মারিয়া’র বিয়ে ভেঙ্গেছে ৪ বার। প্রতিবারই পাত্রপক্ষ দেখতে এসে পছন্দ হয়নি বলে ফিরে গেছে। কারণ একটাই, তার গায়ের রং ছিলো মোটামুটি কালো ধরনের। বলা চলে তাকে পছন্দ করার মতো কেউ ছিলো না। আর এ কারণে সে নিজেকে পৃথিবীর জন্য বোঝা বলে দাবি করতো। এ সমাজ আর সমাজের মানুষের কাছ থেকে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতো। আত্মহত্যা যদি মহাপাপ না হতো, অনেক আগেই হয়তো সে পৃথিবীকে বিদায় জানাতো।
পড়াশুনার চাপ সামলাতে আমি পাড়ি জমিয়েছি শহরে। বাড়ি যাওয়া হয়নি অনেকগুলো মাস। বাড়ি থেকে বার বার ফোন দিচ্ছিলো মা। সময় করতে পারছিলাম না। পরীক্ষার প্যারায় নাজেহাল হয়ে পড়েছিলাম। আজ ক্লাস টেস্ট, পরশু উইকলি টেস্ট, মিডটার্ম, সেমিস্টার ফাইনাল; মনে হচ্ছিলো জীবন মানে পরীক্ষার সমষ্টি! সব ব্যস্ততাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ঈদের ছুটিতে বাড়ি এলাম। আর এসেই যে খবরটি শুনলাম সেটা রীতিমতো অবাক করলো আমাকে। মারিয়ার বিয়ে হয়েছে ৫ মাস হলো। এলাকায় না থাকায় এ খবর আমার শোনা হয়নি। কেন যেন একবার মারিয়া ও তার স্বামীর সাথে দেখা করতে মন চাইছিলো। আর ঈদের মাত্র ৩ দিন পরই আমার সে সুযোগ হয়ে গেলো। ঝকঝক করা টিনের ঘরের সামনে কালো রঙ্গের প্রাইভেট কার দেখেই অনুমান করেছি, মারিয়া’র স্বামী হয়তো অনেক বড়লোক। এমন একটা লোক কি দেখে এ মেয়েটাকে বিয়ে করলো কে জানে! ঘরে ঢুকতেই মারিয়া’র সাথে দেখা। আমাকে দেখেই সে চমকে উঠে বললো-
:আরে ভাইয়া, আপনি! কতদিন পর আপনাকে দেখলাম। তা, ভালো আছেন নিশ্চয়?
:এইতো, আমি ভালো। তুমি কেমন আছো?
:আমি আছি ভালো। আর আপনাদের দোয়ায় অনেক সুখেই আছি।
মারিয়া’র কথা শেষ হতেই পাশের রুম থেকে পুরুষ গলার আওয়াজ শুনলাম। বুঝতে পেরেছি, মারিয়া’র স্বামী। কথা বলতে বলতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো সুঠাম দেহের অধিকারী একজন সুদর্শন ব্যক্তি। উঠে দাড়ালাম আমি।
:কার সাথে কথা বলছো মারিয়া? মনে হচ্ছে নতুন কোনো শালা-টালা আমদানি করেছো!
কথা শুনেই বুঝতে পেরেছি, ভদ্রলোক বেশ রসিক ধরনের। সালাম দিলাম আমি। এগিয়ে এসে হাত মেলালেন আমার সাথে। বেশ হাসি-খুশি একজন লোক, দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে। মারিয়া সম্ভবত নাস্তার আয়োজন করতে ভেতরে চলে গেলো। আর আমরা কথা বলতে বলতে সোফায় গিয়ে বসলাম।
উনার পরিচয় জেনে বেশ অবাক হলাম। প্রথম শ্রেণির বিসিএস কর্মকর্তা। একটি সরকারি কলেজের প্রভাষক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। আমি যাস্ট ড্যাব ড্যাব করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আর মনে মনে ভাবছিলাম এমন একটা লোক বিয়ে করলো কি না মারিয়ার মতো মেয়েকে! এ যেন রূপকথার গল্প! তার কথা শুনছিলাম আর আমার আশ্চর্য্যের মাত্রা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। নিজেকে আর সংবরন করতে পারছিলাম না। হুট করে জিজ্ঞেস করে বসলাম-
:আচ্ছা ভাই, আপনি মারিয়া’র ঠিক কি দেখে ওকে বিয়ে করলেন? আমার এমন প্রশ্ন শুনেও তার হাসি মাখা মুখে কোনো মলিনতার ছাপ দেখতে পেলাম না। বরং হাসিমুখে আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন-
:কেন, মারিয়া’র মধ্যে কিসের অভাব আছে বলে আপনার মনে হয়?
:এর আগে আরো বেশ কয়েকজন পাত্র তাকে দেখে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। তার মূল কারণ…
আমাকে থামিয়ে দিলেন তিনি। নিজেই বলা শুরু করলেন- আপনাদের চোখে মারিয়া’র সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সে দেখতে কালো। হুম, এটা আমাকেও মানতে হবে। দেখুন, পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই, যে ব্যক্তিগতভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। একজন মানুষ পারফেক্ট হয়ে উঠার জন্য অন্য একজন মানুষের সাহায্য অবশ্যই লাগে। আমাদের প্রত্যেকেরই কোথাও না কোথাও ঘাটতি আছে। মারিয়ার গায়ের রঙে সামান্য সমস্যা। এছাড়া তার আর কোনো সমস্যা এতদিনেও আমার চোখে পড়েনি। তার এত এত গুনের ভীড়ে এ সামান্য সমস্যাটা বরং আমার কাছে নিরর্থকই মনে হয়। দেখুন, আমরা কিন্তু বেশ সুখেই আছি।
কথা থামিয়ে গ্লাসে পানি ঢাললেন তিনি। ঢক ঢক করে পানি খাচ্ছেন, আমি তাকিয়ে আছি সেদিকে। পানির গ্লাস হাত থেকে রাখতেই প্রশ্ন করে বসলাম-
:আচ্ছা, আপনার মারিয়াকে পছন্দ হলোই বা কি করে? মারিয়া দেখতে কালো, এটা কি আপনি জানতেন না?
:আমি শুনেছি সে কালো। তারপরও কেন যেন একবার দেখতে মন চাইলো। আর ওর ঘোমটা তুলে যেদিন প্রথম তাকে দেখেছি, দেখলাম তার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। তার মায়া ভরা চেহারার দিকে অনেকটা সময় তাকিয়ে ছিলাম। তার প্রতি কেমন যেন একটা মায়া অনুভব করলাম। তার সাথে তখনও কোনো কথা হয়নি আমার। হুট করে বাবাবে বলে উঠলাম, “বাবা, বিয়ের তারিখ ঠিক করো।”
আমার কথা শুনে মারিয়াসহ সবাই হঠাৎ চমকে উঠলো। আমি মারিয়ার চমকে যাওয়া মুখের দিকে একবার তাকালাম। মনে হচ্ছিলো মেয়েটা হাসতে চেয়েও হাসতে পারছে না। এক ধরনের চাপা কষ্ট তার বুকের উপর ভর করে আছে। মন চাইছিলো সব কষ্ট দূর করে তাকে পৃথিবীর সেরা সুখী বানিয়ে দিই।
:আচ্ছা, আপনার মা-বাবা কি রাজি ছিলো এ বিয়েতে? তারা কিছু বলেনি আপনাকে?
:দেখুন, যে মেয়েটি দেখতে সবচেয়ে কালো, তারও এক সময় বিয়ে হয়ে যায়। কালো আর সুন্দর সবই আল্লাহ্’র সৃষ্টি। আর আমার মা-বাবা এ কথাগুলো খুব ভালোভাবে বিশ্বাস করেন। গায়ের রংটাই সব সময় মুখ্য না। আর আমার পরিবারও আমার পছন্দকে প্রাধান্য দিয়েছে। আমার সুখে থাকাটাই তাদের কাছে সুখ।
কথা শেষ না করতেই নাস্তার ট্রে হাতে মারিয়া রুমে প্রবেশ করলো। চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। খুব সুন্দর করে সেজেছে মেয়েটি। পরনে শাড়ী, হাতে চুড়ি, খোপায় সম্ভবত বেলী ফুল। হঠাৎ আমার নিজের চোখেও তাকে আজ অসাধারন লাগছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম অনেক্ষণ। আমার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, সত্যিই তো পৃথিবীর কোনো মানুষ পারফেক্ট না। প্রত্যেকের মাঝেই কোনো না কোনো অসম্পূর্ণতা থাকে। দ্বিতীয় কারো ভালোবাসা আর যত্নই পারে এ অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করতে।
মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে মারিয়া আবারো ভেতরের রুমে চলে গেলো। চা খেতে খেতে আমি আবারো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম-
:আচ্ছা, মারিয়াকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেলে কিংবা কোনো প্রোগ্রামে গেলে আপনার অস্বস্তি বোধ হয় না? আর আপনার বন্ধু-বান্ধব আপনাকে কেমন সমর্থন দেয়?
:দেখুন, এদেশের মানুষ হলো অতিরিক্ত আবেগী, অতিরিক্ত হিংসুক আর খুব বড় মাপের সমালোচক। সমালোচনা করার জন্য তারা পুরস্কারের দাবি রাখে। একটা কাজ, হোক সেটা পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ, তারা সেটার সমালোচনা করবেই।
আপনি সমাজের ১০টা উপকার করেন, তালি দেয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পাবেন না। একবার একটি মন্দ কাজ করে দেখান, হাজারটা আঙ্গুল তৈরি হয়ে যাবে আপনার বিরূদ্ধে কথা বলার জন্য। এ কারণে আমি এ সমাজ ব্যবস্থাকে পরোয়া করি না। কে কি বললো তাতে আমার কিছুই আসে-যায় না।
মারিয়াকে বিয়ে করার পর অনেকে অনেক রকম কথা বলেছে। ‘এই ছেলের পছন্দ এত নিচু মানের কিভাবে হলো’, ‘এই কালো প্রোডাক্ট আবিষ্কার করলাম কোথা থেকে?’, এগুলো হলো তাদের সমালোচনার নমূনা। আবার কোনো সুন্দরী মেয়েকে যদি বিয়ে করতাম, তখনও তাদের গা চুলকাতো। ‘মেয়েতো সুন্দরী, না জানি কয়টারে ছ্যাঁকা দিছে!’, ‘সুন্দরী মেয়েদের বিশ্বাস নেই, বিয়ের আগেই তাদের বিয়ে হয়ে যায়’, তখনকার সমালোচনার নমূনা হতো এমন। মানে তারা কোনো ভালো কাজকেই গ্রহণ করতে রাজি নয়। যার ফলে সমাজের কোনো কথায় আমি কান দিই না।
:আর আপনার বন্ধু-বান্ধব?
:কিছু বন্ধু প্রথম থেকেই সাপোর্ট দিয়েছে। আর কিছু তিরস্কার করেছে। তবে এখন তারা অনেকটাই শুধরে গেছে। মোটামুটি আমার সব কাজকে সাদরে গ্রহণ করে।
“আজ দুপুরে আমাদের বাড়িতে খেয়ে যাবেন ভাইয়া। আম্মু যেতে মানা করেছে।” -বলতে বলতে আবারো রুমে ঢুকলো মারিয়া। সোজা এসে তার স্বামীর পাশে বসলো। বেশ মানিয়েছে তাদের। মনে হচ্ছে সাংসারিক জীবনে বেশ সুখে আছে ওরা। এটা অবশ্য সন্দেহের কিছু নেই, মারিয়ার স্বামীর মুখের কথা শুনে শতভাগ নিশ্চিত আমি।
:নাহ্, আজ একটু তাড়া আছে আমার। অন্য একদিন এসে অনেক আড্ডা দেবো তোমাদের সাথে। আজ একটা প্রোগ্রামে জয়েন করতে হবে। বলেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। মারিয়ার স্বামীও দুপুরে খেয়ে যেতে বললো। কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে। হাত মেলালাম শেষ বারের মতো। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাবো। হুট করে জিজ্ঞেস করে বসলাম-
:ভাই সাহেবের নামটা যেন কী?
:জ্বী, হাসান মাহমুদ!
নামটা শুনেই বেরিয়ে এলাম। মাথার মধ্যে একরাশ চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। সবগুলো ছেলের চিন্তা যদি হাসান সাহেবের মতো হতো, তবে এ সমাজে কালো মেয়েদের কোনো অনুশোচনা থাকতো না। একজন ভালো জীবন সঙ্গী পাওয়ার ব্যপারে তাদের আর কোনো সন্দেহ থাকতো না। কবিদের গল্প-কবিতা আর উপন্যাসের মতো বাস্তবের মানুষগুলোও যদি কালো মেয়েগুলোকে সাদরে গ্রহণ করতো, তবেই এ সমাজটা সবচেয়ে সুন্দর হতো। সমাজের মানুষ যতদিন তাদের সমালোচনার মিছিল বন্ধ করবে না, যতদিন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে না, ততদিন সমাজ ব্যবস্থা প্রকৃত আধুনিক না হয়ে নামমাত্র আধুনিক হবে।
হাসান সাহেবের প্রতিটি কথা আমার মনে অনুপ্রেরণার মতো কাজ করছে। খুব করে মন চাচ্ছে তার মতো একজন হয়ে যেতে। যে কথাগুলো উপন্যাসের পাতায় পড়েছি, তেমন একটি ঘটনা আজ চোখের সামনে ঘটতে দেখছি। এ যেন এক সত্যিকারের হার না মানা মায়াবতী’র গল্প! আনমনে ভাবছি, আর হেঁটে চলেছি। হঠাৎ পেছনে ফিরে ঝকঝক করা টিনওয়ালা বাড়ির দিকে আরো একবার তাকালাম। বারান্দায় বসে কি একটা খুঁনসুটিতে মেতে হাসাহাসি করছে মারিয়া ও তার স্বামী! এ মুহূর্তে হাসান সাহেবের একটা কথা আবার মনে পড়লো, “আমরা জাতি হিসেবে খুব হিংসুক”। কারন তাদের এমন খুঁনসুটি দেখে আমার নিজেরই প্রচুর হিংসে হচ্ছে!