-যেতেই হবে?
-হু, প্লিস , আজ ছাড়।
-কাল আসবি তো?আমি আর দেরী করব না।
-আসব আবার কাল।
ধড়মড়িয়ে উঠলাম।একেই শীতের রাত, মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম বিন্দু বিন্দু ঘাম।আজ ও এসে “ও” ঘুমটা জাস্ট… ব্যালকনিতে এসে সিগারেট ধরালাম। রাস্তার পাশের নিয়ন আলোটা আজ একটু বেশী ক্ষীণ যেন! তানি ঘুমালো?দেখি তো গিয়ে।আস্তে আস্তে পায়ে টিপে টিপে ওপরের তলাতে এসে আলতো করে দরজা ঠেলে দেখলাম “হু, ঘুমিয়েছে।তবে আজ ও জামাটা জড়িয়ে” ।গলা দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল কিছু।আস্তে করে ভেজিয়ে নীচে নামলাম।বাবা , মা ঘুমাচ্ছে ওই ঘরে।বালিশের নীচ থেকে বার করলাম “ওকে”,আমার শ্রেয়া, শ্রেয়া মুখার্জি । তখন আমি দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছি। চুটিয়ে কলেজ করছি। বিকেলে টিউশন পড়াতাম।কী করব! এত বড় হয়েও যদি বাবাকে গিয়ে বলি,
-বাবা, ফ্রি প্যাকটা শেষ হয়ে গেছে।পয়সা দেবে?
দিয়েও দিত জানেন, কিন্তু বিছানায় রাখা ওই টাকাটার সাথে বাবার দীর্ঘশ্বাস যেন শুনতে পেতাম।যাকগে! সেদিন কলেজে,
-ওই শুনছিস?
সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে ছিলাম।ওপরে তাকিয়ে দেখলাম , একটা মেয়ে পরনে একটা কালো সালওয়ার।চুলটা একটু কোঁকড়ানো।সামনে আসতেই দেখলাম, চোখ দুটো।ওগুলোই যেন কথা বলে! তেমন কিছু দেখতে না, শুধু ওই যে চোখ , ব্যস নেমেই ইয়র্কার মারল। চুটকি মারতেই দেখলাম সামনে, বলল,
-রাহুল তো তুই?
মনে হল কেউ এসে কলারটা তুলে দিল।বললাম,
-তুমি মানে তুই?
-চিনবি না। আমি শ্রেয়া মুখার্জি।আর্টসের মেয়েকে আর এয়াকাউন্ট এর ছেলেরা কী করে চিনবে!!
একটু হেসে বললাম,
-না , সেটা না।সেভাবে অনেকের সাথেই….
মুখের কথা টেনে বলল,
-জানি, জানি।ইউনিয়ন লিডার আপনি, ছোটখাট মানুষদের কী ভাবে চিনবেন!!
বড্ড ভালো লাগছিল কথা গুলো।প্রথম কথা কিন্তু যেন কত জন্মের চেনা।স্বাবলীল কিন্তু কান হয়ে বুকে বিঁধছিল।শেষবার স্কুলে প্রিয়াঙ্কাকে দেখে যেমন তাকিয়ে থাকতাম।বললাম,
-এবার উদ্দেশ্যে তে আসা যাক।
বক বকটা আচমকা গিলে নিল যেন।বলল,
-আসলে সরস্বতী পূজার জন্য যে অনুষ্ঠান হবে, সেটার জন্য অনেক আগে নাম নেওয়া হয়ে গেছে।আমাকে সবাই বলল, তুই পারিস নাম ঢোকাতে, তাই…
পাশে দাঁড়ানো নিলয় বলল,
-হবে না,পরের বছর।
চোখ দুটো ছোট হয়ে গেল হঠাৎ,খেয়াল মনে হয় শুধু আমিই করেছি। থামিয়ে বললাম ওকে,
-কাল দুটোয় ত্রিশ টাকা নিয়ে ক্যান্টিনে চলে এস, স্লিপ দিয়ে দেব।
চলে গেল ও, সেদিকে তাকিয়ে ওর মিলিয়ে যাওয়া দেখলাম।নিলয় বলল,
-রাহুল, শেষমেশ তুই ও?
-ধুর!!
সরস্বতী পুজোর দিন ঠিক সেজেগুজে হাজির শ্রেয়া। আজ কিন্তু শাড়ি, বাসন্তী রঙের একটা।স্টেজের পেছনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে, দেখে বললাম,
-অল দা বেস্ট।
চোখটা একটু চিক চিক করল খুশিতে।ওর নাম ডাকতেই স্টেজে উঠে গেল।খেয়াল করলাম নীচে ওর চুলের কাঁটাটা পড়ে।এদিক ওদিক তাকিয়ে ভরলাম পাঞ্জাবীর পকেটে।বেরোতে বেরোতে শুনলাম ” আমারও পরান ও যাহা চায়…”।
যখন নামল স্টেজ থেকে দেখতে পায়নি ওকে ঝাপসা চোখে।
আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব টা ভালোই জমে উঠেছিল।আজকাল আজ কলেজ মিটিংয়ে যেতে পারতাম না।বুঝত সব, বলত,
-সব ঘেঁটে দিলাম না আমি?
বলতাম,
-না না সব সাজিয়ে রাখছিস
না বলিনি কোনোদিন আই লাভ ইউ ওকে।বলতে হয় নি মুখ ফুটে।একদিন বলল,
-এক জায়গায় যাবি?
বললাম
-কোথায়?
বলল,
-চ না
মানিকতলার মোড়ে এসে রাস্তার ওপারে এসে ওপারের বস্তিটায় নিয়ে এল।প্রথম দুটো বাড়ী ছেড়ে এসে চিৎকার করল,
-কই রে মা
কোথাথেকে একটা বাচ্চা এসে জড়িয়ে ধরল ওকে, সঙ্গে একজন মধ্যবয়সী মহিলা।পেটের কাছে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
-মা
প্রচন্ড অবাক হলাম, কিছু জিজ্ঞেস করিনি। ফেরার পথে নিজেই বলল,
-জানিস আট বছর আগে পেয়েছিলাম ওকে এই শিয়ালদহ এর কাছেই।কেউ ফেলে দিয়ে গেছিল।তুললাম কোলে, আঙ্গুলটা ধরল শুধু। বুঝলি সেদিন মনে হয় কোনো কিশোরী মায়ের স্বাদ পেয়েছিল।ওই মহিলা আমাদের ঘরে কাজ করে।নিজের বাচ্চার সাথে মানুষ করে ওকে।যা পারি দিয়ে আসি।
হঠাৎ করে কথাগুলো শুনে খুব ভালোবাসা পাচ্ছিল আমার।বললাম,
-শ্রী বিয়ে করবি আমায়?
হোঁচট খাচ্ছিল একটু, বলল,
-মানে?
-মানে ফানে বুঝি না।বিয়ে করব তোকে। দেখ দেখতে শুনতে ভালোই আমি, মানে সবাই বলে।পড়া শেষ হলেই কাজে ঢুকে যাব।তুই তোর মত জীবনটা গোছাস, শুধু আমায় নিয়ে গোছাস।
কিছু বলেনি, শুধু বলল,
-ট্যাক্সি করে দে একটা।
চলে গেল ও, মেসেজ হয়ে ঢুকল শুধু,
-সব ঠিক আছে, শুধু পায়ের থেকে মোজার গন্ধ খুব আসে,ওটা নিজেই ধুবি।
আনন্দে ড্রেনে গিয়ে পড়তাম।রোজ না আমার জন্য সেজে আসত শুধু, জিজ্ঞেস করত”কেমন লাগছে?” বলতাম,
-আজ আবার সাজ হয়েছে নাকি?
ভালো লাগত বেশ।সেবার যখন স্টার এর সামনে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে আমার জন্য।শেষমেশ ফোন,
-আসবি না চলে যাব?
সত্যিই সেদিন জ্যাম ছিল, বললাম,
-আর একটু
“গেলাম”মেসেজটা পড়লাম, ভাবলাম মানিয়ে নেব ঠিক। হাতিবাগান যখন ঢুকল আমার বাইক আরও ত্রিশ মিনিট খেয়ে নিল।কোথায় কোন গাড়ি উল্টে কি এক্সিডেন্ট হয়েছে।ফোন করলাম , ধরল না।করলাম বার বিশেক, না ধরেনি।
পরের দিন দেখলাম ওকে, খবরের কাগজের প্রথম পেজে,হাতে আমার দেওয়া ওই ব্রেসলেটটা পড়ে…
ও কিন্তু কথা রাখে এখনো।রোজ দেখা দিয়ে যায়।হু শুধু হাতে হাত রাখতে পারি না।চুলে শ্যাম্পু করলে গন্ধ শুকতে পারি না।পকেটে রুমাল রেখেও ওর আঁচলে ঘাম মুছতে পারি না। হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে ওকে পেছনে দেখতে পাই না। ও হ্যাঁ , ওই মেয়েটা আরে ওই বস্তির , তানিয়া নাম ওর।ঘরে নিয়ে এসেছি, আমার কাছেই মানুষ হবে ও।বলেছি বাবা ডাকতে। মাঝে মাঝে মা কে খোঁজে, আমি ও বলি,
“আমার ও যে ওকে বড় ইচ্ছে করে ডাকতে”