গোবিন্দবাবুর ভিসা

গোবিন্দবাবুর ভিসা

প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে চায়ের আড্ডা ছেড়ে উঠে পড়লেন গোবিন্দবাবু; এদের সঙ্গে কথা না বাড়ানোই ভালো! তাড়াতাড়ি পয়সা মিটিয়ে পেছন থেকে আসা হাসির শব্দ অগ্রাহ্য করে হনহনিয়ে হাঁটা দিলেন বাড়ির দিকে।

ব্যাপারটার শুরু মন্টুর চায়ের দোকানে সন্ধ্যেবেলার আড্ডায়। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে নগেন হালদারের বাড়িতে ময়লা ফেলার জন্য তিনটে রঙিন বাক্স দিয়ে গেছে, আর পইপই করে বলে গেছে একটু বেছেবুছে ময়লা ফেলতে। ‘বায়োডিগ্রেডেবল’ জিনিস সবুজ বাক্সে, ‘রিসাইক্লেবল’ জিনিসের জন্য হলদে বাক্স, আর লাল বাক্সে প্লাস্টিক-পলিথিন ইত্যাদি, যা কিনা পঞ্চভূতে বিলীন হয় না। নগেনবাবু মধ্যমণি হয়ে গারবেজ ম্যানেজমেন্টের ওপর সদ্য লব্ধ জ্ঞান বিতরণ করছিলেন হাত পা নেড়ে, ছেলেছোকরার দল চোখ বড় বড় করে শুনছিল।

ছেলেছোকরা মানে অবশ্য সন্ধ্যেবেলা মন্টুর চায়ের দোকানে আড্ডা জমানো লোকজন; বেশিরভাগই ষাটের আশপাশে। তবু বয়স ভুলে সবাই এসব গপ্পো এমন হাঁ করে শুনতে থাকে যেন বাচ্চারা রূপকথার গল্প শুনছে।

গোবিন্দবাবু ব্যাপারটার মধ্যে নতুনত্ব খুঁজে পাননি; আমেরিকায় মায়া সভ্যতার সময়েও জঞ্জাল আলাদা করার ব্যবস্থা চালু ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, রিসাইক্লিং, ইনসিনারেশান, ডি-পলিমারাইজেশান এসব নতুন না হাতি! জঞ্জাল থেকে বিদ্যুৎ তৈরি অনেক পুরোনো ব্যাপার, এখন তো ইথানল বানিয়ে গাড়ির তেলের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে আমেরিকায়। গোবিন্দবাবুর ছেলে চাকরিসূত্রে আমেরিকায় থাকে, এসব জঞ্জাল তাঁর অনেক আগেই ঘাঁটা আছে। নাগেনবাবুকে মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন মুখে বলে গেছে, আর আমেরিকায় এসবের জন্য আইন আছে, ফাইনও আছে। এই সহজ সত্যিগুলো এদের বোঝায় কে! বিশদে বলা শুরু করতেই তর্কাতর্কি আরম্ভ হয়ে গেল। তার মাঝেই একজন মুচকি হেসে প্রশ্ন করে বসল, “কোথাকার জঞ্জালে গন্ধ বেশি, এদেশের না আমেরিকার?” রেগে গিয়ে আড্ডা ছেড়ে উঠে পড়লেন গোবিন্দবাবু।

এই এদের স্বভাব, কিচ্ছু না বুঝে তর্ক শুরু করলেই হল! বুঝিয়ে বলতে গেলে হয় হাসবে, নয় ফুট কাটবে। খবরাখবর না রাখলে যা হয় আর কি; কুয়োর ব্যাঙ সব! হয় গেল গেল রব তোলে, নয় মাথায় তুলে নাচতে থাকে! সবকিছুই যেন একটা তামাশা! আরে আজ যা নিয়ে সবাই মাতামাতি করছিস আমেরিকার সাহেবরা অনেক দিন আগেই সে কাজ করে ফেলেছে। ব্যাপারগুলো তলিয়ে বুঝতে হবে। গোবিন্দবাবুর মাথার চুলগুলো এমনি এমনি সাদা হয়নি; বিচার, বিবেচনা, অভিজ্ঞতা আর দূরদৃষ্টি মিলেমিশে ওই রং হয়েছে।

তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যাওয়ায় আসল কথাটাই বলা হল না গোবিন্দবাবুর। ছেলে একেবারে নাছোড়বান্দা; খুব করে ধরেছে ওর ওখানে, মানে আমেরিকায়, যাওয়ার জন্য। সবকিছু মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে, পাসপোর্ট তো আগেই হাতে পেয়ে গেছেন, কাল ভিসার জন্য যেতে হবে। ভেবেছিলেন ভিসার কথাটা ফলাও করে বলবেন, কিন্তু সবাই তর্কে মত্ত হয়ে পড়ায় সুযোগই পেলেন না; তারপর তো বিরক্ত হয়ে উঠেই আসতে হল।

আজকাল আড্ডা আর তেমন জমছে না, প্রায়ই এমন ভাবে চলে আসতে হচ্ছে। এই তো দিন কয়েক আগের ঘটনা। আড্ডায় একদিন হৈ হৈ শুরু হল, স্পেস স্টেশনের কৃত্রিম আবহাওয়ায় বিনা মাটিতে নাকি লেটুস পাতার চাষ হয়েছে। বিনা গ্র্যাভিটেশনের ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা ছিল বিজ্ঞানীদের, কিন্তু ফলন ভালোই। গোবিন্দবাবু প্রশ্ন তুললেন, লেটুসের চাষটা করেছে কে! রামা কৈবর্ত নাকি হাসিম শেখ! করেছে তো আমেরিকার নাসার বিজ্ঞানীরা। তোদের দৌড় তো বাবা তাইচুন পর্যন্ত, বড়োজোর ঘর সাজানোর ক্যাকটাস। বোটানিক্যাল বা হর্টিকালচারের কাচের ঘর দেখে কৃত্রিম আবহাওয়ার কথা বলতে এসেছ বাপধন, আমেরিকায় অমন ভুরি ভুরি আছে। মাটি নেই তো নেই! আজ সবাই বাসি খবরের কাগজ হাতে আসর গরম করছে, আর আমেরিকায় ‘হাইড্রোপনিক্স’ বিষয়টার ব্যাপক চর্চা তিরিশের দশক থেকেই চলছে। এমন কি প্যান অ্যামেরিকান বিমান কোম্পানি যাত্রীদের খাওয়ানোর জন্য একটা দ্বীপে মাটি ছাড়া সবজির চাষ শুরু করে দেয় ওই সময়েই।

গোবিন্দবাবু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মহেশ ভৌমিক খুব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “সবজির ওপর গ্র্যাভিটেশনাল এফেক্ট নিয়ে চর্চাও তো আমেরিকায় অনেকদিন ধরে হচ্ছে। ওখানেও নিশ্চয়ই কচি চিচিঙ্গের নিচে পাথরের টুকরো ঝোলানো হয়! তাই না গোবিন্দবাবু?” ভৌমিকের চাপা হাসিটা নজর এড়ায়নি গোবিন্দবাবুর, বিরক্ত হয়ে সেদিনও উঠে এসেছিলেন তিনি।

এমন অনেক উদাহরণ আছে। আধুনিক যুগের ব্যাংকের কাজকর্ম নিয়ে একদিন আড্ডায় কি তুমুল আলোচনা! গুঁফো দারোয়ান, মোটা চেন বাঁধা কোলাপসিবল গেট পেরিয়ে কাউন্টারের ফোকরে হাত ঢুকিয়ে টাকা লেনদেনের দিন নাকি শেষ; এখন বাড়িতে বসে ফোনে বা কম্পিউটারেই সব কাজ হয়ে যাবে! কাজের চেয়ে গালভরা নামের বাহার বেশি। গোবিন্দবাবু সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন, কিসের কী আধুনিক! বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতেই ব্যাঙ্কোগ্রাফ যন্ত্রে টাকা লেনদেন শুরু হয়ে যায় আমেরিকায়; এটিএম চালু হয় ষাটের দশকের শেষে। আশির দশকের শুরুতেই কম্পিউটারের মাধ্যমে আমেরিকায় হোম ব্যাঙ্কিং চালু হয়। ওখানে গোবিন্দবাবুর নাতিও ঘরে বসে নিজের অ্যাকাউন্ট সামলায়। আর এদেশে থেকেও পুরো চাকরিজীবনে তিনি দুবার মাত্র ব্যাঙ্কে গেছেন, একবার অ্যাকাউন্ট খুলতে, আরেকবার পেনশন চালুর সময়। বাকি কাজ তো অফিসের পিওন বটুকনাথই করে দিত। এও তো একধরণের হোম ব্যাঙ্কিং। গোবিন্দবাবু নিজের মতামত জানাতেই চায়ের কাপে তুফান উঠল; একসময় আসর ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন তিনি।

একদিন কাগজে বেরোল, বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহে মানুষের বসতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন; সঙ্গে ওল্টানো সাদা গামলার মতো দেখতে কয়েকটা সম্ভাব্য বাড়ির ছবি। ব্যাস, মঙ্গলগ্রহের আবহাওয়া, মানুষ থাকার পরিবেশ ইত্যাদি জটিল বৈজ্ঞানিক আলোচনায় আসর একেবারে জমজমাট। কেউ বলল, অমন এবড়োখেবড়ো খানাখন্দওয়ালা জমিতে বাড়ি দাঁড় করানোই মুশকিল। কেউ বলল, লাল ধুলোয় দম আটকে যাবে। অন্য দল বলল, মঙ্গলের দিন রাতের মাপ প্রায় পৃথিবীর মতোই, মাটি আছে, মাটিতে জল আছে, সূর্যের আলো আছে যথেষ্ট, তাই খুব একটা অসুবিধে হবে না। জীবজগতের বিস্ময়কর অভিযোজন ক্ষমতা বা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ওপর দার্শনিক ভরসাও রাখল কেউ কেউ। বহুক্ষণ ধরে চুপচাপ ছিলেন গোবিন্দবাবু, মনে মনে হাসছিলেন। আবার নাসা, আবার সেই আমেরিকা; ওরা হাত লাগিয়েছে যখন শেষ দেখে ছাড়বে। আমেরিকায় তো পোর্টেবল বাড়ির ব্যবহার চালুই আছে, শুধু ট্রাকে করে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিতে হয়। গামলাবাড়িও রকেটে চাপিয়ে মঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ঠিক বসিয়ে দেবে ওদেশের ইঞ্জিনিয়াররা। ওসব কাজ ওদের কাছে নস্যি। এ কি আর দেশি কাজ, ট্যাংক নাম্বার আর অ্যাকশান এরিয়ার বাইরে রাস্তাঘাট-আলো-জল কিছুই নেই। কথাগুলো বলতেই ছেলেছোকরার দল রে রে করে উঠেছিল।

এমন আরও কত ঘটনা আছে, গুনতে শুরু করলে শেষ হবে না। মন্টুর দোকানে যেদিন পুরোনো বাল্‌ব্‌ পাল্টে এল-ই-ডি আলো লাগালো, সেদিন সবাই এমন ভাবে কথা বলছিল, যেন এইমাত্র এডিসন সাহেব বাল্ব জ্বালালেন। ওরে বাবা, সে তো ১৮৭৮ সালের আমেরিকার ঘটনা। এল-ই-ডি পঞ্চাশ ষাট বছর আগে ওখানেই তৈরি হয়ে বাজারে এসেছে। এনার্জি সেভিং এর কথা ভেবে ‘এনার্জি স্টার’ ছাপ্পা লাগানো আমেরিকাতেই শুরু হয়। ওখানে ছেলের বাড়িতে তো এল-ই-ডি ছাড়া অন্য আলোই নেই। আর এখানে বাল্ব পাল্টানোর জন্য এত বাকবিতন্ডা! বলতে গেলেই মারকাটারি তর্ক শুরু হয়ে যাবে।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন গোবিন্দবাবু। হুড়মুড়িয়ে একটা বাইক প্রায় ঘাড়ের কাছে এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে আবার সাঁই করে বেরিয়ে গেল। আরেকটু হলেই হয়েছিল আরকি! কপালের ঘাম মুছে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল গোবিন্দবাবুর। আজকাল এই হয়েছে ফ্যাশন, গোঁফ বেরোনোর আগেই বাইক নিয়ে কায়দা দেখাতে রাস্তায় বেরোচ্ছে ছেলেপুলের দল। ছোটবেলা থেকে সার্কাসে মরণকুয়ার খেলা দেখা গোবিন্দ নস্করকে তুই আর বাইকের নতুন কি খেল দেখাবি বাপ! সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি, সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স, ফ্রিকশান সবাই মিলে তোকে আর তোর বাইককে সামাল দিচ্ছে। এ-সবকে অঙ্কে বেঁধে নিউটন সাহেব বড় ভুল করেছেন! আদি মোটরসাইকেল বানিয়ে আগুনে ঘি ঢাললেন বাটলার সাহেব। আর সর্বনাশের মাথায় পা রাখলেন ইন্টারন্যাল কম্বাশান ইঞ্জিন বানিয়ে ডেইমলার আর মেইবাখ। এখন রাস্তায় কিলবিল করছে বাইক, হাঁটাচলাই দায়।

এরা সব্বাই ছিলেন ইউরোপের লোক, আমেরিকার হলে হয়ত ব্যাপারটা অন্যরকম হত। এইতো সাইকেল মিস্ত্রি রাইট ভাইয়েরা কি সুন্দর এরোপ্লেন বানালো; আকাশে ওড়ে, রাস্তা জ্যাম করে না, ঘাড়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে না। একবার বাইক আর গাড়িতে ভর্তি রাস্তার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হাঁটা শুরু করলেন তিনি।

আড্ডায় তর্কাতর্কি শুরু হওয়ায় ফলে একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরলেন গোবিন্দবাবু। আজ অবশ্য তাড়াতাড়ি ফেরাটা দরকার ছিল, অনেক কিছু গোছগাছ করার আছে, কাগজপত্র সব আরেকবার মিলিয়ে নিতে হবে। কাল ভিসার জন্য যেতে হবে।

ওই ভিসাটাই আমেরিকা যাওয়ার আগে সবচেয়ে শক্ত ধাপ। ভিসা অফিসে খুব কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে, কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখে। একটা কী হয় কী হয় ভাব আছে গোবিন্দবাবুর মনে। ফাইল খুলে কাগজপত্র মিলিয়ে নিলেন আরেকবার, ফটোগুলো খাম থেকে বের করে গুনে নিয়ে আবার ঢুকিয়ে রাখলেন। হাতের আঙুলগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিলেন একবার, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে হবে। চোখ কচলে আয়নায় মুখ দেখলেন, মুখের সঙ্গে চোখের মণির ছবিও তুলতে হবে। বসার ঘরে উঁকি মেরে দেখলেন গিন্নি রান্নাবান্নার পাট চুকিয়ে টিভি দেখছেন। অনেক ভেবেচিন্তেই গোবিন্দবাবু রাত্রে খিচুড়ি আর ডিমভাজার কথা বলেছিলেন। কী ভাগ্যি, গিন্নি সে-কথা মেনে নিয়েছেন, বেশি কাটাকাটি বাটাবাটির মধ্যে যাননি। পেঁয়াজ কাটতে বা হলুদ বাটতে বসলে তো চোখের বা হাতের রংই পাল্টে যেত; তখন ইমিগ্রেশন পেরিয়ে আমেরিকায় আর ঢুকতে হত না! খুব কড়াকড়ি কিনা!

চাপা উদ্বেগটা গোবিন্দবাবু বেশ ভালোই টের পাচ্ছেন, কিন্তু কিছুতেই মাথা থেকে চিন্তাগুলো তাড়াতে পারছেন না। মাঝে মাঝেই নিজেকে সাহস জোগানোর জোগানোর চেষ্টা করছেন – দুশ্চিন্তার আছে কী! পয়সা খরচ করে তিনি আমেরিকায় যাচ্ছেন ছেলের কাছে, বেড়া ডিঙিয়ে তো নয়। ভিসা দিলে গট গট করে প্লেনে চড়ে বসবেন, নয়তো নয়।

তবে বিশ বাইশ ঘন্টার প্লেন জার্নিটা একটু ভাবাচ্ছে বইকি। প্লেনের খাবার সহ্য হবে তো! বাড়ির খাবার তো সঙ্গে নেওয়া যাবে না। এ-ব্যাপারে ট্রেন একটু সুবিধেজনক; ব্যাগে করে পরোটা, আলুর দম, সন্দেশ নিয়ে যাও; ট্রেন ছাড়লেই খবরের কাগজ বিছিয়ে ডান হাতের কাজটা সেরে নাও। প্লেনে বাম হাতের সমস্যাটা কতটা ভোগাবে কে জানে! ওদেশে পৌঁছনোর পরেও বামহাত নিয়ে চিন্তা রয়ে যাবে। সাহেবসুবোদের ইংরেজিটাও ঠিকঠাক বুঝতে পারলে হয়।

গিন্নি অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ, ঠাকুর ঘরের গোবিন্দ আর জ্যান্ত গোবিন্দর ভরসায় নিশ্চিন্তে আছেন। তিনিও একটু দুশ্চিন্তা দেখালে স্বস্তি পেতেন গোবিন্দবাবু, অন্তত বোঝা যেত দুশ্চিন্তার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই।

এভাবেই সারা সন্ধে কাটল। রাতে খিচুড়ির পাতে দু’চামচ গাওয়া ঘি পড়তেই খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেল গোবিন্দবাবুর। ঘুমোনোর আগে ভিসা অফিসের সম্ভাব্য প্রশ্নোত্তর আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়ার কথা বলতেই গিন্নি পাশ ফিরে শুলেন, গজগজ করে বললেন, আমেরিকা যেন আগে কেউ যায়নি! অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর নাকডাকা শুরু হল।

গোবিন্দবাবু হাজারো কথা ভাবতে ভাবতে এ-পাশ ও-পাশ করতে লাগলেন, ঘুমোতে চাইলেই কি আর ঘুম আসে! হাতে আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা! সব কাগজপত্রের আরেকটা করে ফটোকপি করে নেওয়া দরকার; সঙ্গে থাকা ভালো। যাওয়ার পথে কোথাও করিয়ে নিতে হবে। পাড়ার দোকানটা খুলতে খুলতে দশটা বাজিয়ে দেয়, ব্যাটা বড্ডো আলসে।

হঠাৎ ঘরের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, “জেরক্স করবে তো, তা সে আর এমন কি! উনিশশো আটচল্লিশ-এ নামটা আমিই চালু করি, পড়াতুম ভাষাতত্ব, আমেরিকার ওহিয়োতে। দুই মক্কেল এসে ধরল, তাদের তৈরি ‘ইলেক্ট্রোফটোগ্রাফি’ মেশিনের একটা জম্পেশ নাম দিতে হবে। গ্রিক শব্দ খুঁজে দিলুম ঠুকে, একেবারে বাজার গরম করে দিল।”

পাশ থেকে কেউ বলে উঠল, “জিনিসটা ভালোই বানিয়ে ছিলুম, শুধু নামে কিছু হয় না মশাই।”

এবার গম্ভীর গলায় তৃতীয় কেউ বলল, “থামো হে মিঃ চেস্টার, কী যেন পুরো নামটা! হ্যাঁ, চেস্টার কার্লসন। ছিলে তো বাপু পেটেন্ট অফিসের কেরানি। বাতের ব্যাথায় কাতরাতে, অফিসে কাগজপত্র নকল করার কাজ শেষ করতে পারতে না। চাকরি বাঁচাতে একখানা যন্তর বানিয়ে ফেললে। আমায় দেখ, এই যে আমি, ডেভিড গেস্টটেটনার। হাঙ্গেরিতে জন্ম, তবু আমেরিকা জুড়ে আমার তৈরি মেশিন বেচেছি, তোমার চেয়ে অন্তত সত্তর বছর আগে। মানছি, তোমার মেশিনটার অনেক সুবিধে; তবে একেবারে আনকোরা কিছু নয়। আর তোমাকেও বলিহারি গোবিন্দ, কয়েকটা কাগজের নকল বানানোর জন্য হেদিয়ে মরছ, ফটোকপি মেশিনের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছ কখনও?”

কিছুক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে রইলেন গোবিন্দবাবু; কী ঘটল, কারা কথা বলল, কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। বোধশক্তি ফেরার পরে হেসে ফেললেন। বড্ডো বেশি ভেবেছেন ভিসা নিয়ে, তাই আধো ঘুমের ঘোরে এমন অদ্ভুত বিভ্রম। চোখ কচলে উঠে বসলেন তিনি; ঘামে ঘাড়-গলা ভিজে গেছে। গরমের জন্যই উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখেছেন। একটু শান্তিতে ঘুমোনোর যো নেই! খেয়াল করে দেখলেন ফ্যানটা বন্ধ, কারেন্ট নেই। মেজাজটা খিঁচড়ে গেল, যখন তখন কারেন্ট চলে যায় আজকাল। বিড়বিড় করে ইলেকট্রিক সাপ্লাইকে গালাগাল দিতে দিতে বাথরুমে যাওয়ার জন্য খাট থেকে নামতে গিয়েই চমকে গেলেন, মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল।

খাটের সামনেই মোটাসোটা ভুঁড়িওয়ালা এক সাহেব দাঁড়িয়ে আছে, মাথার সামনেটা টাক, পেছনে লম্বা চুল, হাতে ধরা ঘুড়ি-লাটাই। গোবিন্দবাবুর মুখের হাঁ বন্ধ হওয়ার আগেই ফ্যাঁসফ্যাঁসে সর্দি বসা গলায় সাহেব বললেন, “ঝড় জল মাথায় করে কত কষ্টে ঘুড়ির সুতো দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি নামালাম মেঘ থেকে, আর তুমি কোথাকার গোবিন্দ হে, আরাম করতে চাইছ ঘরে শুয়ে। যত্তোসব কুঁড়ের দল, হাতপাখাটা নাড়িয়ে যতখুশি হাওয়া খাও না বাপু, কে মানা করেছে!”

“একদম ঠিক বলেছেন ফ্র্যাঙ্কলিন সাহেব, ডায়নামো চালিয়ে পাখার মোটর ঘোরাতে আমার খাটুনিটা কম হয়েছে নাকি; ইংল্যান্ডে বসে কয়েলে তার জড়িয়ে জড়িয়ে হাতে ব্যথা ধরে যেত! আর এ ব্যাটা জমিদারি চালে পাখা চালিয়ে আমেরিকার স্বপ্নে মশগুল।” আরেক সাহেব কখন হাজির হয়েছেন খেয়াল করেননি গোবিন্দবাবু। ছিমছাম চেহারা, মাঝে সিঁথিকাটা কোঁকড়ানো লম্বা চুল, কালো কোটের সঙ্গে বো-টাই গলায়।

টিকালো নাক, মাথার সামনেটা ফাঁকা কিন্তু বাকিটা পরিপাটি ব্যাকব্রাশ করা চুল নিয়ে অন্য এক সাহেবও হাজির। চোখ নাক মুখ কুঁচকে বিরক্তি ভরা গলায় বললেন, “মিঃ ফ্যারাডে, এসব এঁচোড়ে পাকা লোকের কথা ছাড়ুন দেখি। বলে কিনা কারেন্ট চলে গেছে! কারেন্ট যাবে কোথায় মশাই, যাওয়া আসা করে তো চার্জ; তাও সবসময় বেশি থেকে কমের দিকে, একেবারে নিয়ম মেনে। ওহম, অ্যাম্পিয়ার, কুলম্ব, কার্চফ ব্যাটারা গেল কোথায়, থাকলে চার্জের হাঁটাচলা দৌড়োদৌড়ির নিয়মকানুনগুলো বুঝিয়ে বলতে পারত। তবে এই অর্বাচীনগুলো এমন ভাবে বলে যেন বিবাগী হয়ে চার্জ যেদিকে দুচোখ যায় চলে গেছে। কিস্যু জানেনা, বোঝে না। জ্ঞান বিজ্ঞানের আবার ইউরোপ আমেরিকা কী কে জানে! রাগও হয় হাসিও পায় মশাই। এদের ভাষাতেই কী যেন একটা বলে – শফরী ফরফরায়তে।”

এতক্ষণ চুপ করে থাকা লাটাই হাতে সাহেব বললেন, “ছেড়ে দাও ভোল্টা, তোমার তৈরি একটা ‘ব্যাটারি স্ট্যাক’ এই গোমুখ্যুদের মাথায় ছুড়ে মারলেও কিচ্ছু হবে না, একদম নিরেট কিনা।”

মাথা ঝিমঝিম করে উঠল গোবিন্দবাবুর। এরা সব কারা, এই নিশুত রাতে কী হচ্ছে এসব! হতভম্ব ভাবটা কাটানোর জন্য খাটেই বসে রইলেন থম মেরে, মাথায় উঠল বাথরুমে যাওয়া।

কিছুক্ষণের মধ্যেই, একটু ধাতস্থ হতে না হতেই, আবার ভিসার চিন্তা মাথায় চড়ে বসল। ভিসার ফি জমা দেওয়ার জন্য টাকা আলাদা করে রেখেছেন। কিছু খুচরো টাকাও নিয়ে নেওয়া দরকার, ওখানের কাউন্টারে যদি দিতে হয়। ট্যাক্সি ভাড়ার জন্য একটু বেশি করেই টাকা সঙ্গে থাকা ভালো। রাস্তার মোড়ে এটিএম থেকে সকালে টাকা তুলে নেবেন। তবে ওই এটিএম-এ খালি বড় নোট বেরোয়, যতবার তুলেছেন সব দু’হাজারের নোট। দেখা যাক কী হয়, দরকার হলে অন্য কোথাও চেষ্টা করতে হবে।

এমন সময় কে যেন হো হো করে হেসে উঠল। চমকে উঠে গোবিন্দবাবু দেখলেন শিখাধারী এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ, কপালে আড়াআড়ি চন্দনের দাগ, খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হেসেই চলেছেন। কোনোমতে হাসি সামলে সেই প্রৌঢ় বললেন, “বড় আর ছোট কি রে গোবিন্দ, সবই তো স্থানিক মান আর শূন্যের খেলা। দু’হাজার থেকে একটা শূন্য আমায় দিয়ে দে, দুশো পেয়ে যাবি। আরেকটা শূন্য দিয়ে দে, কুড়ি পাবি। আরো ছোট চাইলে শেষ শূন্যটাও দিয়ে দে, ব্যস, দু’হাজার হয়ে গেল দুই। আরও ছোট সংখ্যা চাইলে দশমিক নিয়েও খেলা যায়; কিন্তু ভিখিরিও তখন ছ্যাঃ ছ্যাঃ করবে। এসব খেলা আমার হাতের মুঠোয় রে গোবিন্দ, আমিই তো ওসব শুরু করেছিলাম পাঁচ হাজার বছর আগে, এদেশেই; তোর আমেরিকানরা তো আমার থেকেই শিখল।”

এবার বেশ ভয়ই পেয়ে গেলেন গোবিন্দবাবু। মাথার চুলগুলো সব খাড়া হয়ে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘাড় টনটন করছে, পেটটা গুড়গুড়; ঘেমে নেয়ে একসা। বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে যেন। ভয়ে ভয়ে গিন্নিকে ঠেলা দিলেন আলতো করে; গিন্নি নট নড়ন-চড়ন।

বেশি ঠেলাঠেলি হাঁকডাক করতে কেমন ভয় লাগল গোবিন্দবাবুর। দু’হাতে মাথা চেপে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। এখনো কারেন্ট আসেনি। ‘কারেন্ট আসেনি’ কথাটা মনে আসতেই জিভ কেটে শুধরে নিলেন, বিড়বিড় করে বললেন, “ইলেক্ট্রনের আসা যাওয়া শুরু হয়নি, সম্ভবত পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স তৈরি হয়নি ঠিকমত। অথবা তার ছিঁড়ে হাই রেজিস্ট্যান্স হয়েছে।”

মাথাটা আরও গুলিয়ে যাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর সাহস করে ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে পা টিপে টিপে বাথরুমের দিকে গেলেন। ভয় হল নিউটন সাহেব আবার গ্র্যাভিটেশান, ফ্রিকশান এসব বোঝাতে এসে না পড়েন! আজই সন্ধ্যেবেলা নিউটন সাহেবের ওপর সব দোষ চাপিয়েছেন। তিনি এসে একবার শুরু করলে কোথায় গিয়ে থামবেন ঠিক নেই। না সাহেব দোষ নিয়ো না, ভুলে গিয়েছিলাম আমেরিকায় তৈরি প্লেনের পেছনেও ইউরোপে বসে তোমার করা অঙ্কের লম্বা হাত আছে।

বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে একটু আরাম হল। তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে ঠান্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা ভেবে দেখলেন। কিছু বুঝতে না পারলেও, একটা জিনিস তাঁর কাছে পরিষ্কার – এই গরমের রাতে অতটা খিচুড়ি খাওয়া ঠিক হয়নি, পেটটা ভার হয়ে আছে। বায়ু কুপিত হওয়াতেই এসব উদ্ভট স্বপ্ন দেখেছেন। যতই লোভ হোক কস্মিনকালেও রাতের বেলায় ঘি আর ডিমভাজা দিয়ে ভরপেট খিচুড়ি খাওয়ার মতো ভুল তিনি আর করবেন না।

কে যেন বাথরুমের দরজার সামনে খুক খুক করে হেসে চাপাস্বরে বলল, “ভুল হলে ক্ষতি কী গোবিন্দ!”

আবার! গোবিন্দবাবু পাগল হয়ে যাচ্ছেন, নাকি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছেন! রক্তে সোডিয়াম পটাশিয়াম লেভেল ঠিক আছে তো! কোনোরকমে টলতে টলতে বাইরে এসে দেখলেন ঢেউ খেলানো টুপি পরা এক সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। টুপির নিচ থেকে লম্বা লম্বা চুল কান ছাপিয়ে নিচে নেমেছে, হাতে একটা সেক্ট্যান্ট, দিকনির্ণয় করার যন্ত্র। হাসির মধ্যেই সাহেব বলে উঠলেন, “মাই ডিয়ার গোবিন্দ, ভুল করে থাকলে এত ভাবার কী আছে? ভুল থেকেই তো ঠিক হয়। এই আমাকে দেখো দিকি, ভারতে আসতে গিয়ে ভুল করে আমেরিকায় পৌঁছে গেলাম। আর তুমি, বায়ু চড়েছে বলে বাথরুমে বসে খিচুড়ি ত্যাগের সংকল্প করছ!

“যদি সত্যিই ভুল শুধরাতে চাও তবে আমেরিকার নাম নিয়ে রাজা উজির মারা বন্ধ করে দাও। ছেলেপুলে আমেরিকায় থাকলেই কি সব জানা যায়! নাকি ওদের পাঠানো ছবি দেখে দেশ চেনা যায়! নতুন দেশটাকে দেখে শুনে বুঝে নেওয়ার জন্য পরে আরও তিন বার আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলাম আমি। একটা কথা মনে রেখো, দুনিয়ার সমস্ত ধরণের মানুষকে কাছে টেনে নিয়ে খোলা মনে সব ভালো ভালো জিনিস আত্মস্থ করেছিল বলেই আজ কথায় কথায় তোমরা আমেরিকার নাম নাও। যাও ব্রাদার, অযথা উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলে, মনের জানলাগুলো খুলে দিয়ে দেশটা নিজের মতো করে দেখে শুনে বুঝে এস, যতটা পারো।” আর সহ্য হল না গোবিন্দবাবুর, মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন ওখানেই, তারপর আর কিছু মনে নেই।

গিন্নির ঠেলায় যখন ঘুম ভাঙল তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। কত্তাকে বাথরুমে যাওয়ার জন্য তাড়া দিয়ে গিন্নি চা বসাতে গেলেন। গোবিন্দবাবু চোখ খুলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তিনি তো বিছানাতেই শুয়ে আছেন! সব গুলিয়ে যাচ্ছে, বাথরুমের সামনে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার পরে বিছানায় এলেন কি করে! নাকি পুরোটাই স্বপ্ন ছিল। সন্ধ্যেবেলায় মাথাগরম, রাত্রে পেটগরম, লোডশেডিং আর ভিসা নিয়ে উদ্বেগ, সবকিছুর মিলিত ফল হল ওই স্বপ্ন, স্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্ন!

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে স্বপ্নের চিন্তা মন থেকে বার করে দিলেন গোবিন্দবাবু। কে জানে, স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে শুরু করলে আবার যদি ফ্রয়েড সাহেব এসে স্বপ্নের ব্যাখ্যানা শুরু করে দেন! তার চেয়ে ঝটপট তৈরি হয়ে পড়া ভালো, ঠিক সাড়ে ন’টায় ভিসার ইন্টারভিউ। ভুলে গেলে আমেরিকা যাওয়া হবে না, ছেলে বৌমা নাতি নাতনির সঙ্গে মজাসে কিছুদিন কাটানোও হবে না। ভুল করে সবাই কি আর আমেরিকা পৌঁছতে পারে! সাধারণ পাসপোর্ট হোল্ডার গোবিন্দবাবু, রাজার সনদ নিয়ে তো আর সাগর পাড়ি দিচ্ছেন না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত