অন্যমনস্ক হয়ে চলতে চলতে হঠাৎ ছিটকে পড়লো অনামিকা, তার সাথে সাথে একটা সাইকেল… মানে একটা সাইকেল সহ একটা লোকও হুড়মুড়িয়ে তার প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়লো।
-কি কালা নাকি কানা! রাস্তা দিয়ে চলতে পারেন না নাকি? যত্তসব ফালতু পাবলিক সব আমার কপালেই জোটে গজগজ করতে করতে লোকটি সাইকেলটা তুলে নিজে ওঠে রাস্তা থেকে।
ততক্ষণে ঘোর কেটে গেছে অনামিকার, লজ্জাও করছে খুব লোকটির গজগজানি শুনে।
উঠতে গিয়ে প্রথমে উঠতে পারে না, একটু সামলে নিয়ে কোনোমতে উঠে পড়ে। পায়ের কাছে শাড়ীটা অনেকটা ছিঁড়ে গেছে। থুতনিটা অসম্ভব জ্বালা করছে হাতের তালুটা ছড়ে গিয়ে সাদা মাংস বেরিয়ে গেছে জলজলে একটু রক্ত চোঁয়াচ্ছে। কেনোমতে কষ্ট করে উঠে বলে, সরি সরি দাদা!
লোকটি সাইকেলটা তুলে নিয়ে বললো, কি সরি!
সরি বললে কি হয়? ওটা কি কোনো ব্যাথার মলম নাকি? রাস্তা দিয়ে চলতে পারেন না ? আপনাদের মতো পাবলিকের তো রাস্তায় বেরনোই উচিৎ না।
কি বলবে অনামিকা ভেবে পায়না। নেহাত্ ভর দুপুর রাস্তায় লোক চলাচল কম তাই কোনো লোক জমা হয়ে যায়নি এতক্ষণে নইলে লজ্জার শেষ থাকতো না।
এতক্ষণে তার খেয়াল হয়েছে বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। করুণ সুরে বললো, এটা কোন জায়গা দাদা!
লোকটি যারপর নাই বিরক্ত হয়ে বললো, কোথায় যাচ্ছেন জাননেনা ? তো যাচ্ছিলেন কোথায় উদ্ভ্রান্তের মতো! পাগল নাকি আপনি? ততক্ষণে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে অনামিকা। হতম্ভবের মতো বললো, না মানে…
-এটা মালঞ্চ! আপনার জন্য আমার হাটে যেতে দেরী হয়ে গেল। তো কোথায় থাকা হয়, আপনাকে তো এখানে আগে দেখিনি কখনো!
উল্টো দিকে ততক্ষণে হাঁটা শুরু করে দিয়েছে অনামিকা। পায়ে ভালোই লেগেছে, তবু লোকটিকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাহলে আরো হয়তো কিছু কথা শুনতে হবে ভয়ে। লোকটি তখনও বলে চলেছে, কোথায় যাবেন, কোথাথেকে এসেছেন?
কোনো জবাব না দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ দিয়ে চলতে থাকে সে। কোথায় যাচ্ছিলো সে নিজেই জানেনা। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে সূর্য যেন প্রচন্ড রাগে জ্বলছে। খাঁ খাঁ করছে রোদ। মাথাটা কেমন যেন টাল খাচ্ছে।
হঠাৎ হঠাৎ করেই মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় অনামিকার। মনে হয় বেকার এই জীবনের বোঝা বয়ে বেড়ানোর কোনো মানেই হয় না। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে নিজেকে খুব একা লাগে। মনে হয় সংসারে আর তার কোনো প্রয়োজন নেই। ছেলে মেয়েরা সব বড় হয়ে গেছে। নিজের নিজের সংসারে ব্যাস্ত। দিনান্তে একবার করে ফোন করে খোঁজ খবর যে নেয় এটাই অনেক। আর স্বামী! সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক সময় মতো খাবার, ঠিক সময় মতো ঘুম, বন্ধুবান্ধব, গল্প, আড্ডা পেলেই হলো। অনামিকার কোনো ব্যাপারে এখন আর মাথা গলান না। সে কোথায় গেলো, না গেলো এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। শরীর খারাপ না ভালো এসব নিয়েও কোনো হেলদোল নেই। আগে সে কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এসব নিয়ে প্রশ্ন করতো কিন্তু এখন মানে বিয়ের এতো বছর সংসার করার পর বুঝে গেছে,যাবে আর কোথায়, যাওয়ার কোনো জায়গা আছে নাকি!
ঠিক ফিরবে মানে ফিরতে হবে ইট পাথরের ঘরে। অনামিকার মনে হয় এটা কোনো বন্দীশালা, হাতে পায়ে শিকল নেই তবে সময়ের বেড়াজাল আছে সেখানে।
অনামিকা একটু অন্যরকম,কম কথার মানুষ সে।ভাবে সবাই তাকে বুঝবে, সে কি চায় না চায় তার গুরুত্ব দেবে! না সব বৃথা। জোর করলে হয়তো যা চায় তা পেতো কিন্তু সেই চাওয়াটা সে পারেনা। মাঝে মাঝে হিসেব মেলাতে বসে কি এমন চাই যে সেটা কেউ দিতে পারে না। একটু সময়, একটু যত্ন, একটু ভালোবাসা… এই তো!
যখন ছেলে মেয়েরা ছোটো, যখন স্বামী স্ত্রী দুজনের দুজনকে প্রয়োজন, তখন তিনি নিজের টুকু বুঝে সব দায়িত্ব অনামিকার কাঁধে চাপিয়ে নির্বিকার থেকেছেন। এখনও তাই, রোজগার করে সংসার কি লাগবে না লাগবে এনে দিয়ে দায়িত্ব সেরেছেন। মনের খবর কে বা রাখে!
অনামিকা ভাবে এখন সংসারে দুটো প্রাণী,একজন নিজের টুকু ষোলআনা বুঝে নেওয়া ছাড়া অন্যজন কি চায় বা কি খেলো না খেলো এসবের ধার না ধেরে কি করে এতটা নির্লিপ্ত থাকতে পারে!
প্রথম প্রথম এসব নিয়ে রাগ করতো, অভিমান করতো, কিন্তু পরে দেখেছে এসব করা বৃথা! যার উপর অভিমান করে সে যদি তা না বোঝে তো কি লাভ এসবের। দু একবার এসব নিয়ে বলতে গিয়ে দেখেছে অশান্তি মনোমালিন্য তৈরী হয়েছে আরো বেশী। তাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে চুপচাপ। মন বেশী খারাপ হলে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়, ভাবে নিজেকে যদি অন্য সবার মত ব্যাস্ত রাখতে পারতো তবে এই মন খারাপ বা একাকিত্ব তাকে এতোটা কষ্ট দিতোনা।
এদিক সেদিক উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াতে গিয়েই আজ এই বিপত্তি। বাড়ি ফিরতেই কড়া কথা শোনাতে শোনাতে তার স্বামী বলে, সারাদিন তো ঢ্যং ঢ্যং করে ঘুরে বেড়াও, তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আমার একটা পরিচিতি, একটা সন্মান আছে, সেটা যেন এই বয়েসে তোমার জন্য খোয়াতে না হয়, কথাটা যেন মাথায় থাকে।
সে ভেবেই পায় না, এতোগুলো কথা বলার আগে
লোকটা একবারো তো চিন্তা করলো না যে সে যদি সারাদিন ঢ্যাং ঢ্যং করে ঘুরেই বেড়ায় তবে হাতের কাছে সমস্ত কিছু পরিপাটি করে সময় মতো পায় কি করে!
কথা বলতে ইচ্ছে করলো না, তার কঠিন অসুখ করেছে, একাকিত্ব তাকে গ্রাস করছে ধীরে ধীরে। সারাদিন নিজেকে যন্ত্র মনে করে। শরীরের দিকে খেয়াল রাখতে ইচ্ছে করে না, খেতে ইচ্ছে করে না। শুধু রাত আসার অপেক্ষা করে, রাত আসলেই তার একমাত্র সঙ্গী একটা ঘুমের ওষুধ। যা তাকে তার একাকিত্বের যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়ে নিজের ভালোলাগা বা ভালোবাসার জগতে নিয়ে যেতে পারে।
মাঝে মাঝে মনে হয় বেশ কিছু ঘুমের ওষুধের সাহায্য নিয়ে চিরদিনের মতো একাকিত্বের থেকে মুক্তি পেতে।
না সেটা সে পারবে না, তাতে পরিবারের মান সম্মান নষ্ট হবে।
হায়রে জীবন! নিজের জীবনের প্রতি অনামিকাদের মতো মানুষের কোনো অধিকার নেই, বেঁচে থাকাটা মূল্যহীন হলেও মরা যেন কারো সন্মান হানীর কারণ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে চিরদিন।