চরৈবতি

চরৈবতি

দুজন অসমবয়সী মানুষ কি একে- অপরের বন্ধু হতে পারে? প্রশ্নটা নিজের কাছেই ছুঁড়ে দিল বছর সাঁইত্রিশের কপিল | যার জন্য কপিলের মনে এই প্রশ্নের উদ্ভব সেই মণিদীপার বয়স ত্রিশের কোঠায় | তবে তাদের দুজনের কাউকেই একঝলক দেখে বয়সের আন্দাজ লাগানো সম্ভব নয় | নিয়মিত ব্যায়াম ও স্কিনকেয়ারের ফলে তাদের বয়সের তুলনায় অনেকটাই কমবয়সী দেখায় | তবে এই দুজনের মধ্যে বেশ খানিকটা ব্যবধানও রয়েছে | মণিদীপার বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক আগে, পাঁচ বছর বয়সী এক সন্তানের জননী সে | অন্যদিকে কপিল এখনও ব্যাচেলর, যদিও মাঝেমধ্যেই মায়ের চাপে পাত্রী দেখতে বাধ্য হয় | কিন্তু আদৌ সে বিয়ে করতে চায় কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন না করাই ভালো |

কপিল ও মণিদীপার প্রথম দেখা হয় বিলাসবহুল একটি জিমে | মণিদীপাকে একঝলক দেখেই কপিল বুঝতে পারে নিছকই সময় কাটানোর জন্যই সে জিমে আসে | তবে সুশ্রী মণিদীপার দুঃখী মুখে কপিল যেন ম্যাডোনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেত | প্রথম প্রথম মুখোমুখি হলে হালকা হাসি, ইক্যুইপমেন্ট নিতে গিয়ে টুকরো কথাবার্তা ব্যাস এটুকুই ছিল দুজনের মধ্যেকার সম্পর্ক | তবে কপিল মণিদীপার কাহিনী শোনার আগে ভাবতেও পারেনি আপাত সুখী মেয়েটার মনে এত দুঃখ লুকিয়ে আছে | সে ভাবত আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত এ মেয়েও দুঃখবিলাস করতে ভালোবাসে | শুধু ম্যাডোনার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠা মুখটাই কপিলকে তাড়িত করত মণিদীপার সঙ্গে কথা বলার জন্য | আস্তে আস্তে একে অপরের সঙ্গে সহজ হয়ে উঠতে থাকে তারা |

জিমের পর একসঙ্গে বাড়ি ফেরা, মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া, তবে মণি কোনদিনই নিজের শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করতে রাজি ছিল না | তবে কপিলের কাছে বলেছিল নিজের অসুখী দাম্পত্য, একাকীত্বের অসুখের কথা | এই রহস্যভেদের পরেও কপিলের মণির প্রতি আকর্ষণ কমে যায় নি, উল্টে বেড়েছে | সেই বিষণ্ণতা আঁকা মুখ যেন কপিলের মনে স্থায়ীভাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে, আর অন্য কাউকে চেষ্টা করেও সেখানে বসাতে পারছে না | তাও মায়ের জন্য মাঝেমধ্যেই তাকে মেয়ে দেখতে যাওয়ার নাটক করতে হয় | কিন্তু সে নিশ্চিতভাবে জানে মণি কোনদিনই তার একান্ত আপন হবে না | বোধহয় মণি নিজের বিষণ্ণতাকে সঙ্গী করেই কাটিয়ে দেবে গোটা জীবনপথ |

মণিদীপার স্বামী অনির্বাণ সেন এমনিতে মন্দ নন কিন্তু আবেগহীন, যান্ত্রিক, কেজো মানুষটার জীবনের পুরোটা জুড়েই কাজ আর কাজ | বিয়ের পর থেকেই একাকীত্বের অসহায়তা ঘিরে ধরেছিল মণিকে | ভেবেছিল কোলে একটা সন্তান এলে হয়ত নিজের এই অভিশপ্ত একাকীত্ব থেকে মুক্তি পাবে | যথাসময়ে মণির কোল আলো করে এলো একরত্তি ফুটফুটে রাই ওরফে মহাশ্বেতা | তুলতুলে মিষ্টি রাইকে নিয়ে বেশ কয়েক বছর আনন্দেই কাটল মণির | ছোট্ট রাইয়ের আধো আধো বুলি, একটু বড় হলে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে প্লে স্কুলে যাওয়া, রাইকে নিত্য নতুন সাজে সাজানো এসব নিয়েই সে মেতে ছিল |

স্বামীর শীতলতা, নিজের জগতে বুঁদ হয়ে থাকা কোনকিছুই তার উপর প্রভাব ফেলতে পারত না | যন্ত্রের মতই স্বামীর কাজগুলো করে নিয়ে সন্তানকে নিয়ে নিজের মত করে ব্যস্ত থাকতে শুরু করেছিল মণি | কিন্তু আর একটু বড় হতেই অনির্বাণ নিজের স্ট্যাটাস মেনটেনের দোহাই দিয়ে রাইকে দেরাদুন বোডিং স্কুলে ভর্তি করে দিল | যাওয়ার দিন রাইয়ের কান্নাভেজা মুখটা আজও চোখ বুজলেই দেখতে পায় মণি | মাঝেমধ্যেই ভাবে রাইকে নিয়ে নিজের বাপের বাড়ি ফিরে যাবে কিন্তু সে জানে সেটা সম্ভব নয়, দাদার সংসারে সে নিতান্তই অবাঞ্ছিত অতিথি | সেখান তার আদর অনির্বাণের স্ত্রী হিসাবেই, কিন্তু বোনের পরিচয় নিয়ে সন্তানসহ সেখানে স্থায়ীভাবে থাকা যায় না তা মণি দাদার বাড়ি গেলেই উপলব্ধি করতে পারে | যখন তার বিয়ে হয় তখন অর্থনৈতিকভাবে বাবা ততটা সক্ষম ছিলেন না, তাই সেসময় দাদাই বিয়ের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেছিল | তাই নতুন করে আবার দাদার বোঝা হওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে | এছাড়াও অনির্বাণ সেন যথেষ্ট প্রভাবশালী, তাই ডিভোর্স নিলে আদৌ নিজের মেয়ের কাস্টডিটাও পাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান মণি |

তাই একমাত্র সন্তানকে ছেড়ে থাকতে প্রচন্ড কষ্ট হলেও সে নিজের ভবিতব্যকে মেনে নিয়েছে | এর সবটাই জানে কপিল | সত্যি বলতে কি সময় কাটাতেই জিমে এসেছিল সে কিন্তু সেখানে যে কপিলের মত একজন সংবেদনশীল বন্ধু পাবে তা মণি স্বপ্নেও কল্পনা করেনি | মণির তরফ থেকে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের হলেও কপিল যে এর থেকে তাকে অনেকটা বেশি ভাবে তা বুঝতে মণির খুব একটা সময় লাগেনি | আসলে প্রতিটা মেয়েরই একটা ষষ্ঠেন্দ্রিয় থাকে যার ফলে হয়ত তারা ছেলেদের মনোভাব সহজেই বুঝতে পারে | তাই মণি বারংবার কপিলকে বিয়ের জন্য তাড়া দেয়, ভয় হয় পাছে সেও না কোন একদিন কপিলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে |

এই সংসার, অনির্বাণের সঙ্গে টেনে নিয়ে চলা দাম্পত্য, মেকি সম্পর্কটাকে উপেক্ষা করে মাঝেমধ্যেই মণির পালিয়ে যেতে সাধ হয় | কিন্তু তখনই দুচোখে ভেসে ওঠে ছোট্ট রাইয়ের মুখ | এই টান কোনোমতেই সে এড়াতে পারবে না | যদিও কপিল বলে ডিভোর্সের পর ছোট বাচ্চার কাস্টডি মাকেই দেওয়া হয় তবুও তার মধ্যেও অনিশ্চয়তার একটা চোরাস্রোত রয়েছে তা বুঝতে ভুল হয়না মণির | তাই সন্তান বাৎসল্যের কাছে হেরে কবে যেন এই অসুখী দাম্পত্যের বোঝা টেনে নিয়ে যাওয়াকে সে নিজের নিয়তি হিসাবে মেনে নিয়েছে |

সবাই বলে, আজকাল নাকি সময় বদলাচ্ছে | মেয়েরাও স্বাধীন | সে নিজেই স্টিয়ারিং ধরে নিজের জীবনের ড্রাইভারের ভূমিকা নিতে পারে | সত্যিই কি তাই? মণিদীপার মত মেয়েরা কি পেরেছে নিজের ভাগ্যের চালক হতে? নাকি সবটাই উপর দেখানো এক বিজ্ঞাপনী চমক | প্রথমে দেখলে চোখ ঝলসে যায় বটে কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করলেই টের পাওয়া যায় সবটাই ফাঁকি |

আজও সমাজ সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, শুধু গৃহবধূদের হাউসওয়াইফ নাম বদলে গালভরা নাম হয়েছে হোমমেকার | আগেও নারীর মনের খবর পুরুষ রাখেনি আর আজও রাখেনা | তাই অসুখী দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করেও সুখী দাম্পত্যের বিজ্ঞাপনী মডেল হয়ে ওঠে মণিদীপারা | আর কপিলদের মত সংবেদনশীল পুরুষদের কি হয়? হয়ত তাদের সংবেদনশীল মনকে সামলাবার জন্য কেউ নিজেই এসে তাদের হাতটা ধরে নেয়, নতুবা স্মৃতির বোঝা মনে নিয়ে তারা সারাজীবন একাই রয়ে যায়, এক্কেবারে একা |

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত