প্রফুল্লদা ও ঢিংকাচিকা

প্রফুল্লদা ও ঢিংকাচিকা

প্রফুল্লদা জ্ঞানী মানুষ। সবাই মানে। সেজন্য তার কথার উপর কথা বলার সাধ্যি এ তল্লাটে কারুর নেই। তবে দোষ বলতে মূলত একটাই। প্রচন্ড কিপটে।

তাঁর পকেট থেকে পয়সা বার করা একপ্রকার অসাধ্য সাধন। বন্ধুদেরকে কখনো একটা লজেন্স খাইয়েছেন সে খুচরো রেকর্ডও তার ঝুলিতে নেই। অনেক অনুনয় করেও কোন পূজো পার্বণে একান্ন টাকার বেশী তার কাছ থেকে আদায় করা অদ্যবধি সম্ভব হয়নি। এনিয়ে সবার ভেতরে একটা চাপা ক্ষোভ জমে আছে।

যদিও কিপটেমীটা এই গল্পে সহকারী নায়ক। আসল নায়ক হল প্রফুল্লদার মুদ্রাদোষ। যেটি তিনি সদ্য আয়ত্ত করেছেন।

প্রফুল্লদা আজকাল মনে ভাবছেন এক, মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আরেক। যা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। এজন্য প্রায়শই সবকিছু গুবলেট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
যদিও নিকট আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, পরিবারের লোকজন প্রায় সকলেই তার এই ব্যপারটি সম্পর্কে জেনে ফেলেছেন তা সত্বেও তারাও মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে ফেলছেন তার উচ্চাঙ্গের ত্রুটিতে।

ব্যপারটা একটু খোলসা করা যাক। মানে ধরুন একদিন দুপুরবেলা প্রফুল্লদার বাড়িতে অনেকদিন ধরে জমিয়ে রাখা তাজা তরমুজটি খেতে ইচ্ছে করল। তিনি তরমুজ বলতে গিয়ে বলে বসলেন —আনারসটা কাটো তো গিন্নী।
এমনতর কথা শুনে গিন্নী তো থ। এই অসময়ে আনারস তিনি পাবেন কোথায়? তারপর অনেকক্ষণ ভেবে, ফলের ঝুড়িটা ঘেঁটে বললেন— তুমি কি শুকিয়ে যাওয়া ঝুনো তরমুজটার কথা বলছো?

প্রফুল্লদা লজ্জার হাসি হেসে বললেন—হেঁ হেঁ হেঁ..ঠিক ঠিক।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন—আরে ছাড়ো তো গিন্নী, সব এক..যাহাই বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন..এজগতে সবই মায়া।

তেমনি একদিন চিলি চিকেনে ক্যাপসিয়াম বেশী দিতে বলতে গিয়ে চিলি বেশী দিতে বললেন। পরে নিজের জালে জড়িয়ে ঝালে ঝোলে চূড়ান্ত নাকানিচুবানি খেলেন। কয়েকবার হেঁচে তারপর কেসে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বললেন—বুঝলে গিন্নী মাঝে মধ্যে ঝাল খাওয়া ভালো..পিত্তনাশক!

আরেকদিন পাড়ার দোকানে টুথব্রাশ বলতে গিয়ে বললেন— দাঁতন দিন তো একটা।
দোকানদার বলল— দাঁতন রাখি না দাদা। আজকাল কাস্টমার নেই।
প্রফুল্লদা বলে উঠলেন– সেকি? দাঁতন নেই?
দোকানদার বলল—এ বস্তুটি আপনি আমার দোকান কেন, এখানে কোন দোকানেই পাবেনা না। নেহাতই যদি দরকার হয় ভোর ভোর হাওড়া স্টেশনে চলে যান। ওখানে পেলেও পেতে পারেন। হালে অবশ্য টুথব্রাশ অনেকেরই সহ্য হচ্ছে না। এপাড়ার নিমাইদা, দিনু ব্যানার্জীর মেজো ছেলে..

টুথব্রাশ শব্দটা কনে আসতে বাকি কথা না শুনে প্রফুল্লদা নিজের মনে একপ্রস্ত ঢিংকাচিকা নেচে নিলেন। তারপর পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বললেন — ঠিক আছে ঠিক আছে। টুথব্রাশই দিন। আসলে এমনিই জানতে চাইছিলাম আর কি!

তেমনি একদিন দোকানে পাঞ্জাবি কিনতে গিয়ে মুখ ফসকে বসলেন বারমুডা। দোকানের কর্মচারীটি তৎক্ষণাৎ তাদের বারমুডার স্টক খুলে কালার আর মেটিরিয়ালস বোঝাতে লাগলো। তিনি মন দিয়ে সেসব দেখে অনেকটা সময় নষ্ট করে বললেন— না না। এইমুহুর্তে এইসব আমার লাগবে না।

দোকানদারের মুখটা কাতলা মাছের মত হাঁ হয়ে গেল।ততক্ষনে প্রফুল্লদা রেগে কাঁই। বললেন— সময় নষ্ট না করে বারমুডা দেখাও ছোকরা..মিডিয়াম রেঞ্জ..দেড় হাজারের মধ্যে।

পাশের কর্মচারীর কান ঝালাপালা করে এই স্টাইলের অন্য কালার, এই কালারের অন্য স্টাইল চেয়ে শাড়ি দেখছিলেন গিন্নী। তিনি বিপদের পোড়া গন্ধ পেয়ে ছুটে এলেন। শুধালেন— তোমার পাঞ্জাবি পছন্দ হল?
পাঞ্জাবি শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্রফুল্লদার মনের মধ্যে আরো একপ্রস্ত ঢিঙ্কাচিকা!
এভাবেই কর্মচারীটি ও প্রফুল্লদা দুজনেই সেযাত্রা মুক্তি পেয়েছিল। প্রফুল্লদা বেরুনোর পর মাথার ওপর দুহাত তুলে নমস্কারও করেছিল সে বেচারা!

এই যেমন সেদিন। শীতের বেলা একটু বাড়তেই সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে শহর ছাড়িয়ে পুকুর ঘাটে চললেন। রোজকার মত ঘণ্টাখানেক তেল মাখতে মাখতে খোসগল্প করে, গায়ে ভিটামিন সমৃদ্ধ রোদ লাগিয়ে ঝটপট ডুব দিয়ে উঠে আসবেন।

হঠাৎই অমিয় সেদিন বলল—গায়ে সরষের তেল মাখা সবচেয়ে বেস্ট। হাড় ভীষন শক্ত হয়।
প্রফুল্লদা বললেন— প্রথমত সবচেয়ে বললে বেস্ট লাগে না। দ্বিতীয়ত কোথা থেকে জেনেছিস? তৃতীয়ত যেখান থেকেই জেনে থাকিস ভুল জেনেছিস।কেরোসিন হল বেস্ট।
সবাই হাঁ করে চেয়ে থাকল তার মুখের পানে চেয়ে।
প্রফুল্লদা বলে চললেন— কেরোসিনের গুনাগুন সরষের তেলের ছেয়ে অনেক বেশী। রোদের সঙ্গে মিশে ভিটামিন D অনেক বেশী পরিমানে তৈরী করে। আর জানিসই তো হাড়ের ও রোগ প্রতিরোধের জন্য এ সব ভিটামিনের বাপ। রিসার্চ বলছে ক্যান্সার প্রতিরোধেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ভিটমিন D. তাছাড়া কেরোসিন সরষের তেলের মত চ্যাটচ্যাটে নয়। চুলে ধূলো ধরে কম। চুল ভালো থাকে।

প্রফুল্লদাযে সেদিন নারকেল তেল বলতে গিয়ে কেরোসিন তেল বলেছিলেন সেটা বুঝতে তাঁর দিনতিনেক সময় লেগেছিল। যখন বুঝলেন তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে তার ঢিংকা-চিকা নাচ দেখে গিন্নী পরের রোববার ভূত তাড়ানোর ওঝা ডেকে এনেছিলেন। যদিও বন্ধুরা এ কেসটা আজঅব্দি জানে না।

আরেকদিন প্রফুল্লদা সকলের সামনে কূঁয়োর জল পরিস্কার করতে ব্লীচিং এর স্থানে ফিনাইলের জুড়ি নেই বলে জব্বর এক ভাষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু আজো সেই ফিনাইল রহস্যের কিনারা হয়নি বন্ধুমহলে।

সমস্যার যদি এখানেই শেষ হত তবু ভালো হত। কিন্তু না। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, আজকাল মাঝেমাঝে এক একটা সময় আসছে যখন তিনি কোন কিছুই মনে করে উঠতে পারছেন না। গুরুমস্তিস্ক ব্ল্যাঙ্ক হয়ে পাগলের মত করছেন। মাথার চুল খুচলে, —ইয়ে..আরে ইয়ে..বুঝতে পারছ না! ..আরে ইয়ে..বলে যাচ্ছেন।

কোন হিন্টস ছাড়া কুইজ অসাধ্য বুঝতে পেরে সবাই হাঁ করে তাকে ফোকাসে রেখে তাকিয়ে থাকছে। কেও উল্টোপাল্টা সাজেশনও দিচ্ছে। তখন তার অবস্থা হচ্ছে দেখবার মত। নিজের নামটাও এই বুঝি ভূলে যান! শেষমেষ ঘেমে নেয়ে উপায় না পেয়ে তিনি শেষ অস্ত্র হিসেবে অঙ্গভঙ্গীর মতো আদিম পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। হাত পা নেড়ে ব্যাপার বা বস্তুটিকে বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন প্রফুল্লদা।

কিন্তু তাতে কি? ব্ন্ধু বান্ধবরা এখন আর সঠিক কথাটা সঠিক সময় মনে করিয়ে দেয় না। উল্টে সাহায্যের নামে উল্টোপাল্টা বলে তাকে বিপদে ফেলে মজা নেয়। পকেট থেকে পয়সা খসানোরও অন্যায় দাবী করে। যদিও তাকে অদ্যবধি টলানো যায় নি।

এই যেমন আগের রবিবার। সকাল সকাল সব্জি বাজার সেরে দশটা নাগাদ ঠেকে গুলতানি মারতে বসেছেন।
মিলন বলল–শুনেছি সবুজ রংটা চোখের জন্য ভালো। তাই সকালে ফ্রেশ হয়ে আমি নিয়মিত আমার বাগানে কাজ করি। নতুন চারা পুঁতি। পুরনো গাছের জল দিই। মনটা বেশ ঝরঝরে লাগে।
প্রফুল্লদা বললেন— এটা তুমি ঠিক বলেছ মিলন। এই নেশাটা আমার অনেক পুরনো নেশা। তবে এখন আর সময় পাইনা। তাছাড়া ইয়েটা যে কোথায় রেখেছি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
প্রফুল্লদার কথায় ইয়ের গন্ধ পেয়ে সজাগ হয়ে উঠল সকলে।
তারপর একসাথে সবাই বলে উঠল—কি খুঁজে পাচ্ছনা প্রফুল্লদা?
প্রফুল্লদা বলল—আরে ইয়েরে ভাই। পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছেনা।
কোনমতেই যাতে প্রফুল্লদার সাহায্য না হয় এমন একটা বস্তু খুঁজে বের করে মিলন বলল— তুমি কি ছাতার কথা বলছ?
প্রফুল্লদা রেগে উঠলেন। বললেন —ধূর ছাতার মাথা! বাগানে ছাতা নিয়ে কি করব বলতে পারিস? আরে ইয়ে রে ইয়ে..
একথা বলে গিটারে রিদম বাজানোর মত করে হাতটা ঝাঁকিয়ে নিলেন প্রফুল্লদা।
মিলন বলল— আরে রেগে যাচ্ছ কেন? আজকাল বাগানে ছাতা টাঙিয়ে নীচে টেবল চেয়ার পেতে লোকজন জলখাবার খায় কি না? সেজন্যই বললাম।

বাকিরা সবাই ঠিক ঠিক বলে সমর্থন জানালো। তারপর যাতে কোনমতেই প্রফুল্লদার স্মরনে না আসে সেই চেষ্টা চালাতে লাগলো। কেও বলল — রাংতা? কেও বলল– ফাতনা? কেও বলল— আলু?
প্রফুল্লদা চূড়ান্ত রেগে যেতে যেতেও থমকে গেলেন। তারপর সামলে বললেন– আরে লাগাতে গেলে লাগে যেটা। ইয়ে রে ইয়ে..
একথা বলে মাথার সামনের কয়েকটা চুল অ্যান্টেনার মত উপরে তুলে মুখ খিচিয়ে ভাবতে লাগলেন।
একজন বলে উঠল– আলুর বীজ?
অন্য একজন বলল — বীজ কাটার ছুরি?
প্রফুল্লদা তখন রীতিমত ঘামতে শুরু করেছেন। বললেন—আরে ইয়ে খুঁড়তে লাগে..
অমিয় বলল— সিঁদ কাঠি?
অমিয় দা বিরক্তির চরম অবস্থায় পৌছে বললেন— কিছুটা ওই রকমই।
তারপর কাঁদুকাঁদু মুখে বললেন—ওরে জীবনটা শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে রে। আমাকে তোরা বাঁচা ভাই।

সবাই তখন প্রফুল্লদাকে পেয়ে বসেছে। একজন বলল–আজ তাহলে খাসিমাংস ভাতের ফিস্টি দেবে বলো?
প্রফুল্লদা বলল—তোরা যা চাইবি তাই খাওয়াবো। শুধু আমাকে এযাত্রায় উদ্ধার কর।
অমিয় বলল—খুপরি?
প্রফুল্লদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলে উঠলেন— হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ।
তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন—ওরে কেউ জীবনে আমার এতবড় উপকার করেনি রে..
তারপর মনের আনন্দে ঢিঙ্কাচিকা ঢিঙ্কাচিকা গাইতে গাইতে একপ্রস্ত নেচে ফেললেন।
বন্ধুরা তার মত রাশভারী লোককে নাচতে দেখে অবাক!

হ্যাঁ। সেদিন রাত্রে খুব বড় ফিস্ট হয়েছিল। খাসির সঙ্গে যতখুশী গোপালভোগও খাইয়েছিলেন। যদিও কেও চারটের বেশী টানতে পারেনি।
এরপর প্রফুল্লদা বন্ধুদের সঙ্গে আর কার্পণ্য করেননা। যদিও বন্ধুরা তাকে ওই ব্যপারে বিরক্ত করতে মোটেই ছেড়ে দেয়নি।

কিন্তু পূজোর চাঁদার ব্যপারে? তাঁর সেই এক গোঁ..কেঁদেকেটে একান্ন! এখানেও সেই আগের পদ্ধতিটি ব্যবহার করে তাঁকে জব্দ করে ঢিংকাচিকা নাচের সুযোগ খুঁজছে অমিয়রা।

©সন্দীপ লায়েক

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত