ছোট্ট তুতুলের মনে ভারি দুঃখ। ও কখনো পরীদের দেখা পায় না। ওর খুব ইচ্ছা করে ঐ রঙচঙে ছবিওয়ালা বইটার সাদা জামা পরা এলিসের মত ও যদি একটু আজব দুনিয়ার সফরে যেতে পারত কী ভালোই না হত! অথবা ঐ পরীর গল্পগুলোর মধ্যে যদি ঢুকে পরতে পারত!! কী মজাটাই না হত!
ওদের ফ্ল্যাটের বারান্দা দিয়ে ঝাঁ চকচকে শহর দেখা যায়, বড় বড় শপিং মল দেখা যায়। সুইমিং পুলওয়ালা পার্ক দেখা যায়। কিন্তু আকাশ দেখা যায় এই এক টুকরো, তাও কেমন ধূসর মন খারাপের মত রঙ। তাতে সাদা মেঘের নৌকা নেই, ওতে চড়েই তো পরীরা আসে। অনেক খুঁজেও বড় গাছ চোখে পড়ে না, যাতে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি লুকিয়ে থাকতে পারে। খেজুর বা পাম গাছে সাজানো শহর। নকল গাছ ও রয়েছে কিছু। ওদের ব্যালকনিতে মা অনেক ফুলের গাছ করেছে, তবুও প্রজাপতি আসে না।
তিতির রোজ রাতে ওর রঙিন গল্পের বইগুলো মাথার কাছে নিয়ে শোয়, যদি স্বপ্নের ভেতরেও ও পৌঁছে যেতে পারে এক রূপকথার দুনিয়ায় কী মজাই না হবে! কিন্তু ও স্বপ্নেও রূপকথার দেশের দেখা পায় না। আসে না কোনো পরীর দল। ডাইনি-বুড়ির মত দেখতে ওদের প্রিন্সিপাল আর খুব রাগী মিসটাকেই ও দেখে স্বপ্নে।
তুতুলের বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে, সেদিন ছুটির সময় বৃষ্টিতে ভিজছিল বলে মিস কত বকেছিল। আরেকদিন টিফিনের সময় ও খরগোশের গর্ত খুঁজছিল ঝোপের ধারে। যদি এলিসের মত ঢোকা যেত একবার …… ঠিক তক্ষুনি প্রিন্সিপাল মিস ওকে দেখে ফেলল। ডায়েরি নোটও দিল।
স্কুলে দুটো বড় বড় হলুদ আর লাল ফুলের গাছ আছে, একটায় টেনিস বলের মত হলুদ ফুল হয়, মা বলেছিল কদম ফুল, আরেকটা কৃষ্ণচূড়া। ঐ গাছ দুটোয় যদি ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি আসে তাই ক্লাসের ফাঁকে মাঝেমাঝেই তুতুল ওদিকে তাকিয়ে থাকে। সেদিন মিস দু’বার ডেকেছিল ‘রূপকথা’ বলে। ও না হয় শুনতে পায়নি। বড় লেজওয়ালা পাখিটাকে দেখছিল একমনে। তাই মিস ওকে দু টো পিরিয়ড ব্ল্যাকবোর্ডের পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সব বন্ধুরা হেসেছিল। পিয়াল ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড। ও বলে তুতুলের ভালো নাম যেহেতু রূপকথা তাই ও রূপকথার দেশেই থাকে। ওর নামটা বদলে নেওয়া উচিত।
ঈশ…. কেন বদলাবে তুতুল। নামটা তো ঠাম্মি রেখেছে। ঠাম্মি কী সুন্দর সব রূপকথার গল্প শোনায়। ছড়া বলে বলে সব গল্প। পিয়াল তো সে সব শোনেইনি কখনো। মা অবশ্য এলিস, রাপুনজেল, স্নো হোয়াইটি আর সিন্ডারেলার গল্প বলে। সেগুলোও সুন্দর তবু ঐ তেপান্তরের মাঠ, সোনার কাঠি রূপার কাঠি, রাক্ষসের গল্প শুনতে তুতুল খুব ভালবাসে। আর আছে টুনটুনি পাখির গল্প।
পরীক্ষা শেষ বলে তুতুল গ্ৰামের বাড়ি এসেছিল ঘুরতে। ঠাম্মি আর দাদু থাকে পাহাড়ের কোলে মেটেলি নামে এই ছোট্ট গ্ৰামে। তুতুল এর আগে খুব ছোট থাকতে দুবার এসেছিল। দু’বছর আসেনি।
এখানে এসেই তুতুলের মন ভাল হয়ে গেছিল। কি সুন্দর ঢেউ খেলানো চা বাগান, ওর ড্রইং কপির মত নীল পাহাড়, দূরে কয়েকটা সাদা আইসক্রিম পাহাড়ও দেখা যায়। আর গাছগুলো কী বিশাল বিশাল!
বাড়ির পিছনে ছোট্ট নদী নুড়ি পাথরের মাঝে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে আপন মনে, এরা বলে ঝোরা। কাঠবিড়ালি আর বুনো খরগোস ছুটে বেড়ায় আপন মনে। এমন কালচে, ধুসর, বাদামি ছিটছিট খরগোস আগে দেখেনি তুতুল। আর সকাল বিকেল আসে কত রকমের পাখির ঝাঁক। তাদের কিচিরমিচির, চারদিকে ফুল , মাঠ চা বাগান আর সবুজ বন। তুতুল ভাবে এখানে ঠিক পরীর দেখা পাওয়া যাবে। এই জায়গাটাই তো রূপকথার দেশের মত।
সেদিন নদীর জলে পা চুবিয়ে বসে পেয়ারা খেতে খেতে একটা সজারুর মত ছোট্ট জন্তু দেখে লাফিয়ে উঠেছিল তুতুল। একটা বড় পাথরের ফাঁকে ঢুকে গেছিল ওটা। পরে ঠাম্মি শুনে বলেছিল ওটা নাকি প্যাঙ্গোলিন। সংখ্যায় এত কমে গেছে দেখাই যায় না আর।
তুতুল দু’দিন বুনো হাতিও দেখেছে বারান্দায় বসে। খুব সকালে বা সন্ধ্যা বেলায় এখানে হাতির দল আসে। অবশ্য সবাই পটকা ফাটিয়ে ড্রাম বাজিয়ে ভয় দেখিয়ে ওদের তাড়িয়ে দেয়। ওরা নাকি ফসলের ক্ষতি করে। দাদু বলেছিল আসলে মানুষরা জঙ্গল কাটতে কাটতে সব দখল করে নিচ্ছে। ওরাই বা যাবে কোথায়?
নীল আকাশে তুলোর পেঁজার সাদা মেঘের আনাগোনা দেখে রোজ তুতুল ভাবত পরীদের দেখা সে পাবেই। সবুজ বড় বট গাছটার অসংখ্য ঝুড়ির ফাঁকে ও ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমিকে খুঁজত।
ওয়েস্টকোট পরা ঘড়ি হাতে খরগোশের দেখা না পেলেও একটা সাদা কালো খরগোশের পিছনে ছুটতে ছুটতে বট গাছটার কোটরটা দেখতে পেয়েছিল তুতুল। কয়েকটা ঝুড়ি ওটাকে এমন ভাবে আড়াল করে রেখেছিল যে এই কয়দিন ও দেখতেই পায়নি। খরগোশটা ঐ কোটরে ঢুকেছিল প্রথমে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ করেই গাছের কোটরটা দেখতে পেয়ে তুতুল ঢুকেই পড়েছিল।
ওমা !! থাকে থাকে সিঁড়ি নেমে গেছে ভেতরে। তুতুল ভাবল এটাই কি তবে সেই অজানা দেশের রাস্তা? সিঁড়ি দিয়ে নামছিল ও ধীরে ধীরে, একটু পরেই আলো কমে আসল, তবে ঘুটঘুটে অন্ধকার নয়, নিচে একটা হাল্কা নীলচে আলোর রেশ রয়েছে। কিন্তু নামতে নামতে কত নিচে ও নেমে এসেছে বুঝতে পারছিল না আর। তবে উত্তেজনায় ভয় পেতে ভুলেই গেছিল। হঠাৎ নিচটা দেখতে পেল, একটা নীলচে আলোয় সমুদ্র, নাকি মেঘের আস্তরণ!! ধোঁওয়া ধোঁয়া নীলচে মেঘের সমুদ্রের মাঝে নেমে গেছে সিঁড়িটা। তুতুল ও ঢুকে গেল ঐ মেঘের ভেতর।
আরও কিছুটা নামতেই ও দেখতে পেল একটা নীলচে সবুজ আসমানি রঙের মাঠ, মাঠের শেষে কি সুন্দর বাগান। বাগানের গাছ গুলো সব অন্যরকম। আর এক গুচ্ছ প্রজাপতির মত নীল পরীর দল খেলে বেড়াচ্ছে সেখানে, এমন আসমানি নীল পরী আগে কখনো দেখেনি তুতুল।
পরীরাও ওকে দেখতে পেয়ে ঘিরে ধরেছিল। এরপর বেশ কিছুক্ষণ ওদের সঙ্গে গল্প করেই কেটে গেল। ওরা ওদের দেশটা ঘুরিয়ে দেখাল তুতুলকে। সোনালী রঙের কাঠবেড়ালী, রামধনু রঙের ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি , দুধ সাদা বড় রাজ হাঁস, কত কী রয়েছে সে দেশে।
পরীদের দেশে শুধুই শরৎ আর বসন্ত, দুটো ঋতু। সব গাছেই ফুল রয়েছে, কত নাম না জানা ফল রয়েছে। একটা বড় নদীর ধারে ময়ূরপঙ্খী নাও নিয়ে দাঁড়িয়ে সেই খরগোসটি, সে তুতুল কে দেখেই বলল নদীর ও পারে গোলাপি পরীরা থাকে, এমন সাতটি নদীর ধারে সাত রঙের পরীদের দেশ। সব শেষে কালো আর অন্ধকার দেশে থাকে রাক্ষসের দল। ময়ূর পঙ্খীতে চড়ে সাতটি দেল ঘুরে আসল তুতুল। সবুজ পরীর দেশে পান্না সবুজ গাছ, আর সব সবুজ ফল, লাল পরীদের দেশের গাছের পাতাও লাল, হলুদ পরীরা একটু চুপচাপ, মেশে কম। বেগুনী পরীর দল শুধুই হাসে। কমলা পরীর দেশের মাটিও কমলা, ওরা অনেক ম্যাজিক জানে। আর সাদা পরীদের দেশের সব ফল, পশু, পাখি সাদা। জামরুল ছাড়া আর কোন ফল সাদা হয় আগে তুতুল জানতই না। সব পরীদের সঙ্গেই তুতুলের বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল।
সবশেষে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমির পিঠে চড়ে তুতুল গেল মেঘের ওপর পরীদের রানির সঙ্গে দেখা করতে। সোনালী রঙের প্রাসাদের পৌছতে হয় দুধ সাধা ঝর্ণার ভেতর দিয়ে।পরী রানি হাতির দাঁতের নৌকায় চড়ে মেঘের ভেতর ভেসে বেড়ায়। সেই রাজপ্রাসাদের বাগানে কত নাম না জানা ফুলের গাছ।
তুতুল সব ঘুরে ঘুরে দেখছিল আর অবাক হচ্ছিল। ও পরী রানিকে শেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলল ওদের শহরে কেন পরী দেখা যায় না? কেন ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি নেই? শহরের বাচ্চারা যে এদের চেনেই না।
পরীরানি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল যে শহরের বাচ্চারা তো রূপকথার গল্প কম শোনে। তাছাড়া শহরে এত গাছ নেই, ফুল নেই, পরীদের খেলার জায়গা নেই, নীল আকাশ নেই। তাই তো পরীরা যায় না ওখানে। ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমিদের বসার জন্য বড় গাছ চাই, মাঠ চাই, ওড়ার জন্য দূষণহীন খোলা আকাশ চাই। তাই ইচ্ছা থাকলেও আর পরীরা যেতে পারে না।
ফেরার সময় ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমি ওকে সেই ঝুড়ি ওয়ালা বট গাছের কাছে নামিয়ে দিয়ে একটা রামধনু রঙের বড় পালক দিল। আর বলল যখনই ওর পরীর দেশে যেতে ইচ্ছা করবে এই পালকটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে। পালকের সঙ্গে সঙ্গে ও পৌঁছে যাবে ঐ দেশে।
মায়ের ডাকে যখন তুতুলের ঘুম ভাঙল, ও দেখে ও বটগাছের নিচে ঘাসের মধ্যেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। উঠে বসে চোখ কচলে ও চারদিকে তাকায়, একবার বটগাছের চারদিক ঘুরে আসে, কোটরটা আর দেখতে পায় না। একটা সরু ফাটল আছে অবশ্য, তবে তা দিয়ে তুতুল গলতে পারবে না। কিন্তু ওর পরিষ্কার মনে আছে এ পথেই ও গিয়েছিল পরীর দেশে!!
মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফেরার সময় মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। ও কি তবে স্বপ্ন দেখল? হঠাৎ মনে হল হোক না স্বপ্ন!! পরীর দেশ তো দেখা হল। হাত পা ধুয়ে জামা বদলাতে গিয়ে তুতুল দেখল ওর জামার পকেটে একটা রামধনু রঙের পালক!! ঠিক যেমন ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমির গায়ে ছিল। ওমনি ওর মনে পড়ল ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমির কথাটা। পরীর দেশের চাবি এখন ওর হাতের মুঠোয়। এবার শুধু পরীদের শহরে আসার ব্যবস্থা করতে হবে সবাইকে বুঝিয়ে।