অপরাধী

অপরাধী

ওই ছয় বছরের ছেলেটার সাথে যেন এক অব্যক্ত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে মিতা… ছেলেটা যে অপরাধ করছে ওর চোখেই টের পাওয়া যায়…কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কৌশলে মিতার চোখ থেকে সে বাঁচিয়ে নেয় নিজেকে প্রত্যেকবার…

ঘটনাটা শুরু হয় সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই…. দু মাস হলো মিতা মা হয়েছে… সিজারিয়ান বেবি…. তাই সে শারিরিকভাবে বেশ দুর্বল…. শুভ্র কেউ অফিস যেতে হয় রোজি… তাই কাজের মেয়ে তুলসীর উপর মিতা ভীষণভাবে নির্ভরশীল… বেশ কিছুদিন তুলসী আসতে দেরি করছিল সকালে… জিজ্ঞাসা করাতে বলে,”কি করুম দিদিমনি..ছেলেডা কাজে আসছি দ্যাখলেই কয় মুই ও যামু,কিছুতেই পিছু ছাড়তে চায়লা..উয়াকে লুকায় পরে আসতে টো হয় মুকে.”

মিতা এখন ছোট্ট তিস্তা কে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত…. পরিবারের সেরকম কেউ নেই যে এই অবস্থায় একটু সাহায্য করবে ওকে… এই সময় তুলসী দেরি করে এলে শুভ্র টিফিন টুকুও নিয়ে যেতে পারবে না… তাই সে তুলসি কি জিজ্ঞাসা করল, ” তোমার ছেলে কত বড়?”

তুলসী বলে,”বেশি বড়ো লয় কেনে…পাঁচ ছয় সাল হবেক…আমরা তো উ তুদের মতো হিসাব টা জালিক লা.”
” বেশ তো,তুমি ওকে নিয়ে এসো তোমার সাথে,”বলে উঠলো মিতা বাধ্য হয়ে.

পরদিন তুলসীর সাথে ওর ছেলে বংশী ও এল… ওকে প্রথম দেখে মিতার ভালো লাগলো না ওর দৃষ্টি টা… ওর চোখ গুলো যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে কিছু একটা…

“বাড়িময় দামি জিনিস পত্র ছড়ানো রয়েছে.. কার মনে কি আছে কে বলতে পারে? একটু চোখে চোখে রাখতে হবে ছেলেটাকে”… নিজের মনেই বলে ওঠে মিতা…

ছেলেটা কম কথা বলে… বেশিরভাগ সময়ই এক জায়গায় বসে এদিক ওদিক দেখতে থাকে… কখনো মায়ের সাথে কাজ করে দু-একটা… প্রথম দুদিন ওর দৃষ্টি টা ছাড়া আর কিছু অস্বাভাবিক চোখে পড়েনি মিতার… কিন্তু তার পরে একদিন রান্নাঘর থেকে তিস্তার কান্না শুনে বেড রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখে বেডরুমের এক কোণে ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা.. মিতা বেশ রেগে জিজ্ঞাসা করে,”এই ছেলে,তুই বেডরুমে কি করছিস?”

“মুকে মা ঝাড়ু দিতে কইছিলো ই ঘরটা”ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয় সে…
তবে তার গলার অস্বাভাবিকতা সহজেই প্রমান করে মিথ্যে বলছে সে… কিন্তু ছেলেটার হাতে এমন কোনো জিনিস নেই যে তাকে চোর বলা যায়…বা কোনোজিনিসই তো হারায়নি ওদের বাড়ি থেকে…সরাসরি তুলসীকে বলাও যায় না যে ছেলেকে এনোনা… এখন কাজের মেয়ের যা অভাব… তুলসী কাজ ছেড়ে দিলে অকূল সাগরে পড়বে মিতা…তাই ঠিক করে হাতে নাতে ধরবে ছেলেটাকে…

ছেলেটাকে আড়চোখে লক্ষ্য করতে থাকে প্রায়ই…বেশিরভাগ সময়ই ওর চোখ থাকে বেডরুমের দিকে… তবে ছেলেটা কম হুশিয়ার নয়… মিতা অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই ধরতে পারছে না ওকে এত সাবধানী সে, কিন্তু রোজ যে সে সুযোগ পেলে বেডরুমে ঢুকে যায় সেটা বেশ বুঝতে পারে মিতা..

অবশেষে একদিন ধরতে পারল তাকে… বেডরুম থেকে যেই বের হচ্ছে অমনি চেপে ধরে ওকে মিতা….” এই ছেলে তোর হাতে ওটা কি? কি লুকোচ্ছিস.. দেখা.. দেখা আমাকে? ”

প্রথমটায় না দেখাতে চাইলেও মিতার চাপাচাপিতে সে হাতের জিনিসটা এনে দেখায় মিতাকে…দেখে বেশ অবাক হয়ে যায় সে … একটা পুরোনো খেলনা ওর হাতে… খেলনাটা তার বাড়ির নয় হয়তো ছেলেটারই…ছেলেটাকে আর কিছু বলতে না পারলেও জেদ চেপে যায় ওর মনে.. কি এমন করে ও মিতাকে লুকিয়ে যে ও ধরতে পারে না??

শুভ্র কে সব বলতে ও ব্যাপারটা বেশ মন দিয়েই শোনে… শেষে বলে,” ঠিক আছে তোমার যখন এত সন্দেহ তোমার ক্যামেরাটা অন করে রেখো, ও কি করে না করে ধরা পড়ে যাবে সবই… ”

আইডিয়াটা মন্দ লাগে না মিতার… পরদিন ক্যামেরা লাগিয়ে প্রহর গুনতে থাকে শুভ্রর বাড়ি ফেরার…

রাতে শুভ্র আসা পর্যন্ত অনেক প্রশ্ন ও কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করল মিতা… শুভ্র আসতেই রেকর্ডিং টা চালু করে দিল…

ছেলেটা রান্না ঘরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিল একবার… তারপর বেডরুমে পা টিপে টিপে ঢুকলো চোরের মত… তিস্তার দামী দামী খেলনায় ওর কোন নজর নেই… ডেস্কে রাখা খাবারের দিকেও না… এগিয়ে গেল তিস্তার দিকে…ও তখন ঘুমিয়ে… ছেলেটার হাতে পুরোনো সেই খেলনাটা…তিস্তার কাছে গিয়ে বলছে,”বনু দেখ,মুই তুর লাগি ই খেলনাটা আনিছি…তু আর মুই একলগে খেলবো কেনে…”
তারপর ছেলেটার গলার আওয়াজে জেগে তিস্তা… না কাঁদছে না ও… হয়তো পরিচিত সে এই কথাগুলোর সাথে…

ভিডিও টা দেখতে দেখতে চোখে জল গড়িয়ে পড়ে মিতার..শুভ্রর চোখ ও আর্দ্র হয়ে ওঠে .. চোখ মুছে মিতা বলে, “বোকাটাকে কাল বলে দেবো বোনের সাথে খেলতে লুকিয়ে লুকিয়ে আসতে হয় না. ”

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত