আইসক্রিম

আইসক্রিম

রিকশাতে উঠার কিছুক্ষণ পর শ্রাবণী খেয়াল করলো রিকশার হুট উপরে তুলা যায় না। শ্রাবণী তখন রিকশা ওয়ালাকে বললো,

— মামা, হুটটা উপরে তুলে দেন তো?  রিকশাওয়ালা পান খাওয়া লাল দাঁত গুলো বের করে হাসি দিয়ে বললো,

~আফা, রিকসার হুটে সমস্যা। উপরে তুলুন যায় তো না..

কথাটা শুনে শ্রাবণীর মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। এই ভর দুপুরে গরমের মাঝে রিকশার হুট বাদে ও কিভাবে যাবে।আর এখন যদি রিকশা থেকে নেমে যায় তাহলে অন্য রিকশাও পাবে না। গরমে শ্রাবণীর সারা শরীর ঘামতে লাগলো। আর ফর্সা মুখের মাঝে গোলাপি রঙের আভার সৃষ্টি হলো রিকসা এখন ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে আছে। শ্রাবণী টিস্যু দিয়ে বারবার ওর মুখের ঘাম পরিষ্কার করছে। এমন সময় নীল টিশার্ট আর চোখে কালো সানগ্লাস পড়া একটা ছেলে শ্রাবণীর সামনে এসে বললো,

~ আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি এই গরমে খুব অস্বস্তিতে আছেন। এই আইসক্রিমটা খান দেখবেন ভালো লাগবে।

এই কথাটা বলে শ্রাবণীর হাতে ছেলেটি আইসক্রিমটা দিয়ে চলে গেলো। শ্রাবণী অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে লক্ষ্য করলো। ছেলেটিকে দেখেই রাস্তার পাশে থাকা কতগুলো ছোট ছোট টুকাই ছেলে মেয়ে ঘিরে ধরলো আর ছেলেটি তখন সবাইকে আইসক্রিম কিনে দিচ্ছিলো। নীল টিশার্টে ছেলেটিকে অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগছিলো। প্রথম দেখেই কাউকে ভালোবেসে ফেলা এই কথাটা শ্রাবণী বিশ্বাস করতো না কিন্তু আজ তার সাথেই এমন ঘটনাটা ঘটলো। শ্রাবণী রিকশা থেকে নেমে ছেলেটির সামনে চুপচাপ দাড়ালো। ছেলেটি শ্রাবণীর দিকে তাকাতেই শ্রাবণী বললো,

— আপনার ফোন নাম্বারটা দিবেন?

শ্রাবণী এই কথাটা বলে নিজেই চমকে গেলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো, বেহায়ার মত এই আমি কি বললাম। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার চলে গেলো। আর শ্রাবণী ছেলেটির এই মুচকি হাসি দেখে ওর সারা শরীর নিথর হয়ে গেলো। একটা ছেলের হাসি যে এত সুন্দর হতে পারে সেটা এই ছেলেকে না দেখলে ও বুঝতো না…

এই ছেলে আইসক্রিম দেওয়ার পর থেকেই শ্রাবণীর মাঝে এক অদ্ভুত পরিবর্তন হওয়া শুরু হলো। সে এখন সারাক্ষণ আইসক্রিম খায়।এমন কি রাত ৩ টার সময় দারোয়ানকে দিয়ে আইসক্রিম আনিয়ে ও খায়। শ্রাবণীর বাবা মা প্রথমে ভেবে ছিলো এই গরমের জন্য হয়তো তাদের মেয়ে এত আইসক্রিম খায় কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাদের মেয়ের কোন সমস্যা হয়ছে। অতিরিক্ত আইসক্রিম খাওয়ার জন্য শ্রাবণীর এখন ১০৪° জ্বর। শ্রাবণীর মা শ্রাবণীর মাথায় হাত বুলিয়ে কান্নাভেজা চোখে বললো,

~মারে, তোর কি হয়েছে? তুই সারাক্ষণ আইসক্রিম খাস কেন? শ্রাবণী অনেক কষ্টে চোখ মেলে ওর মার দিকে তাকিয়ে বললো,

— মা, আমি আইসক্রিম খাবো….

শ্রাবণীর পাগলামো দিন কে দিন বাড়ার ফলে ওর বাবা মা ওকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার সব কিছু পরিক্ষা করে বললো, আপনার মেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ। ওর কোন সমস্যা নেই। মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে দিয়ে দেন সব ঠিক হয়ে যাবে আফজাল সাহেব রোজ সকালের মত আজকেও পত্রিকার কাগজ নিয়ে বসেছেন আর চা খাচ্ছেন। এমন সময় দরজায় কলিংবেলর আওয়াজ হলো। তিনি দরজা খুলে দেখলেন ২২- ২৩ বছরের একটা খুব সুন্দরী মেয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে। তিনি বললেন,

~কাকে চাই?? মেয়েটি আইসক্রিম খাওয়াটা শেষ করে বললো,
— আমি আফজাল সাহেবের কাছে এসেছি।
~আমিই আফজাল আহমেদ ।
— আংকেল, আমার নাম শ্রাবণী।আপনার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে। প্লিজ একটু ভিতরে চলুন। শ্রাবণী সোফায় বসতে বসতে বললো,
— আসলে আংকেল, আজ বিকালে আপনারা যে মেয়েকে দেখতে যাবেন আমি সেই মেয়ে আফজাল সাহেব কিছুটা অবাক হয়ে মেয়েটিকে বললো,
~তা মা, হঠাৎ তুমি এইখানে কেন?
— আসলে আংকেল আমি আপনাকে কিছু সত্যি কথা বলতে এসেছি।

আমি জানি এই কথা গুলো আমার বাবা মা আপনাদের বলবে না। তাই আমি নিজেই বলতে চলে এলাম। আসলে আংকেল, আমি প্রেগন্যান্ট। একটা ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো। ছেলেটা যখন জানতে পারলো আমি প্রেগন্যান্ট তখন থেকে সে আমার সাথে কোন যোগাযোগ করছে না। তাই বাবা মা চাইছে মান সম্মানের ভয়ে আমাকে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিয়ে দিতে। আফজাল সাহেব মন দিয়ে চুপচাপ মেয়েটির কথা শুনছিলেন। মেয়েটি কথা বলার এক পর্যায়ে যখন কেঁদে দিলো তখন আফজাল সাহেব মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বললো,

~মা তুমি কেঁদো না। আমি অবসর প্রাপ্ত কর্ণেল আফজাল আহমেদ বলছি, এই ছেলেটিকে খুঁজে বের করে তোমার সাথে বিয়ে দেওয়ার দ্বায়িত্ব আমার। আর এইসব ছেলেদের কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় সেটা আমি জানি পিয়াস আজ অফিস যায় নি কারণ ওর বিয়ের জন্য আজ তার বাবার সাথে মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা। ওর মা হঠাৎ করে মারা যাওয়ার পর থেকেই ওর বাবা চাইছে ও যেন বিয়ে করে। ড্রয়িংরুমে এসে পিয়াস তার বাবাকে বললো,

– বাবা, মেয়ে দেখতে কয়টার সময় যাবে?  আফজাল সাহেব মুখটা গোমড়া করে বললো,

~ মেয়ে দেখতে যাওয়ার দরকার নেই। মেয়েই এইখানে চলে এসেছে পিয়াস তার বাবার কথা শুনার পর খেয়াল করলো একটা মেয়ে তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। পিয়াস কিছু বলতে যাবে এমন সময় মেয়েটি তার বাবাকে বললো,

–এ কি আপনার ছেলে?? আফজাল সাহেব বললেন,
~ হে ও আমার ছেলে পিয়াস।ওর বিয়ের জন্যই তোমাকে আমারা দেখতে যেতে চেয়েছিলাম। শ্রাবণী তখন কান্না করতে করতে পিয়াসকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— তুমি এমনটা করতে পারলে? আমি প্রেগন্যান্ট দেখে তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে। কতবার তোমায় ফোন দিয়েছি কিন্তু তোমার ফোন অফ। কোন যোগাযোগ তুমি আমার সাথে রাখো নি। আর এখন তুমি তোমার বাবার সামনে বলবে, তুমি আমাকে চিনোই না। মেয়েটির কথা শুনে পিয়াস অবাক হয়ে মেয়েটিকে সরিয়ে দিয়ে বললো,

-আরে আপনি কে? আর এইসব আপনি কি যা তা বলছেন? শ্রাবণী তখন আফজাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে কান্না করতে করতে বললো,

— আংকেল, আপনার ছেলের বাচ্চায় আমার পেঠে। এখন সে আপনার ভয়ে আমাকে না চিনার অভিনয় করছে। আপনি কথা দিয়েছিলেন আমার বিয়ের দ্বায়িত্ব আপনার। আফজাল সাহেব রাগীরাগী চোখে পিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললো,

~তুই আমার ছেলে হয়ে একটা মেয়ের এত বড় সর্বনাশ করতে পারলি? তকে এই মুহূর্তে এই মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। আর তুই যদি এখন ওকে বিয়ে না করিস আমি তকে এই মুহূর্তে গুলি করে মারবো পিয়াস কিছু বুঝতে পারছিলো না তার সাথে কেন এমন হচ্ছে। আর তার বাবাকেও কিছু বলতে পারছিলো না। কারণ ছোটবেলা থেকেই ওর বাবাকে ও খুব ভয় পাই….

মুহূর্তের মাঝে কি থেকে কি হয়ে গেলো পিয়াস কিছু বুঝতে পারছে না। রাতে যখন বাসর ঘরে না ঢুকে রুমের বাহিরে পিয়াস হাটাহাটি করছিলো তখন আফজাল সাহেব ধমক দিয়ে বললো রুমে যেতে রুমে ঢুকে পিয়াসের ইচ্ছে করছে মেয়েটার গলা চেপে ধরে মেরে ফেলতে। ও মেয়েটাকে চিনেই না আর মেয়েটা বলছে ওর পেঠে না কি তার বাচ্চা। পিয়াস যখন মেয়েটির কাছে যায় তখন শুনতে পেলো মেয়েটির গোমটার আড়াল থেকে কিসের যেন আওয়াজ আসছে। পিয়াস টান দিয়ে গোমটা সরিয়ে দেখে মেয়েটি বরফের টুকরা খাচ্ছে.. পিয়াস তখন অবাক হয়ে মেয়েটিকে বললো,

– কি করছেন আপনি?
— বরফ খাচ্ছি। আপনাদের বাসার ফ্রিজে কোন আইসক্রিম পেলাম না। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছি।
– আপনার সমস্যা কি? আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন?
— আপনার জন্যই তো আমার সমস্যা।

সেদিন আমার হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। তারপর থেকে যে কি হলো আমার আইসক্রিম ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না। আমি আপনার নাম্বার চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি দেন নি। আপনি জানেন আমি আপনাকে পাগলের মত খুঁজেছি। যেখানে আপনি ছেলে মেয়েদের আইসক্রিম খাইয়েছিলেন আমি প্রতিদিন সেখানে গিয়ে বসে থাকতাম কিন্তু আপনাকে পাইনি। এখানে এসেছিলাম আপনারা যেন আমায় পছন্দ না করেন কিন্তু আপনাকে দেখে মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপলো তাই এমনটা করলাম…

পিয়াসের এখন সব মনে পড়লো। সেদিন সে দোকানে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলো খুব সুন্দরী একটা মেয়ে গরমে ঘামছিলো বারবার টিস্যু দিয়ে মুখ পরিষ্কার করছিলো।আর এজন্যই মেয়েটাকে আইসক্রিম দিয়ে ছিলো। কিন্তু সে লক্ষ্য করেনি এই মেয়েটাই সেই মেয়েটা ছিলো। পিয়াস এইবার শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আইসক্রিম খাবে? শ্রাবণী খুব খুশি হয়ে বললো,
— হে

এই নিরিবিলি খোলা রাস্তায় হলুদ সোডিয়ামের আলোর নিচে হাটছে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।মেয়েটার এক হাতে আইসক্রিম আর অন্য হাত দিয়ে ছেলেটাকে শক্ত করে ধরে আছে…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত