চকচকে, আনকোরা নতুন বইগুলি হাতে নিয়ে আনন্দের চোটে একপ্রস্থ নেচেই নিল অদ্রিজা!
গত কয়েকবছরে নয় নয় করে হলেও খান নয় গল্প লিখেছে ও, পাঠিয়েছে ছোটদের ছোটবড় নানা পত্রপত্রিকায়। কিন্তু মনোনীত হয়নি একটাও। হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত হালই ছেড়ে দিতে বসেছিল ও।
মা তো রাগ করে মাঝে মাঝেই বলেন”ওরে, ওইসব ছাইপাঁশ লিখে সময় নষ্ট না করে যদি একটু পড়াশুনোয় মন দিতিস, তাহলে রেজাল্টটা আরো ভাল হত!”
আসলে অদ্রিজা জানে, এই লেখালেখিটাকে ভুলে থাকা অসম্ভব ওর কাছে। এই স্বপ্নটা ছোট থেকেই ওর মধ্যে চারিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। বাবা খুব ভাল গল্প লিখতেন। মাঝেমাঝেই নানা পত্রপত্রিকাতে প্রকাশিত হত। গতবছর একটা অ্যাক্সিডেন্টে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে লেখালেখির ভূতটা আরো যেন ওর মাথার ওপর চেপে বসেছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল, আজ অবধি ওর একটা লেখাও কোথাও ছাপা হয় নি!
এতদিন ধরে বন্ধুদের টিটকিরি শুনে শুনে শেষে রেগেমেগে ঠিকই করে নিয়েছে অদ্রিজা, আর কোনোদিন ও লিখবে না! আর ঠিক এমন সময়েই, হঠাৎই এক মনমরা বিকেলে এল সেই ফোনটা!
ফোনের ওপারে গম গম করছিল এক অপরিচিত গলার স্বর, “হ্যালো অদ্রিজা, আমায় তুমি চিনবে না। আমি একটি ছোট প্রকাশনা সংস্থা চালাই। তোমার সবকটি গল্পই আমি পড়েছি! গল্পগুলো আমার খারাপ লাগেনি, তবে…”
থতমত অদ্রিজা কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। প্রবল উত্তেজনায় ধুকপুক বুকে ফোন আঁকড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ফোনের ওপার থেকে ভদ্রলোকের গম্ভীর আওয়াজ ভেসে আসছিল, “তোমার একটি গল্প নিয়ে আমি একটি ছবির বই অর্থাৎ কিনা ‘পিকচার বুক’ প্রকাশ করতে চাই। আরো চারটি গল্প আমি আলাদা করে রেখেছি, কিন্তু চূড়ান্তভাবে তা মনোনীত হবে তখনই, যখন তুমি তোমার লেখনীক্ষমতার মৌলিকতা প্রমাণ করতে পারবে। সেটা কীভাবে? ঐ পাঁচটি গল্পের প্রতিটির দুর্বল জায়গাটি বা আমার অপছন্দের জায়গাটি আমি বাদ দিয়ে দেব, তার বদলে নতুন করে গল্পের সেই হেঁয়ালি বা সমস্যার সমাধান তোমায় করতে হবে। যদি তা পারো এবং সেটা আমার পছন্দ হয়, তবেই সেই গল্পটি চূড়ান্তভাবে মনোনীত হবে। তোমার একটি গল্পে ইতিমধ্যেই একটি সমস্যা পুরে পাঠিয়ে দিয়েছি তোমার ঠিকানায়। তোমার কাজ হল, সেই সমস্যার সমাধান করে ফেলা। এই গল্পটি মনোনীত হলে আরেকটি গল্প, তারপর আরেকটি…”
সেদিন বিকেলে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সব শুনেটুনে মা ভ্রূ কুঁচকে বলেছিলেন, “হুম, ব্যাপারটা তো ঠিক সুবিধের ঠেকছে না!”
আর ক্লাসে ওর বেস্টফ্রেন্ড অশ্বিনী এসব শুনে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে বলেছিল, “ওরে এ তো দারুণ খবর রে অদ্রিজা! তোর মত এক অজানা, অচেনা মেয়ের বই তিনি নিজের গ্যাঁটের টাকা খরচা করে প্রকাশ করবেন বলছেন-এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে?”
বছর বারোর চনমনে অশ্বিনী নিজে একলাইন লিখতে না পারলেও বন্ধু অদ্রিজাকে কিন্তু বরাবর লেখায় উৎসাহ দিয়ে এসেছে!
আজ বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে লেটারবক্সে উঁকি মারতেই অদ্রিজা দেখল, ব্রাউনরঙের একটি খাম উঁকি মারছে বাক্সের ভিতর থেকে। বাক্সটা খুলে খামটা বার করে আনল অদ্রিজা। মা এখনো অফিস থেকে ফেরেনি। ঠামিও গতকাল বিকেল থেকেই পিসির বাড়িতে। আজ রাতেই ফিরে আসবেন তিনি।
তড়িঘড়ি ব্যাগ থেকে চাবি বার করে ঘরে ঢুকে সযত্নে খামটা খুলল ও, খামের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে ওর একটি গল্পের পান্ডুলিপি! পাতাগুলি হাতে নিতেই অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ পেল অদ্রিজা। গন্ধটা যেন খুব চেনা চেনা! কী এক অদম্য আকর্ষণে পান্ডুলিপির পাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে ওর মনে হল-মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে! আরে, অক্ষরগুলো সব চোখের সামনে এমন ফিকে হয়ে আসছে কেন? চারিপাশের সবকিছুই বা এমন ঝাপসা হয়ে আসছে কেন?
হঠাৎই এক অবশ ঘোরের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে অদ্রিজার মনে হল, গল্পের প্রতিটি অক্ষর যেন ঘুমের মাসি ঘুমের পিসির মত এক অদ্ভুত সম্মোহনে ওকে জড়িয়ে ধরতে শুরু করেছে!
কেমন একটা তীব্র অস্বস্তির মধ্যে চোখ মেলল অদ্রিজা। এক ঝুপসি গাঢ় অন্ধকার ঝুলে রয়েছে ওর চারপাশে। চোখ কচলে ভাল করে চেয়ে দেখল ও, মাথার ওপর নীল আকাশ বলে কিচ্ছু নেই, যা আছে তা হল থাকে থাকে ঝুলে থাকা এক ঘন কালো ধোঁয়ার স্তর! যা বাব্বা! এ আবার কোথায় এসে পড়ল ও!
অসহ্য গরমে অদ্রিজার দমবন্ধ হয়ে আসছিল। মাথা তুলে ও দেখল-দিগন্তবিস্তৃত কালচে বালির সৈকতে শুয়ে আছে ও। একটু দূরেই ফেনিল সমুদ্র আপনমনে ফুঁসে চলেছে।
থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়াল অদ্রিজা। চারিদিকের এই পরিবেশ, এই আবহমণ্ডল–এ সবই যে ওর ভীষণ পরিচিত। এ যে ওরই গল্পের পটভূমি! প্রশান্ত মহাসাগরের কোলে জেগে থাকা এক ছোট্ট অজানা দ্বীপ। গুগল ম্যাপে যার কোন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সে দ্বীপ আছে, আছে তার সমস্ত অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য নিয়ে, জাদুকরি দীপ্তি নিয়ে, অবাক গল্পের সম্ভার নিয়ে! তবে কি ওর গল্পটাই অভিনীত হতে চলেছে এবার? আর ওর গল্পের প্রধান চরিত্রের জায়গায় এসে হাজির হয়েছে ও নিজে?
সারা গায়ে জমে ওঠা ধূসর ছাইএর মিহি প্রলেপ ঝাড়তে ঝাড়তে এদিক ওদিক তাকাল অদ্রিজা। জনমানবহীন দ্বীপের কালচে বালিপাথরের বেলাভূমি জুড়ে পড়ে আছে সমুদ্রের জলের সাথে ভেসে আসা ‘ড্রিফটউড’ অর্থাৎ ভাঙাচোরা গাছের টুকরো।
আর দ্বীপের মাঝখানটিতে একটা সবুজ পাহাড়, যার মাথায় ধিকি ধিকি জ্বলে চলেছে এক উজ্জ্বল আগ্নেয়গিরি। গলানো আগুন গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের গা বেয়ে, মুহূর্তের মধ্যে সেখানে জমে উঠছে কালো আগুনপাথরের চাঁই! শিমুলতুলোর মত চারিদিকে ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো ছাই! উর্দ্ধগামী কালো ধোঁয়ার প্রতাপে মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে ঘনকালো মেঘ গাঢ় হয়ে ঝুলে রয়েছে। সেই কুটিল কালো ধোঁয়ার স্তর যেন চিরস্থায়ী এক চাঁদোয়ার সৃষ্টি করেছে ওর মাথার ওপরে। যে কালো চাঁদোয়ার বুক ফুঁড়ে চাঁদের আলো তো দূরের কথা, সূর্যও হয়ত আজকাল এখানে উঁকি মারতে ভয় পায়।
অদ্রিজা জানে ঐ আগুনপাহাড়েই থাকে এক অদ্ভুতদর্শন লাল পাখি। যার ছোটো ভারি ডানা, লেজটা মোরগের মত, আর ঠোঁটটা কুমীরের মুখের মত। অজরপাখি। এই অজানা দ্বীপের ড্রিফটউড অধিবাসীদের কাছে একমাত্র পবিত্র পাখি। কিন্তু তার ছোট্ট ছানা হারিয়ে যাওয়াতে সে এখন প্রবল রাগে ফুঁসছে। তার প্রবল রোষাগ্নি থেকে কারোর মুক্তি নেই।
“মুক্তি নেই বললেই হবে?” একটা খটখটে গলার স্বরে চমকে উঠে অদ্রিজা চেয়ে দেখল ওদের পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা ভেজা ড্রিফটউড হঠাৎই বদলে গিয়ে চারফুট লম্বা এক কেঠো বুড়োর চেহারা নিয়েছে, “তুমিই গল্প লিখেছ, সুতরাং মুক্তির উপায় তোমাকেই খুঁজে বার করতে হবে! যাকগে, তুমি এসে গেছ মানে এবার আমাদের সমস্যার একটা সমাধান হবেই হবে।”
ওদের কথার মাঝেই বিশাল ভারি শরীর নিয়ে সমুদ্রের দিকে থপথপিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ড্রাগনের মত দেখতে,গায়ে কাঁটাওলা একটা ড্রিফটউড সামুদ্রিক গোসাপ। আড়চোখে অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, “কিন্তু যা করার একটু তাড়াতাড়ি কর তো বাপু, এ কষ্ট যে আর সহ্য হচ্ছে না। উফফ, সমুদ্রে নেমেও শান্তি নেই গো, জলেও ভেসে বেড়াচ্ছে দলা দলা ছাই!”
ভাল করে তাকিয়ে দেখল অদ্রিজা, এ হল ওর গল্পের সেই কথা বলা ইগুয়ানাটা!
পাশ থেকে তিড়িংবিড়িং লাফাতে লাফাতে অনেকটা হেরিং-এর মত দেখতে একটা ভোঁতা ঠোটের ডানাহীন কালো ড্রিফটউড পাখি টিপ্পুনি কেটে বলে গেল, “কেন অত অবাক হওয়ার কী আছে শুনি? তুমি আমাদের নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে গপ্পো লিখতে পারো, কিন্তু আমরা সশরীরে সামনে এসে হাজির হলেই ভিরমি খেতে হবে?”
কী কান্ড! এ দ্বীপের জীবজন্তুরা সব্বাই ওর মনের কথা সব বুঝতে পারে নাকি! বিষম বিস্ময়ে বিষম খেতে খেতে অদ্রিজার মিষ্টি মুখটা লাল টুকটুকে টমেটোর মত হয়ে গেল।
ইতিমধ্যেই আশেপাশে বালির ওপর শুয়ে পড়ে থাকা ড্রিফটউড মানুষের দল ঠকাঠক আওয়াজ তুলতে তুলতে এসে ভিড় জমিয়ে ফেলেছে ওর চারপাশে-ছোট ছেলেকোলে উলোঝুলো মা; পায়ে বাত ঠাকুমা; থুড়থুড়ে ঠাকুর্দা; দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবা; গোমড়ামুখো পালোয়ান; টিংটিঙে দুষ্টু ছোঁড়া, কে নেই সেখানে! ওদের কেঠো জমায়েত ছাপিয়ে অদ্রিজার চোখ চলে গেল আগুনপাহাড়ের দিকে। ধোঁয়াটে অন্ধকারে গায়েমাথায় ক্রমাগত জমতে থাকা ছাই-এর স্তর ঝাড়তে ঝাড়তে অদ্রিজা জিজ্ঞেস করল, “এবার তাহলে গল্পের নায়িকা ছোট্ট তিন্নির মত আমাকে অজরপাখির ছানাটাকে উদ্ধার করে আনতে হবে?”
কেঠো বুড়োটা বিজ্ঞের মত হাতের লম্বা আঁকশি দিয়ে বেলাভূমিতে কয়েকটা আঁক কেটে বলে উঠল, “তা করতে হবে বইকি! শোন, বিকেল হয়ে গেছে! তোমার হাতে আর বেশি সময় নেই। আর দেরি করা যাবে না, অজরপাখি সন্ধে হলেই বেরোবে আর সামনে যা পাবে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে! আমরা তখন সব নিথর হয়ে শুয়ে পড়ব সমুদ্রের কোলে।”
অদ্রিজার মনে পড়ে গেল-এই দ্বীপের উত্তরদিকে একটা ছোট্ট খাঁড়ি মত আছে, সেই খাঁড়ির ওপারে আছে এই দ্বীপেরই এক যমজ দ্বীপ। সেটাও ড্রিফটউড পিপলের দ্বীপ। দুটি দ্বীপেরই অধিবাসীদের অভিভাবক এবং রক্ষক হল সেই দ্বীপের অজরপাখি। একসময় খাঁড়ির ভাগ নিয়ে এদের মধ্যে রেষারেষি চরমে পৌঁছেছিল। তখন দুই দ্বীপের দুই অজরপাখির লড়াইতে মারা গিয়েছিল ঐ দ্বীপের অজরপাখি। অজরপাখি একশ বছর বাঁচে, আর এর মাঝে সে মাত্র একবারই ডিম পাড়ে। ঐ দ্বীপের অজরপাখি ডিম পাড়ার আগেই মারা যাওয়ায় দ্বীপের অধিবাসীরা প্রায় অনাথ হতে বসেছিল। তখন ওদেরই মধ্যে কিছু দুষ্টু লোক ফন্দি করে এই দ্বীপের অজরপাখির ছানাটাকে চুরি করে নিয়ে যায়। বন্ধুত্বের ভান করে উপঢৌকন নিয়ে আসছে বলে একটা বড় ঝুড়িতে করে তারা নিয়ে এসেছিল সে দ্বীপের বিভিন্ন গাছের চারা। কারণ এ দ্বীপের অধিবাসীরা ইতিমধ্যেই দ্বীপের অর্ধেক গাছপালা সাফ করে ফেলেছিল। আসলে গাছপালা কেটে জলে ভাসিয়ে দেয় এরা, যাতে সেগুলো এসময় ড্রিফটউড হয়ে ফিরে আসে ওদের সমাজে! কিন্তু ওরা ভুলে গেছিল যে, জঙ্গল হল পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থান। কারণ জঙ্গল নিজেই নিজের আবহাওয়া আর জলবায়ু সৃষ্টি করে। কিন্তু এদিকে গাছপালার অভাবে বৃষ্টির অপ্রতুলতা থেকে শুরু করে নানা সমস্যা যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করল কেবল তখনই এদের টনক নড়ল। সুতরাং ঐ দ্বীপ থেকে কয়েকজন যখন চারা নিয়ে এ দ্বীপে এল, তখন কেউ কিচ্ছুটি সন্দেহ করেনি। আর সেই ঝুড়িতে করেই লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ঘুমন্ত অজরপাখির ছানাটাকে।
সেই সঙ্গে ওরা ভুলে গেছিল আরো একটা কথা, এক দ্বীপের অজরপাখি কখনোই অন্যদ্বীপের অজরপাখির জায়গা নিতে পারে না। ফলে মাঝখান থেকে দুই দ্বীপের সম্পর্ক আরো খারাপ তো হয়ে গেলই, নিজের ছানাটাকে হারিয়ে এই দ্বীপের অজরপাখিও চূড়ান্ত ক্ষেপে গেল। তার আস্ফালন জাগিয়ে তুলল পাহাড়ের মাথার আগ্নেয়গিরিকে। এখন আরেকটা যুদ্ধের মাধ্যমে অজরপাখির ছানাটাকে উদ্ধার করে আনতে পারলে তবেই এই দ্বীপ আবার আগের পরিস্থিতিতে পৌঁছতে পারবে!
“আরে না না, আমরা আর যুদ্ধ করতে চাই না!” কেঠো বুড়ো যেন অদ্রিজার মনের কথাটা লুফে নিয়েই তড়িঘড়ি বলে উঠল”এই দ্বিতীয়বার যুদ্ধটা আর ঘটতেই দেওয়া যাবে না! তোমাকে নতুন কিছু পথ খুঁজে বার করতে হবে! মারামারি, কাটাকাটি-এসব কখনোই কোনকিছুর সমাধান হতে পারে না। দিনের বেলা অজরপাখি চোখে দেখতে পায় না। এই সুযোগে ঐ দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে আনতে হবে তার ছানাটাকে-কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়!”
অদ্রিজা অবাক হয়ে কেঠোবুড়োর কথা শুনছিল। গল্পের এই অংশটা ওর কাছে পুরো অজানা লাগছে। ওর গল্পে ও লিখেছিল, দুই দ্বীপের মধ্যে আবার একটা যুদ্ধ হবে। তবে কি প্রকাশক ভদ্রলোক গল্পের ঠিক এই জায়গাটাই বাদ দিয়ে দিয়েছেন? কিন্তু যুদ্ধ ছাড়া এ সমস্যার আর কী সমাধান হতে পারে?
“যুদ্ধ ছাড়াও সমস্যার সমাধান হতে পারে বইকি!” কেঠোবুড়ো গম্ভীরগলায় বলল, “দ্বীপের উত্তরপশ্চিমের খাঁড়িটা যেখানে সমুদ্রে মিশেছে, সেইখানে জলের তলায় একধরনের লাল ইচ্ছেকোরাল পাওয়া যায়, যার সাহায্যে কেবল একটিই ইচ্ছেপূর্ণ করা যায়। তবে ইচ্ছেকোরালকে জলের বাইরে নিয়ে এলেই কিন্তু তার জাদুক্ষমতা ফুরিয়ে যায়। এই কোরালের গল্প আমাদের বলে গেছেন এক ভদ্রলোক, যিনি নাকি কী’সব বইটই প্রকাশ করেন। তবে ঠিক কোথায় যে কোরালটা পাওয়া যায় তা আমরা কেউই জানি না। কী করে জানব বলো? আমরা ড্রিফটউড মানুষের দল তো জলের তলায় ডুব দিতেই পারি না, জলে নামলেই যে ভুসভুসিয়ে ভেসে উঠি সবাই! তবে সেই ইচ্ছেকোরাল নিয়ে একটা সুন্দর ছড়াও তিনি বলে গেছেন আমাদের। দেখো দেখি সেই ছড়া থেকে কিছু খুঁজে বার করতে পারো কিনা!” কেঠো বুড়ো তারপর হেলেদুলে সুর করে বলে উঠল,
“নীল সবুজে মেশে
মণির খনিতে এসে!
চরকি পিছনে ফেলে!
রাঙামীন চর মেলে!”
“হুম, তাহলে আগে ঐ খাঁড়ির কাছে গিয়ে দেখতে হবে এই হেঁয়ালির কোন সমাধান করতে পারি কিনা। যদি পারি-তাহলে তো সব চুকেবুকে গেল। আর যদি না পারি-তখন আমাকে অন্য কোন উপায় ভাবতে হবে।” অদ্রিজা গম্ভীরভাবে বলে উঠল।
“বেশ তো, তাহলে আর দেরি না করে রওনা দিয়ে দাও! আর হ্যাঁ, একটা কথা, পথে পড়বে এক ছোট্ট জঙ্গল, যেখানে প্রচুর ডানাওলা মুজ্ অর্থাৎ হরিণ আছে। ওদের যেন আবার ঘাঁটাতে যেও না।” কেঠোবুড়ো ওকে সাবধান করে দিল, “ওরা রেগে গেলে শিঙের ডগা দিয়ে মাথা গুঁতিয়ে, থেঁতলে দেবে যেমন দিয়েছিল কয়েকটা আক্রমণকারী ক্যাটফিশের মাথা। সেই থেকে ক্যাটফিশদের মাথা চ্যাপটা হয়ে গেছে আর মুসদেরও আর কেউ ঘাঁটাতে সাহস করে না!”
“বুঝেছি, বুঝেছি!” অদ্রিজা এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলে উঠল, “মুসদের অরিজিন স্টোরি শুনে এখন সময় নষ্ট করলে চলবে না! আমার এখন অনেক কাজ বাকি!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ! তাহলে আর দেরি না করে এবার দুগগা দুগগা বলে রওনা হও দেখি!” কেঠো বুড়ো তার হাতদুটো কপালে ঠেকিয়ে ঠিক মায়ের মতই ঠাকুরের উদ্দেশ্যে দুটো পেন্নাম ঠুকল! কেঠো বুড়োর দেখাদেখি সকলেই কেঠো হাতে খটাখট আওয়াজ তুলে ওদের বিদায় জানাল।
খাঁড়ির পথে যেতে যেতে জঙ্গলে দুএকটা ড্রিফটউড মুসের সাথে ওর দেখা হল ঠিকই, কিন্তু তারা ওর কোন ক্ষতি তো করলই না, উলটে পরামর্শ দিল “খাঁড়িতে একডুবে লালকোরালের খোঁজ করতে হবে, নয়ত কিন্তু তা খুঁজেই পাবে না!” সারাটা পথ ও হেঁয়ালিটাকে কেটে-ছিঁড়ে একশা করে ফেলল, কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। অবশেষে খাঁড়ির কাছে এসে ওর চোখে পড়ল,খাঁড়ির সবুজ জল গিয়ে মিশেছে নীল সমুদ্রে এবং সেই দুটি রঙের বিভাজনরেখা একটু ভাল করে খেয়াল করলেই নজরে পড়ে! খাঁড়ির ওপারেই যমজ দ্বীপ, কালো ধোঁয়াটে মেঘের রাশি ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছে সে দ্বীপেরও আকাশ!
এবার যেন ছড়াটার মানে ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে অদ্রিজার কাছে। মণির খনি এখানে কোত্থেকে আসছে? মণির খনি মানে কী? রত্নাকর? অর্থাৎ সমুদ্র? খেয়াল করে দেখল অদ্রিজা, ঐ নীলসবুজ জলের মিলনস্থলের কাছেই সমুদ্রের একটা জায়গায় এক ছোট্ট ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ‘চরকি’ মানে নির্ঘাৎ ঐ ঘূর্ণাবর্তকেই বোঝানো হয়েছে। সেই চরকিকে পিছনে ফেলে আরো এগিয়ে যেতে হবে। তবে ‘রাঙামীন চর মেলে’ মানেটা ঠিক বুঝল না ও। মীন মানে কি হীনচেতা? কিন্তু সেটা তো ইংরেজি শব্দ! নাহ, তা তো হবে না! একবার বাবার কাছে মীন শব্দটা শুনেছিল ও, কি যেন মানে ওটার..ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে- মাছ! ‘চর’ মানে কী? নদীর চর নাকি গুপ্তচর? অর্থাৎ সংবাদদাতা? তবে কি লালমাছ বলে কোন মাছ আছে? তাদের অনুসরণ করলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে লালকোরালের কাছে?
এমনিতে সাঁতার কাটতে অদ্রিজার দারুণ লাগে, রোজ সকালে পাড়ার লেকে সাঁতার কাটতে যায় ও। কিন্তু তাবলে এভাবে একাকী এমন সুনসান খাঁড়িতে? খাঁড়িটা কত গভীর কে জানে! অথচ আর কোনো উপায় আছে বলেও তো ওর মনে হল না। গল্পের সমস্যার সমাধান না করলে বোধহয় ওর আর ফেরার কোন পথও নেই!
সত্যি বলতে কী, এইমুহূর্তে হাতপা ছড়িয়ে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে অদ্রিজার। মাকে কি আর ও কোনোদিন দেখতে পাবে? উফ! কী কুক্ষণে যে ও গল্পটা লিখতে গিয়েছিল!
অনেক দোনামনা করে অবশেষে ভয়ে ভয়ে খাঁড়ির সবুজ জলে নেমেই পড়ল ও। আহ, বেশ ঠাণ্ডা জল। কিছুটা সাঁতরে এসে কেন জানিনা ওর মনে হল, ঘূর্ণিটাকে যত কাছে মনে হয়েছিল, তা মোটেই ততটা কাছে নয়!
কতক্ষণ ধরে ও সাঁতরেছিল সে খেয়াল ওর নেই, অবশেষে ঘূর্ণিটাকে নিরাপদ দূরত্বে পিছনে ফেলে এসে যখন থামল, অবাক হয়ে দেখল, জলের মধ্যে পাক দিয়ে বেড়াচ্ছে এক ঝাঁক কুচো কুচো লালমাছ। এই প্রথম কোনো রক্তমাংসের প্রাণী ওদের নজরে পড়ল! কিন্তু ওকে প্রচন্ড চমকে দিয়ে লালমাছগুলোও হঠাৎ খলবলিয়ে উঠল, “দেখো বাপু, শুধু নিজের কথাই ভাবে যারা, তারা কিন্তু আমাদের এ দুনিয়ায় কোনোদিন প্রবেশ করতে পারে নি, পারবেও না! আমরা আসলে সকলেই অন্যের শুভচিন্তা করি, অন্যের কথাই ভাবি! তা যদি পারো, তাহলেই আমাদের সঙ্গে এসো-নয়ত দমবন্ধ হয়ে মারা পড়বে কিন্তু সেকথা আগেভাগে বলে রাখলাম!”
হেঁয়ালির উত্তরটা তাহলে নির্ঘাৎ ঐ লালমাছেদের দঙ্গলেই লুকিয়ে আছে! ‘যা থাকে কপালে’ এই ভেবে মাছগুলোকে অনুসরণ করে ও জলের আরো গভীরে যেখানে নেমে এল, সেখানে আলোছায়ার আলপনা ঘিরে রেখেছে চারপাশ। জলের তলায় এ যেন এক অন্য রূপকথার রাজ্য! নানাধরনের, নানা রঙের, লম্বা, বেঁটে জলজ উদ্ভিদের সাজানো বাগান। কত বিভিন্ন আকারের রংবাহারি, চকচকি পাথর-তা থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে মায়াবী আলো! কত অদ্ভুতরকমের, ছোটবড় সামুদ্রিক প্রাণী নিশ্চিন্তে গল্প করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে! রামধনু রঙ যেন টাটকা চাঁদের আলোতে মিশিয়ে মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের গায়ে, চারিদিকে উজ্জ্বল রঙের খেলা। ঝিকিমিকি, ঢেউখেলানো গালিচা বিছিয়ে শুয়ে আছে রংবাহারি সমুদ্রঘাসের দল। বর্ণময়, ছন্দময় সমুদ্রশ্যাওলায় ফুটে উঠেছে মায়াবী আলোর কারুকাজ। আর তার মাঝেই-আরে, ঐ তো, ঐ তো-একটা পাথরের খাঁজে আগুনের মত ধিকি ধিকি জ্বলছে ওগুলো কী? ওগুলোই কি লালকোরাল?
অদ্রিজার সাতরঙা ইচ্ছে বুড়বুড়িয়ে উঠতে শুরু করেছে লালকোরালের জাদুজগতে! এবার অবশ্যই দূর হয়ে যাবে দুই দ্বীপের যত সমস্যা, নিভে যাবে অজরপাখির রোষ, মুছে যাবে আগুনধোঁয়ার রাজত্ব!
আর ঠিক তখনই, অদ্রিজার মনে হল সুদূর থেকে কে যেন ওর নাম ধরে ডেকে চলেছে! এক চিরচেনা গলার স্বর যেন ক্রমশই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে শুরু করেছে!
“অদ্রিজা! অ্যাই অদ্রিজা! ঘুমিয়ে পড়লি নাকি রে? ওরে দরজাটা খুলবি তো!” মায়ের গলার স্বরে উপচে পড়ছে অপরিসীম আশঙ্কা আর উদ্বেগের সুর!
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে চোখ কচলে অদ্রিজা চেয়ে দেখল টেবিলের ওপর মাথা রেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল ও! আর পাশেই বইখাতা, পেনের স্তূপের মাঝে আলগোছে পড়ে রয়েছে সদ্য লালকালি দিয়ে সংশোধন করে রাখা ওর গল্পের পান্ডুলিপিটা!
দুড়দাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই সন্ধের এক ঝলক ঠান্ডা, সতেজ বাতাস হুমড়ি খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল অদ্রিজার গায়ের ওপর! “বাপরে, কী মারাত্মক ঘুম রে বাবা! কখন থেকে ডেকে চলেছি তোকে সে খেয়াল আছে?”
সেদিনের সেই ঘটনাটা নিছকই স্বপ্ন ছিল না অন্য কিছু তা হাজার ভেবেও কোন কূলকিনারা খুঁজে পায়নি অদ্রিজা! কাউকে সেসব কথা বলারও সাহস করে উঠতে পারে নি ও। এমনকি অশ্বিনীকেও নয়। পাছে সবাই ওকে পাগল বলে! দুরুদুরু বুকে তারপর একদিন পান্ডুলিপিটা পাঠিয়েও দিয়েছিল ও খামের ওপরে লেখা ‘পি ও বক্স’ নাম্বারে!
কিন্তু মাসখানেক বাদেই যখন এক ঝলমলে বিকেলে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে মা অফিস থেকে বাড়ি ফিরল, অবাক চোখে অদ্রিজা তাকিয়ে দেখল, মায়ের হাতে ধরা রয়েছে ব্রাউনখামে মোড়া কয়েকটা বই!
বইগুলোর গায়েও যেন লেগে আছে সেই চেনা চেনা গন্ধটা। অনেকটা যেন বাবার ধুলোমাখা ঘেমো গায়ের গন্ধের মত, চরম হতাশার সময় যা অদ্রিজার চারপাশে ভোরের চকচকে আলোয় মত ছড়িয়ে পড়ত, ফিসফিসিয়ে বলত, “ওরে পাগলি, হতাশায় ভেঙে পড়ে যারা হাল ছেড়ে দেয়, তাদের নিয়ে কিন্তু কখনোই কোন গল্প লেখা হয়নি! গল্প লেখা হয় তাদের নিয়ে যারা হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পিছিয়ে না পড়ে ইচ্ছেঘুড়িতে চেপে পার হয়ে যায় সকল বাধা! তোকে আমি সেরা হতে বলব না কখনো। কিন্তু, যখন যাই করবি, তুই তোর সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করবি। আর এই চেষ্টাটুকুই কিন্তু সব!”
মা মিটিমিটি হাসছেন। এক অদ্ভুত ভালোলাগা বিকেলের নরম রোদের মত চুঁইয়ে পড়ছে সে হাসিতে, “তোর ‘অচিন দ্বীপের অলীক কথা’ নামের ছবির বইটা পাড়ার দোকানে এসে গেছে রে অদ্রিজা। শুধু আমাদের পাড়া না, অশ্বিনীর মা আমাকে ফোন করে বললেন ওদের ওখানেও সব দোকানে আজ পৌঁছে গেছে তোর বই। যারাই এ বই পড়েছে, সবাই নাকি বলেছে-খুব, খুব ভাল লিখেছিস তুই! এ বই নাকি বেস্ট সেলার না হয়ে যায়ই না!”
ক্রিরিরিরিরিরিরিং! নিঝুম বিকেলের অলস নিস্তব্ধতাকে ভেঙে চূরমার করে দিয়ে বসার ঘরে ফোনটা সশব্দে বেজে উঠেছে।
“হ্যালো…” দৌড়ে গিয়ে অদ্রিজা ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল প্রকাশকের গম্ভীর গলার স্বর।
“হ্যালো অদ্রিজা, তোমার নতুন বইএর জন্যে আমার আন্তরিক অভিনন্দন! আর হ্যাঁ, সেইসঙ্গে জানাই, তোমার আরেকটি গল্প এবার আমি প্রকাশ করতে চলেছি। চিন্তা কোরো না, খুব শিগগিরি দ্বিতীয় গল্পের পান্ডুলিপির খামটি পৌঁছে যাবে তোমার কাছে!”