সন্তপ্ত সূর্যোদয়

সন্তপ্ত সূর্যোদয়

কনকনে শীত ভালবেসে জড়িয়ে ধরেছে পৃথিবীর দেহটা। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঠার আগেই কাঁধে ঝুলানো ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে এসেছে ওরা। অরণ্য সদ্য কেনা শালটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে খুব আদর করে। ওর মুখ দেখে যে কেউ বুঝে নেবে ওর মনের মাঝে কড়া রোদের উত্তাপ ছড়াচ্ছে তীব্রভাবে! বড় এক বোতল পানি এগিয়ে দিতে দিতে অলি বলে-

-কী হয়েছে তোমার?

রাগে কটমট করে তাকায় পাশে বসা অলির দিকে। বেশ ঝাঁঝালো সূরে বলে–আবার জিজ্ঞাসা করছ কী হয়েছে আমার? একটা পানি আনতে এতক্ষণ লাগে? আর যাবার সময় কী বলে গেলে?

পাশাপাশি বসেছে ওরা দুজন। অরন্য’র কথা শুনে চারপাশটা দেখে নিয়ে অলি নিচু স্বরে বলে-

-আরে দোকান খোলা না থাকলে আমি কী করবো? আর এতো জোরে জোরে কেন কথা বলছ…! সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে!

-কেন আমি চোর নাকি যে ফিসফিস করে কথা বলবো? তাও আশে পাশে দেখে। আমি মিথ্যে শুনতে পারিনা তুমি জানো না?

-আমি কী এমন মিথ্যা বললাম?

অলি অবাক হয়ে আগের চেয়েও নিচু স্বরে কথা বলে। ওদের সীটের পাশের সারিতেই একটা যুবতী মিটিমিটি হাসছে। অলির সাথে চোখাচোখি হতেই মনে হল এই শীতের সকালে সে লজ্জায় দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে।

সে জানে অরণ্যকে থামাতে হলে ওর থেকে উঁচু স্বরে কথা বলতে হবে। কিন্তু কেন যেন আজকে পারছেনা। হয়ত পাশের ঐ মেয়েটা এবং তার পাশে বসা মুরুব্বীই বাঁধা হয়ে আছে। একটু আগে বাইরে এই মুরুব্বীর সাথে অলির কথা হয়েছে। উনি উনার নাতনীকে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামে। মেয়েটা ওর নানার বাড়িতেই থাকে। ওর বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে গত রাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে! মেয়েকে দেখতে চেয়েছে তাই এই পথচলা! নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।

– তুমি বলনি কাল রাতে আমি যা করেছি ওটা করা ঠিক হয়নি? কেন কাল রাতের কথা এই সুন্দর সকালে টেনে এনে সকালটা মাটি করে দিলে শুনি? অরণ্য কটাক্ষ করে কথাগুলো বলে যায়।

-ওহ মাই গড! তুমি ঐ কথা ধরে এতক্ষণ ট্যাপা মাছের মত ফুলছিলে? তুমি না আসলেও…!
অলি নড়চড়ে বসে ভাবখানা যেন সে আকাশ থেকে পড়েছে।

-তুমি কী ঝগড়া করতে ছাইছো ? আগেই বলে রাখি আমার কিন্তু মুড নেই হাঁ…।
অরণ্যও নড়চড়ে বসে।

-সব সময় তেলাপিয়া মাছের মত ভেসে ভেসে চুক চুক করে পানি খাও তুমি…ঝগড়া আমি করতে চাইছি না তুমি?
গলার সূরটা আগের থেকে একটু চড়া করে বলে অলি।

-কী আমি তেলাপিয়া মাছের মত ভেসে ভেসে…

কী ভেবে যেন অরণ্য থেমে যায়। বিস্ময়ে চোখ দুটো যতটা সম্ভব বড় করে বলে-

– আরে দাঁড়াও দাঁড়াও…কী বললে তুমি? তেলাপিয়া মাছের মত ভেসে ভেসে… মানে তেলাপিয়া মাছ পানিতে ভেসে থাকে? তাহলে কাল রাতে কেন বললে মাছ ধোঁয়া হয়নি কাঁদার গন্ধ আসে? কেন বললে মাছ ভাল করে ভেঁজে রান্না করিনি? তারমানে তুমি কাল মিথ্যে বলেছিলে আমার দোষ ধরার জন্য? ছিঃ।

রাগে মাথা গরম হয়ে উঠেছে ছিঃ শব্দে ! এই একটা শব্দ কেন যেন অলি সইতে পারেনা…। গরম কড়াই থেকে তেল ছিটে গায়ে লাগলে যেমন জ্বালা ধরায় মনে হল অলি’র গায়েও কথাটা অমন জ্বালা ধরিয়েছে!

-ছিঃ মানে কী…তুমি জানো না কাঁদা তেলাপিয়া মাছের প্রিয় খাবার? আর পাঙ্গাশ মাছের প্রিয় খাবার…
-থাক থাক আর বলতে হবে না। অনেক বার শুনেছি পাঙ্গাশ মাছের প্রিয় খাবার কী! আমি পছন্দ করি তাই ঐসব কাহিনী…তুমি আসলে চান্স পেলেই আমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বল…।

অরণ্য ঠোঁট উল্টে শালের মাঝে মুখ চাপা দিতে দিতে মাথাটা রাখে অলির কাঁধে। নিমিষে দু’জনে শান্ত হয়ে যায়। ওরা ভুলে গিয়েছিল আসলে কোথায় আছে। অলি সম্বিত ফিরে পেল মুরুব্বীর কথায়-

-নতুন বিয়ে বুঝি?

কথাটা শুনে লজ্জা পেয়ে মৃদু হাসে অলি। মাথাটা এমনভাবে ঝাঁকিয়ে সাঁয় দেয়,তাতে বোঝা যায় “হ্যাঁ নতুন বিয়ে।” আসলে ওদের আজ পঞ্চম বিয়ে বার্ষিকী। অরণ্যর বাবা মায়ের ধারনা প্রেমের বিয়ে বেশিদিন টিকে না! আর তাই অলির সাথে বিয়ে হলে এবং পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী পর্যন্ত টিকে থাকলে মায়ের বাড়ীতে এসে ভাই বোনের সাথে আনন্দ করবে! অলি অরণ্যের এই সামান্য আবদারটুকু মিটাতেই এই ভয়াবহ সময়েও দোয়া দরুদ পড়ে ভোরের আলো ফোঁটার আগেই বের হয়েছে।

এই সময়ে নাকি চারিদিক বেশ শান্ত থাকে। কুয়াশার কারনে এবং গাড়ি ছাড়বে কী ছাড়বে না এই দোটানায় পড়ে একটু দেরীতেই ছেড়েছে। শহর ছেড়ে গ্রামে ঢুকতেই কিছুটা নিরাপত্তা মনে করেছে অলি। গ্রামের সহজসরল মানুষগুলো নিশ্চয় শীতের এই স্নিগ্ধ সকাল বেলা তাণ্ডব করার জন্য বসে নেই! আর কিছুটা পথ গেলেই অরণ্যের বাবার বাড়ী। প্রায় তিন বছর পর এসেছে ওরা…। সময়ের সাথে সাথে জীবনও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। ভালবাসা মায়া মমতা বন্ধন সব কিছুই কেঁড়ে নিচ্ছে টিকে থাকার লড়াইয়ে কঠিন বাস্তবতা!

সারাদিনের ব্যস্ততা আর বসের মন জয় করার আপ্রাণ চেষ্টায় মনটা থাকে বিষিয়ে। তার উপর বাড়তি প্রেসার দেশের চলমান পরিস্থিতি! এ যেন প্রসব বেদনার সময় বিষ ফোঁড়া ফেটে যাওয়া! প্রিয়জনের সৌন্দর্যও এখন ফিকে হয়ে ধরা দেয়। মিষ্টি ভালবাসাও ভীষণ বিরক্ত ছড়ায়! অনেক সুখও বিন্দু হয়ে ধরা দেয়! দায়িত্ব পালন করতে করতে “ভালবাসি তোমায়” এই কথাটা বলার মত যে আবেগ;তা যেন ক্লান্তির সরোবরে ডুবে কণ্ঠ চিরে কোনভাবেই বের হতে চায়না! অরণ্যর মৃদ্যু অভিমান অলি কখনো তাকে “ভালবাসি তোমায়” বলেনি!

যদিও ওদের বিয়েটা দুই বছর প্রেম করার পরে হয়েছে। অলি বুঝে পায়না মুখে কেন বলতে হবে? ভাল না বাসলে সেকী এতো কষ্ট করে? যখন যা দরকার তা এনে দিয়ে,দুঃখ ব্যথায় পাশে থেকে সুখী করার চেষ্টা কী ভালবাসা নয়? অলি কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী…আর তাই হয়ত কথাটা বলার প্রয়োজনীয়তা সে কখনো অনুভব করেনি! অল্প পেলেই যে সুখী,সেই অরণ্যকে নিয়ে বেশ ভাল আছে অলি। যতটুকু আছে সুখেই আছে।

কেবল দুশ্চিন্তা অরণ্য’র শারীরিক অবস্থা এই সময়ে ভাল যাচ্ছে না। কোন মেয়েরই হয়ত এই সময় শরীরটা ভাল যায় না। মধ্যবিত্ত পরিবারে একজন নতুন অতিথিকেও এখন বোঝা মনে হয়। যদিও মা হবার আনন্দে অরণ্য অনেক খুশি। অলি নিজেও যে অখুশি তা কিন্তু নয়। তারপরও বাড়তি খরচের চিন্তাটা কোনভাবেই মাথা থেকে বের হয় না।

অরণ্যের ইচ্ছে আর তো মাত্র দুই মাস…। আজ সে বাবার বাড়ীতে গিয়ে একেবারে নতুন অতিথীকে সঙ্গে নিয়ে তারপর বাসায় ফিরবে। এই পরিস্থিতির মাঝে অলি অরণ্যকে নিয়ে বের হতে চায়নি। কিন্তু ওর কেন যেন মনে হচ্ছে ডেটের আগেই, এমন কি দশ বারদিনের মাঝেই অরণ্য মা হবে! তার উপর এখন অফিসে চাপটা অনেক কম। পরে হয়ত আর অফিস থেকে ছুটিও পাবেনা আর জমে থাকা কাজের চাপও বেড়ে যাবে! তারউপর বউয়ের জেদ,যদি আজ না যাওয়া হয় তাহলে আর হয়ত যাওয়া হবে না। বিয়ের সময়ই নাকি সে মানত করে রেখেছিল যখন বিয়ের পাঁচ বছর হবে তখন বাবার বাড়ীতে এসে বড় করে মিলাদ দেবে…!

“এই ছেলে মানুষীর কোন মানে হয়? এই যুগে এইসব কেউ মানে?” কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অস্বস্তি লাগছিলো। এতক্ষণ যে ভয়টা মনের কাছাকাছি থেকেও তর্কের ভিড়ে চাপা ছিল। ছুটন্ত বাতাসে সাঁতার দিতে দিতে সেই ভয়টাই দুরুদুরু মনকে কাঁপিয়ে তুললো অজানা আশঙ্কায়। ঝাঁকিতে মাঝে মাঝে দুলে উঠছে অরণ্যের শরীর। অলি ডান হাত দিয়ে অরণ্যকে জড়িয়ে নেয় নিজের শরীরের সাথে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোদের ঝিকিমিকি ওর গালে খেলা করছে। অলি অবাক হয় গভীর নিঃশ্বাসের শব্দে। বাম হাতটা কেমন করে যেন অরণ্য’র পেটে লেগে যায়… চমকে উঠে সে! এবার সে হাতটা রাখে পেটে…স্বর্গীয় অনুভূতি মনের মাঝে আনন্দের ঝড় তোলে! হেসে দেয় আপন মনে।

-দেখেছো বাবার স্পর্শ পেয়ে কীভাবে হাত পা ছুড়ছে! তোমার মত জ্বালাবে আমাকে…!

ফিসফিস করে কথাটা বলে অরণ্য। অলির খুব ইচ্ছে করে ওর কপালে একটা চুমু দিতে… খুব ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে এতদিনে না বলা কথাটা আজ বলে দিতে। মনে মনে ভাবে আর কোন দুশ্চিন্তা করবেনা সে…এই সন্তানের জন্য না হয় সে আরও দুই ঘণ্টা অভারটাইম বেশি করবে।

-শুনছো আমার না খুব খিদে পেয়েছে !
আহ্লাদী সূরে অরণ্য বলে। কে বলবে এইতো কিছুক্ষণ আগেই ওরা ঝগড়া করছিলো!
– এই তো প্রায় এসে গেছি। পনেরো বিশ মিনিটে পৌঁছে যাব।
-শুনো কালকের রাতের জন্য সরি…অমনটা আমি না করলেও পারতাম!

– বেচারা তেলাপিয়া,তোমার জেদ আর রাগের আগুনে পুড়ে পুড়ে একেবারে কয়লা হয়ে গিয়েছিলো! কেমন করে তরকারীর বাটি থেকে নিয়ে রান্না মাছ আবার ভাঁজা শুরু করলে…!

-সরি বলেছি তো…। আসলেও কাল মাছের গন্ধে এতো বমি করেছি যে মাছ ভাঁজি করে রান্না করতে ভুলে গেছি।
– যাক স্বীকার করলে…সত্যিটা বললেই হত! তোমার ভুলের জন্য কাল মাছ চুলায় জ্বলেছে দুবার… আর সারা রাত আমার পেট জ্বলেছে খিদেয়।

কথাটা বলে দু’জনে হাসে। এমন সময় “বুম” করে একটা শব্দ। একটা ঝাঁকি দিয়ে গাড়ীটা থেমে যায়! একেবারে সামনে এসে পড়েছে জ্বলন্ত কাঁচের বোতলটা। তরল কিছু একটা এসে পড়ে যুবতী মেয়েটা ও মুরুব্বীর জামায়। এক মুহূর্ত সময় না দিয়ে তীব্রভাবে জ্বলে উঠে আগুন! মুহুর্তেই সুন্দর চেহারাটা বিকৃত হয়ে যায়! অলি অরণ্যের শালের উপর দিয়ে ওর হাতটা ধরে টানতে টানতে বের হতে থাকে।

সামনে কেবল একটা দরজা! পিছনে দরজা থাকলে ভাল হত কারণ বোতলটা ড্রাইভার এবং ইঞ্জিন লক্ষ্য করে সামনে মারা হয়েছে! যেভাবেই হোক অরণ্যকে নিয়ে বের হতে হবে। সবাই বের হতে হতে হুড়মুড় করে একে অন্যকে টেনে ধরছে। অলির মনে হল ছোট্ট একটা বাচ্চা “বাঁচাও বাঁচাও ” বলে চিৎকার করছে! অরণ্যের সাথে সাথে বাচ্চাটাকে বাঁচাতে সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কচি হাত দুটো অলির হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে। দরজা থেকে টেনে বের করে এনেছে অলি…! একেবারে রাস্তায় এসে লুটিয়ে পড়েছে … কিন্তু একী…! কোথায় অরণ্য? কোথায় কচি হাত! অলি কেবল শালটা টেনে বের করে এনেছে! শালটার একমাথায় বিজয়ী দাপটে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।

বাঁচার অদম্য প্রতিযোগিতায় অরণ্য হেরে গেছে…! ওকে পিছনে ফেলে অর্ধদগ্ধ অবস্থায় কেউ কেউ বের হয়ে আসে! কে যেন অলিকে টেনে দূরে সরিয়ে দেয়! পোড়া শালটা হাতে নিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠে-

– অরণ্য! আই লাভ ইউ সো মাস অরু …অ…রু…! আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি অরু…! প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে

দিওওও।

অলির হাত পা দগ্ধ হয়ে কালো হয়ে ফুলে উঠেছে…মুখের খানিকটা চামড়া উধাও হয়ে গেছে। অথচ কোনদিকে একটুও খেয়াল নেই। পাথর দৃষ্টি মেলে দেখে সামনে বাসটা ধীরে ধীরে লাল হতে হতে কালো হয়ে যায়!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত