অামার ছোট বোন টা যেদিন পালিয়ে গেলো অাব্বার সামনে দাঁড়াতে ভয় হচ্ছিলো।অাব্বা রাগী মানুষ অামরা ভাই-বোনেরা যতো টা পারতাম তার কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। অাব্বা বসে নুডুলস খাচ্ছে। এমন একটা মুহূর্তে অাব্বার স্বাভাবিক অাচরন, অস্বাভাবিক কিছুর সংকেত দিচ্ছে বুঝতে পারছি। নিজেকে যতেটা পারি সংকুচিত করে, কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই অাব্বা অামাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে বাচ্চা ছেলেদের মতো কাঁদতে লাগলেন। জগতের তীব্র যন্ত্রণার একটা বড় যন্ত্রনা বাবার চোখের জল।কারন বাবারা কাঁদতে জানে না।
অামার প্রচন্ড গলাব্যাথা করছে,কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অাব্বা নামক রাগী মানুষ টা বাচ্চার মতো হয়ে গেলেন সেদিনের পর থেকে। মানুষের পরিবর্তনের জন্য অনকগুলো ঘটনার প্রয়োজন হয়না,একটা ঘটনাই যথেষ্ট। অামি অামার মেঝো ভাই কে নিয়ে একটা মেসে থাকি।প্রাইভেট পড়াই অার চাকরি খুঁজি দুই ভাই। ধীরা কে যখন পড়াতে যাই মেয়ে টা খুব লজ্জা পায় অামাকে। প্রেমের লক্ষণ কি না বুঝতে পারি না। মাথায় সব সময় ঘুমটা দিয়ে রাখে,নিজেই রান্না ঘর থেকে চা এগিয়ে নিয়ে অাসে। গ্রাম্য বঁধূর মতো ঘোমটা টা সামনের দিকে অারেকটু টেনে চোখ নিচে রেখে খুব যত্ন করে টেবিলে চায়ের কাপ টা রাখে। বড় অাপা সকাল ছয় টায় কল দিলো। ভয়ে ভয়ে ফোন ধরলাম, কারন মৃত্যুর সংবাদ ছাড়া এতো সকালে কোন কল কখনো পাইনি।
রাকিব যে ছাত্রী কে প্রাইভেট পড়াতো সেই মেয়ে বাড়িতে এসে হাজির। মেয়ের কথা অাগে কাবিন করে রেখে তারপর যেনো ট্রেনিংয়ে যায়।অামারা তিন ভাইয়ের মাঝে সবার ছোট ভাই রাকিব,সরকারি চাকরি হয়েছে তার। রাকিব ও এক পায়ে দাঁড়িয়ে অাছে তাকে কোন কিছুই বুঝানো যাচ্ছে না। দাদী অাপার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে বললো “ভাই হে তো দেওয়ানায় বেবছ । ” বেবছ মানে অচেতন,শুদ্ধ ভাবে বললে “দেওয়ানায় অচেতন।” ছোট ভাই রকিবের বিয়ে মেনে নেয়া হলো।বাড়ি ভর্তি মানুষ, অাব্বা রান্না ঘরে ঘুরঘুর করে।বাচ্চাদের মতো অাম্মার পিছনে পিছনে হাঁটে।অথচ যে অাম্মা অাব্বার ভয়ে কাঁপতো। “পুরুষ মানুষের জীবন টা বোধহয় এমনই,একটা সময় লাগামহীন ঘোড়ার মতো দিকবিদিক ছুটে,বয়সের শেষদিকে গৃহপালিত প্রাণী হয়ে যায়।”
বন্ধুরা লজ্জা দেয় বিয়ের জন্য,অন্তত একটা প্রেমিকার কথা ও তাদের জানাই। অামি ধীরা কে অল্প অল্প পছন্দ করি কিন্তু জানাতে পারি না কাউ কে,অামার গলায় শিকল বাঁধা দায়বদ্ধতার কিংবা দায়িত্বের।অামি পরিবারে বড় সন্তান অামাকে এইসব ইন্টুমিন্টু করা মানায় না। প্রেম-ভালোবাসা কে একেক জন একএক নামে ডাকতে পছন্দ করে।বড় দুলাভাই ইন্টুমিন্টু নামে ডাকে। দুলাভাইয়ের মতে, যার হাতে মোবাইল অাছে তার একটা হলেও ইন্টুমিন্টু অাছে। কিন্তু অামি অধমের নাই। ধীরা অামাকে দেখে লজ্জা পাওয়ার কারন টা বুঝতে পারলাম।ধীরার মা-বাবা একটা কাগজ অামার সামনে দিয়ে দাঁড়িয়ে অাছেন।মেঝো ভাই সাদিক অার ধীরার ছবি ওরা কোর্টম্যারেজ করেছে।অামাকে চাপ দিচ্ছে অামার পরিবার নিয়ে এসে ছোট্ট করে হলেও অানুষ্ঠানিকতা শেষ করার।
অামার ছাত্রীর সাতে ইন্টুমিন্টু করছে অামার ভাই অামি বুঝতেই পারলাম না। ধীরা অামাকে ভাশুর ভেবে লজ্জা পেতো ভেবেই অামার লজ্জা হচ্ছে। বাড়িতে কেউ এই ব্যাপার টা মানতে রাজি হচ্ছে না। রাকিব চাকরি করে তাই মেনে নিয়েছে।কিন্তু সাদিক তো বেকার।তার উপর অামি ভাইদের মাঝে বড়, সমাজ বলে একটা কথা অাছে। ধীরা কে পড়াতে যাই না।নতুন টিউশনি নেবার ইচ্ছে নেই, না নিয়েও উপায় নেই।অাব্বা -অাম্মার খরচ তো চালাতেই হবে যে করেই হোক।তার মাঝে ছোট দুইভাই বিয়ে করেছে তাদের বউদের কিছুদিতে হবে। দুই বোন কে এটা সেটা দেয়া ও অামার দায়িত্ব থেকে বাদ দিতে পারি না। ছোট বোন কে অামরা মেনে নিয়েছি।অবশ্য মেনে না নিয়ে উপায় নেই তার জামাই তাকে নানান ভাবে অত্যাচার করে।
হৃদি নামে ক্লাস ফাইভে পড়ে একটা বাচ্চা মেয়ে কে পড়াই।অধিকাংশ সময় মাগরিবের নামাজ তাদের বাসাতে পড়তে হয়। তমা হৃদির বড় বোন। অামাকে দেখলে খুব লজ্জা পায়।মেয়ে গুলো অামাকে দেখলে লজ্জা পায় কেন বুঝতে পারি না। তাদের লজ্জা চোখে অথচ লজ্জার ধরন ভিন্ন।ধীরার চোখে ছিলো শ্রদ্ধার লজ্জা,যা অামি ভালোবাসা ভাবতাম। তমার চোখে ও লজ্জা এটা প্রেম ভেবে ভুল করতে চাই না।কারন চোখের ভাষা পড়ার যোগ্যতা অামার নেই। তবে তমার জন্য অামার বুকে চিনচিন যন্ত্রনা হয়,রাতে ঘুমোতে গেলে তমার মুখটা ভেসে উঠে। মাঝে মাঝে অবাধ্য হতে ইচ্ছে করে।ইচ্ছে করে তমার চুল ছোঁয়ে দেখি,হাতে হাত রাখি। একদিন তমার বাবা অামকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন,অামি রাজি থাকেল যেনো অামার পরিবার নিয়ে এসে কথা বলি।
মেঝো ভাই সাদিকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে সবাই।অবশেষে অাব্বা-অাম্মা অত্মীয় স্বজন নিয়ে দুই মাইক্রো বাস ভাড়া করে ধীরা কে বউ করে তুলে নিতে অাসেন। বড় দুলাভাই কে তমার ব্যাপার টা বলেছিলাম,তাই সবাই ঠিক করলো এক ঢিলে দুই পাখি মারবে।সাদিকের অানুষ্ঠানিকতা শেষ করে সবাই মিলেমিশে তমাদের বাড়িতে হুটকরে চলে যায় সেদিন সন্ধ্যায়।তমার মা-বাবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরলো,সাথে অামি ও।
রাতে মেসে গেলাম যে রুম টায় অামি অার সাদিক থাকতা তা একদম ফাঁকা লাগছে।তাই ঘর থেক বেড়িয়ে অজানা গন্তব্যে হাঁটাহাঁটি করছি।মনেহচ্ছে বুকে বিশাল একটা পাথর বসে অাছে।প্যান্টের বাঁ দিকের পকেটে অামার দশ হাজার টাকার এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন টা রখি,কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না।দশ হাজার টাকা অামার কাছে কোটি টাকার চেয়েও বেশি।ডান পকেট থাকে পাঁচশো টাকা দিয়ে কেনা বাটন মোবাইল।মোবাইলটা বের করে বাড়িতে কল দিলাম।
সবাই ঠিকঠাক মতো পৌঁছেছে কিনা,মোবাইল টা হারিয়ে ফেলেছি জানানো প্রয়োজন।ফোন রিসিভ করে বড় বোন, ছোট বোন, অাম্মা,চাচা,মামা যার যা মনেচায় কথা শুনালো অামাকে।শুধু অাব্বা কিছু বলেনি।তমা কে তাদের পছন্দ হয়নি,তমার বাবা বলেছে অামাকে ঘর জামাই থাকতে।তাদের কথায় বুঝতে পারলাম সবার উপর পুষে রাখা দুঃখ অামার উপর ঝাড়ছে। অামার কথা শুনার কারো প্রয়োজন হয়নি কিংবা মনেকরেনি।তমারা দুই বোন, ভাই নেই সেই হিসেবে তমার বাবা কথাটা বলেছে।ঘরজামাই শব্দ টা অামার পরিবারের মানুষেরা নিজের মনের মাধুরি দিয়ে বানিয়ে নিয়েছে।
অামি কাওকে কিছু বলতে পারি না,অামার কাঁধে হাজারো দায়িত্ব।পকেটে টাকা নেই তাই ঠিকঠাক পালন করতে না পারলেও অবহেলা করতে পারিনা। নিজের অাবেগ কে কখনো পশ্রয় দিতে পারিনি। অামার ইচ্ছে করছে সাদিকের মতো অামিও কোর্ট ম্যারেজ করে ফেলি।বড় দুলাভাই কল দিয়ে বললো,” অাতিক তোমার কি মন খারাপ?”দুলাভাই কে জানালাম, অামার মোবাইলটা চুরি হয়ে গেছে।দুলাভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “অামরা বুঝে ঠেকেছি, যদি কম বুঝতাম তবে অন্যকে ঠেকিয়ে রাখতে পারতাম।” দুলাভাই ও তার ভাই-বোনদের মধ্যে বড়।তাকে সব সময় অামার মতো বোকা কিসিমের মানুষ মনে হতো, অাজ তা মনে হচ্ছ না।
“জীবনের প্রথম হালকা পাতলা ইন্টুমিন্টু হয়ে ছিলো ধীরার নামের উপর। অাজ সে তোমার ভায়ের বউ,মোবাইল টা ও অাজ হারিয়ে ফেললা, একটা সিরিয়াস ইন্টুমিন্টু হইছিলো তাও অাজ রিজেক্ট হয়ে গেলো।”
ধীরার ব্যাপার টা কাউ কে কখনো বলিনি,দুলাভাইয়ে চাপাচাপিতে একবার মুখ ফসকে বলেছিলাম “ধীরা নাম টা কেমন লাগে?”এটা সে মনেরেখেছে,যে কোন দূর্ঘটনা একটা সাক্ষী রেখে যাবেই।
কাঁদতেছো মনেহয় অাতিক? অামি চুপ করে অাছি। মন খারাপ করো না,তোমার জায়গা টায় তুমি পূর্ন,তাই সবার কষ্ট গুলো তোমার কাছে অাশ্রয় চায়। তোমার জন্য অামি তমা কে এনে দেবো একটু অপেক্ষা করো শালা।দুলাভাই হাহাহা করে হাসছে। অাকাশের বিশালতায় একা চাঁদ নিজের পূর্ণতা নিয়ে অামার দিকে তাকিয়ে অাছে। রাত কয়টা বাজে ধারনা করতে পারছিনা। ইচ্ছে করলে মোবাইলে সময় দেখতে পারি কিন্তু বেশ বিরক্ত লাগছে।অামি এখন কাঁদবো,বেশ অায়োজন করে কাঁদবো।
ঘাসের উপর চিত হয়ে শুয়ে পরলাম দিগন্তের বিশালতায়। নিজে কে চাঁদের মতো পূর্ণ মনেহচ্ছে। প্রচন্ড গলা ব্যাথা করছে অামার।অাব্বার মতো করে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম।কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারলে কান্নার অায়োজন টা সুন্দর একটা পূর্ণতা পেতো। তবে কাঁদতে অামার খুব ভালোলাগছে।