ফটিক মিত্র লেন উত্তর কলকাতার একটা ছোট্টো পাড়া| সব বাড়িই বহু বছরের পুরানো আর গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে| হঠাৎ কেউ এই গলিতে ঢুকলে নিজেকে পুরোনো যুগের মানুষ বলে মনে করতেই পারেন|
এই ফটিক মিত্র লেন যাঁর নামে .. তিনি ছিলেন তখনকার দিনের নাম করা ডাক্তার| আর মিত্র বাড়ি এই পাড়ার সব থেকে পুরানো বাড়ি| কিন্তু, সেই বাড়ির ভগ্নদশার জন্য সেখানে আর কেউ বসবাস করেন না…তা ও প্রায় বিশ বছরের উপর বাড়িটা ফাঁকা পরে আছে…শরিকী ঝামেলার জন্য প্রোমোটারেরাও থাবা বসাতে পারেনি|
হঠাৎ একদিন দেখা গেলো সরু মতো ঢ্যাঙা একটা লোক আর প্রায় চার ফুট উচ্চতার একজন মহিলা অনেক পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে সেই মিত্র বাড়িতে ঢুকছে!
গলির মুখে বিনুদার চায়ের দোকানের সকালবেলার বিনি পয়সার খবরের কাগজ পড়ুয়াদের চোখের সামনে দিয়ে সদর্পে তারা গিয়ে মিত্র দের ভাঙা বাড়িতে যখন ঢুকে পড়েছে… তখন সকলের টনক নড়লো| দুজন অজানা অচেনা মানুষ পাড়ায় একটা ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে গেলো কাউকে কিছু না জানিয়ে!
মাতব্বর গোছের দু চার জন গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ওনাদের পরিচয় জানতে চাইলেন| ভদ্রলোক বেড়িয়ে এসে বললেন… তিনি নাকি মিত্রদের ছোটো তরফের বড় ছেলের শালা| ওনার গলার স্বরে এমন একটা আত্মবিশ্বাস ছিলো যে সবাই চুপচাপ চায়ের দোকানে ফিরে এলো| তবে সেদিন থেকে সারা পাড়ার একমাত্র আলোচ্য বিষয় হয়ে গেলো সেই দম্পতি|
কিন্তু, কিছুদিনের মধ্যে সারা পাড়া জুড়ে এমন উৎপাত শুরু হলো যে কারোর নজর আর নতুন আগন্তুকদের দিকে রইলোনা|
মিত্র বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িটা পানু দের| পানুর বাবার ৯০ বছর বয়সী ঠাকুমা মাঝেমধ্যেই বাড়ির সকলের সাথে ঝগড়া করে ছাদে উঠে পানুর ছোটো বোনের খেলার তাঁবু টাঙিয়ে থাকেন …সেই তাঁবু কে যেনো মাঝরাতে উড়িয়ে নিয়ে দাসেদের নারকেল গাছের মাথায় রেখে এসেছে| সেই নিয়ে বুড়ি চিৎকার করে পাড়া মাথায় করে তুলেছে|
আবার পাড়ার মনোহর বাবুর আদরের কুকুর জিকোর গলার চেন খুলে নিয়ে কে যেন নাড়কেল দড়ি পরিয়ে দিয়ে গেছে| কেউ বুঝতেই পারছেনা যে জিকোর মতো মারকুটে কুকুরের গলার চেন খোলার সাহস কার হলো| পাড়ার রকবাজ বুড়ো গনু বাবুকে আবার কে নাকি পেছন থেকে খালি জনার্দন বাবু বলে ডাকছে| জনার্দন বাবু হলো ওনার বাড়িওয়ালা… আর দুজনের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক| ঠাকুর মশাই মনোজবাবুর একটু পরিস্কার বাতিক আছে… তাঁর বাড়ির সামনে কে একগাদা মাছের আঁশ ফেলে দিয়ে গেছে… সকাল বেলা ঘরের বাইরে পা দিয়েই তিনি পাড়ার ছেলে – ছোকরা দের গুষ্ঠি উদ্ধার করে চলেছেন| পাড়ার বয়োঃজ্যেষ্ঠ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার সাহাবাবু.. কেউ ওনার কাছে গেলেই প্রথমেই, “হাঁ করতো মনা” বলে খানিক ওষুধ খাইয়ে দিয়ে তারপরে রোগের কথা শোনেন.. তাঁকে কে যেন ঘুমের মধ্যে “হাঁ করতো মনা” বলে টিংচার আইডিন খাইয়ে দিয়েছে|
সব মিলিয়ে এক ভয়ানক পরিস্হিতি … কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেনা|
পাড়ার মাতব্বরেরা সবাই মিলে বিনুদার চায়ের দোকানে রবিবার সকালে আলোচনায় বসলেন| কিন্তু, আলোচনা কিছুতেই এগোয় না.. কেউ বলে ভূতুরে কান্ড আবার কেউ বলে পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের কাজ| নিজেদের মধ্যে ঝামেলার চোটে আলোচনা প্রায় বন্ধই হয়ে যাওয়ার অবস্হা|
এরমধ্যে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে পানুর বাবাকে দেখা গেলো দু টো কালো বিড়াল ছানা হাতে নিয়ে হন্ হন্ করে বড় রাস্তার দিকে চলেছে|
সবাই ঝগড়া থামিয়ে পানুর বাবা কানুকে দেখছে| এমন সময়ে গনু বাবু গলা তুলে চেঁচিয়ে বললেন,
“এই যে কানু…বলি পাড়ায় এতো জরুরী একটা মিটিং চলছে সেখানে তোমরা কেউ এলেনা তো! আবার বিড়াল ছানা নিয়ে কোথায় চললে?”
কানু কিরকম একটা অপ্রস্তুত মুখে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললো, “পরে এসে বলছি কাকা|” -“উঁহু…পরে টরে হবে না| এখনি বলো|”
-“আজ্ঞে.. এই দুটোকে ছেড়ে আসি আগে|”
-“এতো জন মান্যি গন্যি মানুষের ডাক উপেক্ষা করে বেড়াল ছানাদের বেড়াতে নিয়ে যাবে সে হবেনা কানু|”
– “রাগ করেন কেনো কাকা? এগুলো শুধু বিড়াল নয়…ভূত|”
এবারে উপস্হিত জনগণের মধ্যে একটা অস্হিরতা দেখা গেলো|
সাহা ডাক্তার বললেন, ” এই বিড়াল ছানা গুলো ভূত? গুরুজনদের সাথে মজা করছো?”
– ” না না মজা করবো কেনো ডাক্তার বাবু? বিগত কয়েকদিন ধরে সারা পাড়ায় যে সব অদ্ভুত কান্ড কারখানা চলছে … তার মূলে এরা|”
– “অ্যাঁ ..ইয়ার্কি? দু টো বিড়াল ছানা ভূত আর তারা এতসব করছে ?”
– ” তাহলে প্রথম থেকে বলতে হয়… আপনারা সকলেই জানেন পুরো পাড়ার সকলের মতো আমাদের পরিবারের সাথেও অনেক অদ্ভুত কান্ড কারখানা ঘটছে কদিন ধরে| আমার ঠাকুমা মাঝে মাঝেই রাতে বাড়ির ছাদে তাঁবু খাটিয়ে শুতেন… এই উৎপাতের জন্য তা ও কদিন বন্ধ| গতকাল রাতে আমার মায়ের সাথে ঝগড়া করে ঠাকুমা আবার ছাদে ওঠেন… এবং দেখেন মিত্র বাড়ির নতুন দুই বাসিন্দা ছাদের ওপরে নৃত্য করছে এবং তাদের পা দুটো শূন্যে! ভয় পেয়ে উনি নিজের হাতের রুদ্রাক্ষের মালাটা ওদের দিকে ছুঁড়ে দেন| আশ্চর্যের ব্যপার সঙ্গে সঙ্গে ওরা মিলিয়ে গিয়ে দু টো কালো বিড়াল ছানা হয়ে যায়| ঠাকুমা চিৎকার করে আমাদের সবাইকে ডাকেন| আমি আর আমাদের চাকর টাকলু টর্চ নিয়ে মিত্র বাড়িতে গিয়ে দেখি …বাড়ি বেবাক ফাঁকা! কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন মাত্র নেই… এমনকি প্রচন্ড ধুলো আর ঝুল| ভাঙ্গা সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে এই বেড়াল ছানা দুটোকে পাই| সারা রাত এদের পাহারা দিয়ে সক্কাল বেলা গুরুদেব কে ফোন করলাম| উনি সব শুনে বললেন এরা ভূত| তাই এদের পার করতে হবে|”
– ” কিন্তু, ওই রাতের অন্ধকারে তোমার ঠাকুমা এতো কিছু দেখলেন কী করে?”
– “আহা…কাল রাতে তো পূর্ণিমা ছিলো |”
– “তা এদের কোথায় নিয়ে চললে?”
-” আজ্ঞে… গুরুদেব বলেছেন… এদের নিমতলার শিব মন্দিরে ছেড়ে আসতে… তাই যাচ্ছিলাম|”
-“আচ্ছা… আচ্ছা… যাও যাও| শুভ কাজে বিলম্ব কেনো?”
কানু বিড়াল ছানা গুলো নিয়ে চলে যেতেই সকলে মিলে চললেন মিত্র বাড়ি.. সরেজমিনে তদন্ত করতে|
আশ্চর্য ব্যপার …সত্যিই পুরো বাড়িতে কোনো মানুষের চিহ্ন নেই! দু দুটো মানুষ একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেনো!
তারপর থেকে ফটিক মিত্র লেন আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছে … আর কোনো সমস্যা নেই|
তবে সাবধানের মার নেই| আপনারা কেউ যদি নিমতলার শিব মন্দিরে দুটো কালো বিড়াল ছানা দেখেন…ভুলেও যেন মায়া করে বাড়িতে নিয়ে যাবেন না