ডিভোর্স পেপারটা

ডিভোর্স পেপারটা

মামুন সাহেব আজ বেশ খুশী। খুশীর কারণ উনি আজ উনার স্ত্রী আয়েশার হাত থেকে অবশেষে মুক্তি পেতে চলেছেন। ডিভোর্সটা দুজনের সম্মতিতেই হচ্ছে। মামুন সাহেব ডিভোর্স পেপারটা আয়েশার হাতে দিয়ে বাসা থেকে বেরুলেন। মুক্ত বাতাসের স্বাদ নিতে তিনি একা একাই আজ পুরো এলাকা হেঁটে বেড়াবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মামুন সাহেব আর আয়েশার দুই বছরের সংসার। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর গ্রাম ছেড়ে চলে এলেন মফস্বলে। মফস্বলে এসে মামুন সাহেব এক বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরী নিলেন। আয়েশার দায়িত্ব পড়লো ঘর সামলানোর। মামুন সাহেবের বেতন খুব বেশী না, কিন্তু তাতেও দুজনের ছোট্ট সংসার চলে যায় বেশ।

বছর দুয়েক না পেরোতেই বাধলো বিপত্তি। শুরু হলো দুজনের মতের অমিল। যত দিন যায় সংসারের খরচ বাড়ে। মামুন সাহেবের অল্প বেতনে খরচ কুলিয়ে উঠেনা। আয়েশা শিক্ষিতা মেয়ে, সংসারের স্বচ্ছলতার জন্য আয়েশা চাকরী করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়না মামুন সাহেবের। মামুন সাহেব খুবই রক্ষণশীল স্বভাবের। উনার ধারণা মেয়েদের বাইরে চাকরী তো দূরে থাক, বাড়ীর বাইরে বেরুনোই উচিত না। শুরু হয় ঝগড়া। সংসারে কোন একটা বিষয়ে মতের অমিল থাকলে বাকী সব বিষয়গুলোতেও তার প্রভাব পড়ে। মামুন সাহেবের এখন আর আয়েশার কোন কিছুই ভালো লাগেনা, সব কিছুতেই খুঁত খুঁজেন খালি। ছোটখাটো যেকোন বিষয় নিয়েই আজকাল মামুন সাহেব ঝগড়া লাগিয়ে দেন আয়েশার সাথে। আয়েশারও আত্মসম্মানবোধ বেশ। তারপর দুজনের সম্মতিতেই ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটা হলো।

মামুন সাহেব বাড়ীর বাইরে পা দিয়ে কোথায় যাবেন ভেবে পান না। হাতের বামে একটা সোজা রাস্তা আছে। সেই রাস্তা ধরে তিনি হাঁটতে থাকেন। হাঁটতে হাঁটতে হাজার চিন্তা এসে ভর করে মামুন সাহেবের মাথায়। ডিভোর্সের ব্যাপারে দোটানায় পড়ে যান তিনি। একবার ভাবেন ডিভোর্সের ব্যাপারটা ঠিকই আছে, আরেকবার ভাবেন কোথাও হয়তো কিছু একটা ভুল হচ্ছে, ভালোবাসার সংসারটা এভাবে শেষ করে দেওয়া উচিত হচ্ছেনা।

মামুন সাহেবের সামনে দিয়ে স্কুল পড়ুয়া দুইটা ছেলে মেয়ে পাশাপাশি হেঁটে যায়। তিনি তাকিয়ে থাকেন তাদের দিকে। তাকাতে তাকাতে অতীতের কিছু সুখস্মৃতি এসে তার মাথায় ভীড় জমায়। একসময় এভাবেই পাশাপাশি হেঁটে স্কুলে যেতেন তিনি আর আয়েশা। কলেজেও গিয়েছেন এভাবেই। কত আবেগ, কত স্মৃতি জমা পড়ে আছে। মামুন সাহেবের স্মৃতির পাতা দ্রুত উল্টাতে থাকে। একসময় মনের অজান্তেই মুচকি এক হাসির রেখা ফুঁটে উঠে মামুন সাহেবের ঠোঁটে। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি আবার কঠোর হয়ে উঠেন। আবেগকে প্রশ্রয় দেন না। যে মেয়ে বাইরে চাকুরী করার কথা ভাবতে পারে, এবং এই ব্যাপারে তার সাথে তর্ক করতে পারে, সেই মেয়ের সাথে সংসার করার কোন অর্থ মামুন সাহেব খুঁজে পান না।

মামুন সাহেব হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছেন। আশেপাশের চেনা জগৎটাকে তিনি যেন আজ নতুন করে দেখছেন। রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধা একটা ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছেন। ভ্যানের উপর এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। উনাদের কাছাকাছি হতেই মামুন সাহেব দাঁড়িয়ে পড়েন। বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করেন ভ্যানের উপর লোকটা কে। জবাবে বৃদ্ধা বলেন উনি তার স্বামী। বৃদ্ধ স্বামী অসুস্থ, স্ত্রী নিজেরও বয়স হয়েছে, সংসারে উনার করার কিছু নাই, কোন অবলম্বনও নাই। তাই স্বামীকে ভ্যানে বসিয়ে রাস্তার ধারে ভিক্ষা করছেন। মামুন সাহেব পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলেন। মানিব্যাগের এক পাশে ভাঁজ করা একটা একশো টাকার নোট আর আরেকটা পাঁচশ টাকার নোট পড়ে আছে। পাঁচশ টাকার নোটটা বৃদ্ধার হাতে গুঁজে দিয়ে মামুন সাহেব আবার হাঁটা ধরেন। পেছন থেকে বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা দুজনেই অবাক চোখে মামুন সাহেবের চলে যাওয়া দেখতে থাকেন।

বৃদ্ধ দম্পতির ঘটনাটা মামুন সাহবের মনে বেশ নাড়া দিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে উনি তাদের কথা ভাবতে থাকেন। কি সহজ সরল একটা দম্পতি। জীবন সায়াহ্নে এসে কোন অবলম্বন ছাড়া যেখানে নিজেরই বেঁচে থাকা দায়, সেখানে কেউ কারো হাত ছাড়েন নি। অথচ জীবনের সোনালী সময়েই উনি নিজের স্ত্রীর হাত ধরে রাখতে পারছেন না ভেবে হঠাৎ আফসোস জেগে উঠে মামুন সাহেবের মনে।

বেশ অনেকটা পথ হেঁটে এসে মামুন সাহেবের ক্লান্তি ধরে গেল। রাস্তার ধারে একটা টঙ দোকান দেখে উনি বসে পড়লেন। ক্লান্ত গলায় হাঁক ছাড়লেন, কে আছো চা দাও একটা।
একটু পর টঙ দোকানের ভেতর থেকে কথা ভেসে এলো, সাহেব নেন আপনার চা।

গলার স্বর শুনে চমকে উঠে তাকালেন মামুন সাহেব। টঙ দোকানের চা বিক্রেতা এ যে স্বয়ং একজন মেয়ে। একটা মেয়ে রাস্তার ধারে টঙ দোকানে চা বিক্রি করছে এটা মামুন সাহেবের কল্পনারও বাইরে, এই ঘটনা তার মানসিকতার সাথে যায়না। মামুন সাহেব চা নেওয়ার বদলে অবাক তাকিয়ে থাকলেন চা বিক্রেতা মহিলার দিকে। মহিলা লজ্জা পেয়ে মাথার ঘোমটাটা আরো লম্বা করে টেনে নেন মুখের উপর।

চা নিতে নিতে মামুন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার স্বামী নাই? মেয়ে হয়ে আপনি চা বিক্রি করেন কেন?”
মহিলা উত্তর দেয়, “আমার সোয়ামীর পীড়া। ডাক্তার কইছে বড় অপারেশন করা লাগবো। ম্যালা টাকা দরকার। আমাগো কোন জমিজমা নাই। আমার সোয়ামী ভালা থাকতে এই দোকানডা চালাইতো। এহন আমি চালাই। তাতে যদি কিছু পয়সা পাই তাহলে আমার সোয়ামীর চিকিৎসার কিছু ব্যবস্থা হইবো।”

মামুন সাহেব হা করে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর চা শেষ করে মানিব্যাগে অবশিষ্ট থাকা একশো টাকার নোটটা তিনি বাড়িয়ে ধরেন মহিলার দিকে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, “পুরোটা রেখে দেন আফা। আমার বেশী টাকা পয়সা নাই তাই আপনার কোন উপকার করতে পারলাম না।”

মামুন সাহেব আবার হাঁটছেন। প্রথমে বৃদ্ধ ভিক্ষুক দম্পতি আর এখন এই চা বিক্রেতা মহিলার ঘটনার সাথে নিজের জীবনের চিত্র মিলাতে গিয়ে ভাবনায় জট পাকিয়ে ফেলেন তিনি। স্বামী অসুস্থ বলে স্ত্রী নিজে দোকানে চা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন আর স্বামীর অপারেশনের টাকা জোগাড়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এই স্বামীর মতো ভাগ্যবান স্বামী কয়জন আছেন দুনিয়ায়! এমন ভালোবাসা সংসারে থাকতে অর্থ কড়ির কি দরকার আর!

হুট করে মামুন সাহেবে মাথার জট খুঁলে যায়। বৃদ্ধ ভিক্ষুক দম্পতি আর চা বিক্রেতা মাঝবয়েসী মহিলার ঘটনায় উনি ভালোবাসার নতুন সংজ্ঞা খুঁজে পান। আর নিমিষেই মেয়েদের বাইরে চাকুরী করার ব্যাপারে উনার ভুল ধারণাটাও ভেঙ্গে যায়। চা বিক্রেতা মহিলা উনার এই ভুল ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন। মহিলা চা বিক্রি না করলে তাদের সংসার একেবারেই অচল, আর এদিকে অসুস্থ স্বামীরও চিকিৎসা হবেনা। মামুন সাহেব বুঝতে পারেন মেয়েদের বাইরে চাকুরী করার অবশ্যই দরকার আছে, এবং এটা দোষের কিছু না।

মামুন সাহেবের ভুল ভাঙ্গলো। দেরীতে হলেও উনি বুঝতে পারলেন উনাদের ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। তিনি হঠাৎ করে অস্থিরতায় ভুগতে থাকেন। আয়েশা কি ডিভোর্স পেপারে সই করে দিয়েছে? মামুন সাহেব হঠাৎ উনার হাঁটার দিক পরিবর্তন করে দ্রুত হাঁটতে থাকেন উনার স্কুলের দিকে। স্কুলে ঢুকার মিনিট দুয়েক পর উনি একটা কাগজ হাতে নিয়ে বেরুলেন। তারপর দ্রুত হাঁটা ধরলেন বাসার দিকে।

দুরু দুরু বুকে মামুন সাহেব বাসায় ঢুকলেন। আয়েশা যদি ডিভোর্স পেপারে একবার সই করে ফেলে তো সব শেষ। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করারও সুযোগ পাবেন না তিনি। বাসায় ঢুকে মামুন সাহেব এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে আয়েশাকে খুঁজতে থাকেন। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলেন।

আয়েশা মাটির চুলার পাশে বসে রান্না করছিল। ধীর পায়ে মামুন সাহেব আয়েশার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। কোমল স্বরে ডাকলেন, “আয়েশা!” আয়েশা মুখ তুলে তাকালো। কিছু বললোনা। চুলার পাশে বসে রান্না করাতে তার শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার।  মামুন সাহেব আবার বললেন, “আয়েশা, ডিভোর্স পেপারটা কই?”

আয়েশা লাজুক এক মুচকি হাসলো। এবারো কিছু বললোনা সে। মামুন সাহেবের মনের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠে হঠাৎ। আয়েশা কিছু বলছেনা কেন? সে কি ডিভোর্স পেপারে সই করে ফেলেছে? মামুন সাহেব কাঁপাকাঁপা গলায় আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ডিভোর্স পেপারটা কই আয়েশা?”

মাটির চুলার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আয়েশা বললো, “রান্না করতে চুলায় আগুন ধরানোর জন্য হাতের কাছে কিছু পাচ্ছিলাম না। তাই ওই ডিভোর্স পেপারটা দিয়ে আমি রান্নার আগুন ধরিয়েছি!”

আয়েশার কথা শুনে বড় এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন মামুন সাহেব। প্রশান্তির এক প্রসারিত হাসি ছড়িয়ে পড়লো তার মুখ জুড়ে। তারপর নিজের হাতে থাকা কাগজটা আয়েশার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “আমাদের স্কুলে নতুন শিক্ষিকা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তোমার জন্য একটা আবেদন ফর্ম নিয়ে এলাম। দেখো এটাও আবার চুলার জ্বালানি বানিয়ে ফেলো না!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত