সিরিয়ালআসক্ত ফ্যামিলি

সিরিয়ালআসক্ত ফ্যামিলি

আমার মা প্রচুর পরিমাণে সিরিয়াল আসক্ত।দিন নেই রাত নেই সারাদিন সিরিয়াল নিয়ে বসে থাকেন।প্রতিটা ভারতীয় চ্যানেলের প্রতিটা সিরিয়ালের কাহিনী তার মুখস্থ। কিছুদিন ধরে মা স্বপ্ন দেখছে যে তার পরিবার সিরিয়ালের পরিবারের মত হবে।আর তাই তিনি ঠিক করেছেন যে এখন থেকে বাড়িতে সিরিয়ালের মহিলাদের মতই সেজেগুজে চলবেন।

যেই ভাবা সেই কাজ নিজের যত দামী দামী শাড়ি গয়না আছে সব বের করে তিনি একেকদিন একেক শাড়ি পড়তে শুরু করলেন।শুধু এসব করেই থামেন নি তিনি।আমাকে আর বাবাকেও এখন থেকে সবসময় ফর্মাল পোশাকে থাকতে বললেন। যদি আমরা না মানি তবে সেদিন আমাদের খাবার বন্ধ।তাই কি করা আমি আর বাবা মেনে নিলাম।সারাদিন স্যুট টাই সু পড়ে বসে থাকি আমি আর বাবা। যেই সময়টুকু অফিসে থাকি শুধু সেই সময়টুকুই শান্তিতে থাকি। অবশ্য এসব কিছুতে আমার বোনের বেশ লাভই হচ্ছে।সে স্কুল যাওয়া, লেখাপড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। মা এ নিয়ে কিছু প্রশ্ন করলেই সে বলে উঠে

-সিরিয়ালের মেয়েদের কখনো পড়তে দেখেছ? কখনো স্কুল যেতে দেখেছ?

মা ও, বোনের সাথে মাথা নাড়িয়ে বলে যে হ্যা সিরিয়ালের মেয়েরা কখনো স্কুলে যায় না। কিছুদিন ধরে মা আমাকে প্রেম করতে বলছেন।মায়ের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।পরে বোন এসে আমাকে সিরিয়ালের কাহিনী বুঝিয়ে দিলো। কাহিনী হচ্ছে আমি প্রেম করবো কিন্তু মা জানতে পেরে আমাকে অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবেন। আমি মানা করতেই মা আর বোন মিলে আমার দুইদিনের খাবার বন্ধ করে দিলো।দুইদিন ধরে হোটেলের বাসি খাবার খেতে খেতে যখন আমার পেট পঁচে যাওয়ার অবস্থা তখন বাধ্য হয়ে প্রেম করতে রাজি হলাম।

থিয়েটার এর একজন ছোটখাটো আর্টিস্ট কে ঠিক করলাম আমার সাথে প্রেমের নাটক করার জন্য।
সারাদিন মেয়েটাকে নিয়ে মায়ের চোখের সামনে দিয়ে ঘুরাঘুরি করি।কিন্তু মা যেন আমাদের দেখেও দেখে না।
এর মধ্যেই মা কোথা থেকে এক কাজের মেয়ে নিয়ে এলো বাড়িতে কাজ করার জন্য।কাজের মেয়ে দেখে আমি আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলাম।কারণ কয়েকদিন আগে এক সিরিয়ালে দেখেছিলাম নায়কের মা কাজের মেয়ের সাথে নায়কের বিয়ে দিয়ে দেয়।আমি মনে মনে ভয় পাচ্ছি আমার মা ও হয়তো ঠিক একই কাজ করবেন।এসব কথা ভাবছি আর খুব করে ঘামছি। এদিকে কাজের মেয়েটার চাহনি ও ভালো লাগছে না।কেমন যেন চোরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

কাজের মেয়েটার নাম ফুঁলি কিন্তু মা মেয়েটার নাম রাখলো জবা।এই নাম শুনে আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম।কারণ সিরিয়ালেও কাজের মেয়ের নাম জবা ছিল। বোনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম কাজের মেয়েকে জবা নাম দেওয়ার কারণ কি? তখন বোন বললো নামটা নাকি মা দেয় নি।ফুঁলি নিজেই নাকি নিজের নাম জবা রেখেছে।জবা নাকি তার রোল মডেল। মনে মনে কিছুটা খুশি হলাম যে,মা নামটা রাখেন নি।তাহলে মায়ের মনে এই নাটকের প্লট নেই। অন্যকোনো নাটকের প্লট আছে। অফিস থেকে এসে সবে রুমে ঢুকেছি এমন সময় বোন এসে বললো

-কালকে তোর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বাজারে ঘুরতে যাস।

-কেন?

-সেসব পরে বুঝতে পারবি।

বোনের কথামতো ভাড়াকরা গার্লফ্রন্ডকে নিয়ে বাজারে এলাম। এসেই দেখলাম মা অগ্নিদৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর স্লোমোশন এ আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন

-মেয়েটা কে,তানভীর?

মায়ের কথা শুনে আমি টাস্কি খেলাম।এই মেয়েকে নিয়ে ত এতদিন মায়ের সামনে ঘুরাঘুরি করছি তাহলে মা এখন কেন জিজ্ঞেস করছে মেয়েটা কে? পরা বুঝলাম এটা নাটকের প্লটের অংশ। তাই আমিও নাটকীয়ভাবে বললাম

-মা, ও আমার প্রেমিকা আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। মা হুট করে রেগে গিয়ে বললেন

-তোর বিয়ে আমার পছন্দ করা মেয়ের সাথেই হবে।বাড়িতে চল।

মা আমাকে টানতে টানতে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুললেন। সেদিনই মা ঘটক ডেকে ঘটককে বললেন মেয়ে দেখতে।মেয়ে ফর্সা,সুন্দরি, ভদ্র হতে হবে,রান্না জানতে হবে, শিক্ষিত না হহলেও চলবে আর সবচাইতে বড় কথা ভারতীয় সব সিরিয়াল দেখতে হবে। ঘটক চলে যাওয়ার পর কাজের মেয়ে জবা।সিরিয়াল দেখতে বসে গেলো।কিছুক্ষণ পর উঠে সেজেগুজে এসে মায়ের সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো।তখন মায়ের প্রিয় সিরিয়াল চলছিল। জবা বারবার টিভির স্ক্রিনের সামনে চলে আসায় মা দিল এক ঝাঁড়ি। যার ফলে জবা মন খারাপ করে চলে গেলো। মেয়ে দেখতে এসেছি প্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেলো।কিন্তু মেয়ে এখনো আমাদের সামনে আসছে না। কিছুক্ষণ পর মেয়ের বোন মেয়েকে নিয়ে আমাদের সামনে বসালো। মেয়ের দিকে এক পলক তাকিয়েই বুঝতে পারলাম মেয়ে বেশ সুন্দরি। মা এবার মেয়েকে প্রশ্ন শুরু করলেন

-নাম কি তোমার মা?

-ইরা।

-বাহ বেশ ভালো নাম।তা এতক্ষণ কেন আসোনি সামনে? এইবার মেয়ে আমার মায়ের দিকে মুখ তুলে বললো

-কিউকি আমি ঘাষুটি জিন্দেগি হ্যায় দেখতাছিলাম। মা বেশ খুশি হয়ে গেলেন মেয়ের মুখে সিরিয়ালের নাম শুনে।মা খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন

-আমি তো কাল রাতেই দেখে পেলেছি। তুমি এখন দেখলে যে?

-কিউকি কাল রাতে আমি ফলার্স টিভির কাঠ খন্ডন দেখেছি।

মা আর মেয়ে এবার দুজনেই সিরিয়াল নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলো।টানা তিন ঘন্টা পর তাদের কথা শেষ হলো।
এদিকে তাদের আলাপ শুনে আমি আর বাবা ক্লান্ত হয়ে গেলেও মা কিংবা ইরা কেউই ক্লান্ত হয়নি। মা ইরাকে আংটি পড়িয়ে চলে এলেন। ইরাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। রাত বারোটা বাজে আমি বাসরঘরে বসে আছি কিন্তু ইরা এখনো আসছে না।কিছুক্ষণ পর পর আমি উঁকি দিয়ে দেখছি  যে সে কি করছে। মায়ের সাথে বসে তখনো সিরিয়াল দেখছে। এদিকে কাজের মেয়ে জবা আমাকে দুইবার দুধের গ্লাস এনে দিয়ে গেলো। তৃতীয়বার আনতেই আমি ধমক দিয়ে বললাম

-এত দুধ কেন আনছস? জবা মুখ কাছুমাছু করে বললো

-কিউকি আজকে রাত্রে এই দুধ খেয়েই কাটাতে হইবে।ইরা আইবে না মনে হয়। পুনরায় ধমক দিয়ে বললো

-ইরা কিরে? ভাবি বল।আর “কিউকি” কথাটা কোথা থেকে শিখছস?

-খালান্মা আর ভাবি ত দেখি কথার লগে লগে কিউকি কয়।তাই আমিও কইলাম।

জবাকে আরেকটা ধমক দিয়ে রুম থেকে বের করে দিলাম। ঠিক বারোটা একত্রিশ মিনিটে ইরা ঘরে প্রবেশ করলো। আমি কিছুটা ধমকের সুরে বললাম

-এতক্ষণ আসো নি কেন?

-কিউকি আমি আর শ্বাশুমা মিলে খুমখুম হাগিয়া দেখছিলাম।

-কিউকি মানে কি? আর কথার সাথে সাথে কিউকি কেন বলো?

-কিউকি আমি কিউকি বলতে ভালোবাসি।আর কিউকি মানে কারণ।

-আবার কিউকি?

-কিউকি আমার একটা অভ্যাস।এটা ছাড়তে পারবো না।

-ছাড়তে পারবে না কেন? মানুষ চাইলে সব পারে।

-কিউকি এটা আমার পুরানো অভ্যাস।

-এমন বাজে অভ্যাস কেন করছো?

-কিউকি…..

-থাক আর বলতে হবে না।গিয়ে শুয়ে পড়ো।

ইরার কিউকি র চাপে আমার মাথা ধরে গেছে।তাই ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ইরা পাশে নেই।ভাবলাম মাকে নিয়ে সিরিয়াল দেখছে। ড্রইংরুম এ গিয়ে দেখলাম দুজনের একজনো নেই সেখানে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ইরা, মা আর আমার বোন মিলে বাইরে থেকে আসছে। তাদের দেখেই আমি জিজ্ঞেস করলাম

-কোথায় গিয়েছিলে? বোন এসে বললো

-কিউকি আমাদের ফিট থাকতে হবে তাই হাঁটতে গিয়েছিলাম। এবার মা বললেন

-কিউকি আমি এখনো ইয়াং তাই ফিট থাকা জরুরী। এবার আমার বউ ইরা বললো

-কিউকি আমি নতুন দুলহান তাই আমাকে ফিট থাকতে হবে।

আমাকে ইগ্নোর করেই তিনজনই কিউকি নিয়ে আলোচনা করতে করতে ভেতরে ঢুকে গেলো। দিন দিন বাড়ির পরিবেশ খারাপ হচ্ছে তাই আমি ভাবলাম মা,বউ আর বোনকে জব্দ করা দরকার। অফিস থেকে বেশ কিছুদিনের ছুটি নিলাম।বাবাকেও নিতে বললাম। এরপর আমি আর বাবা মিলে অফিস না গিয়ে মা,বউ আর বোনের সাথে বসে সিরিয়াল দেখতে লাগলাম। আমাদেরকে সিরিয়াল নিয়ে আগ্রহী দেখে সবাই বেশ খুশি হলো। একদিন গেলো দুইদিন গেলো তৃতীয়দিন মা এসে জিজ্ঞেস করলেন

-কিরে অফিস যাবি না?

-কিউকি সিরিয়ালের পুরুষেরা অফিসে যায় না তাই আমিও যাব না। মা হতাশ হয়ে বাবার কাছে গিয়ে বললেন

-কি গো তুমি অফিস যাবে না?

-কিউকি সিরিয়ালের বাবারা কাজ করে না তাই আমিও করবো না। মা কিছু না বলে চলে গেলেন। পরদিন মা এসে বললেন

-কিছু টাকা দে ত শপিং এ যাব।

-কিউকি আমি এখন চাকরি করি না তাই টাকাও নেই। এরপর আমি আর বাবা মিলে সিরিয়াল নিয়ে আলাপ শুরু করলাম আমি বললাম

-কিউকি নায়িকা সুন্দর ছিল তাই ভিলেন তাকে তুলে নিয়ে গেলো। এবার বাবা বললেন

-কিউকি ভিলেন শক্তিশালী ছিল তাই সে নায়িকাকে তুলে নিয়ে গেলো।

-কিউকি নায়িকাকে বাঁচানোর কেউ ছিল না তাই ভিলেন নায়িকাকে তুলে নিয়ে গেলো।

-কিউকি ভিলেনের সুন্দরি মেয়ে পছন্দ তাই সে নায়িকাকে তুলে নিয়ে গেলো।

-কিউকি নায়িকা আরো কিছু বলতাম কিন্তু তার আগেই ইরা আমাদের থামিয়ে দিয়ে বললো

-আপনারা এমন কেন করছেন? আমি আর বাবা একসাথে উত্তর দিলাম

-কিউকি আমরা সিরিয়ালফ্রিক ফ্যামিলি তাই সিরিয়াল নিয়ে আলোচনা করছি।

ইরা, মা আর বোন আমাদের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালো।তাকাক গেই আমাদের কি? আমরা ত আমাদের প্রিয় সিরিয়াল দেখছি। মা,ইরা আর বোন এখন সিরিয়াল দেখা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে।বোন এখন প্রতিদিন স্কুলে যাচ্ছে।মা ও আর আগের মত উদ্ভট সাজ সাজে না। ইরাও কথার সাথে সাথে কিউকি কিউকি করে না। সবই ঠিক আছে।কিন্তু আমার আর বাবার কি হয়েছে বুঝতে পারছি না।সিরিয়াল ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারছি না।এদিকে অফিসের ছুটি প্রায় শেষ কিন্তু আমি আর বাবা সিরিয়াল ছেড়ে উঠতে পারছি না

-কিউকি আমি আর বাবা তাদের জব্দ করতে গিয়ে নিজেরাই সিরিয়ালখোর হয়ে গেছি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত