শালবনের কিনারা ঘেঁষে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো কাঁঠালগাছ। গাছভরা কাঁঠাল। একটি গাছের একটি কাঁঠাল আগাম পেকেছে। ম-ম গন্ধ ছড়াচ্ছে চারপাশে।
বিকেল বেলায় একটি খ্যাঁকশিয়াল শালবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় টের পেল পাকা কাঁঠালের গন্ধ। কাঁঠাল-খিদেয় পেট তার চোঁ চোঁ করে উঠল। লোভী চোখে তাকিয়ে ভাবল—কাঁঠাল পাকলে খ্যাঁকশিয়ালের কী! যেমন বেল পাকলে কাকের কী!
না না! কাককে তো সে এ বছরই বেল খেতে দেখেছে! কোথায়, কোথায়! হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেবার একটি গাছপাকা বেল বাতাসে টুপুস করে শক্ত মাটিতে পড়েই ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। সেই বেল খেয়েছিল কাকটি। এমন কোনো সুযোগ কী আছে পাকা কাঁঠালের ক্ষেত্রে? অবশ্য কাঁঠালের বোঁটা যা শক্ত! পেকে-পচে কাঁঠালের কোয়া-ভুচরা মাটিতে পড়ে যেতে পারে, তবুও বোঁটাটা ছিঁড়বে না। ভাবতে ভাবতে তার চোখ আটকে গেল পাকা কাঁঠালের ওপর—কাঁঠালের মুখে ছিদ্র করার চেষ্টা করছে দুটো পুঁচকে কাঠবিড়ালি! তাই তো! যে ডালের আগায় পেকেছে কাঁঠাল, সেটা তো বলতে গেলে মাটির দিকেই নেমেছে। চেষ্টা করলে ওই গাছে তো ওঠা যায়! ভাবতে না ভাবতেই দৌড় দিয়ে সে কাঁঠালগাছটার গোড়ায় গেল। বেশ কসরত করে কিছুটা ওঠার পর দিব্যি হেঁটে হেঁটে নুয়ে পড়া ডাল হয়ে পৌঁছে গেল পাকা কাঁঠালটির কাছে। কাঠবিড়ালি দুটো ছিদ্র প্রায় করেই ফেলেছিল, খ্যাঁকশিয়াল দেখে ভয়ে ওরা পালিয়ে গেল। খ্যাঁকশিয়াল উবু হয়ে শুয়ে প্রথমে ছিদ্র করল কাঁঠালটার মুখের কাছে, তারপরে মজা করে খেতে শুরু করল মধুর রসে ভরা কোয়া। নিচের দিকে তাকিয়ে ভয় অবশ্য করছে অল্প অল্প। মাটি থেকে ১০ ফুট উঁচু তো হবেই। কাঁঠালগাছের মালিক যদি এসে পড়ে, লাফ দিতে হবে। হাড্ডিগুড্ডি ভেঙেও যেতে পারে! তা যাক। কতকাল যে পাকা কাঁঠাল খায় না সে!
শালবনের ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এল একটা ধাড়ি পাতিশিয়াল, প্রচণ্ড খেপে হাঁক দিল, ‘ব্যাটা পুঁচকে খ্যাঁকশিয়াল! সাহস তো কম নয় তোর? রোজ সকাল-বিকেল এসে আমি দেখে যাই কাঁঠাল পাকল কি না! আর তুই কিনা আমার সেই কাঁঠাল গিলছিস গাছে চড়ে! ব্যাটা খেকু, তোর আজ ঘাড় মটকাব।’
খ্যাঁকশিয়াল তার কাশফুলের মতো ঝোপালো লেজটি নিচের দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওরে পাতু! তুই আমার এই লেজটারও কিছু করতি পারবিনে।’
পাতিশিয়াল খেপে একেবারে কাই হয়ে চিত্কার দিল, ‘খেকুরে! বেশি খ্যাঁক খ্যাঁক করলি কিন্তু আমি এখনই দূরের ওই গেরস্থ বাড়ির সামনে গিয়ে ‘হুক্কা হুয়া’ ডাক শুরু করব। অমনি ওই বাড়ির বাঘা বাঘা কুকুরগুলো ধাওয়া করবে আমাকে। আমি দৌড়ে এই কাঁঠালতলায় এসে দেখিয়ে দেব তোকে। বুঝবি তখন ঠ্যালা!’
এবার খ্যাঁকশিয়ালটি ‘খ্যাঁক খ্যাঁক’ শব্দে হাসতে শুরু করল। মুখ থেকে ছিটকে বেরোল কাঁঠালের একটি বিচি, পড়ল গিয়ে পাতি শিয়ালটির নাকের ডগায়। তারপরে হাসতে হাসতেই বলল, ‘বোকা পাতুরে! কী বুদ্ধি তোর! বাঘা কুকুররা বুঝি তোকে ছেড়ে দেবে! তুই যেমন গাছে চড়তে পারিসনে, তেমনি কুকুরও গাছে চড়তে পারে না। ডেকে আন তোর দোস্তদের।’
পাতিশিয়াল এবার কাকুতি ভরা কণ্ঠে বলল, ‘তুই না আমার জাতভাই! একাই খাবি? আমাকেও দে না দু-পাঁচটা কোয়া। অত বড় কাঁঠালটা তুই তো আর একা খেয়ে শেষ করতে পারবিনে। পাশের ওই বড় বড় কাঁঠাল দুটোও তো মনে হচ্ছে পেকেছে। দে না ছোট ভাই।’
খেকু এবার সোজা হয়ে ডান থাবা বাড়িয়ে পরখ করল বাকি দুটো কাঁঠাল। তারপর বলল, ‘এ দুটো ভালো করে পাকবে আজ রাতেই। কাল সকালে আমি আমার তিন ছেলেমেয়ে ও তাদের মাকে নিয়ে আসব। গাছে চড়ে মজা করে কাঁঠাল খাব। এটুকু বলে মুখ থেকে একটা বিচি নিচের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘নে পাতু, কাঁঠালের বিচি গিলে খা। বিচিতে ভাইটামিন আছে।’
বিচিটা কপালের মধ্যিখানে পড়তেই খেপে একেবারে আগুন হয়ে পাতু বলল, ‘পণ্ডিতের সঙ্গে ফাজলামো! জানিস, আমার মাথার খুলির মধ্যে আছে ৬৪ রকমের বুদ্ধি! শিয়াল পণ্ডিত আমি!’
বিচি ফেলে আরেকটি কোয়া গলার ভেতরে চালান করে বলল এবার খেকু, ‘তুই আমার কচু করবি। আসল পণ্ডিত হলাম আমি।’
পাতু বলল, ‘যুগ যুগ ধরে আমিই শিয়াল পণ্ডিত। তুই আবার পণ্ডিত হলি কবে?’
‘আরে মূর্খ পাতু, বইটই তো পড়িসনি জীবনে, যাসনি পাঠশালায়, জানিস না ইতিহাস-ভূগোল। আমাদের পাঠশালায় পড়ে কত কুমিরছানা-মুরগিছানা-ছাগলছানা মানুষ হয়ে গেল! তা ঈশপের নাম শুনেছিস তো, মূর্খ!’
পাতু এবার প্রচণ্ড আক্রোশে দুটো লাফ দিয়ে চিত্কার করে বলল, ‘ওই ব্যাটা ঈশপই তো মূর্খ। মূর্খ না হলে সে সিংহকে বনের রাজা বলে! তোর মতো ইঁদুরমুখো খেকুদের বলে পণ্ডিত! ছ্যা, ছ্যা!’
‘গায়ের জোরে কিন্তু ইতিহাস বদলানো যায় না। ঈশপ হচ্ছে একটা দলিল।’
‘দলিল না ছেঁড়া কাঁথা! ঝড়ে ছেঁড়া কলার পাতা! আরে বোকা খেকু, ওই ঈশপ ব্যাটা তো জীবনে সুন্দরবনের বাঘ দেখেনি, পাতিশিয়ালও দেখেনি। দেখেছে ইঁদুরমুখো খেকুদের আর গরুলেজা-ঘোড়াকেশী সিংহদের। আরে, আমাদের সুন্দরবনের বাঘ দেখলে তো ঈশপ মাথা ঘুরে পড়ে যেত! “মহারাজ” খেতাব দিত বাঘকে। আমাকে খেতাব দিত “মহাপণ্ডিত”!’
খেকু আবারও হাসল খ্যাঁক খ্যাঁক করে। বলল, ‘তা কে বড় পণ্ডিত, প্রমাণ তো তুই দেখতেই পাচ্ছিস! আমি গাছে বসে আরামে কাঁঠাল খাচ্ছি। আর তুই জিভে লালা ঝরাচ্ছিস।’
‘আমি কিন্তু গরু-ছাগলের দড়ি দাঁতে কাটতে পারি। মানুষের মাটির ঘরে সিঁদ কাটতে পারি। তুই কি পারবি ওই কাঁঠালের বোঁটা কাটতে? দেখি তোর দাঁতের ধার!’
‘পারব না মানে! দ্যাখ তবে!’ বলেই খেকু প্রবল জেদে দাঁত দিয়ে কেটে দিল আধখাওয়া কাঁঠালটির বোঁটা। প্রচণ্ড শব্দে কাঁঠালটি পড়ল তলায়। পাতু কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়েই বলল, ‘ওরে ও খেকু। জীবনে আমি ৩০ বার গরু-ছাগলের দড়ি কেটেছি। তুই অন্তত তিনটি কাঁঠালের বোঁটা কেটে দেখা! তাহলে শুধু আমি কেন, বাংলাদেশের শিয়ালসমাজ তোকেই পণ্ডিত বলে মেনে নেবে। আমাদের ছেলেমেয়েদের তোর স্কুলে পাঠাবে।’
অমনি খেকু জিদ দেখিয়ে অন্য দুটি পাকা কাঁঠালের বোঁটাও কেটে দিল। পড়ল তলায়। এতক্ষণে পাতু ঘাড়-মাথা উঁচিয়ে গলা ছেড়ে ডাকতে শুরু করল হুক্কা হুয়া! দেখতে না দেখতে শালবনের মাটির তলার সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এল ছানাপোনাসহ এক ডজন শিয়াল। দৌড়ে এসে সবাই মিলে পাকা কাঁঠাল ভেঙে খেতে শুরু করল হুটোপুটি করে।
গল্পের বিষয়:
গল্প · ছোট গল্প