রবির আলোয়

রবির আলোয়

শহরতলির এই দিকটা এখনো পুরোপুরি শহর হয়ে ওঠেনি, অনেকটা গ্রাম্য ভাব বজায় রেখেছে। শহরের সমস্ত সুবিধা অথচ গ্রাম্য পরিবেশ আছে দেখে অবসরপ্রাপ্ত অরুণবাবু বাড়িটা কিনেছিলেন। সবে দুবছর হল এসেছেন। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে অসুবিধা তো হয়ই-নি, বরং বেশ ভালোই আছেন। মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, ছেলে মুম্বাই’য়ে চাকরি করছে। এই গাছ-গাছালি ঘেরা বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী দুজনের ভালোই কেটে যাচ্ছে। আজ সকাল বেলা অরুণবাবু দ্বিতীয় বারের চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে সবে খবরের কাগজটা খুলেছেন, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। এ সময় কে আসতে পারে?

গিন্নি গেছে মেয়ের বাড়ি, এখন তিন-চারদিন আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজের মাসি কাজ করে চলে গেছে। পেপার, দুধ সব চলে এসেছে; খাবারের জন্য হোম ডেলিভারি অর্ডার দেওয়া আছে, তারও আসতে ঢের দেরি। তাহলে সকাল থেকে যাদের কথা ভাবছিলেন তারাই কি এসে পড়ল? ভাবতে ভাবতে দরজাটা খুললেন। যা ভেবেছিলেন, ঠিক তাই! দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার-ই চার-পাঁচ জন ছেলে। ছেলে না বলে যুবক বলাই ভালো। পাড়ার ক্লাবে অনবরত দেখা যায় এদের। অরুণবাবু পোড় খাওয়া লোক, সন্দিগ্ধ হয়ে বললেন- ‘কি চাই?’

এক হাতে পেন, অপর হাতে কাগজের বান্ডিল ধরা সুবেশ ছেলেটি এগিয়ে এল। বোঝা-ই যাচ্ছে ওগুলি চাঁদার স্লিপ। তিন আঙুলে লেখার ভঙ্গিতে পেনটা ধরে হাত নেড়ে নেড়ে বলল– ‘জেঠু, আজ পঁচিশে বৈশাখ, প্রতি বছরের মতো এবছর’ও রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করব। এই অনুষ্ঠানে গেস্ট হিসাবে আপনাকে আমরা পেতে চাই। বিকেল পাঁচটায় অবশ্যই আসবেন।’

অরুণবাবু হাসলেন- ‘গেস্ট না হাতি! তার চেয়ে সোজাসুজি বলো এবছর চাঁদার পরিমানটা বেশি লাগবে। সে আমি বুঝতে পেরেছি সকাল থেকে তারস্বরে মাইক বাজানো দেখেই। কিন্তু আমার সোজা উত্তর- এবছর একটা টাকাও আমি দেবো না।’

ছেলেগুলো খানিকটা মুষড়ে পড়ল, একসঙ্গে অনুযোগের সুরে গুঞ্জন করে উঠলো- ‘কেন? কেন? আমরা কি কোনো অন্যায় করে ফেলেছি?’ স্লিপ ধরা ছেলেটি সবাইকে থামিয়ে বলল- ‘গতবছর আমরা যা চাইব আশা করেছিলাম, তার থেকে বেশি দিয়ে আমাদের উৎসাহ দিলেন; যাতে ঘটা করে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করতে পারি! আর এবছর কি এমন ঘটল যে, একেবারে সোজাসুজি বলে দিচ্ছেন এক টাকাও দেবো না?

অরুণবাবুর মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল- ‘এবছর এখনো আমি চাঁদাটাই দিই নি, তাই এবছরের ব্যাপারে কিছু বলছি না। কিন্তু গত বছর যা ঘটেছে, তাতে আমি প্রচন্ড অসন্তুষ্ট। যদি জানতাম রবীন্দ্র জয়ন্তীর নামে জগাখিচুড়ি একটা অনুষ্ঠান করবে তোমরা, তাহলে গত বছরও একটা টাকা দিতাম না!’

-‘কেন, আমরা তো সব নিয়ম মাফিক করে ছিলাম। মাল্যদান থেকে শুরু করে বিচিত্রা অনুষ্ঠান। এমন সুন্দর একটা অনুষ্ঠানকে জগাখিচুড়ি বলছেন?’

অরুণবাবু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলেন- ‘তোমাদের সঙ্গে কথা বলা-ই বেকার!’ তারপর চোয়াল শক্ত করে বললেন- ‘গতবছর রবীন্দ্র সংগীতের নামে যে গানগুলো বাজালে, তার একটাও কি রবীন্দ্র সঙ্গীত ছিল? তারপর বিচিত্রা অনুষ্ঠানের নামে যা হল- তা রবীন্দ্র জয়ন্তীর সঙ্গে কিভাবে খাপ খায় আমার মাথায় আজও ঢুকেনি। এবছর’ও সকাল থেকে তারস্বরে যা বাজছে, তাকে আমার রবীন্দ্র সঙ্গীত বলতে আপত্তি আছে। যাইহোক, তোমরা আসতে পারো।’ বলেই অরুণবাবু দরজা লাগাতে উদ্যত হলেন। পিছন থেকে একটা ছেলে বলে উঠল- ‘কাকু, একটা কথা বলব; আপনার সঙ্গে আমিও যে সম্পূর্ণ অসহমত, তা নয়। তবে যুগের সঙ্গে তাল মেলানো বলেও তো একটা কথা আছে! পুরোনো দিনের রবীন্দ্র সঙ্গীত আমারও শুনতে ভালো লাগে, তবে কিনা সেই রবীন্দ্র সঙ্গীতকে একটু আধুনিক ধাঁচে ঢেলে যদি বেশি সংখ্যক লোকের শুনতি ভালো লাগে, তাতে ক্ষতি কি?’

অরুণবাবুর মুখমণ্ডলে সপ্রতিভ ভাব ফুটে উঠল। ছেলেটিকে চেনেন অরুণবাবু। ছেলেটির নাম- তপন, ফিজিক্সে অনার্স করে কিছুদিন চাকরির চেষ্টা করল। এখন টিউশনি পড়িয়ে আর ক্লাবে আড্ডা দিয়ে সময় পার করছে। অরুণবাবু বললেন- ‘তোমার সঙ্গে এ নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে মনে হচ্ছে। যদি তোমাদের হাতে সময় থাকে, ভিতরে এসো।’ বলেই দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে অরুণবাবু সরে দাঁড়ালেন।

তপন এগিয়ে গেলে, বাকিরা খানিকটা ইতস্তত করে তারাও ঢুকে পড়ল। ড্রয়িং রুমের বড় সোফাটা দেখিয়ে বসতে বলে, অরুণবাবু নিজে সিঙ্গেল সোফাতে বসলেন। ছেলেগুলি ঠাসাঠাসি করে বসল। অরুণবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন- ‘তোমার নাম তো তপন? তোমার নামের সঙ্গে আমার নামের মিল আছে। এখন দেখা যাক মতের মিল কতটা আছে! তুমি কি বলছিলে; রবীন্দ্র সঙ্গীতকে আধুনিক ধাঁচে ঢালার কথা? তোমার কি মনে হয় রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট আধুনিক নন?’

তপন আমতা আমতা করে বলল- ‘না, তা আমি বলতে চাইনি। আমি বলতে চেয়েছি- এতদিন রবীন্দ্রনাথের গান যে ভাবে গাওয়া হতো তা মুষ্টিমেয় কিছু লোক শুনতো। সেই গানগুলিকেই একটু আধুনিক ধাঁচে ঢেলে যদি সকল শ্রেণীর লোক শুনতে পারে সেটা তো একদিক দিয়ে ভালোই।’

অরুণবাবু বললেন- ‘প্রথমত- সকল শ্রেণীর মধ্যে আমিও পড়ি, আমার শুনতে মোটেই ভালো লাগে না। আমার মতো অনেকেই আছেন, যাঁদের গাত্রদাহের কারণ এই তথাকথিত আধুনিক গানগুলি। আচ্ছা, একটু ভেবে বলো তো; আমাদের পাড়ায় কতজন এমন লোক বাস করেন, যাঁরা ইংরেজি বোঝেন কিন্তু বাংলা মেটেই বোঝেন না?’
তপন বলল- ‘একজনও না।’

অরুণবাবু হাসলেন, দূর থেকে ভেসে আসা গানের শব্দ নির্দেশ করে বললেন- ‘এখন যে গানটা বাজছে, তা তোমরাও নিশ্চয় শুনতে পাচ্ছো? আমি যদি খুব ভুল না করে থাকি- কবিগুরুর লেখা “আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী” গানের থেকে কথা থেকে বেশ কিছু শব্দ নেওয়া হয়েছে। গানটিকে ওইরকম ইংরেজি-বাংলা জগাখিচুড়ি ভাষায় গাইবার কি দরকার? আর তোমাদের বাজাবার-ই কি দরকার? গানের মধ্যে গায়ক-গায়িকা একবারও ‘বিদেশিনী’ শব্দটি উচ্চারণ করছেন না! ওনাদের কি ‘বিদেশিনী’ শব্দটা উচ্চারণ হয় না? আর এত বাদ্যযন্ত্র বাজাবার-ই কি দরকার? বাদ্যযন্ত্রের শব্দে গানের কথাগুলোই তো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে! আজ সকাল থেকে যতগুলো গান তোমরা বাজালে, তার একটাও কি রবীন্দ্র সঙ্গীত ছিল?’

সুবেশ ছেলেটি বলল- ‘জেঠু, এগুলো হল রক্ মিউজিক। আমরা হলাম ইয়ং জেনারেশন। গানের মধ্যে একটু রক্ না থাকলে চনমনে ভাবটা ঠিক আসে না!’

অরুণবাবু বললেন- ‘তা বাবা তোমার নামটা কি যেন? মনে পড়েছে- ভিক্টর। তা ভিক্টর, তুমি এইটুকু জ্ঞান নিয়ে কি বিজয় করবে? চনমনে হওয়ার জন্য আরো অনেক গান তো পড়ে আছে! একটা আচ্ছা-খাসা গানের মধ্যে কয়েকটা ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দিয়ে, অবাঞ্ছিত কিছু বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, একটা নাম দিয়ে দিলে- রক মিউজিক; ব্যাস হয়ে গেল আধুনিক রবীন্দ্র সঙ্গীত? এই তোমাদের আধুনিকতা? শোনো, আজকের এই ২০১৯ এ দাঁড়িয়ে কেউ যদি আধুনিক হয়ে থাকেন, তিনি হলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওনাকে আরো আধুনিক করতে যেয়ো না! যে শিশুটির সবে মুখে কথা ফুটেছে, সে থেকে শুরু করে বার্ধক্যের চূড়ান্ত সীমায় যিনি পৌঁছেছেন, সবার জন্য বেঁচে থাকার রসদ দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁকে জানতে সারা জীবন ব্যয় করলেও জানার শেষ হবে না! সেই রবীন্দ্রনাথকে তোমরা আরো আধুনিক করতে চাও? আমি জানি, কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর থেকেই এইসব ভাবনা গুলো তোমাদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। শোনো, কপিরাইট রাখার পিছনেও যথেষ্ট কারণ ছিল। তুলে দেওয়ার পিছনেও যথেষ্ট কারণ আছে। এখন কপিরাইট তুলে দিয়েছে বলেই যা খুশি করার অধিকার জন্মে যায় না! যাঁরা রবীন্দ্র সঙ্গীতকে নিয়ে এই ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন, আর যাঁরা শুনছেন উভয়ের জন্যই কবিগুরু তাঁর শেষ ইচ্ছাটুকু বলে গেছেন। তোমরা যদি শুনতে চাও, তাহলে দু লাইন পড়ে শোনাই-

সকলেই উদ্গ্রীব হয়ে জানাল- শুনতে চায়। অরুণবাবু উঠে গিয়ে দেওয়াল আলমারির দরজা টানতেই দেখা গেল- থরে থরে বই সাজানো।

কি নেই সেখানে; রবীন্দ্র রচনাবলী, সঞ্চয়িতা, গীতবিতান থেকে শুরু করে নজরুল, বিবেকানন্দ, শেলী, কিটস, সেক্সপিয়র সব থরে থরে সাজানো। সেখান থেকে রবীন্দ্র রচনাবলীর একটা খণ্ড এনে, নির্দিষ্ট পাতাটা খুঁজে নিয়ে বললেন- ‘১৯৪০ সালের ৩০শে জুন কবির বক্তৃতার কিছু অংশ পড়ে তোমাদের শোনাচ্ছি- “আমার গান যাতে আমার গান ব’লে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো। আরো হাজারো গান হয়তো আছে-তাদের মাটি করে দাও-না, আমার দুঃখ নেই। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার মিনতি–তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি। এখন এমন হয় যে, আমার গান শুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়।

নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য। মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সব-কিছু সইতে হয়, এও যেন আমার পক্ষে সেই রকম।” এই পর্যন্ত পড়ে অরুণবাবু থামলেন, তারপর ভিক্টর, তপন ও তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললেন- ‘কবিগুরুর জীবদ্দশাতেই অনেকেই ব্যতিক্রমী করতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি শঙ্কিত হয়ে জানকিনাথ বসুকে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন- “গায়কের কণ্ঠের উপর রচয়িতার জোর খাটে না, সুতরাং ধৈর্য ধরে থাকা ছাড়া অন্য পথ নেই। আজকাল অনেক রেডিয়োগায়কও অহংকার করে বলে থাকেন, তাঁরা আমার গানের উন্নতি করে থাকেন। মনে মনে বলি, পরের গানের উন্নতি সাধনে প্রতিভা অপব্যয় না করে নিজের গানের রচনায় মন দিলে তাঁরা ধন্য হতে পারেন। সংসারে যদি উপদ্রপ করতেই হয় তবে হিটলার প্রভৃতির ন্যায় নিজের নামের জোরে করাই ভালো।”

ছেলেগুলি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। অরুণবাবু একটু থেমে আবার বললেন- ‘এখন আমার কথা হচ্ছে- আমরা যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে এতটুকুও ভালোবাসি, তাঁদের কি উচিৎ নয়- কবির ইচ্ছাটুকুর মূল্য দেওয়া? কিম্বা যাঁরা নিজেদেরকে শিল্পী হিসাবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন, তাঁদের কি উচিৎ নয় আরেকজন শিল্পীর ইচ্ছাটুকুর মূল্য দেওয়া?” অরুণবাবুর কথা শেষ হতেই একটি ছেলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। অরুণবাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তপন বলল- ‘ও এক্ষুনি আসছে। আপনি বলুন, রবীন্দ্রনাথকে নতুন ভাবে জানছি, খুব ভালো লাগছে।’

অরুণবাবু আবার বলতে শুরু করলেন- ‘আচ্ছা ভারতীয় সঙ্গীত বলে একটা ব্যাপার আছে তোমরা জানো? আমিও খুব একটা জানি না! রেডিওতে মাঝে মধ্যে শুনি বটে- যাকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বলা হয়। শুনি ওই পর্যন্তই। বুঝিনা কিছুই। বুঝতে গেলে শিখতে হবে। এতটা কষ্ট করার মতো মানসিকতা বা ধৈর্য আমাদের অনেকেরই নেই। সে জায়গায় সহজ সুরে, সহজ কথায় আমাদের জীবনের ছোটো ছোটো চাওয়া পাওয়ার কথাগুলো লিখে গেছেন রবি ঠাকুর।

এইরকম সহজ গান শোনার মতো কান তৈরি করতে পারলাম না, তো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনার কান তৈরি হবে কি ভাবে? আবার অনেকেই মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সঙ্গীতের ক্ষতি করেছেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যে স্বীকারোক্তি করেছেন, কয়েকটি লাইন পড়ি।’ বলেই পাতা উল্টে পড়তে শুরু করলেন- “আমি অত্যন্ত ‘পলাতকা’ ছিলুম বলে কিছু শিখি নি, নইলে কি তোমাদের কাছে আজকে খাতির কম হত? এ ভুল যদি না করতুম, পালিয়ে না বেড়াতুম, তা হলে আজকে তোমাদের মহলে কি নাম হত না? সেটা হয়ে উঠল না, তাই আমি এক কৌশল করেছি–কবিতার-কাছঘেঁষা সুর লাগিয়ে দিয়েছি। লোকের মনে ধাঁধা লাগে; কেউ বলে সুর ভালো, কেউ বলে কথা ভালো। সুরের সঙ্গে কথা, কবি কিনা। কবির তৈরি গান, এতে ওস্তাদি নেই। ভারতীয় সংগীত ব’লে যে-একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার আছে, আমার জন্মের পর তার নাকি ক্ষতি হয়েছে–অপমান নাকি হয়েছে। তার কারণ আমার অক্ষমতা। বাল্যকালে আমি গান শিখি নি–এতে সহজে শেখা যায় না, শিখতে কষ্ট হয়, সেই কষ্ট আমি নেই নি।” এই পর্যন্ত পড়ে বইটা কোলের উপর নামিয়ে রেখে, চশমার কাঁচ দুটো মুছে নিলেন অরুণবাবু।

ততক্ষণে দৌড়ে বেরিয়ে যাওয়া ছেলেটা ফিরে এসে সোফায় বসল। ওদিকে তারস্বরে মাইক বন্ধ হয়ে গেছে। বোঝা গেল ছেলেটি মাইক বন্ধ করতে গেছিল। অরুণবাবু চশমাটা পরে নিয়ে বইটা তুলে বলতে শুরু করলেন- “রবীন্দ্রনাথ কখনোই দাবি করেন নি, তাঁর গান ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জায়গা নেবে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল? যাঁরা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সাধনা করেন, রবীন্দ্র সঙ্গীত তাঁদের আগ্রহের বিষয়বস্তু নয়, আবার তোমাদের মতো তথাকথিত ‘আধুনিক’দের বিষয়বস্তু নয়। তাহলে এই গান তিনি রচনা করলেন কাদের জন্য? এই বিষয়টা আমার কাছে খুব পরিষ্কার। দেখবে, জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ ধরো- প্রচন্ড দুঃখের মধ্য দিয়ে সময় যাচ্ছে, “এই করেছ ভালো নিঠুর হে—” কিম্বা “দুখের বেশে এসেছ ব’লে তোমারে নাহি ডরিব হে—” এই গানটি হালকা চালে একান্তে বাজাও।

মনে শক্তি পাবে। বাজানোর সরঞ্জাম যদি না থাকে, গলা ছেড়ে গাইবার চেষ্টা করো, তাহলেও দুঃখ অনেকটা নিরাময় হবে। ধরো, তোমরা যেটাকে বলছো- ‘ইয়ং জেনারেশন’ অর্থাৎ সমস্ত বন্ধুরা মিলে আনন্দের মধ্যে আছো; একটু লাউড ভলিউমে “আমরা নতুন যৌবনেরই দুত” এই গানটা বাজাও। দেখবে আনন্দের মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো বয়সে রবীন্দ্রনাথকে কাছে ডেকে নাও। দেখবে জীবন অনেক মধুময় হয়ে উঠেছে। তার জন্য নিজেকে সঙ্গীত শিল্পী হতেই হবে এমনটা নয়। শুধু মনের মধ্যে শিল্পী ভাবটাকে বাঁচিয়ে রেখো। এই প্রসঙ্গে কবি বলছেন- “আমার গান যদি শিখতে চাও, নিরালায়, স্বগত, নাওয়ার ঘরে কিংবা এমনি সব জায়গায়, গলা ছেড়ে গাবে। আমার আকাঙ্ক্ষার দৌড় এই পর্যন্ত–এর … বেশি ambition মনে নাই রাখলে।”

সারা ঘরে সুচ পড়ার শব্দ নেই। সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। তপন নীরবতা ভঙ্গ করে বলল- “শুনে খুব অবাক লাগছে- আজ থেকে এত বছর আগে কবিগুরু অনুমান করেছিলেন, তাঁর গান নিয়ে কাটাছেঁড়া হতে পারে। তাই আগে থেকে সেই শঙ্কার কথা প্রকাশ করে গেছেন! তাঁর শঙ্কা কতখানি সত্য আজ তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে । সত্যি, কপিরাইট তুলে দিয়ে খুব খারাপ হয়েছে!”

অরুণবাবু অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বললেন- “আমি তো প্রথমেই বললাম- কপিরাইট রাখার পিছনে যেমন কারণ ছিল, তুলে দেওয়ার পিছনেও কারণ আছে। আরেক দিন সময় করে এসো, সেদিন এই বিষয়ে কথা বলব। আসলে কি জানো, অবাধ স্বাধীনতা পেলে, একটা শ্রেণীর মানুষ তার অপব্যবহার করবেই। তাদের কথা চিন্তা করে বাকিদের বঞ্চিত করাটা কি ঠিক? আমরা যারা এ বিষয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করি, রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসি, তারা যদি এই অপসংস্কৃতিকে বয়কট করি, ওঁরা এই দুঃসাহসিকতার বিন্দুমাত্র সুযোগ পাবে না।’

আবার ঘরে নীরবতা। সকলেই মাথা নিচু করে গভীর চিন্তায় মগ্ন। সময় হু হু করে পেরিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কারো খেয়াল নেই। একটা সময় কলিং বেলের শব্দ হতেই সকলের ভাবনায় ছেদ পড়ল। তপন এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই প্রবেশ করল- লাঞ্চ ক্যারিয়ার সহ এক মহিলা। ডাইনিং টেবিলে সমস্ত নামিয়ে, অরুণবাবুর কাছে রাত্রের খাবারের অর্ডার নিয়ে মহিলা বেরিয়ে গেলে, তপন বলল- ‘আমাদের জন্য আজ আপনার অনেকটা বেলা হয়ে গেল!আপনি খাওয়া-দাওয়া করুন, আমরা আজ আসি।’ বলেই সকলে উঠে দাঁড়াল। অরুণবাবু হাঁ-হাঁ করে উঠলেন- ‘আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও; সকাল থেকে তোমরা বসে আছো, তোমাদের জলটুকু পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি! জল খাও, তোমাদের চাঁদাটা নাও, তারপর যাবে।’ বলেই অরুণবাবু ফ্রিজ খুলে একটা প্লেটে বেশ কিছু মিষ্টি সহযোগে জলের বোতল নামিয়ে দিলেন। সকলে একটা করে মিষ্টি মুখে দিয়ে জল পান করল। অরুণবাবু মানিব্যাগ খুলে একটা পাঁচশো টাকার নোট ভিক্টরের হাতে দিতে গেলে, ভিক্টর হাত জোড় করে বলল- ‘আপনি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছেন, আপনার কাছে চাঁদা নিতে পারব না!’
অরুণবাবু অবাক হয়ে বললেন- ‘তাহলে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করবে না?’

ভিক্টর বলল- ‘আজ সকাল থেকে এই বাড়িতে যা হল, তা রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের থেকে কম কিসে? আমার মনে হয় এর থেকে ভালো রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন আমরা কোনো বছরই করিনি। আজ বুঝলাম- রবীন্দ্র জয়ন্তী যে উদ্দেশ্যে আমরা পালন করি, তা আড়ম্বরে নয়, বরং মননে পালন করা উচিৎ।’ বলতে বলতে ভিক্টরের চোখ আদ্রর্তায় ভরে উঠলো। বাকিদেরও চোখের কোণ চিকচিক করে উঠেছে। অরুণবাবু টাকাটা মানিব্যাগে রেখে বললেন- ‘বাঃ, খুব সুন্দর বলেছো! আড়ম্বরে নয়, মননে স্মরণ করা উচিৎ। এইটি যদি তোমরা করতে পারো তার থেকে ভালো কিছু আর হয় না। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং আমাদের কাছে বিস্ময়! তাঁকে জানতে যুগ পেরিয়ে যাবে, তবু জানার শেষ হবে না! সেই তিনিই বলছেন-’ বলেই দুহাত মেলে উদাত্ত কণ্ঠে শুরু করলেন-

“আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।”
অরুণবাবুর সঙ্গে সকলে গলা মিলিয়ে গাইতে শুরু করল-
“অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার-ভাঁটায় ভুবন দোলে
নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান॥
ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে,
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে,
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।
কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত