আর কোনো ভয় নেই

আর কোনো ভয় নেই

রিমি প্রথম রোজা রেখে অনেকটাই কাহিল। ইফতার করে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে। ভেতরে টেনশন একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে। তার স্বামীর নাম্বারে কল যাচ্ছে না। সেই বিকেল থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভেবেছিলো ইফতারের আগেই সে অফিস থেকে চলে আসবে কিন্তু আসার কোনো খবর ই নেই। হয়তো মোবাইলের চার্জ শেষ তাই কল যাচ্ছে না, সম্ভবত রাস্তায় অনেএএক জ্যামে আটকা পড়েছে। তবুও মনটাকে এত সহজে মানিয়ে নিতে পারছে না। আজ বেশি লেট করার কথা না। বিয়ের পর এবারই তাদের প্রথম রোজা, একসাথে বসে ইফতার করবে সেটাও আর হলো না।

হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। কে?? জিজ্ঞেস করতেই দরজার ওপাশ থেকে ভারগম্ভীর কন্ঠে ভেসে আসে….
— আসসালামু আলাইকুম আম্মাজান! রোজার সমস্ত বরকত আপনার উপর বর্ষিত হউক!
— ওয়ালাইকুমস সালাম, কে?
— আম্মাজান আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি মহান আল্লাহ্’র একজন অতি সাধারণ গোলাম।
— আপনি কাকে চান?
— মা… আমি আপনার দুয়ারেই আইছি মা, মাগো কিছু খাবার দিবেন? পানি দিয়া রোজা ভাঙছি, পেটে বেদনা শুরু হইছে, কয়টা খাবার দিবান?
রিমি দরজার ফুটো দিয়ে ভালো করে দেখে নিলো, চাদর মুরি দেওয়া মধ্যবয়স্ক একজন ফকির।
— বাসায় কেউ নাই, আপনি পরে আসেন।
— মা গো, খুব কষ্টে আছি, কিছু খাওয়ান দেন মা, অনেক দুয়া করি মা।
রিমির মায়া ধরে যায়, টেবিলে অনেক খাবার পড়ে আছে, লোকটিকে খাবার দিতে সমস্যা নেই। রিমি খাবার পলিথিনে তুলে নেয় তাকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিন্তু তার স্বামীর বলা কথাটা মনে পড়ে যায়। তার স্বামী বার বার প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে বলে যায়, পাশের বাসার ভাবী ছাড়া অন্য যে কেউ ই হোক দরজা কখনওই খুলবে না। এদিকে লোকটি রোজাদার ব্যক্তি। সে কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে ব্যাগ থেকে ২০ টাকা বের করে দরজার নিজ দিয়ে টাকাটা দিয়ে দেয় আর বলে দেয়, অন্যদিন আইসেন, আপাতত টাকা দিয়ে কিছু কিনে খান।

— মা.. রে,,, শরীর খুব দুর্বল,,, কয়টা খাবার দিলে পেটের বেদনাটা কমতো
— না, মাফ করেন, আপনি অন্য বাসায় যান, আমি পারবো না।
রিমি খাবার বেড়েও মুহূর্তেই নিজেকে ঘুরিয়ে নেয়।
লোকটি আর কথা না বাড়িয়ে উপর তালায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়।
দেখতে দেখতে রাত ৯টা বাজে!!

রিমি তার হাসব্যান্ডের অপেক্ষায় বসে আছে। কিছুই ভালো লাগছেনা, ফোনের কি হলো.. কল কেন যাচ্ছেনা, মন অনেকটাই অস্থির হয়ে উঠেছে। এদিকে এলাকায় মনেহয় কোনো গণ্ডগোল হয়েছে, অনেক হৈচৈ শব্দ.. পুলিশের গাড়ি তাদের গোলীতে ঘুরাফেরা করছে।

এসব দেখে রিমি রিতিমত ঘাবড়ে যায়। অনেক কষ্টে স্বামীর অফিসের এক কলিগের নাম্বার খুঁজে বের করে। কথা বলে জানতে পায় তার হাসব্যান্ড আজকে অফিসে যায়নি!!

মাথায় আকাশ ফেটে পড়ে। এবার আর চোখের পানি কোনো সান্ত্বনা মানে না… টপ টপ করে ঝরে পড়তে থাকে। তাহলে ওর কি কিছু হয়েছে! আশেপাশের পরিবেশ আর স্বামীর নিখোঁজ বার্তা তার হার্টবিট বাড়িয়ে দেয়।

ছেলেটির বাবা মা ভাই বোন কেউ নেই, আপন বলতে শুধু রিমিই তার একমাত্র আপনজন। দু’মাস আগে পারিবারিক ভাবে তাদের বিয়েটা হয়। চাকুরীর সুবাদে শহরে এসে বাসা ভারা করে নতুন সংসার শুরু করে তারা।
রিমি এখন কি করবে কাকে বলবে কোথায় যাবে কিচ্ছু মাথায় আসছে না।

এক পর্যায়ে রিমিদের বাসায় পুলিশ নক করে। সে দরজা না খুলে বার বার বলে যায় আমার হাসব্যান্ড আমাকে দরজা খুলতে বারন করেছে আমি দরজা খুলবো না… আপনি যেই হন না কেন। ম্যাডাম আমরা পুলিশের লোক, আপনার স্বামীর ব্যাপারেই এসেছি।

না আমি খুলবো না! নিষেধ আছে। আগে আমার স্বামী আসুক।
এইবার দরজায় পাশেরবাসার ভাবীও এসে যোগদিলো, রিমি… দরজাটা খুলো, কোনো ভয় নেই, আমরা আছি এখানে। দরজার ফুটো দিয়ে ভাবীকে দেখে আশ্বাস পেলো। এবার সে বের হয়ে আসে।
সবাই তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে “তুমি ঠিক আছো? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
না, ঠিক আছি, কিন্তু কি হয়েছে ভাবী।
পুলিশ একটি মোবাইল বের করে রিমিকে জিজ্ঞেস করে
— এটা কি আপনাদের মোবাইল?
— আরে হ্যা..! আমার হাসব্যান্ডের…

!! সে কই???
— চিন্তাকরবেন না, উদ্ধার করা হয়েছে তাকে, কিছু ফরমালিটির জন্য থানায় আছে, সার্জেন্টকে পাঠিয়েছি তাকে নিয়ে শীঘ্রই চলে আসবে ।
— মানে কি? কি হয়েছিলো?? ও ঠিক আছে??
জী… এখন আর টেনশনের কিছু নেই, উনি ঠিক আছেন। পুলিশ তেমন কোনো বিস্তারিত না বলে মোবাইল ফেরত দিয়ে তারা নিচে চলে গেল।

ভাবী বাসায় ড্রয়িংরুমে বসে রিমিকে সবকিছু খুলে বলে। আজ সন্ধ্যারপর উপর তলায় দুইটা ফ্ল্যাটে ডাকাতি হয়েছে!!
রিমি চমকে উঠে! বলেন কি!

হ্যা… ফকিরের ছদ্মবেশে এসে এসব ঘটিয়েছে। সবাই দামী দামী মালামাল নিয়ে ভেগে গেলেও একজন ধরাপড়ে যায়। তাকে এলাকাবাসী ধরে পিটুনি দেয়, পুলিশ ডেকে আনে। তার কাছ থেকেই তোমাদের মোবাইলটা পাওয়া যায়। এরপর গড়গড়িয়ে সব কথা বেড়িয়ে আসে। তারা আজ সকালে তোমার হ্যাসবেন্ডকে ফলো করে। এরপর বিকেলের দিকে বাসায় ফিরার পথে তারকাছ থেকে ছিন্তাই করে সবকিছু নিয়ে গিয়ে.. তাকে অজ্ঞান করে রাস্তায় ফেলে রাখে। এরপর তাদের প্ল্যান ছিলো.. তোমাদের বাসায় ডাকাতি করার! কারণ আগে থেকেই তারা সব ফলো করে এসেছিলো। তুমি দরজা না খোলায় তারা এই ফ্ল্যাটে আর ঢুকতে পারেনি। সুযোগ বুঝে অন্যফ্ল্যাটে হামলা চালিয়ে বড়সড় লুট করে নিয়ে যায়।

রিমি পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়! এগুলা কি বলছে! অনেক কষ্টে আবেগ সামলে রেখে বলে উঠে…
— পুলিশকে ফোনদিয়ে ওর সাথে একটু কথা বলার ব্যবস্থা করে দিবেন? ভাবী ওর কিছু হয় নি তো?
ভাবী মুচকি হেসে বলে উঠে কিচ্ছু হয়নি, বিশ্বাস না হলে নিজ চোখেই দেখে নাও.. এই বলে পিছনের দিকে ইশারা দেয়।
রিমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তার স্বামী সুস্থ দেহে এইমাত্র দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে!! রিমির মনে হচ্ছিলো কেউ যেন ফ্রিজ থেকে একবালতি বরফ এনে তার উপর ঢেলে দিলো! এতটা ঠান্ডা অনুভূতি সে আগে কখনওই পায়নি। আত্মাটা শীতল হয়ে যায়। চোখ ভারী হয়ে আসে। ভাবী দু এক লাইন কথা বলে দ্রুত বিদায় নিয়ে চলে যায়। ছেলেটা দরজাটা আটকে দিতেই রিমি তাকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়! মুখে কোনো কথা নেই… কোনো কথাই কারো মুখ দিয়ে বেরহচ্ছে না, কান্নাগুলো কথা বলার কোনো সুযোগ ই দিচ্ছে না। অনেকক্ষনপর দুজনের মুখে কথা ফুটলো। এরপর কার সাথে কি কি হয়েছে আজ সব কিছু দুজন খুলে বললো।
সবকিছু শুনে ছেলেটা বলে উঠে..
আমার বিশ্বাস ছিলো আল্লাহ্ তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিবে না। আমি জানতাম বাসায় ফিরে ঠিক এইভাবে তোমাকে নিরাপদ দেখতে পাবো।

জানো রিমি.. আমি প্রতিটাদিন অফিসে যাওয়ার সময় আল্লাহ্ কাছে বলে যাই “আল্লাহ্ আপনি ছাড়া আমার রিমিকে দেখে রাখার মতন বাড়িতে আর কেউ নাই.. প্লিজ আল্লাহ্ তাকে আপনি নিরাপদে রাখেন”

আর যখন এসে দেখতে পাই তোমার মিষ্টিমাখা হাসিমুখ… সাথেসাথে শুকরিয়ার সাথে “আলহামদুলিল্লাহ্” বলে আল্লাহ্ কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। আল্লাহ্ মনে হয় আমাকে আজ সেই প্রতিদানটাই দিয়েছেন। যেখানে ছিনতাই করা হলো আমার মোবাইল, অজ্ঞান করা হলো আমাকে, আমার বাসায় হামলার প্ল্যান করা হলো, আমরাই এই এলাকার নতুন আর অনেকটা জনবল বিহীন বাসিন্দা,, আর দেখো আল্লাহ্ কিভাবে আমাদের বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন! দরজাটা খুলতে নিয়েও কিভাবে তোমার মনটা ঘুরে গেল! আমিও অক্ষত বেচে ফিরলাম.. তুমিও সুরক্ষিত অথচ আমাদের পাসের বাসা গুলো থেকে সর্বস্ব লুটপাট করে নিয়ে গেলো! আমার সামান্য একটা মোবাইল সেটাও আবার আমার হাতে ফিরে এলো!

তুমি সবসময় শুধু বলতে আমরা একা, এই ভয় সেই ভয়.. না না ভয়ভীতি..
শুনো রিমি.. আমরা একা না, আল্লাহ্ আমাদের সাথেই আছেন। শুধু মন থেকে ভরসাটা রাখো, আল্লাহ্ সব সমই আমাদের পাশে আছেন এবং থাকবেন। আজ থেকে আর কোনো ভয় নেই, নিরাপত্তার মালিক একমাত্র আল্লাহ্।
রিমি তার স্বামীর বুকে মাথা রেখে.. কথাগুলো চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনে যায়।
“ভরসা”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত