বিবাহনামচা

বিবাহনামচা

দৌড়ে দৌড়ে স্যান্ডেলজোড়া চেঞ্জ করতে আসছিলো নয়না। বিয়ে বাড়ির দৌড়াদৌড়ি করতে করতে ভরা অনুষ্ঠানের মজার মুহুর্তে স্যান্ডেলজোড়া ছিরে গেলো ফট করে। মেজাজ টা খুব চিরবিরিয়ে উঠেছিলো তখনই। কি বিরক্তিকর? এখন আমি স্যান্ডেল পাবো কোথায়? কমিউনিটি সেন্টার এ তো আর কেউ একস্ট্রা সু নিয়ে আসে না? ঐ সময়ই জিনিয়া ওকে বাঁচালো। জিনিয়া! নয়নার খালাতো বোন।

“নয়নাপু, দোতলার ঐ কোনার দিকের রুমে আমি একজোড়া সু রেখে এসেছি। আমারটা অবশ্য তোমার পায়ে বড় হবে। তবুও কাজ চলুক আপাতত। মিথিপুর বিদায়ের তো আর বেশি দেরি নেই! আমরা তো বাসায়ই ফিরবো, তাই না?”নয়না জিনিয়ার কথা মেনে নিলো। অবশ্য না নিয়ে উপায়ই বা কি? এখন যে একজোড়া স্যান্ডেল পাওয়া গেছে এই ঢের! ছেঁড়া স্যান্ডেল দু’টো হাতে নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে দোতলায় উঠছিলো নয়না। কয়েকবার ভারী লেহেঙ্গায় পা বেধে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো।

দোতলার এই পাশটায় ভীর কম। বউকে শুরুতে দোতলায়ই বসান হয়েছিল। এখন বিদায়ের আগে নিচে বরের পাশে বসিয়েছে। তাই ভীর সব এখন নিচে। নয়না এঘর ওঘর উকি দিয়ে পরে জিনিয়ার বলা রুমটায় ঢোকার জন্য নবটা ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই অন্ধকারে কেউ একজন নয়নাকে রুমের ভিতর টেনে নিয়ে দরজা আটকে দিলো। নয়না চিৎকার দেওয়ার আগেই কারো ঠোঁটের নিচে চাপা পড়লো ওর ঠোঁট জোড়া।

এহেন কাজে নয়না ভয় পেয়ে নড়তে চড়তেও ভুলে গেলো, কি হচ্ছে ওর সাথে সেটাও যেন ওর বুঝে আসছে না? অনুভুতিগুলো সব অসার হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথায় যেন বাজ পরলো নয়নার? নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য হালকা একটু মোচরা মুচরি করতেই বাঁধন আলগা হয়ে গেলো। যে ধরেছিলো সে মনেহয় চুমুর ঘোরে বাঁধন আলগা করেছে। নয়না অন্ধকারে ভীত গলায় প্রশ্ন করে-“কে আপনি? এসব কি আচরন? বাতিটা দিন প্লিজ?”ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ এলো না। তবে কিছুক্ষনের মধ্যে রুমের বাতি জ্বলে উঠলো। নয়নার চোখের ধাঁধা লাগানো ভাব কাটতেই চোখ মেলে দেখলো ওর মামাতো ভাই হাসান খুব নার্ভাস ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাসানকে দেখেই নয়নার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সব ভুলে ও চিৎকার করলো- “হাসান ভাই তুমি? তুমি একাজ করলে? কেন?”

হাসানও চমকে নয়নার দিকে তাকালো। নয়নাকে দেখতেই ওর মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো-“নয়না! তুমি! জিনিয়া কোথায়? বিশ্বাস করো নয়না, আমি জানতাম না তুমি আসবে? এখানে তো জিনিয়ার আসার কথা ছিলো। ঔ তো আমাকে বললো এখানে ওয়েট করার জন্য? আমি তো ভাবলাম জিনিয়াকে “নয়নার ততক্ষণে মনমেজাজ চরমে উঠেছে। এই হাদারাম হাসান তাকে জিনিয়া ভেবে কিস করেছে ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে নয়নার। শেষ পর্যন্ত কিনা এই গাধাটা ওর ঠোঁটে প্রথম স্পর্শ দিলো? গাধার মুখে জিনিয়ার নামটা শুনতেই মনটা আরো তেতে গেলো। গাধাটা কি জিনিয়াকে ভালোবাসে নাকি? আর এই মেয়ে কি ওকে ইচ্ছে করে ফাঁসিয়েছে? ওকে তো দেখে নেবে? কিন্তু এখন এই হাসানের কি করবে? এই গাধা আবার মামীকে সব বলে না দেয়? গাধা তো পড়ালেখা আর মা ছাড়া কিছু বোঝে না। কিন্তু গাধাটা বিয়েতে আসলো কখন? মামীতো বলেছিলো, গাধার পরীক্ষা চলে ও আসবে না! নয়নার ইচ্ছে হয় হাসানকে ঠাটিয়ে চড় মারতে। কিস করবি তো দেখে করবি না? শালা, তোর বিয়ে করা বউকে যদি এভাবে কেউ চুমু দেয়, ভাল্লাগবে?

নয়না কি করবে বুঝতে পারছে না। হাসান তখনও কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। নয়না ভালোমতো তাকিয়ে দেখলো হাসানের মুখ লালচে হয়ে আছে। আপনাতেই নিজের ঠোঁটে হাত চলে গেলো নয়নার। ওর লিপিস্টিক মনেহয় লেগে আছে হাসানের মুখে! নয়নার খুব লজ্জা লাগলেও সেটা ঠেলে মনের গোপন কুঠুরিতে পাঠিয়ে দিলো। এই হাঁদারাম এর কাছে লজ্জা পেয়ে লাভ নেই কোনো! ও নিজের হাতে ধরা টিস্যুটা হাসানের দিকে বাড়িয়ে দিলো-
“মুখটা ভালোমতো মুছে নাও হাসান ভাই? আর খবরদার একথা যেন কেউ না জানে? তুমি কি জিনিয়াকে ভালোবাসো নাকি? ও বলতেই এখানে চলে এসেছো কেন?”

হাসান টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে লজ্জা পেয়ে মুখ আরো নামিয়ে নিলো। তুতলিয়ে বললো- “না মানে হ্যা মানে সেরকম কিছু না…আসলে মানে..”হাসানের তোতলানো দেখে নয়নার রাগ আরো বাড়লো। এই গাধা কিভাবে যে বিআইটি তে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং এ চান্স পেলো আল্লাহ জানে। বিরক্ত হয়ে নয়না হাসানকে থামিয়ে দিলো-“আচ্ছা থাক! হয়েছে আর বলতে হবে না। তবে একটা কথা বলে দিচ্ছি আবারও এঘটনা কেউ যেন না জানে?”নয়না শাসিয়ে দিলো হাসান কে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে জিনিয়ার বলা স্যান্ডেল জোড়া খুঁজলো। কিন্তু পেলো না। হাসান নয়নাকে দেখছে দূরে দাঁড়িয়ে- “কিছু খুঁজছো নাকি?” “হুম, আমার স্যান্ডেল জোড়া ছিড়ে গেছে। জিনিয়া বললো এখানে নাকি একজোড়া স্যান্ডেল রাখা আছে? ওটা নিতেই তো এলাম?” “তুমি তো দেখি বোকার হদ্দ! জিনিয়া তোমাকে কেন এখানে পাঠাইছে এখনো বোঝোনাই? স্যান্ডেল তো বাহানা মাত্র?

নয়নার হুস আসলো। আসলেই তো? জিনিয়া তাকে সত্যি এই জন্যই পাঠাইছে তাইলে? রাগে নিজের স্যান্ডেল জোড়া ঘরের এককোনায় ছুড়ে দিলো নয়না। হাসান শুধু দেখে যাচ্ছে। কিছু বলার মতো সাহস হচ্ছে না ওর। এমনিতেই মেয়েদের কে ও ভয় পায়। তারউপর নয়না খুব রাগি মেয়ে। ফ্যামিলির সবাই ওকে ভয় পায়। হাসান তো কোনোদিন নয়নার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত! আজ পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে খারাপ লাগছে না মেয়েটাকে। রাগী তবে রাগটা মনেহয় ওর সৌন্দর্য! রাগলে ওর ফর্সা গালদুটো লাল হয়ে যায় আর চোখগুলো কাঁপে বেশি। নয়না হাসানের দিকে তাকাতেই হাসান ওর চোখ সরিয়ে নিলো।

নয়নার ভ্রু কুঁচকে উঠলো। শালা, হাসানের বাচ্চা ওর দিকে এমন লুকিয়ে তাকাচ্ছে কেন? রাগি গলায় নয়না বললো-“কি? কি হইছে? এভাবে কি দেখো? যাও, যায়ে জিনিয়াকে দেখো?” হাসান নয়নার রাগ পাত্তা না দিয়ে বললো-“তুমি বরং আমার এই স্যান্ডেলজোড়া পর। আমি খালি পায়ে থাকলে সমস্যা নাই।”বলে হাসান ওর নাগরাটা খুলে দিলো। যেহেতু আজ ড্রেসকোড পাঞ্জাবি ছিলো তাই হাসানের পায়ে নাগরা। নয়না চোখ লাল করে তাকালো হাসানের দিকে -“বেশি প্রেম দেখায়ো না হাসান ভাই? তোমার জুতার গুষ্টি কিলাই?লাগবে না আমার স্যান্ডেল পড়া, এরচেয়ে খালি পায়ে হাঁটা ঢের ভালো!”

জোরে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে নয়না। খালি পায়েই দুপদাপ করে দোতলা থেকে নামে। নিচ তলায় গেটের কাছে ভীর দেখে বুকটা কেঁপে ওঠে। আপুর কি বিদায় হয়ে গেলো? দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো সামনে, ওকে দেখেই ওর মা ধমকে উঠলেন- “কোথায় ছিলি নয়ন? মিথিকে নিয়ে যাচ্ছে আর তুই নাই?” নয়নার চোখ জ্বলে ভরে উঠলো। আপুর কতশত খুনসুটি ভরা স্মৃতি! দুই বোন এক ভাই নয়নারা। নয়না আর মিথি যেন একে অপরের কলিজার টুকরা! কখনো ঝগড়া হয় না ওদের! দুই বোনের এমন মিল সচরাচর পাওয়া যায়। মিথির হাত ধরে নিয়ে আসছিলো ওর বাবা। বোনকে দেখেই কেঁদে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো মিথি। কান্নাকাটির পর্ব শেষ করে মিথিকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে পেছনে এসে দাড়াতেই কেউ একজন নয়নার দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো। আনমনা নয়না টিস্যু দিয়ে চোখের কোল মুছে নিলো। যে টিস্যু এগিয়ে দিয়েছিলো সে আড়ালে হারিয়ে গেলো।

কলেজ থেকে বেড়ুতেই চোখ পরলো হাসানের দিকে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে হাসান। মিথির বিয়ের ছয়মাস পার হয়ে গেছে। নয়নার মনের স্মৃতিও হালকা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ঝট করে মনে পরে বটে সেই আচমকা চুম্বন এর কথা তবে তা মাথায় রাখতে চায় না নয়না। গাধা হাসানের কথা তো আরো না! সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে জিনিয়াকে ধরেছিলো নয়না।

“নিয়া, এসব কি? তুই আমাকে ইচ্ছে করে ওই রুমে পাঠিয়েছিলি?” জিনিয়া ভয় পাওয়া গলায় বললো-“আপুনি, আমার কোনো দোষ নাই। সামির ভাইয়াই তো বললো আমাকে এমনটা করতে? “”সামির?” নয়নার কন্ঠে বিস্ময়! সামির ওর ভাই মামুনের বন্ধু। কিন্তু ও কেন একথা বলবে? অবশ্য মামুন, সামির, হাসান এরা সব সেম ব্যাচ। বয়স একটু আধটু আগে পিছে হতে পারে। নয়নার অসহ্য লাগলো ব্যাপারটা। সে কড়া চোখে জিনিয়ার দিকে তাকালো- “তোর কি আবার সামিরের সাথে কিছু চলছে নাকি?”জিনিয়া ঢোক গিললো, নয়নার কথা শুনে ওর গলা শুকিয়ে গেলো। “তারমানে আমি যা বলছি তা সত্যি? “নয়না গর্জে উঠলো। জিনিয়া একটু কেঁপে উঠলো সে গর্জন শুনে।

“নাহ আপু, তুমি যা ভাবছো সেরকম কিছু না। আমি শুধু সামির ভাই যা বলতে বলেছে তাই বলেছি। এর বেশি কিছু জানিনা। বিশ্বাস করো আপু আমার কোনো দোষ নাই এখানে?” জিনিয়ার কন্ঠে অনুনয়। নয়না হাল ছেড়ে দিলো। এমনিতেই সারাদিনের দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত, এখন এসব ভালো লাগছে না। নয়না এরপর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেছিলো। এখন হাসানকে দেখে পুরনো কথা মনে দোলা দিয়ে গেলো। ওকে দেখেই হাসান এগিয়ে এলো-“নয়না, একটু কথা ছিলো তোমার সাথে? ” “কি কথা?” রুক্ষ কন্ঠে জানতে চায় নয়না। “দেখো হাসান ভাই, তুমি আবার আমার প্রেমে ট্রেমে পড়নিতো? এসব কিন্তু আমার একদম অপচ্ছন্দ? আত্মীয় স্বজনের মধ্যে রিলেশন আমার দুই চোখের বিশ। আই হেইট ইট!”

“নয়না, তুমি না বড্ড কেমন যেন? কোথায় আমি এতো দূর থেকে তোমার সাথে দেখা করবো বলে ছুটে এলাম, আর তুমি এখনো নিজেতেই আটকে আছো?নিজেকে ছাড়া কিছু বোঝো না দেখছি!আজিব?” আমার জন্য? আমি বলেছি তোমায় আসতে? তোমার সাথে কথা হলো কখন আমার?” বিস্ময়ে আকাশ থেকে পড়ে নয়না। “উফফ, তোমার সাথে কথা বলাই বেকার! তার থেকে যা হচ্ছে হোক, পরে আবার আমায় দোষ দিয়ো না যে আমি তোমায় কিছু বলিনি? আমি তোমায় বলতেই এতোদূর ছুটে এলাম কিন্তু তুমি শুনলে না!” বলেই হাসান গটগটগট করে হেঁটে চলে গেলো। নয়না অবাক হয়ে হাসানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি বলতে এসেছিলো হাসান? শোনাই তো হলো না? উফ! এতো কেন যে রাগ ওঠে হাসানকে দেখলে? একদম ভাল্লাগে না!

বাসায় ফিরে দেখলো মিথিলা এসেছে। মিথিলাকে দেখেই নয়না ছুটে যেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো- “আপুনি, তুমি কখন এলে? এতোদিনে ভাইয়া তোমায় একা ছাড়লো তবে? আজ কিন্তু থাকতে হবে আমার সাথে? একদম ছাড়বো না তোমায় বলে দিচ্ছি? ” “উফ, ন! কেবলই তো এলি? আগে যা গোসল দে, তারপর এসব থাকা থাকি। যা তাড়াতাড়ি যা। তোর সাথে খাবো বলে বসে আছি। খিদেয় পেট চো চো করছে একেবারে!” হাসান খুব মেজাজ খারাপ করে বাসায় ফিরলো। যে কথা বলার জন্য নয়নার কাছে গেলো সেকথা আর বলা হলো না। বলা হলো না যে, মা নয়নার সাথে ওর বিয়ের কথা পাকা করেছে এবং বিয়েটা আজই হচ্ছে। সবাই মোটামুটি জানে ব্যাপারটা শুধু নয়না বাদে। নয়নার চরম মেজাজ সবাই ভয় পায় বলে কেউ ওকে জানানোর সাহস পাচ্ছে না।

হাসানের পড়ালেখা শেষ, ফাইনাল সেমিস্টার শেষ করে এলো। এদিকে একদিন মায়ের কাছে কথায় কথায় নয়নার কথা বলতেই মা খুশিতে বাক-বাকুম করে উঠলো। মায়েরও নাকি নয়নাকে খুব পচ্ছন্দ। এদিকে হাসানের মনেহলো সে ফেঁসে গেছে। নয়না জানতে পারলে নির্ঘাত তাকে কচু কাঁটার মতো করে কাটবে। হাসান আসলে প্রেমে পড়েছে নয়নার। চুমু খেয়ে প্রেম বললে ভুল হবে, আসলে সেই ঘটনার পর থেকে নয়নাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে হাসান। এবং অবাক হয়ে দেখলো বেশ ভালোই লাগে ভাবতে। মেয়েটার রাগি রাগি চেহারা মনে পড়লেই হাসানের মুখে চোখে কেমন একটা হাসি ছড়িয়ে যায়। ভালোলাগায় মনটা একেবারে ভরে ওঠে। কিন্তু নয়না তো সেরকম কিছু ভাবছে না? ও তো বিষয়টা কবেই ভুলে গেছে! উল্টো আজ বলে দিলো যে, আত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয়তা ওর পচ্ছন্দ না? ও বিয়ের কথা শুনলে কি করবে আল্লাহ জানে!

মিথির সাথে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেছিলো নয়না। ঘুম থেকে উঠতেই দেখলো বাসা ভর্তি মানুষ। নয়না অবাক হয়ে দেখলো প্রায় সবাই এসেছে বাসায়, মামা, চাচা, খালা, ফুফু সবাই। জিনিয়া ওকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। মিথি নয়নার মাথার কাছেই বসে ছিলো। ও ওঠা মাত্রই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো- “ন, যাতো বাথরুম থেকে ভালোমতো হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। এসে এই শাড়িটা পড়।” মিথির হাতে একটা লালনীলের মেশানো কাতান শাড়ি। নয়না অবাক হয়ে একবার শাড়ীর দিকে আর একবার মিথির দিকে তাকাচ্ছে।

“আমি কেন শাড়ি পড়বো?” “আহ, যা না। আগে ওয়াশরুম হয়ে আয়।” নয়না অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। মিথি ওকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর নয়না বেড়িয়ে আসতেই মিথি ওকে ধরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে দিলো- “শোন ন, তুই রাগ করিস না হ্যা? বাবা মা তোর বিয়ে ঠিক করেছে।” “বিয়ে? কার সাথে? আর আমাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার কি প্রয়োজন পরলো? আমি তো আর কারো সাথে প্রেম করছি না? কেবল মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম? “নয়নার কথা শুনে জিনিয়া ফিক ফিক করে হাসছে। মিথি জিনিয়াকে ধমক দিলো। জিনিয়া ওর হাসি লুকানোর চেষ্টা করছে।

“আহা, এভাবে বলছিস কেন? শুধু প্রেম করলেই বুঝি বিয়ে দিতে হবে? ভালো পাত্র পাওয়া গেলেও তো বিয়ে দেওয়া যায়, তাই না?””তা ভালো পাত্রটা কে শুনি?””হাসান। সে নাকি তোকে পচ্ছন্দ করে? মামী প্রস্তাব দিলে বাবা মা আর না করেনি।”নয়না রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালো। “আপু, তুমি জানোনা আমি আত্মীয়তার মধ্যে আত্মীয় বানানো পচ্ছন্দ করি না?” “জানি তো রে! কিন্তু বাবা মায়ের কথাও ভাব। মামাীকে কথা দিয়ে ফেলেছে, এখন যদি মানা করে তাহলে কি হবে? প্লিজ ন, বোন আমার! এমন কিছু করিস না যাতে বাবা মা কষ্ট পায়। প্লিজ!” নয়নার ইচ্ছে হলো সবকিছু ভেঙে চুরে শেষ করে দিতে। এরা এমন কেন? এরচেয়ে তো প্রেম করলেই ভালো হতো? নয়না জিনিয়ার দিকে রাগি চোখে তাকাতেই জিনিয়া সেখান থেকে কেটে পড়লো। হাসানের বাচ্চা তাহলে তখন সেই কথাই বলতে এসেছিলো? রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে হলো নয়নার।

রাত আটটার দিকে বিয়ে পড়ানো হলো নয়নার। হাসানকে ওর পাশে বসাতেই নয়না অগ্নি দৃষ্টি হানলো হাসানের উপর। তা দেখে ভয়ে একেবারে সিটিয়ে গেলো হাসান। রাতে যে কি করবে নয়না তা ভাবতেই বুক হিম হয়ে গেলো। হাসানের মা জোর করেই নয়নাকে নিয়ে এলো বাসায়। নয়নার বাবা মা অবশ্য রাজি ছিলো না। অনুষ্ঠান করে বিদায় করতে চেয়েছিলো নয়নাকে। নয়নার মামী সেসব কথা শুনলেন না। বললেন- “সে যখন হবে তখন হবে। আপাতত বউকে সাথে নিয়ে যাই। হাসান এখন বাড়িতে আছে, বউয়ের সাথে একটু সময় কাটাক। চাকরিতে ঢুকলে আবার ব্যস্ত হয়ে যাবে।”

অগত্যা সবাই মেনে নিলো। নয়নাকে হাসানের রুমে বসিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। রুমটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে। নয়না ওভাবেই বসে ছিলো, যেভাবে মামী ওকে বসিয়ে রেখে গেছে। হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো। হাসান আস্তে করে দরজা ঠেলে ঢুকলো। একবার বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো নয়না বসে আছে ঠায়। হাসান দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। এখন নয়নার কাছে গেলে ওকে আস্ত রাখবে না। হাসান আস্তে আস্তে পা টিপে বারান্দায় যেতে চাইলো, তার আগেই নয়না তাকে ডাকলো- “হাসান ভাই, এদিকে এসো?”

হাসান নয়নার কাছে এসে দাঁড়ালো। নয়নার মুখে ভাই ডাক শুনে ফিক করে হেসে দিলো। নয়না কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে – “নিয়া আমায় সব বলে দিয়েছে। ” একথা শুনেই হাসান ঘামতে শুরু করেছে “ক…কি…বলেছে?””তোমার সব প্ল্যান বলে দিয়েছে আমায়। তুমি কিভেবেছিলে আমি কিছু জানতে পারবো না?””তা ভাববো কেন? একদিন না একদিন তো জানতেই!”নয়না উঠে দাঁড়ালো। ছুটে এসে হাসানের পাঞ্জাবির কলার ধরলো- “কেন করলে এমন? আমি কি করেছি তোমার?” “কিছুই করনি আবার করেছো। মনে আছে, একবার তানিয়া আপুর বিয়েতে একটু মজা করেছিলাম বলে তুমি আমায় চর মারলে? তবে সেটা বড় কথা না! বড় কথা হলো আমি সেই চর খেয়ে তোমার প্রেমে পরলাম। কিন্তু তুমি যে রাগি! জানি তুমি কখনো রাজি হতে না, তাই এই প্ল্যান করতে হলো।” নয়না খেয়াল করলো হাসান একটুও তোতলাচ্ছে না। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথাগুলো বললো।

“বিয়ে করলেই বুঝি পাওয়া হয়ে যায়?” হাসান শব্দ করে হাসলো একটু। দু’হাতে নয়নার কোমর জড়িয়ে ধরলো। নয়না নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো, হাসান আরো চেপে ধরলো নয়নাকে- “এই যে দেখো, এতোক্ষণ নিজে ধরে ছিলে কিছুই হলো না, যেই আমি ধরলাম ওমনি তোমার নড়াচড়া শুরু হয়ে গেলো? ” হাসানের কথা শুনে নয়না স্থির হয়ে গেলো। হাসান নয়নার নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলে- “বিয়ে করে তোমায় অর্ধেক পেয়ে গেছি। বাকি অর্ধেকও পেয়ে যাবো। তোমার মন জয় করা আমার দুদিনের ব্যাপার। এই যে দেখে তোমার চোখে চোখ রেখেছি, আর তুমি আমার চোখের মাঝে ডুবে যাচ্ছো।” এ কথা শুনে নয়না হাসানের চোখে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। দূর্বল গলায় বললো- “ছাড়ো আমাকে? ” হাসান নয়নাকে আরো একটু কাছে নিয়ে এলো, যতটুকু কাছে আনলে একে অপরের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। তারপর চট করে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে- “ভয় পেয়ো না, কিছু করবো না। তবে বেশিদিন না। তুমিই চলে আসবে আমার কাছে। আমার ভালোবাসার জোরেই আসবে, দেখো?” “এহহহ, কখনোই না।”

নয়না বললো বটে কিন্তু নিজের কাছেই নিজের গলা অচেনা লাগছে। এ কি হলো নয়নার? হাসানকেও আর আগের মতো অসহ্য লাগছে না। এটা কি বিয়ের আছর হচ্ছে নাকি ওর ওপর! আর নাকি হাসানের সুন্দর করে কথা বলা, পুরুষালী আচরন একেবারে মুগ্ধ করে দিচ্ছে নয়নাকে! এতোদিন যে হাসানকে চিনতো, এই হাসান যেন একেবারে নতুন মানুষ! এতোটুকুও তোতলাচ্ছে না, একটুও নার্ভাস হচ্ছে না!

“এই যে ম্যাডাম, কি ভাবছেন? আজকেই আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন নাকি?” নয়না লজ্জা পেয়ে হাসানের বুকে মুখ লুকালো। “বাব্হা, না চাইতেই বৃষ্টি! একেবারে বুকে চলে এলে?” “তুমি খুব খারাপ হাসান…” নয়না কথা শেষ করার আগেই হাসান ওর মুখে হাত চাপা দেয়, কানে ফিসফিস করে- “ভাই বোলো না যেন? তোমার স্বামী হই এখন?” নয়না আরো একপ্রস্থ লজ্জা পেলো। হাসান তাকিয়ে আছে অপলক নয়নার দিকে, কি সুন্দর লাগছে নয়নাকে। একেবারে সাক্ষাৎ পরী যেন! নয়না হাসানের তাকিয়ে থাকা দেখে জিজ্ঞেস করে-

“কি দেখছো এমন করে?”
“আমার পরীটাকে। কি সুন্দর যে লাগছে?”
“ধ্যাত!”
“নয়ন!”

নয়নার বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো হাসানের ডাক শুনে। শরীরময় ভালোবাসার বান ছুটলো যেন! এ কেমন অনুভুতি! নয়না কাঁপা কাঁপা গলায় বললো- “কি?” “খুব ভালোবাসি তোমাকে। খুব খুব বেশি ভালোবাসি।”

নয়না কিছু বলে না। কি যে এক অদ্ভুত মাদকতা এই ভালোবাসা শব্দটায়! শুধু কি ভালোবাসা নাকি পবিত্র ভালোবাসা? বিয়েটা যে সম্পর্কটাকে একটা পবিত্র বাধনে বেঁধে দিলো? নয়না শুধু ভালোবাসার অনুভূতি অনুভব করতে চায়। ও চুপচাপ হাসানের বুকে মুখ গুজে থাকে। হাসানের হৃৎস্পন্দনের শব্দ শোনে। মনেমনে বলে-
“আমিও একদিন বলবো তোমাকে। সেদিন নিশ্চয়ই পৃথিবীটা অন্যরকম লাগবে আমাদের কাছে? সেদিন খুব তাড়াতাড়ি আসবে হয়তো? ততদিন তোমারটাই না হয় শুনবো সকাল, দুপুর, রাত?”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত