হুঁমোখালির গাঙটার কথা কে না জানে! শিবসার সাথে গিয়ে মিশেছে শেষবেলা। শিখনের বাবা এ গাঁয়েরই ছেলে। বাবার কাছে শিখন শুনেছে তার ছেলেবেলার গল্প। বাবা বলে- ওই গাঙটাকে তার সবচেয়ে বড় বন্ধু মনে হয়। শিখন বলে-সে কী বাবা, গাঙ কী কখনও কারও বন্ধু হয় নাকি? বাবা বলে- হ্যাঁ, হয় তো- হবে না কেন! পাখি যদি মানুষের বন্ধু হতে পারে, গাছ যদি মানুষের বন্ধু হতে পারে তো গাঙও মানুষের বন্ধু হতে পারে। বাবার তো আর গল্পের শেষ নেই এই গাঙ নিয়ে। গাঙের কত গল্প বাবার কাছে যে জমে আছে!
বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গেছে কুলকুল করে এই গাঙ। পৌষের শেষ দিকে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় চর, হয়ে পড়ে ফুটিফাটা। চাঁদনি রাত চকচক করে গাঙের কূলের দিকটা। কত রকমের মাছে যে ভরা গাঙ এটা। দুই পারের মানুষে জাল দিয়ে মাছ ধরে। পৌষের মাঝামাঝি সময়ে জেলেরা আসে পুরো মাস ধরে জাল টানে দুপাশ দিয়ে সে এক অপরূপ দৃশ্য। বাবার গল্প বলার সাথে সাথে গাঙের এ দৃশ্যগুলো যেন চোখের সামনে ধরা পড়ে শিখনের। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। মায়ের কথা না শুনলে মা মন খারাপ করবে। মাকে ছাড়া যেমন শিখনের চলে না তেমনি বাবাকে ছাড়াও শিখন চলতে পারে না। বাবা-মাকে শিখন খুউব ভালোবাসে। মা-বাবা কোনো কারণে কষ্ট পাবে তার ব্যবহারে তা শিখন চায় না।
২
শিখনকে কে যেন ডাকছে, “শিখন সোনা, শিখন সোনা ওঠো ওঠো…”
শিখন চোখ খুলে দেখে একটা ছোট্ট রুপো রঙের মাছ।
মাছটা শিখনকে ডাকছে, শিখন চোখ বড় বড় করে চাইল।
বিশ্বাস হচ্ছে না শিখনের। এত সুন্দর মাছ শিখন আগে কখনও দেখেনি। শিখনের এমন হতবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে রুপো রঙের মাছটা বলল, “আহা, শিখন সোনা তুমি অমন করে চেয়ে আছো কেন? আমায় চিনছ না? আমি তোমার বাবার বলা গল্পের সেই মাছ! আমায় তুমি তোমার বন্ধু করে নাও। আমি তোমার মাছবন্ধু। জানো তো- আমি জলের দেশে থাকি। সে এক মজার জগৎ। এখানে কত্তো কত্তো যে আনন্দ! কত কত মাছেরা এখানে বসবাস করে তুমি ভাবতেও পারবে না। আমার মা-বাবা রয়েছে ভাই-বোন রয়েছে।
“আমাদের স্কুল আছে। আমরা মাছেরা সেই স্কুলে পড়ি। আমাদের খেলার মাঠ আছে। আমরা জলের তলায় কত আনন্দ করি। জানো শিখন সোনা, এক সময় মাছেদের কোনো রোগবালাই হত না, দিব্যি তখন সুখে ছিলাম আমরা সব মাছ। প্রচুর ডিম হত তখন আর নতুন বাচ্চা তখন ফুটত সেই ডিম থেকে। অথচ এখন কোনো মাছ বেশি ডিম পাড়তে পারে না।
শিখনের দুঃখ হল রুপো রঙের এই মাছের কথা শুনে। শিখন তখন বলল, “তুমি এত্তো জানো কী করে?”
রুপো রঙের মাছ বলল, “মা-বাবার কাছে আমি শিখি। তারা আমায় কত্তো কী শেখান! আমি তাদের কাছে শিখি আবার আমাদের মাছেদের স্কুলেও পড়ি, শিখি। আমার সেই স্কুলে অনেক মাছ বন্ধু আছে। তারা দেখতে আমার মত এ-রকম। জানো তো আমরা জন্মেই সাঁতরাতে পারি। সাঁতার আমাদের শিখতে হয় না। ডিম থেকে ফুটেই আমরা শিখি জলের দুনিয়ায় কীভাবে ভেসে থাকতে। কী সুন্দর সুন্দর শ্যাওলা আমাদের জলের পৃথিবীতে দেখি। আমি অবাক হই। দেখি কত কত অজানা মাছেরাও ঘোরে। কারও কারও দাঁত আছে, কারও তো লম্বা লম্বা চুলও আছে। জানো তো শিখন, এই আনন্দের পৃথিবী বড় ভালো লাগে আমার। তুমি চাইলে আরও জানবে তোমার বইয়ে আর জল নিয়ে বইয়ের ভেতর। তারপর রুপো রঙের মাছটা কোথায় জানি পালাল আর অমনি জেগে গেল শিখন। দেখল মা পাশে বসে বসে হাসছে মিটিমিটি করে। শিখন মায়ের মিষ্টি হাসি দেখে বুঝল এতক্ষণ সে স্বপ্নই দেখছিল।