবে গেছিল যে বুঝতে পারেনি সময় দ্রুতগতিতে তাঁর নাগালের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ভাবনার তাল কাটল মহীতোষবাবুর ডাকে।

মহীতোষ বাবু:- শ্রীতমা, বলি আজ কি চা টা পাবো না? (রেগে গেলে উনি শ্রীতমার নাম ধরে ডাকেন নাহলে অন্যান্য সময় বৌমা বলেন)।

এই রে বড্ড দেরী হয়ে গেল। আজ আবার ভাগ্যে বকুনি আছে। কেন যে খামোখা দাঁড়াতে গেলাম। নাহ তাড়াতাড়ি যাই। ভাবতে ভাবতে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সটান রান্নাঘরে ঢুকে গেল। চা বানিয়ে নিয়ে মহীতোষবাবুর কাছে গেলেন শ্রীতমা।

চা টা নিতে নিতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন – ” পুরো আধ ঘন্টা লেট।”

শ্রীতমা:- আজ একটু দেরি হয়ে গেল বাবা।

মহীতোষ বাবু:- তা দেরি হওয়ার কারণটা কি জানতে পারি??

শ্রীতমা:- আসলে বাবা আজ….

মহীতোষ বাবু:- থাক। আবার তো কতকগুলো মিথ্যে অজুহাত দেবে। এই সংসারের কাজ ছাড়া তো আর কিছুই করতে হয় না তোমাকে তাতেও এতো গাফিলতি। যাও যাও আর দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের কাজ কর।

শ্রীতমা:- আচ্ছা বাবা।

এরপর একে একে সকলকে চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে শুরু করল। নিজের যে চা টুকু খাওয়া হল না সেদিকে বোধহয় শ্রীতমার খেয়াল নেই। আজ রোববার। সকলে বাড়িতেই থাকবে। তাও সকলে নিজের মতো মশগুল। কেউ পেপারে, কেউ অফিস ফাইলে তো কেউ ল্যাপটপ বা মোবাইলে। এমনিতে তো সারা সপ্তাহ কারুর পাত্তা পাওয়া যায় না এই রোববারটা শ্রীতমা আশা করে সকলের সাথে একটু সময় কাটাবে কিন্তু আজকাল কার দিনে কারুর কাছেই কারুর জন্য সময় থাকে না। সবাই নিজেকে নিয়ে দিনরাত ব্যাস্ত।

কথায় বলে ছেলেমেয়েরা বড়ো হলে মা বাবার উচিত তাঁদের স্পেস দেওয়া। সেই স্পেস দিতে দিতে আজ একটা মস্ত বড়ো স্পেস তৈরি হয়ে গেছে। তাও শ্রীতমা বারবার ছুটে যায় ছেলেদের কাছে, স্বামীর কাছে দুটো মনের কথা বলার জন্য দুটো মনের কথা শোনার জন্য কিন্তু শ্রীতমাকে কোনোদিনই তাঁরা পাত্তা দেয়নি। আর এখন শ্রীতমাও মেনে নিয়েছে। সারাদিন সকলের খুঁটিনাটি জিনিসপত্রের খেয়াল রাখা, সকলকে ভালো রাখা, যত্নে রাখা এইগুলোকেই জীবনের একমাত্র ব্রতী করে নিয়েছে।

দুপুরে সকলের খাওয়া হয়ে গেলে সব গোছগাছ করে শ্রীতমা পেপারটা খুলে বসে। প্রতি রবিবার আনন্দবাজার পত্রিকায় যে ছোটো গল্পটা দেওয়া হয় ওটা শ্রীতমা নিয়ম করে পড়ে। আজও পড়তে বসেছে। আজকের গল্প –

তোমায় নিয়ে গল্প হোক

আজ রোববার। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকের সকালটা একটু অন্যরকম। একটু গড়িমসিতে ভরা আলসেমিতে ভরা। সূর্য টা ও যেন আজ উঠতে দেরি করছে। যদিও বিজ্ঞান বলে সূর্য নিজের জায়গায় স্থির। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে তার চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এই আবর্তনের ফলেই দিন রাত্রির পার্থক্য দেখা যায়। তবে কি বলা উচিত আজ পৃথিবীর গতি কিঞ্চিত মন্থর ছিল তাই সকাল হতে দেরি হয়েছে। যাই হোক এসব বড়ো জটিল তত্ত্ব। এ ব্যাপারে আলোচনা বৃথা। মূল গল্পে ফেরা যাক।

সালটা 1972। দত্ত গিন্নির কোল আলো করে এল এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান। সেই সময় টা ছিল পুজোর পর পর। ঠিক এখনকার মতো। ফুটফুটে মেয়েটার নাম রাখা হল শ্রী। বাড়ির সবচেয়ে ছোটো সন্তান। শ্রীয়ের চার দাদা রয়েছে। সকলের ছোটো শ্রী সকলের ভীষণ আদরের। একটু একটু করে গুটিগুটি পায়ে দাদাদের আর মা বাবার কোলে খেলে বড়ো হতে লাগল শ্রী। আর পাঁচ টা সাধারণ মেয়েদের মতোই ছিল শ্রী। সেই সাধারণ মেয়েটার ছোট্ট ছোট্ট ইচ্ছে স্বপ্ন গড়ে উঠছিল। শ্রী অনেক বড়ো বয়স পর্যন্ত দাদাদের মায়ের কোলে চড়ে ঘুরেছে সবচেয়ে বেশি সেজদার কোলে। মেজদা শ্রী কে ভীষণ ভালোবাসত। একবার লাল জামা লাল ফিতে আর লাল পুতুল কিনে দিয়েছিল মেজদা। সেগুলো পেয়ে মেয়ের আনন্দ ধরে না। নতুন জামা পরে নতুন পুতুল নিয়ে খেলতে বসে পড়ে। সেই সময় পাশের বাড়ির হারান দা সেখানে আসে। আর এসে শ্রী কে বলে ” আমাকে দে পুতুল টা।”

শ্রী তো কিছুতেই তাঁর সাধের পুতুল হাতছাড়া করতে রাজি নয়।

শ্রী:- না দেব না। এটা তো আমার।

হারানদা:- দিবি না মানে?? দে বলছি।

শ্রী:- না দেব না।

কিছুক্ষণ এইভাবেই তর্ক চলল। তারপর শুরু হল পুতুল যুদ্ধ। একজন দৌড়াচ্ছে পুতুল নিয়ে আর একজন তাঁর পিছন পিছন। দৌড়াদৌড়ি করার সময় শ্রী পড়ে যায়। বেশ চোট লাগে। পড়ে গিয়ে শ্রী কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। সেই দেখে হারানদা বেশ ভয় পেয়ে যায়। দৌড়ে গিয়ে সকলকে ডেকে আনে। সকলে এসে শ্রী কে সামলায়। সেদিন রাতে আবার যাত্রা ছিল গ্রামে। সন্ধ্যে থেকে শ্রী বায়না জুড়েছে যাত্রা দেখতে যাবে কিন্তু পায়ে চোট লেগে বেচারি হাঁটতে ই পারছে না। শেষমেশ অনেক বায়না করার পর কোলে করে নিয়ে যাওয়া হল শ্রী কে। তবে মেয়ে খুশি।

মাঝে মাঝে বাবার সাথে শ্রী বাবার অফিসে যেত। সেখানে দাসকাকু শ্রী কে ভীষণ ভালোবাসতো। যখনই যেত চকলেট লজেন্স বরাদ্দ ছিল শ্রীয়ের জন্য। আসলে দাসকাকুর নিজের কোনো সন্তান ছিল না। শ্রী কে উনি নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। শ্রী ও ওঁনাকে খুব ভালোবাসত।

পড়াশুনা পুতুল খেলা আর দাদাদের আদর আর শাসনের মধ্যে বড়ো হচ্ছিল শ্রী। বড়দা শ্রী কে পড়াশুনো করাতো। আর পড়া না পারলেই বেদম মার।

এখন শ্রী ক্লাস এইট। দস্যিপনাটা একটু কমেছে। বড়দা আর মেজদার বিয়ে আগেই হয়েছিল। শ্রী বয়সে অনেকটা ছোটো ছিল। ওই আগেকার দিনে যা হত আর কি। এবার সেজদার বিয়ে। মহাআনন্দ শ্রী র। বিয়ে হয়ে গেল। নতুন বৌদি পেয়ে শ্রী খুব খুশি।

তখন বাড়ি বাড়ি টিভি ছিল না। ঠিকমতো ইলেকট্রিসিটি আসেনি সব বাড়িতে। ঐ দুএকটা বাড়িতে থাকত। শ্রী মহাভারত আর রামায়ণ দেখতে ভীষণ ভালোবাসত। দুটো বাড়ি পরে যাদের বাড়িতে টিভি ছিল সেখানে যেত টিভি। তখনকার দিনের ব্যাপারটাই আলাদা ছিল। এখনকার মতো সবকিছু হাতের মুঠোয় পেয়ে যেত না। তাই সব জিনিসের কদর বুঝতো।

সামনে শ্রীর মাধ্যমিক পরীক্ষা। কিন্তু ভাগ্যচক্রে পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি শ্রীর। সম্বন্ধ আসে শ্রীর জন্য। পুতুলের বিয়ে দেওয়া মেয়েটা আজ নিজে বিয়ের পিড়িতে বসবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। ছেলের বেশি কিছু ছিল না। থাকার মধ্যে ঐ মাটির বাড়িটা সম্বল। কিন্তু ছেলে ভাল। মেহনতি। তাই আর কেউ আপত্তি করেনি আর তখনকার দিনে মেয়ে বড়িতে থাকলে সকলের এই চিন্তায় থাকতো যে কবে বিয়ে দিয়ে পার করানো যায়। যথাসময়ে যথালগ্নে হয়ে গেল বিয়ে। এরপর চোখের জলে বিদায়ের পালা। মেয়ে এবার সবকিছু ছেড়ে নতুন জায়গায় গিয়ে সংসার করবে। এটা প্রত্যেকটা মেয়ের কাছেই এক কঠিন পরীক্ষার মতো। পরীক্ষাটা সোজা হয় তখনই যখন শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা নতুন সদস্য কে প্রাণ খুলে আপন করে নিতে পারে। শ্রীর জন্য পরীক্ষা টা অতটাও সোজা ছিল না। বিয়ে করে নতুন সংসারে পা রাখল শ্রী। শুরুর দিকে সবকিছু ভালোই চলছিল। সমস্যা কোথাও ছিল না। যেটা ছিল সেটা হল একটা অদম্য লড়াইয়ের গল্প।

একদিন ভাত বসিয়ে শ্রী অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। ফলে ভাত টা গলে যায়। শ্রীয়ের শাশুড়ি তা দেখে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়। এমনকি ভাতের থালা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে ” এটা ভাত হয়েছে??? যাও গিয়ে গরুকে দিয়ে আসো খাবার টা।”

সেদিন শ্রী ভীষণ কেঁদেছিল কিন্তু নীরবে। কাউকে বলতে পারেনি এমনকি নিজের স্বামীকে ও না। তাঁর স্বামী তখন প্রতিনিয়ত ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে সাফল্যের লড়াই লড়ে যাচ্ছে। সেই পুরো সময়টা আদর্শ স্ত্রীর মতো পাশে ছিল শ্রী। বাইরের কাজটা একা অনিকেই করতে হত সেখানে শ্রী সাহায্য করতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু কোনো চাহিদা ছিল না শ্রীর। যতটুকু অনি দিতে পেরেছিল ততটুকু নিয়ে ই খুশি ছিল। এটা চাই ওটা চাই এই বোঝাটা কোনোদিন চাপিয়ে দেয়নি। জীবনটা কষ্টের হলেও তার মধ্যেই সুখ খুঁজে নিয়েছিল শ্রী। এর মধ্যেই সুখবর আসে। শ্রী মা হতে চলেছে। সকলে ভীষণ খুশি কিন্তু ভাগ্য। এখানেও ভাগ্য শ্রীয়ের প্রতি বিরূপ। একদিন পুকুর ঘাটে বাসন মাজতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় শ্রী। নষ্ট হয়ে যায় তাঁর গর্ভজাত সেই ছোট্ট ভ্রূণ। খুব কষ্ট হয়েছিল শ্রীর। প্রথম বার মা হওয়ার আনন্দ প্রথম সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় পরিণত হয়। এখানেও সব দোষ নির্বিচারে শ্রীয়ের ঘাড়ে দেওয়া হল। শ্রীর আরও বেশি সাবধান হওয়া উচিত ছিল শুধু অপয়া আর অলক্ষীর অপবাদ ও জোটে কপালে। ভাঙা মন আর ভাঙা শরীর নিয়ে কয়েকদিন বিছানায় পড়েছিল শ্রী। কিন্তু আর কতদিন। জীবন যে কারুর জন্য থেমে থাকে না। তাঁকে যে এগোতেই হয় নিজের নিয়মে। তাই হল। আবার একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করে শ্রী। শাশুড়ির মুখ ঝামটা ততদিনে গা সওয়া হয়ে গেছে শ্রীর। তবুও মাঝেমধ্যে কারণে অকারণে চোখে জল আসে। কিন্তু কষ্টগুলো যে চিরকালই ওঁর একান্ত নিজের।

কেটে গেছে অনেকগুলো দিন, মাস, বছর। আজ শ্রী দুই সন্তানের মা। বড় ছেলে প্রতিষ্ঠিত আর ছোটো ছেলে পড়াশোনা করছে। সেই কষ্টের দিন আর নেই। অনি নিজের চেষ্টায় অনেকদিন আগেই উন্নতি করেছে। ছেলেদের সুশিক্ষিত করেছে। ভালো জীবন উপহার দিয়েছে। কোনোরকম কষ্ট পেতে দেয়নি। দেখতে দেখতে সেই ছোট্ট শ্রী হয়ে উঠেছে সুগৃহিণী। অনেক কিছু বদলেছে বদলায়নি শ্রীর জীবন। আগে শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামীর জন্য করে গেছে এখনও করে চলেছে আর তাঁর সাথে যোগ হয়েছে তাঁর দুই ছেলে। ছেলেদের একটু একটু করে বড়ো করা, মানুষ করা এর পিছনেই নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছে। নিজের স্বপ্ন নিজের ইচ্ছের কথা কখনও ভুলেও ভাবেনি। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে রান্না করেছে তবে সেটা অন্যের পছন্দের নিজের পছন্দ অপছন্দকে আগেই ভুলেছে। বাড়িতে ভাল রান্না হলে নিজের ভাগেরটুকু ও দিয়ে দিয়েছে। কেউ হয়তো কখনো খেয়াল ও করেনি। সন্তানের জ্বর হলে রাতের পর রাত জেগে সেবা করেছে কিন্তু নিজের একটু আধটু শরীর খারাপ কে কোনোদিন আমল দেয়নি। সেই নিয়ে সব কাজ করে গেছে নিঃশব্দে। পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে সঙ্গী হয়েছে শ্রী। আচ্ছা এত কিছু করে সে কি পেল বলুন তো জীবনে। সন্তানদের ইগনোরেন্স। সকলের অবহেলা।

এই গল্পে আলাদা করে কিছু বলার নেই। খুবই সাধারণ ঘটনা। প্রত্যেকটা বাড়িতেই হয়তো শ্রীর মতো একজন মা একজন বৌমা রয়েছে। আজ নতুন করে কেন এ গল্প বলছি জানেন?? আজ একটা বিশেষ দিন। তবে যার জন্য বিশেষ তার হয়তো মনেও নেই। আজ শ্রীর জন্মদিন। আর আমি শ্রীর সেই সন্তান বা কুসন্তান। যে মায়ের কথা আলাদা করে ভাবার সময় পায়না। নিজের বন্ধু বান্ধব আর নিজের জীবন নিয়ে ভীষণভাবে ব্যস্ত। একসময়ে যে মা গল্প না বললে ঘুম আসত না আজ তাঁর সাথে দুটো গল্প করার ও সময় থাকে না। কী ভাবছেন তবে আজ এত ভালবাসা এলো কী করে যে গল্প লিখতে বসলাম। মায়ের পড়ে থাকা ডায়েরি টা পড়ে। জানতাম না মায়ের ডায়েরি লেখার অভ্যাস আছে। গুটিকতক ছোট্ট লেখা, কবিতাও দেখলাম। আমার মাধ্যমিক পাশ না করা মা যার কোয়ালিফিকেশন বলতে গেলে লজ্জায় পড়তে হত সে যে এত ভাল লেখে তা ভাবতে পারিনি।ঐ ডায়েরির পাতাগুলো আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমার মার অবস্থা। ঐ ডায়েরি টাই হয়তো মায়ের প্রকৃত বন্ধু। একাকিত্বতার সময়ে সঙ্গ দিয়েছে। আজকে তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার তোলা রইল। শুভ জন্মদিন মা।
কলমে:- অরূপ বসু।

গল্পের শেষে লেখকের নামটা দেখে চমকে ওঠে শ্রীতমা। একি অরূপ লিখেছে। হ্যাঁ তো আজ আমার জন্মদিন। ভুলেই গেছিলাম। আমাকে তো সকলে শ্রী বলেই ডাকে। অরূপ আমায় নিয়ে গল্প লিখেছে। ও আমার ডায়েরিটা পড়ে নিয়েছে। কি যে করে ছেলেটা। এখনও ছোটোই রয়ে গেল।

দ্রুত পা চালিয়ে শ্রীতমা ছেলের ঘরে গেল। কিন্তু গিয়ে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। ছেলে মন দিয়ে কি যেন করছে। এখন বিরক্ত করা কি ঠিক হবে? যদি আবার রেগে যায়। আগে তো এমন কতোবার হয়েছে। এমন সময় অরূপ শ্রীতমাকে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে ” কি হল মা?? বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?? ভেতরে এস।”

অরূপ:- কিছু বললে??

শ্রীতমাকে চুপ করে থাকতে দেখে অরূপ বোঝে ব্যাপারটা। হাত ধরে মাকে পাশে বসায়।

অরূপ:- গল্পটা পড়লে?? কেমন হয়েছে??

শ্রীতমা ছলছলে চোখে বলে ওঠে “খুব ভাল হয়েছে রে বাবু। আমি তো ভাবতেই পারছি না।”

অরূপ:- আচ্ছা তোমার কি আমাদের উপর কখনও রাগ হয়না??

হালকা হাসে শ্রীতমা।

শ্রীতমা:- কি যে বলিস রাগ হবে কেন?? তোরাই তো আমার সব। তোরা খুশি থাকলেই আমি খুশি।

অরূপ:- নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বোধহয় এটাকেই বলে।

শ্রীতমা:- কিন্তু তুই কি করে জানলি আজ আমার জন্মদিন। আমি তো কাউকে কোনোদিন জানায়নি। নিজেরই মনে থাকে না।

অরূপ:- সেদিন তোমার ভোটার কার্ডের জেরক্স করাতে গিয়ে চোখ পড়ে যায়। তখনই খেয়াল করি আর কিছুদিন পরেই তোমার জন্মদিন। আর তাঁর কিছুদিন আগেই তোমার ডায়েরি টা ও পাই। আমি তো তোমার লেখা গুলো ও বিভিন্ন ছোটো ম্যাগাজিনে দিয়েছি। খুব শিগগিরই ছাপা হবে।

শ্রীতমা:- কি??? এসব কেন করতে গেলি?? আমার লেখা কি ছাপার মতো??

অরূপ:- তোমার লেখা কেমন তুমি নিজেও জানো না। আমি স্যোস্যাল মিডিয়া তে ও তোমার লেখা দিয়েছি। ভালো রেসপন্স এসেছে। সবাই খুব ভালো বলেছে। দেখবে??

শ্রীতমা:- কি মিডিয়া??? সেটা আবার কি??

অরূপ:- একটা মাধ্যম। যেখানে অনেক লোকজন তোমার লেখা পড়তে পারে।

শ্রীতমা:- তা তুই আমার ছোটোবেলা, বিয়ের পরের এতো ঘটনা কি করে জানলি??? সে সব তো ডায়েরিতে লেখা ছিল না।

অরূপ:- হুমমম সে সব জানতে হয়েছে। ঠাকুমা আর দিদার থেকে জেনেছি। ওঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোমার জীবনের ঘটনা গুলো। তোমার ফেলে আসা দিনগুলো একবার তোমায় ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।

শ্রীতমা:- খুব ভালো লেগেছে রে আমার। সত্যি। খুব খুশি হয়েছি।

অরূপ:- এটাই তো। তুমি অল্পেতে ভীষণ খুশি আর আমরা ভীষণেও অল্প খুশি হতে পারি না।

আলতো হেসে শ্রীতমা বলে “আমি যে মা রে পাগল।”

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত