জীবনের বাঁকে গল্প নতুবা গল্পের বাঁকে জীবন

জীবনের বাঁকে গল্প নতুবা গল্পের বাঁকে জীবন

আট বছর পর কানাডার অন্টারিও থেকে দেশে ফিরতেছি, সেই ইন্টারমিডিয়েট কমপ্লিট করে এখানে এসেছিলাম। তারপর কোনরকম ঝড় ঝঞ্ঝা ঠেলে পড়াশোনা শেষ করে একটা জব কনফার্ম করে তবেই এখানে ঠিকে যাওয়া। এর পেছনে ‘ইলিনা ডি ক্রুজ’ এর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ভেবেছিলাম আরো দু’বছর পর যাবো। সবকিছু গুছিয়ে। ‘ইলিনা ডি ক্রুজ’ আমার গার্লফ্রেন্ড।

ওর সাহায্য ছাড়া এই বিশাল দেশে ঠিকে থাকাটা কোনভাবেই সম্ভব হতো না। ওর ঋন কোনভাবেই সুদ করার মতো না। ওকে বিয়ে করে ওকে নিয়েই দেশে ফেরার ইচ্ছে ছিলো খুব। কিন্তু দাদু দ্বিতীয় বারের মতো কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে বেঁচে ফিরে একটাই আবদার করেছেন, তার একমাত্র নাতির মুখ দেখে মরবেন। আম্মা আব্বু দুজনেই কান্নাকাটি করে দেশে আসতে বলায় বাধ্য হলাম। কেনাকাটা কিছুই করিনি একদম খালি হাতেই দেশে যাচ্ছি। বিমানে বসে থাকতে থাকতে কোমরে ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। কখন যে নামবো!

অবশেষে ভোরে ল্যান্ড করলাম। এয়ারপোর্টে এন্টার গ্রাউন্ডে ফোন করার ব্যবস্থা আছে। আব্বুকে কল করলাম। আব্বু আশেপাশেই ছিলো। গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। গাড়ি থেকে নেমেই জড়িয়ে ধরে কি কান্নাকাটিই না শুরু করলো। আব্বুকে ছোট বাচ্চার মতো করে গাড়িতে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছি আব্বু কেঁদেই যাচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আগে রেস্তোরাঁতে ঢুকে ইচ্ছে মতো খাইলাম। কিন্তু আব্বু ক্যানো জানি এখনো মুখ গোমড়া করে বাইরে তাকিয়ে আছেন।

– আব্বু কি হয়েছে?
– না বাবা কিছু হয়নি, তুই আর কিছু খাবি?
– পেট ভরে খেয়েছি। আপনি মন খারাপ করে আছেন ক্যান? আমি তো এসে গেছি আব্বু। আম্মা তারা সবাই ঠিক আছেন তো? দাদু ঠিক আছে?

– সবকিছু ঠিকঠাক বাবা। চল যাওয়া যাক।
সিলেটে আসতে আসতে বিকেল চারটা বেজে গেছে। বাড়িতে এসে দেখি সারা বাড়ি রঙিন কাগজ আর ঝিলমিল বাতি দিয়ে সাজানো। আমাদের বাংলো ঘরটাও সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। উঠোনে মাদুর বিছিয়ে বাড়ির মহিলারা বিয়ের গীত গাইছে। এটা গ্রামের ঐতিহ্য। কতদিন পর এসব দেখছি, যেন সব স্বপ্নের মতো। আমায় দেখে একটা বড়সড় কোলাহল লেগে গেলো যেনো। আম্মা সবাইকে ঠেলে এসে আবার জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি। আমার আম্মা এমনিতেই তার ছেলে ভক্ত। আমায় সারা মুখে গালে কপালে চুমু খেয়ে সবাইকে ঠেলে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন। আব্বু এখনো মন খারাপ করে আছে। আপুর সাথে দেখা করলাম, সেম অবস্থা। যেনো খুশি হওয়ার চেয়ে মন খারাপটাই বেশি সবার। কিছুই বুঝতে পারছি না। দাদুভাই বারান্দায় বসে আছেন। উনাকে গিয়ে সালাম করলাম। দাদুভাই অনেক খুশি। জিজ্ঞেস করলাম দাদুভাইকে;

– দাদু সবার মন খারাপ ক্যান?
– মানুষের ভাল কিছু সহ্য হয়না, বুঝলি দাদুভাই? আমার মতামত কবে কার ভালো লাগে ক’তো? এই আরকি সমস্যা, তুমি চিন্তা করবা না আমি তোমার ভালোর জন্যই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যা হবে ভালো হবে। ওদেরকে পাত্তা দিয়ো না।

– আচ্ছা কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এবার? বাড়িতে বিয়ে কার?
– তোমার বিয়ে। আগামী শুক্রবার তোমার বিয়ে ঠিক করেছি আমার দোস্তের নাতনীর সাথে। আমার দোস্ত চার বছর আগে মারা গেছে, মেয়েটার বাপ মা দুজনেই মেয়েটা ছোট থাকতেই মারা যায়। এতিম মেয়ে কেউ নাই। আমার হেফাজতে ছিল। অনেক লক্ষ্মী মেয়ে। আল্লাহর রহমত পাইবা দাদুভাই, বুঝলা?

আমি যেন আসমান থেকে পরলাম! এসব আমি কি শুনছি? এটার মানে কি? আমি জানি এই বাড়িতে দাদুর রায় চূড়ান্ত রায়। তাই বলে আমার লাইফ নিয়ে এসব খেলানেলা? উফফফ! এতোক্ষণে বুঝলাম সবার এই অবস্থা ক্যান। আমার কান্না চলে আসতেছে:

– দাদু আপনি কোনরকম না ভেবেই সিদ্ধান্ত নেয়াটা ঠিক হয়নি। আমার কোন প্রস্তুতি নাই দাদুভাই, প্লিজ এটা বন্ধ করেন।

– আসার পরেই কানপড়া পেয়ে গেছো? আমি যা সিদ্ধান্ত নেই খুব ভেবেচিন্তে নেই। যাও ঘরে যাও। প্রস্তুতি আমি নিবো তুমি না।

আজকে জামাই গোসল। এটা বিয়ের আগের দিন হয় গ্রামে। হলুদ মরিচ নাকি কি কি যেন ঘষিয়ে গোসল করানো হয়। আমার রাগ উঠতেছে! রাগে কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিছুই সহ্য হচ্ছেনা। বারবার ইলিনার কথা মনে পড়ছে। এটা ক্যান করলো দাদু ধ্যাত! সবাই উঠোনে রঙ মাখিয়ে খেলতেছে খুব আমি বসে বসে দেখতেছি। আমার বিয়ে, আমার মন মানসিকতা না ভেবেই তারা কি মজাটাইনা করতেছে! আমি জানতাম মতের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। আজকে আমি এর শিকার। কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে সেটা বুঝতে পারতেছি। এখনো নিজেই জানিনা কাকে বিয়ে করছি, দেখতে কেমন, কি করে, যোগ্যতা কি কিছুই জানিনা। কি পাপ করছিলাম আমি!

পরেরদিন আমার বিয়ে, একদম ছোট পরিসরে। মসজিদে বিয়ে পড়ানো হবে। ইচ্ছে ছিল অনেক দুমদাম করে ইলিনাকে এনে অনুষ্ঠান করবো দেশে। করা হয়েছে ভালো করেই! দাদুর একটাই কথা বিয়ে শাদি ফরজ কাজ। বেশি রঙ তামাশা আর বাজিয়ে করলে শয়তান আছড় করে। রহমত থাকে না। করলাম বিয়ে, কিভাবে কি ম্যানেজ করবো আই কান্ট ইমাজিন। সারাটা পথ ভেবে আসছি। বাড়িতে আসার পর কাপড় চেঞ্জ করে ছাদে গেলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। একটা কল দিলাম ইলিনাকে ধরলো না। মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে হয়তো অনেক। দেশে এভাবে হুটহাট আসাটা ঠিক হয়নি। সমস্ত টার্গেট এলোমেলো করে দিলো দাদু।

রাত একটা বাজে। রুমে আসলাম, একটা গলা কাশি দিতেই খাট থেকে নেমে নিশি আমাকে কদমবুসি করলো। খাটে উঠে ওর ঘোমটা টেনে দিয়ে যা দেখলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। নিশি তার নামের যথার্থ রুপ নিয়েই জন্মেছিল। ওহ্ আল্লাহ! কি পাপ করছিলাম বলে এরকমটা হলো? এতো কালো মেয়ে আমার কপালে। মিনমিন করে বললাম বুইড়ার ভীমরতি হইছিলো শেষ বয়সে। নিশি কাঁদতেছে;

– কি হলো আপনার? কাঁদছেন ক্যান?
– আমি আপনার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম রবিন। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমি কোনদিন এমনটা স্বপ্ন দেখিনি। আমি আর চার পাঁচটা মেয়ের মতো কখনো ভাবিনি আমিও সুখে সংসার করবো, কারো ঘরের বউ হবো। আমার এই যোগ্যতা নেই! দাদুর মতামতের উপর আমি কিছুই বলতে পারিনি। উনি এমনটা করলেন ক্যান? উনার দয়াতেই বেঁচে ছিলাম এতোদিন। তারপরে সারাজীবনের জন্য দয়ার আশাটা করিনি আমি।

– কান্নাকাটি বন্ধ করেন। আমার জীবনটা তো শেষ’ই, কি আর করার, থাকেন।

সকালে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো গুনগুন শব্দে। নিশি কোরান পড়তেছে। সেই ছোটবেলায় আম্মার কোরান পড়া শুনে ঘুম ভাঙতো। পরে আমি নিচে নেমে আম্মার কোলে শুয়ে কোরান শুনতাম। আম্মা বিভিন্ন সূরা পড়ে আমার মাথায় ফু দিতো। কোন একটা বিশ্বাস থেকে এই ফু টা যেনো বেহেশতি সুখ দিতো আমায়। আমায় উঠতে দেখে নিশি সালাম করে বললো। নামাজটা পড়ে নেন। এখনো ওয়াক্ত রয়েছে। ভাবলাম পড়েই নেই। বিদেশ যাওয়ার পর অনেক ইরেগুলার হয়ে গিয়েছিলাম। পড়লাম, তারপর একটু বের হলাম। সুন্দর একটা সকাল। দাদুভাই মসজিদ থেকে ফিরতেছিলো আমাকে দেখে বললো;- কি বিদেশী সাহেব। কেমন কাটলো আপনার রাত? দাদুভাই এমনটা ঢং খুব কম করেন। তবে আজ ভালই লাগছে,

– দাদুভাই নিয়তিকে মেনে নিলাম।
– আলহামদুলিল্লাহ! এটাই জ্ঞানের কথা, আসো পুকুর পাড়ে বসি।
– জ্বি আসেন।

পুকুর পাড়ে এসে বসলাম। কতশত স্মৃতি জড়ানো এই পুকুর। যেখানে আমার বেড়ে ওঠা। মাছ ধরা, সাতার শেখা, আড্ডা দেয়া। ভালো লাগছে, অনেকগুলো পদ্মফুল আস্তে আস্তে ফুটতেছে। দাদুভাই অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন;

– দাদুভাই মন খারাপ করেছো? মন খারাপ করো না। পৃথিবীটা অনেক ছোট। আমরা এই ছোট পৃথিবীতে অনেকগুলো দায়িত্ব নিয়ে আসি। সুখে গা ভাসিয়ে দেয়ার মধ্যেই জীবনের স্বাদ নিহিত না, এটা ভুলে যাই। আমরা বাহ্যিক রূপ লাবণ্য, চকচক, বড়, আর বেশি এসবে আকৃষ্ট খুব। আল্লাহ আমাদের জোড়ায় জোড়ায় এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। আমরা সুন্দর খুঁজে খুঁজে মরিয়া হই।

আমরা সঠিক মানুষ পাইনা দাদুভাই। সবাই সঠিক মানুষ পায়না। ভালোবাসা চড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, খুঁজতে হবে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে, পবিত্র হয়ে পবিত্র নজরে। আমার ক্যান জানি মনে হয়েছিল এই কালো মেয়েটাই তোমার আসল জীবন সঙ্গী। জানো, আমার অনেক প্রশান্তি লাগছে অসহায় মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে। তুমি এর অবহেলা কইরো না দাদুভাই। আমি এখন নিশ্চিত হয়ে মরবো। আর তুমি তারে তোমার কাছে রাইখো। এটা নিয়ম, দূরত্ব পাপের সন্নিকটে ঠেলে দেয়। স্বামী স্ত্রীর দূরত্ব রাখতে নেই।

দাদুভাইকে কোন উত্তর দিতে পারিনি। আমি একটা জটিল পরিস্থিতির শিকার। শুধুমাত্র হুম বলে চলে আসলাম।

এসে দেখি নিশি অনেক রকম নাস্তা তৈরি করলো। নাস্তা করলাম। রুমটা অনেক পরিপাটি করে রাখা। সেল্ফে অনেক বই সাজানো। এসব বই নিশি সাথে করে নিয়ে আসছে। বাংলা সাহিত্য নিয়ে অনার্স করছে। ভালই বইপোকা। সব বিখ্যাত লেখকদের বই।

এভাবেই কয়েকদিন কাটালাম দেশে। এর মধ্যে স্বামী স্ত্রী সম্পর্কটা এখনো গড়ে ওঠেনি। নিশি তার মতো করেই সানন্দে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কাজ করছে বই পড়ছে আমার সেবা করছে। সব ঠিকঠাক, আর আমার সাদা চামড়ার মানুষ দেখতে দেখতে কালো চামড়া নিতে পারছিলাম না। একটা জিনিস ভেবে খুবই অবাক হলাম, অনেক বন্ধু বান্ধবরা আসলো বাড়িতে, নিশিকে দেখলো কথা বললো মিশলো কিন্তু এখন পর্যন্ত মেয়েটাকে নিয়ে কেউ আপত্তি দেখালোনা। বরং আমাকে পিঠ চাপড়ে বলে গেলো ভাবী একদম খাঁটি মানুষ রবিন। আমিই শুধু নিতে পারছি না ক্যান যেনো।

আজকে চলে যাচ্ছি কানাডা। গতকাল থেকেই আমার সবকিছু প্যাক করে দিচ্ছে নিশি। কিছু ঠান্ডার ঔষধ খাওয়ার নিয়ম লিখে লিখে আলাদা করে ঠিক করে দিচ্ছে। আরো কি কি যেনো প্যাক করলো। ভোর রাতে নিশির ফুঁপানো কান্নার শব্দে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। মেয়েটা নামাজ পড়ে দোয়াতে বসে কাঁদছিলো চোখ বুঁজে। অবশেষে চলে আসলাম কানাডায়। সবার আগে প্রথম দৌড়ে গেলাম ইলিনার কাছে। ইলিনা আর আমার জন্য বসে থাকেনি। ও ওর নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে অন্য দেশে ছুটি কাটাতে গেছে।

ভালবাসাটা এদেশে তাদের চামড়ার মতোই ফ্যাকাশে। বাঙ্গালীর মতো নরম কোমল হৃদয় না তাদের। ভালবাসা নামক অনুভূতির ছিটেফোঁটাও নেই। খুব ইজিলি তারা মিশে যেতে পারে আবার চলে যেতেও পারে। এসব ব্যাপারে সময় এবং মেধা কোনটাই ব্যয় করতে রাজি না তারা। ভালই হয়েছে, ভেবেছিলাম ওর কাছে কোন মুখ নিয়ে ক্ষমা চাইবো আরো কত কি। এসবের গুল্লি মেরে দিলো মেয়েটা। বাসায় ফিরে আসলাম। ব্যাগ খুলে দেখি নিশি কয়েকটা বই দিয়েছে। কয়েকটা পাঞ্জাবী, টিশার্ট সাথে ছোট ছোট চিরকুট। মেয়েটা অনেক গুছানো।

তারো অনেকদিন পর আজকে নিশি কানাডায় আসতেছে। দাদুর কথা রাখতেই ওকে আনতে হচ্ছে। আব্বুকে কল করেছিলাম। আব্বু এয়ারপোর্ট নিয়ে আসতেছে। আমিও অফিস শেষে ওকে রিসিভ করতে যাবো কাল। অফিস শেষ করে বের হতে হতে লেট হয়ে গেছে। বোকা মেয়েটা কিভাবে কি করবে কে জানে! এসে এয়ারপোর্ট ঢুকলাম। ইনফরমেশন বুথ থেকে ঘুরে খুঁজ নিলাম আধা ঘন্টা আগেই এয়ারবাস ল্যান্ড করেছে। অনেকক্ষণ খুঁজে দেখি একটা বোরকা পরা মেয়ে বেঞ্চে বসে কি যেনো লিখতেছে।

আমি সামনে যেতেই ওঠে তাড়াতাড়ি সালাম করলো, বুঝে গেলাম এটাই আমার বউ। জিজ্ঞেস করলাম কোন অসুবিধা হয়নি? তার সাবলীল জবাব, কই নাতো। বাসায় এসে কাপড় চেঞ্জ করার আগেই কাজে লেগে গেছে। কোথায় রেস্ট করবে খাবে এসব না করেই পরিষ্কার করা গোছানোতে লেগে গেল। মেয়েটা এতো স্বাভাবিক ভাবে সবকিছুতে নিজেকে কিভাবে খাপ খাইয়ে নেয় কে জানে! ফ্রিজে মাংস আর সবজি ছিলো রান্না করলো, গোসল দিলো। তারপর পেট ভরে খেলাম। অনেকদিন পর যেনো ছোট একটা বাংলাদেশ ফিল করতেছি এই ঘরটাকে। আমি বোধহয় আস্তে আস্তে নিশির প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।

নিশি আসার পর থেকে আমাদের বন্ডিং অনেক ক্লোজ হচ্ছে আজকাল। নিশি আমাকে তার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনায় প্রতিদিন। খুব হাসি হাসি করে কাছে এসে বলে এই একটা কবিতা লিখছি শুনবেন? মেয়েটার হাসি এই প্রথম খেয়াল করলাম, এতো মায়াবী হাসি খুব কম মানুষ হাসে। তার চুল তার সমান’ই। চোখ জোড়া গোল গোল। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে কিছু না কিছু অপূর্ণতা দিয়ে রাখেন। নিশির রঙটাই তার অপূর্ণতা।

– আচ্ছা শুনাও তোমার কবিতা।
– “দিবসে নিশি আমার,

গোধুলিতে প্রভাত”

“একাধারে কাটতো আমার
নির্ঘুম সকল রাত”

“বক্ষ জুরে হাহাকার কত’যে হৃদপিন্ডে করছে আঘাত”

“আজ তোমাতে ডুবে ভাসি, আবার এই মায়াতেই মৃত্যু নির্ঘাত”

“অদূর থেকে উকিয়ে আবার,
দুর্বার দুরাশা যেন দিচ্ছে ডাক”

“বলছে নির্জন একাকীত্বের স্তব্ধতায়,
দীর্ঘশ্বাস যেন আমারই থাক”

“তীব্র উষ্ণ ভাল লাগাই কি আজ দিচ্ছে মোরে দুমড়ে মুচড়ে?
নির্বাকতায় তাকিয়ে আছি শেষটা দেখবো অচিরে”

“একপা দু’পা করে এগুয়ে,
রোগ্নতা নিজেকে খুঁজি”

“অবেলায় নামলো সন্ধা,
ত্যক্ত সর্বস্ব দু’চোখ বুঁজি”

“দেয়ালে আছড়ে পরা চিত্রে রাঙ্গা সেই লাবন্য মাখা আবেগ
দগ্ধাতায় দেয়ালের দু’পিষ্ট হঠাৎ’ই হবে যেন দুর্বেদ”

“দু’টানায় পরে আজ ভাবছি খুব, সুখ কি তবে এসেছে? নাকি ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে জমেছে মধুর বিবেধ”

কবিতার আগামাথা কিছুই আমি বুঝিনা। তবে খুব ভালো লেগেছে আমার। যেনো কতশত আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছে, মনের এলোমেলো ভাবনা। কিছু ভালবাসা, কিছু প্রাপ্তি আর কিছু হারানোর ভয় সবকিছুর একটা সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে মেয়েটা।

ছুটির দিন নিশিকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে বের হলাম। সামার চলছে ওন্টারিওতে। আমি সাদা পাঞ্জাবী আর নিশি নীল শাড়ি পরেছে। বের হওয়ার পর অনেকগুলো কানাডিয়ান মেয়েরা জড়ো হয়েছে। ভেবেছিলাম নিশি ভড়কে যাবে! কিন্তু অবাক হলাম কতো সাবলীল ভাবে ইংরেজিতে তাদেরকে আমাদের সংস্কৃতি বুঝিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা ইংরেজিতেও অনেক পটু। ভাবাই যাচ্ছেনা গ্রামের বাসিন্দা হয়েও তার মধ্যে কোন কিছুর কমতি নেই। দাদু মানুষটা সত্যিই খুব জ্ঞানী। আমরা দুজন বাইরে দুপুরের খাবার খেয়ে বাঙালী মার্কেট থেকে কিছু সবজি মাছ মাংস কিনে ফিরলাম বাসায়। মেয়েটা এসেই সবজি, মাছ কাটাকাটিতে লেগে গেছে। এই প্রথম ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। চোখ বুঁজে বুঁজে এগিয়ে সত্যিই ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

মধ্যরাতে হঠাৎ নিশির ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। কান্নার জন্য কিছু বলতে পারছে না। ফুঁপাচ্ছে।
– নিশি কি হলো? কাঁদছো ক্যান?
– দাদুভাই মারা গেছেন রবিন।

যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথায়। দাদু চলে গেলেন। আমার জীবনের সেরা মানুষটাকে হারিয়ে ফেললাম। নিশি খুব বেশি ভেঙে পড়েছিলো। অনেক কষ্টে ওকে স্বাভাবিক করলাম। এভাবেই কেটে যায় একবছর। একদম আমাদের বিবাহ বার্ষিকী যেদিন সেদিন নিশি আমাকে ফোন করে বললো। আমি নাকি বাবা হতে যাচ্ছি। এ এক অদ্ভুত সুখ। কিএক্টা যেনো এলোমেলো হয়ে যায়, ইচ্ছে করছিলো অফিস থেকে উড়ে চলে যাই নিশির কাছে। আজকে নিশিময় আমার পৃথিবী। অনেকগুলো ফুল আর একটা গিফট কিনলাম ওর জন্য। বাসায় এসে হাটু গেড়ে প্রপোজ করলাম। ও একটা হাসি দিয়ে বললো কয়েকটাদিন পেছনে ঘোরানো উচিত ছিলনা?! এই মেয়েটা অসম্ভব রোমান্টিক। জড়িয়ে ধরে বললাম তাই না? ঘুরাবা? দাঁড়াও, তোমাকে নিয়েই ঘুরবো। কোলে তুলে ইচ্ছে মতো ঘুরালাম অনেক। এখন চিল্লাছে; এই ফাজিল নামাও পরে যাবো তো। ঠিক আছে বাবা ঘুরাবো না, প্রপোজাল এক্সেপ্টেড।

কিছুদিন পর হাফ ডে অফিস করে নিশিকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গেলাম। সবকিছু ঠিকঠাক। আমাদের একটা মেয়ে আসবে বলেছে ডক্টর। আমার এতো ভাল লাগছে বলে বুঝানো সম্ভব না। ক্যান জানি দাদুর প্রতিটি কথা আমার আজ প্রাণে বাজছে। খুব হাসিখুশি মনেই সেদিন হসপিটাল থেকে বের হই। রাস্তার পাশে ওকে দাঁড় করিয়ে আমি ওপাশ থেকে কিছু ফ্রুট কিনছিলাম। হঠাৎ পেছনে একটা শব্দ শুনে তাকালাম।

নিশি রাস্তায় পরে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পিচ। নাহ্ আর নিতে পারছিলাম না। চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসছে, আমি পরে গেলাম রাস্তায় থেঁতলে। তিনদিন হসপিটালে এডমিট থেকে আমার নিশি আমার পৃথিবীটা অন্ধকার করে চলে গেলো। একটা রেস কার স্ট্যান্ট করতে গিয়ে উল্টে গিয়ে নিশির উপর পরে। আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। অনেকদিন চিকিৎসার পর আমি দেশে আসি লম্বা একটা ছুটি নিয়ে। নিশির একটা ডায়েরী ছিলো, এতো সুন্দর করে গুছিয়ে লিখা ডায়েরী। কিছু কিছু পাতায় বড্ড অভিমানের ভাষায় লিখা;- “আমাকে আপনি কালো বানালেন ক্যান? আমি কি দোষ করছিলাম, হ্যাঁ? আচ্ছা আমার স্বামী কেমন হবে? কালো হবে? দেন দেন সব কালোই দিয়ে দেন”। আরো কিছু পাতায় অনেকগুলো কবিতা ছিলো। ছিলো আমায় নিয়ে অজস্র মনের কথোপকথন। এয়ারপোর্টে বসে কিছু লিখা ছিলো:- “আপনি কি আমাকে এসে খুঁজবেন? খুঁজে পাবেন? আমাকে এসে নিবেন তো? অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। আচ্ছা ভালবাসা হবে আমাদের? আমি কিন্তু আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি, আপনি শুধু আমার”

দেশে ফিরলাম। সেই গ্রাম সেই পুকুর সবকিছুই আগের মতো আছে। নাই আমার ভালোবাসার মানুষ দুটো। দাদু ভাইর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষন কেঁদে কেঁদে বললাম; পারিনি দাদু আপনার কথা রাখতে। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। আপনিই আমার শেষ ভরসা ছিলেন। আপনিই সঠিক ছিলেন। আমি আপনার কাছে আসা অবধি আমার নিশিকে আপনার হেফাজতে রাইখেন আবার। প্লিজ দাদুভাই প্লিজ।

আম্মা আব্বু আপু সবাই হন্নে হয়ে আমার জন্য বউ খুঁজতেছে। আবার বিয়ে করাবে। আগেরবার ছিলো দাদুর আবদার আর এবার আমার মায়ের আবদার। আমাকে নিয়ে যেনো কেউ একজন খেলতেছেন। ক্যানো? জানিনা। সবার মন রক্ষার্থে আমি কিছুই বলছি না। নিশি আমি আর দাদু আমরাই ছিলাম আমাদের। আজ যেনো সবাইকে খুব স্বার্থপর লাগছে। আমিও তাদের মনোরঞ্জন করতে বিয়ের পিরিতে আবার বসলাম। অনেক সুন্দরী সুন্দরী দেখে আমাকে দেখানো হচ্ছে কিন্তু আমার নিশির মতো কাউকে খুঁজে পেলাম না। অবশেষে দুমদাম করে একজনকে করলাম আবার বিয়ে। বাসর ঘরেই সে আমার পায়ে পরে বলেছিলো আমাকে আপনি হেল্প করেন। আমাকে জোর করে এই বিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি আরেকজনকে ভালবাসি। আমি ওকে ছাড়া বাঁচবোনা। আমি ওকে চাই। করলাম হেল্প, নিম্নচাপের জন্য কয়েকদিন আবহাওয়া অনেক খারাপ। ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যেও হানিমুনের নাম করে মেয়েটিকে তার ভালবাসার মানুষের কাছে পৌঁছে দিলাম।

তারপর এগারো তলা হোটেলের ছাদের একদম কিনারে দাঁড়িয়ে আছি, আকাশের পানে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজছি আর নিশিকে ডেকে বলতেছি:- আমি কত স্বার্থপর দেখলা নিশি? বলেছিলাম না আমি শুধু তোমার? কিন্তু তারপরেও আমি আরেকজনকে খুঁজতে নেমে পরছিলাম। কতো খারাপ আমি। রাগ করেছো সোনা? পুরুষ মানুষগুলাই সব খারাপ, এটা বলতেছো? আচ্ছা তাহলে আমার শাস্তি কি হওয়া উচিত? কি বললা? তোমার কাছে চলে আসবো? আচ্ছা ডান, আসতেছি বলেই সামনে এক’পা এগুলাম। আমি উড়তেছি, আমি যাচ্ছি আমার নিশির কাছে। এই নোংরা পৃথিবী হয়তো এটাকে অতিরঞ্জিত করে সমাজে আমাকে হেয় করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, নেক। নিশি আর আমিই সত্য।

“জীবনের বাঁকে গল্প নতুবা গল্পের বাঁকে জীবন”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত