জীবন যেখানে দাঁড়িয়ে

জীবন যেখানে দাঁড়িয়ে

আমাদের কোম্পানির নতুন একটা শাখা খুলেছে কলকাতা শহরে। কোম্পানি ঐ শাখাতে আপাতত অভিজ্ঞ সাত জন কর্মী বাংলাদেশ থেকে পাঠাবে। সাত জনের তালিকা আজ ঘোষণা করলো। দোয়া করছিলাম যেনো আমি না হই। দোয়া শেষ করার আগেই সবার প্রথমে আমার নাম ঘোষনা করা হয়েছে। যে সাত জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে তারা সবাই ব্যাচেলর। বিবাহিতরা আপত্তি করবে এটা জানা আছে কোম্পানি পরিষদের। যদিও সেলারি একটু মোটা করে দিবে তাও আমি নিজেকে এখানটায় খুব ভালো ভাবে সেট করে নিয়েছিলাম। কোন চান্স নাই আর, টিম লিডার আর কলকাতা অফিসের ব্যবস্থাপক হিসেবে চার মাস আমাকে ওখানেই থাকতে হবে। সাতদিন পর সবকিছু ম্যানেজ করে আজকের সন্ধ্যায় কলকাতা যাচ্ছি।

ফ্লাইটে যাবো সো আই হোপ খুব একটা সময় লাগবে না। লাগেও নাই, সময় হালকা আর ইমিগ্রেশন কমপ্লিট করতে যা লাগলো। ওখানে অফিসের স্টাফদের থাকার জন্য কোম্পানি একটা হোটেল ফিক্সড করেছে। রাত দশটা বেজে গেছে পৌঁছাতে। হোটেলের বাহির দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। অফিসের কাছাকাছি হওয়ায় এটা ঠিক করেছে। তাই বলে এতো নিম্নমানের হবে? শহরে আরো ভালো ভালো থাকার জায়গা অবশ্যই আছে। বিশাল একটা শহর। এটলিস্ট এই হোটেলে ওয়াশরুম পর্যন্ত এট্যাচ নাই। আমি এখানে থাকা সম্ভব না। দেশে আমাদের মেস কোয়ার্টার কতো হাই ক্লাস ছিলো। এখানে কিভাবে থাকা যাবে? আমি অথরিটির সাথে আলাপ করলাম। দ্যান ভালো একটা প্লেস দেখে মুভ করার ডিসিশন নিলো। আপাতত দু’চারদিন কষ্ট করে থাকতে হবে এখানে।

দুইদিন অফিস করলাম। এই দুইদিন কি পরিমান দখল গেছে আমার উপর দিয়ে তা বলে বুঝাতে পারবো না। সবচেয়ে বড় সমস্যা সারাদিন অফিস করে গিয়ে হোটেলে খেতে পারিনা, খাবারের মান আর কি বলবো! নিশ্চয়ই কম দামে পেয়ে যাওয়ায় কোম্পানি নিয়ে নিয়েছে। ক্যান্টিনে নিভু নিভু লাল বাতি তারপর রুমে উইপোকা, ওয়াশরুম বাহিরে। কি এক ঝামেলায় পরলাম। পরদিন সকালে অফিসে হাফ ডে ডিউটি করে আমি বের হলাম একটা বাসা নিবো। এভাবে আমি থাকতে পারবো না। সাথের কলিগদের খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। তারা আলগা পানির নাগাল পেয়ে গেছে এখানে। সবকটার অভ্যাস খারাপ। আর তার উপর তাদের লিড দেই আমি, আবার আমিই নিয়ে থাকি খাই ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না! যাইহোক ঢাকা শহরের চেয়ে এ শহর খুব একটা পিছিয়ে নেই যা বুঝলাম। ব্যাচেলর ভাড়া দিবেই না। পুরাই পুরান ঢাকার সিন এই এলাকাটি। শেষমেশ একটা লিফলেট পেলাম চিলেকোঠা ভাড়া দেয়া হবে। তবে এটা দুর্গাপাড়া এলাকায়।

অফিস থেকে মিনিট পনেরো দূরে। হোক, ফোন দিলাম। কথা হলো, বিকেলে দেখা যাবে বাসাটি। হোটেলে ফিরে গোসল দিয়ে খেয়ে বিকেলে গেলাম দুর্গাপাড়া। ফোন করলাম, কার্তিক বাবু যিনি বাড়ির মালিক উনি নিজে এসে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। পুরাই পুরান ঢাকার মতো গিজগিজ এলাকাটা। তিন তলা বাড়ি, অনেক পুরনো। বাহির থেকে চিলেকোঠাটা দেখতে খারাপ হলেও ভেতর দেখে আমার বেশ লেগেছে। চারদিকে চারটা জানালা। সারা ছাদ ভরতি ফুলের গাছ। অর্কিড ফুল’ও আছে, আমার প্রিয়। কার্তিক বাবু পান চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন; ‘কি দাদা! কেমন দেখলেন? ভালো লেগেছে তো?’ ‘জ্বি হ্যাঁ ঠিকঠাক, বাসাটা সুন্দর। কালকেই উঠবো ভাবছি। আর খাবারের জন্য আমাকে একটা বুয়া ম্যানেজ করে দিবেন দাদা?’ ‘ও নিয়ে টেনশন করবেন না, বাঙ্গালি বাঙালি। বুয়া পাওয়ার আগ অবধি আপনি আমার বাসায় খাবেন। বুজদে পেরেছেন?’ ‘জ্বি, তাহলে কাল আসছি।’

পরের দিন ছুটি ছিল। অন্যান্য কলিগদের বললাম আমি একটু আলাদা থাকার ব্যবস্থা করেছি দুর্গাপাড়াতে। এখানে একটু অসুবিধা। আপনাদের কোন আপত্তি না থাকলে ওখানে আপনাদের জন্যও একটা বাসা দেখবো? তারা তো আমি থাকবোনা মানে আরো খুশি, যেখানে আছে সেখানেই বেশ, এমনটাই ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝালো। আমার সুবিধাই হলো। চলে আসলাম। সারাদিন নন্দ’দাকে নিয়ে রুম গুছালাম কিছু হাড়িপাতিল কিনলাম, বেডিং আর যা যা লাগে। নন্দদা পুরোনো কাজের লোক এ বাড়ির।

খুব সহজেই মিশে গেছে আমার সাথে। তার কোন এক মাসি ছিলো বাংলাদেশের বরিশালে এটা সেটা কত কি গপ্প করলো এই কিছু সময়ের মধ্যেই। নন্দ’দাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরে খেয়ে এসে যেই ঘুমাবো, দেখি কার্তিক বাবু এসে বেজায় রাগ দেখাচ্ছেন। উনি খাবারের আয়োজন করেছিলেন উনার ঘরে। আমি কেনো বাইরে থেকে খেলাম। পরে কথা দিলাম রাতে খাবো। দ্যান একটু ঘুমাইলাম।
ছাদে কেউ একটা লাফাচ্ছে আর চিল্লাচ্ছে। ঘুমটা ভেঙে গেলো। জানালা খুলে উকি দিয়ে উঠে দেখি একটা মেয়ে কোঁকড়ানো ঘন চুল, পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চি উচ্চতা। উল্টো দিকে ঘুরে মুখে হাত চেপে হাসতেছে, পারার ছেলেরা ঘুড়ি উড়াচ্ছে আর এটা দেখে মজা পাচ্ছে সে। চেহারা দেখতে পারছিনা। অনেকটাই চেনা চেনা লাগছে। কেনো জানি মনে হচ্ছে আমি ওকে চিনি। একটু বের হলাম, যেই মেয়েটা ঘুরে তাকালো আমি ওকে দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, একটা শকড্ খেলাম।

শ্রেষ্ঠা! অবিকল আগের মতোই সে। সেই কোঁকড়ানো চুল, সেই নাক সেই হাসি। একটুও বয়সের ভাজ পড়েনি। কতো হাস্যজ্জ্বল মেয়েটি। এতো বছর পর দেখা। এটা কিভাবে সম্ভব! কল্পনা হবে হয়তো। কোথাও কি ভুল করতেছি আমি? কোথায় ভুল করবো? এখানে কি করে আসবে ও? মাথাটা ঘুরছে। বুকে একটু চিনচিন ব্যথা করছে। আমি পুরনো স্মৃতি ঘাটিনা। নিতে পারিনা, কাঁপা কাঁপা গলায় কাছে গিয়ে বললাম;
‘শ্রেষ্ঠা তুমি এখানে!  ‘না কাকু, আমি অথৈ। আপনি মামুনিকে চেনেন? ‘ওহ্ তুমি শ্রেষ্ঠার মেয়ে? তোমার মা কোথায়? আমি তোমার মায়ের ছোটবেলার বন্ধু, বাংলাদেশ থেকে।’ ‘আপনি রবিন কাকু?!  ‘হ্যাঁ! চেনো আমাকে? ‘মায়ের মুখে এই নামটা কতো শুনেছি। বলেই, মেয়েটা দৌড়ে ওর মাকে আনতে চলে গেল নিচে। কেমন কো-ইন্সিডেন্স!

শ্রেষ্ঠা আমার প্রথম ভালোবাসা ছিল, প্রথম আবেগ আর প্রথম স্বপ্ন। যে সময়টাতে আবেগ জন্মে কৈশোরে, যে সময়টায় আবেগ জমে গিয়ে ভালবাসায় ঠেকে এবং যে সময়টায় মানুষ প্রথম ভুল করে একদম সেখান থেকেই আমাদের সম্পর্কটার শুরু। অদ্ভুত হলেও সত্য যে আমরা তখন থেকেই ভালবাসি যখন আমাদের লেভেলটা প্রাইমারী স্কুলে যাওয়ার বয়স। আমার গ্রামের বাড়িটা সিলেটের একটা বর্ডার সাইট এলাকায়। ইন্ডিয়া ত্রিপুরা রাজ্যের শহরে ঢুকতে মাত্র তিন মিনিট সময় লাগতো। আমাদের বাপ দাদারা ত্রিপুরা গিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। সে সময় এতো কড়াকড়ি কিছুই ছিল না।

দু’দেশের মানুষের মধ্যে কতটা আন্তরিকতা ছিল তা আর কি বলবো! আমাদের এলাকায় প্রতি সপ্তাহে একটা হাট বসতো, আসাম থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে ব্যাবসা করতো। আমি প্রায়ই স্কুল থেকে এসে বই খাতা রেখে নদী পার হয়ে ওপারে খেলতে যেতাম। ইন্ডিয়ার মাঠ ছিল ওটা। সারাদিন খেলে, ত্রিপুরা শহরের একটা টাউনে ঘুরতাম। আমার একটা বন্ধু ছিল ওখানকার, নাম ছিল রৌণক। খুব ডানপিটে ছেলে। সারাদিন দুটো একসাথে ঘুরতাম। ওর বাড়িতে কত খেয়েছি। মাসি আমাকে অনেক আদর করতো। রৌণক আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল ছোটবেলার। আমি বাংলাদেশের চেয়ে ইন্ডিয়াতেই বেশি থাকতাম বলতে হবে। একদম সরাসরি যাওয়া যেতো না, আমি কাস্টম এরিয়া হয়ে না গিয়ে চা বাগান ঘুরে একটা বাঁধের নিচে দিয়ে লুকিয়ে ঢুকতাম আর আসতাম। ওখান দিয়ে বিএসএফ কম গার্ড দিতো। কোন তারের বেড়া ছিলনা তখন।

একদিন রৌণকের স্কুলে গিয়ে শ্রেষ্ঠার সাথে দেখা, শ্রেষ্ঠা ছিল রৌণকের কাকাতো বোন। কোঁকড়ানো ঘন চুল, মায়াবী হাসি। প্রথম দিন পরিচয়েই শ্রেষ্ঠা মিশে গিয়েছিল আমার সাথে। তারপর থেকে ছিলাম আমরা তিন জন। মাঝে মাঝে আমি আগে এসে রৌণকের সাথে দেখা না করে ডিরেক্ট শ্রেষ্ঠার সাথে দেখা করতাম। শ্রেষ্ঠা টিফিন বক্সে খাবার নিয়ে আসতো। সেই খাবার আবার আমরা দুজনে কালি ব্রিজের নিচে বসে খাইতাম। ব্রিজটা এখনো মনে পরে, নিচের পিলারের গোড়ায় বসলে পা নদীর পানিতে লাগতো। শ্রেষ্ঠা জানতে চাইতো আমাদের দেশ আমাদের এলাকা সম্পর্কে আমি বলতাম, শ্রেষ্ঠা কেচ্ছা কাহিনী শুনার মতো শুনতো। মেয়েটা অনেক ভাল গান গাইতো। বিনিময়ে আমায় গান শুনাতো, আর আমি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখতাম। ভালোবাসাটা তখনো হয়নি আমাদের মাঝে। তখনো আমরা বন্ধু ছিলাম।

প্রতি বছরের একটা সময় আমাদের গ্রামে মেলা বসে। বিশাল বড় মেলা। তখন বর্ডার সাইট খুলে রাখে বিএসএফ। ইন্ডিয়া থেকে এন্ট্রি করে অনেক মানুষ মেলায় আসতো। শ্রেষ্ঠার খুব শখ ছিল বাংলাদেশ আসবে, মেলা ঘুরবে আমাদের বাড়িতে আসবে, চা বাগান দেখবে। আমিও কথা দিয়েছিলাম ওকে নিয়ে আসবো। মেলার দুদিন আগে ওকে বলে রাখছি ভোরে যেনো রেডি থাকে ওকে নিয়ে আসবো এলাকায়। শ্রেষ্ঠা অনেক বেশি খুশি হয়েছিল। ওর ফ্যামিলিতে বলে এসেছিল বান্ধবীর বাড়িতে সারাদিন থাকবে। সেবার রৌণকও এসেছিল। তিনজন বাঁধের নিচে দিয়ে ভোরে এসেছিলাম লুকিয়ে। তারপর নৌকা করে বাংলাদেশ। অনেকপথ পাড়ি দিয়ে এসে শ্রেষ্ঠা আমাকে বলেছিল ‘তুমি এতো কষ্ট করে আসো রবিন? তাও প্রতিদিন? কিভাবে রবিন? আমিতো হাঁপিয়েই মরে যাবো।’ সেদিন আমি ওকে বলতে চাইছিলাম ‘শুধু তোমার জন্য শ্রেষ্ঠা, এটাতো অল্প।’

সেদিন সারাদিন ঘুরেফিরে মেলা থেকে অনেকগুলো রেশমী চুড়ি কিনে দিয়েছিলাম, কপালের টিপ কিনে দিয়েছিলাম শ্রেষ্ঠাকে। তারপর বাড়ি নিয়ে আসি। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করলাম। আম্মা শ্রেষ্ঠাকে অনেক আদর করেছে। শ্রেষ্ঠাও সারাক্ষণ আম্মার সাথে সাথেই ছিল। একদম বাধ্য মেয়ে, যেনো সেও একদিন এই সংসারের গিন্নী হয়ে আসবে। আমার অনেক ভালো লেগেছিল। যাইহোক, বিকেলের শেষের দিকে শুরু হয় প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি। শ্রেষ্ঠাকে যেভাবেই হোক যেতে হবে ইন্ডিয়াতে। শ্রেষ্ঠা কান্না শুরু করে দিয়েছে। বারবার বলতেছে, ‘বাবু জানলে আমাকে মেরে ফেলবে রবিন, দয়া করে আমাকে নিয়ে চলো।

‘এই বৃষ্টিতে কিভাবে যাবা তুমি?’ ‘জানিনা তুমি আসো’ সেদিন বৃষ্টিতে ভিজেই রওনা দিলাম। নদীতে এসে দেখি অনেক পানি। শ্রেষ্ঠা ভয়ে চিল্লায়া কান্না শুরু করে দিয়েছে। আমি ওর হাত ধরে বলেছিলাম ‘আমি আছিতো শ্রেষ্ঠা, একটু ধৈর্য ধরো’ শেষে রৌণককে নিয়ে আমাদের একটা কলা বাগান ছিলো নদীর চরে, ওখান থেকে তিনটা কলা গাছ কাটলাম। গড়িয়ে গড়িয়ে নদীর তীরে এনে বাঁশ দিয়ে ভেলা বানালাম। শ্রেষ্ঠা সাতার জানতো না। ওরে ভেলার উপর কোনরকম তুলে দুপাশে রৌণক আর আমি ভরা নদী ঠেলে পাড় হয়েছিলাম। ওদের ত্রিপুরা দিয়ে এসে দেখি আমার ভেলা নাই। নদীতে আরো পানি। পানির শা শা শব্দে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাও চোখ বন্ধ করে সাতরে আসি এপারে। চরে এসে উল্টে পরে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে ছিলাম।

সেদিন বাড়িতে এসে প্রচুর জ্বর আসে আমার। জ্বর সারতে পাক্কা পাঁচ দিন লাগে। পাঁচদিন পর শুনি আমার বার্ষিক পরীক্ষা। তারপর গুনেগুনে সতেরো দিন পর গিয়েছিলাম ত্রিপুরাতে। কালি ব্রিজের নিচে এসে শ্রেষ্ঠা আমাকে জাপটে এসে জড়িয়ে ধরে প্রচুর কেঁদেছিল। আমি তখন জানতাম, আমাদের মধ্যে ভালোবাসাটা হয়ে গিয়েছে। আমাকে কথা দিতে হয়েছিল সেদিন, যেনো কোনদিন ওকে ছেড়ে আর কোথাও না যাই। এভাবেই আমরা বড় হয়েছিলাম। কোনো একদিন ভোরে উঠে শুনি দুই দেশের গার্ডদের মধ্যে একটা ঝামেলা বেঁধেছে। বিএসএফ এদেশের পাঁচজনকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। তারা অবৈধ ব্যবসায়ী ছিলো। ঘোষণা করা হয়েছে আর দু’দেশের মধ্যে অবাধে কেউ আসা যাওয়া করতে পারবে না। তারের ইলেকট্রিক বেড়া নির্মাণ করে ফেলবে। সেবার আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। আম্মা আমাকে ঘর থেকে বের হতে দেয়না। আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। আমার যেভাবেই হোক শ্রেষ্ঠার কাছে যেতে হবেই। সেবার লুকিয়ে ঘরের জানালার রড তুলে পালিয়ে গিয়েছিলাম রাতের বেলা একটা ট্রস লাইট নিয়ে। সকালে দেখা করলাম। শ্রেষ্ঠাকে সব বলার পর সে নিজেও ভেঙে পড়ে অনেক। আমি বলেছিলাম শ্রেষ্ঠা চলো আমরা পালিয়ে যাই। তুমি আমার সাথে চলে আসো। আমি তোমাকে ভালোবাসি শ্রেষ্ঠা, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। শ্রেষ্ঠা সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ‘আমিও পারবো না রবিন, চলো পালিয়ে যাই’।

নাহ্ শ্রেষ্ঠা আর আসেনি। অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত এসে কি যেনো মনে করে আমার পায়ে পরে কান্না শুরু করে দিয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলতেছিল; ‘রবিন আমি পারবো না। আমি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। তারা মরে যাবে রবিন, তুমি চলে যাও।’ আমি সেদিন শ্রেষ্ঠাকে চিনতে পারিনি। শ্রেষ্ঠা মাঝ পথ থেকে চলে গিয়েছিল। আমি বাড়িতে এসে অনেক কাঁদি। একদিন রৌণকের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠা একটা চিঠি পাঠিয়েছিল; ‘তোমাকে খুব মিস করতেছি রবিন। বুঝাতে পারবো না আমি। আমি তোমাকে চাই খুব, কিন্তু কিভাবে সম্ভব এটা বলো? আমি হিন্দু আর তুমি মুসলিম। এটা মনে আছে? আমারতো মনেই ছিল না রবিন। রৌণক আমাকে আজ বললো। হয়তো সান্ত্বনা দিতে। আমি ধর্মের ফারাক বুঝিনা। তোমাকেই চাই, অপেক্ষায় রইলাম, তুমি আসবা একটু আমার কাছে?

নাহ্ সেবারো আর সম্ভব ছিলনা যাওয়া। অনেক কঠোর ব্যবস্থা জারি করা হয়েছে বর্ডার এরিয়াতে। ডিরেক্ট গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে যেখানেই অবৈধ ভাবে কেও ঢুকার চেষ্টা করছে। আর পাসপোর্ট করার মতো কোন অবকাশ ছিলনা আমার। আমি তখন ভোটার হয়নি। কিংবা কোন ইস্যু ছিলনা পাসপোর্ট করার। পাসপোর্ট করে ভিসা করে তিন মিনিটের এতো পরিচিত পথে যাবো! এটা মানতেই পারছিলাম না।

তারো অনেকদিন পর ঠিকই আমি ভিসা পাসপোর্ট ছাড়াই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি শ্রেষ্ঠা আর অপেক্ষা করে নাই। বিয়ে করে ফেলেছিল। সেদিন কালি ব্রিজের নিচে বসে একা একা অনেক কেঁদেছিলাম। ভেবেছিলাম লাফ দিয়ে মরে যাই, পারিনি। আমি আর দ্বিতীয় প্রেমে পড়ার সাহসও পাইনি। শ্রেষ্ঠা আজো আমার বুকের ভেতরেই আছে। সেই কল্পনাগুলো জমা করেই বেঁচে ছিলাম এতদিন। আর আজকে নিয়তি এসে কোথায় কিভাবে মিলিয়ে দিলো!
অথৈ শ্রেষ্ঠাকে টেনে নিয়ে আসতেছে। আমি ছাদ থেকে দেখতেছি। মুটিয়ে গেছে খুব। মহিলা হয়ে গেছে আমার পিচ্চি শ্রেষ্ঠা। মেয়েটাকে বকতেছে আর বলতেছে; ‘ছাদে নতুন ভাড়াটিয়া আসছে, তুই কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছিস! ‘আরে মামুনি এসেই দেখোনা।’ শ্রেষ্ঠা আমার সামনাসামনি; ‘নমস্কার দাদা, আমাদের এখানে কোন সমস্যা হচ্ছে নাতো? আমার মেয়ে আপনাকে চেনে তাই আমাকে নিয়ে আসলো।’

ভুলেই গেছে তাহলে, ভুলবে না ক্যান! আজ এতো বছর পর মনে থাকার কথাই না। তখন আমার চুল অনেক লম্বা ছিল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল। আর এখন অফিসিয়াল, ক্লিন শেভ, ছোট চুল। শরীর স্বাস্থ্য বেড়েছে। আগে একদম শুকনো ছিলাম। ‘শ্রেষ্ঠা আমি রবিন, ভুলে গিয়েছো?’ শ্রেষ্ঠা আমাকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো। মেয়েটার দিকে ঘুরে তাকাতেই মেয়েটা নিচে নেমে গেছে। খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে।’কেমন আছো?”এইতো, তুমি?”একি অবস্থা তোমার? চিনতেই পারছিলামনা।”চেনার প্রয়োজন অনেক আগেই ফুরিয়ে গিয়েছিল, কি করে চিনবে তুমি শ্রেষ্ঠা?”সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালবো, গেলাম আমি’ শ্রেষ্ঠা একা একা নিচে নামতে পারছিল না। কেমন যেন একটা ঘোরে ঢুকে আঘাত পাচ্ছে খুব। এভাবে হুটহাট দেখা হওয়াটা অস্বাভাবিক খুব।

চারমাস থেকেছি। শ্রেষ্ঠা একটা স্থানীয় উন্নয়ন পল্লী পরিষদে চাকরি করে। মাঝে মাঝে আমাদের দেখা হয় রাস্তায়। কখনো হাওরা ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থাকি। হাই হ্যালো বলে দুজনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে নতুবা একজন উত্তর দিকে তাকিয়ে থাকি আরেকজন দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে আঁচল আর রুমাল দিয়ে চোখ মুছি। এভাবেই, খুব কথা নেই। ইন্দ্রিয় একটা অনুভূতি অনুভূতিতে বড্ড অভিমান হয়। কেউ কাউকে কিছু বলার উপায় পাচ্ছেনা। যেন পরিস্থিতি আজ সম্পর্কের মধ্যে শক্ত একটা তারের ভেড়া তৈরি করে দিয়েছে।

প্রতিদিন অথৈ এসে খাবার দিয়ে যায়। কোন বুয়ার প্রয়োজন পড়েনি। এটাই হয়তো, এভাবেই দাবিদাওয়া পূর্ণ করার ব্যর্থ চেষ্টা চলছে। কাল চলে যাবো দেশে। রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি, আকাশে পরিস্কার চাঁদ। এই এলোমেলো চার মাস আমার জীবনে না আসলেই বড্ড ভালো ছিলো বোধ করছি। স্মৃতির পাতাগুলো অহেতুক ভারি করে ফেললাম। কি দরকার ছিল? শ্রেষ্ঠা আজকে নিজে খাবার নিয়ে এসেছে। ‘রবিন খাবে না?’ পেছন ফিরে বললাম; খিদে নেই, অথৈ কোথায়?’

ঘরেই আছে, আসো খাবে’ রুমে এসে দেখি গরুর মাংস রান্না করে এনেছে। বহুদিন আগে শ্রেষ্ঠা কালি ব্রিজের নিচে আমার কাঁধে মাথা রেখে বলেছিলো; ‘তুমি যেহেতু গরুর মাংস খেতে পছন্দ করো, আমি তোমাকে বিয়ের পর খাওয়াবো রান্না করে। কিন্তু আমাকে সাধতে পারবানা, ঠিক আছে?’ আমি মাথা নাড়তাম। আজ শ্রেষ্ঠা তার হাত দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে। অনেক স্বাদ লাগছে, বোঝাই যাচ্ছে না কোন একটা মানুষ তার জীবনে কোনদিন না খাওয়া একটা জিনিস নিজে বানিয়ে নিয়ে এসেছে।

তোমার চুল কেটে ফেলছো ক্যান রবিন?’ চুল ভালো লাগে না আর, শ্রেষ্ঠা চলে যাও তুমি, কার্তিক বাবু খুজতে পারে তোমায়’ তোমার চুল আমার প্রথম প্রেম ছিল রবিন। কার্তিক বাড়িতে নাই। কাজে গেছে আজ চারদিন হলো। বিয়ে করোনি ক্যানো তুমি?’ বুড়ো হয়ে গেছি?’ নাহ্ ঠিক আছো তুমি, তুমিই ঠিক ছিলা।’ কাঁদছো ক্যান? চলে যাও এখান থেকে। ভাল্লাগছে না।’ ক্ষমা করো রবিন, বড্ড অসহায় ছিলাম। নিয়তি আমাকে অনেক সাজা দিয়েছে।’

কোন দোষ করোনি তুমি, ভুলে যাও। ভুলে যাওয়াই মঙ্গল’ আসছো ক্যান তুমি এখানে? কেনো রবিন!’ শ্রেষ্ঠা আমাকে ছাড়ো, কান্নাকাটি ভাল্লাগে না। এ কয়দিন অনেক সেবা করেছো, কৃতজ্ঞ থাকবো।’ শ্রেষ্ঠাকে একরকম জোর করে বিদেয় করলাম। মায়া জিনিসটা খারাপ অনেক। আমি খারাপে জড়াতে পারবো না। পুরনো অধিকার জাগিয়ে সম্পর্ককে কলঙ্ক করবো না। ছাদে আসলাম। আজ নন্দ’দাকে দিয়ে সাদা পানি আনালাম, আলগা পানি আরকি। খাবো, খেলে নাকি অনেক ঘুম আসে চোখে। একটা ঘুম দরকার খুব। চার চারটা মাসের একটা রাতও ঘুমাইনি আমি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত