আর বাঁচার ইচ্ছা নেই, জীবনটা তো ফালতুই হয়ে গেছে। পায়ে হেঁটে হাওড়া ব্রীজের মাঝ বরাবর চলে এসে, নীচে গঙ্গা নদীর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো স্মরণ।
হঠাৎ, ঠাকুমার গলায় স্পষ্ট শুনতে পেলো-
আত্মহত্যা মহা পাপ নরকে গমন।
ঠাকুমা প্রতিদিন সুর করে গীতা পাঠ করতেন, তাই হয়তো জীবনের চরম সময়ে সেটাই মনে হলো! নাহলে প্রায় বছর দশেক আগে মৃতা ঠাকুমা কোথা থেকে আসবেন?
হুঁহ্, নরক! এই জীবনটাই বা নরকের থেকে কম কিসে? বাবা ক্যানসারে নিজে ভুগে আর অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও পুরো পরিবার কে ভুগিয়ে গত মাসে চলে গেছেন। ঠিক তারপরই একদিন জানা গেলো যে, বাবা ওদের ছোট্টো দু কামরার বাড়িটা চড়া সুদে বন্ধক রেখে গেছেন| সেই শুনে মায়ের দুর্বল হৃদয় সহ্য করতে পারলোনা, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। হাসপাতালে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে তিনি জীবন্মৃত হয়ে ঘরে ফিরলেন আর সাথে স্মরণের ধারও খানিক বাড়িয়ে দিলেন। একটা ছোট্টো দোকানে খাতা লেখার কাজ করে আর বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে স্মরণ এই দেনা কিভাবে সুদবে ভাবতেই পারছেনা।
উফ্! এরপর তো বাড়ি থেকে লোকজন ধাক্কা মেরে বার করে দেবে। অসুস্হ মা কে নিয়ে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে? তার থেকে মরে যাওয়াই ভালো।
চোখ বন্ধ করে শেষবারের মতো মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো স্মরণ। আবার চোখ খুলে সন্ধ্যের মায়াবী আলোয় শহরের ঝলমলে ছবির দিকে তাকিয়ে চোখের কোন থেকে একফোঁটা জল বাঁ হাতের চেটোয় মুছে নিলো। শহর তারমতোই থাকবে, কোনো কিছুই বদলাবেনা। শুধু স্মরণের নামটা সকলের কাছ থেকে মুছে যাবে আর মা ও হয়তো সেই শোক সহ্য করতে না পেরে মারা যাবেন।
অবশ্য মা যদি এরপরেও বেঁচে থাকেন তবে যে কী হবে ভাবতেই ভয় করে। নাহ্, আর ভাববেনা কিছু স্মরণ। চোখ বন্ধ করে সবে ঝাঁপ দিতে যাবে এমন সময়ে ডান হাতে নরম একটা স্পর্শ পেয়ে ঘুরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। একটা রং চং মাখা, অদ্ভূত সাজগোজ করা লাস্যময়ী মেয়ে ওর হাতটা চেপে ধরে আছে! দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ্যা।
– আহ্! ছাড়ুন আমার হাত।
– না, ছাড়বোনা। আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে।
– আশ্চর্য ব্যাপার! আপনাকে চিনিনা, জানিনা- কেনো যাবো আপনার সাথে? আপনাকে দেখেই আপনার চরিত্র বোঝা যাচ্ছে।
– বাহ্, আমায় দেখেই চরিত্র বুঝে গেলেন? আপনি কিরকম ভালো চরিত্রের মানুষ মশাই? সত্যি বলতে, আপনার কোনো চরিত্রই নেই নাহলে আত্মহত্যা করতে যান?
– আপনি কিভাবে জানলেন আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি? যত্তসব!
– সে আপনার হালচাল দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে, আর আমি তো লোক চড়িয়ে খাই তাই ভালোই বুঝি। দুঃখটা কিসের? চাকরি গেলো না প্রেমিকা পালালো?
– যদিও আপনাকে বলাটা বাধ্যতামূলক নয় তবুও বলি, আরো জটিল ব্যাপার। অনেক দেনা রেখে বাবা ক্যানসারে মারা গেছেন। আর সদ্য মায়ের অসুস্হতায় আমাকে আরো দেনা করতে হয়েছে। মৃত্যু ছাড়া আর গতি নেই। আপনি এবারে মানে মানে কেটে পড়ুন।
– আপনার মা কি মারা গেছেন নাকি?
– না, মা জীবন্মৃত অবস্হায় বেঁচে আছেন।
– চমৎকার! মা অসুস্হ, বাবা নেই আর আপনি ড্যাং ড্যাং করে মা কে দেনার মধ্যে ফেলে মরতে চললেন?
– দেখুন, আপনার মতো ফালতু মেয়ে মানুষের জ্ঞান আমি শুনবোনা।
– সেই তো! তা শুনবেন কেনো? শুনলে তো আপনার পৌরুষে লাগবে। তার থেকে অসহায় মা কে ফেলে মরে যাওয়াও ভালো। আমার গল্পটাও মরার আগে শুনে যান। আমার বাবা-মা রোড এ্যাক্সিডেন্টে মারা যান আজ থেকে দশ বছর আগে। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়তাম। ছোটো ভাইকে নিয়ে অসহায় অবস্হা। যদিও বাবার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়ির ভাগ ছিলো। তখন পাড়ার এক দিদির সাহায্যে আমি পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা মানে দেহব্যবসায় নামি। আমি তাও অসহায় ভাইকে ফেলে মরার কথা ভাবিনি। পালাবো কেনো বলুনতো? ভাইকে পড়াশোনা শেখাতে থাকি দাঁতে দাঁত চেপে। গতকাল আমার ভাই চাকরি পেয়েছে। আমি ওর পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের ভবিষ্যতের জন্য টাকাও জমিয়েছি বেশ কিছু। আসলে আমার নিজের মতে শুধু মনেরই দাম আছে, শরীরের কানা কড়িও দাম নেই। অন্য ছোটোখাটো কাজ করলে ভাইকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে পারতামনা। যাইহোক, আজ আমি দায়িত্ব মুক্ত তাই নিজের একটা দোকান খুলতে চাই। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন? ধার দেনা আমি শোধ করে দেবো। না হয় আরো কিছুদিন আদিম ব্যবসা চালাবো। এখন চলুন মায়ের কাছে যাই।
স্মরণ শুধু অস্ফুটে বললো,
– কেনো?
– কিসের কেনো? আমার নিজের মা পাবো সেটাই যথেষ্ট। তাছাড়া, ওপরওয়ালার কাছে ভালো কাজের জন্য দুটো নম্বরও পাবো। সং এর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে জলদি চলুন।
– ইয়ে মানে…. আপনার নামটা তো জানা হলোনা।
– আমার তো অনেক নাম। আপনার জন্য আমার নাম আশা। এবার তো চলুন।
*********** সমাপ্ত****************