আমি ‘হাফসাতুল আনি’। অনেক ভালবেসে বিশ্বাস করে বিয়ে করেছিলাম। ভেবেছিলাম ওকে নিয়েই সুখি হবো। পারিনি, আমার বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে আজ। আমি যেদিন প্রথম রবিনকে চিনি সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একটা ছেলে এতো সুন্দর করে লিখে অথচ তার লুকটা কোন লেখকের ধার কাছেও নেই। বাউণ্ডুলে আর চার পাঁচটা স্বাভাবিক ছেলের মতোই। আরো অবাক হয়েছিলাম, যে ছেলেটা এতো এতো রোমান্টিক গল্প জন্ম দিয়েছে সে আদতই রোমান্টিক না। আমি যে সুন্দরী একটা মেয়ে ওকে সারাদিন টেক্সট করি তার কোন সিরিয়াস ভ্রুক্ষেপই নাই। ঘুম আসলে ঘুমিয়ে পরে। কথা বললে খুব স্বাভাবিক।
তবে এটাই আমি চেয়েছিলাম। আনকমন, ডিসেন্ট, এক্সেপশনাল। আমি তাকে পেয়েছি। বিয়েটাও করে ফেললাম। ভেবেছিলাম ওকে আমি ঠিকঠাক করে ফেলবো। পারিনি। একটা গাধা কখনো ঘোড়া হয়না। ন্যাকারা লেখক হলেও লুইচ্চা হয় সেটা জানতাম না। বিয়ের পরে কোথায় বউকে নিয়ে লিখবে নিজেকে নিয়ে লিখবে, তা না ইরা মিনা টিনা নিয়েই আছে। তাদের কেউ একটার সাথে নিশ্চয়ই কোন সম্পর্ক ছিল। তা না হলে এমন হবে ক্যান? সেদিন জিজ্ঞেস করলাম; রবিন তুমি এদের নিয়েই লিখো, কারা এরা? সেদিন মুখের উপর বলে দেয়; তুমি যে জাবেদ রাইয়ান নিয়ে লিখো তারা কারা? শুধুই ফ্রেন্ড? নাকি অন্য কিছু?
এই কথা শুনার পর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। রবিন ভালো করেই জানে এসব শুধু চরিত্র। আর নাম বন্ধুদের দেই ইচ্ছে করেই। আমার সব বিশ্বাস সেদিন চিরতরে হারিয়ে যায় যেদিন আমার পুরাতন ফেক আইডি দিয়ে ওকে টেক্সট করে পরীক্ষা করলাম;
– হাই লেখক সাহেব!
– হ্যালো
– আপনি খুব সুন্দর লিখেন। আমি আপনার লিখার অনেক বড় ফ্যান।
– ধন্যবাদ। কোথা থেকে বলছেন?
– ঢাকা, গুলশান। আপনি অবশ্যই সিলেট থেকে? আমি সব জানি। আমার প্রিয় লেখক বলে কথা।
– হাহাহা থ্যাঙ্কু সুন্দরী।
এবার গা’টা জ্বলে উঠলো। কতো ফাস্ট একটা অপরিচিত মেয়ের লুতুপুতু রিপ্লাই দিচ্ছে, অথচ অফিসে আছে এখন। আমার মেসেজ দুদিন আগে দেয়া, এখনো সিন করেনি। যাক, তারপর
– আপনিও অনেক হ্যান্ডসাম লেখক সাহেব।
– ইউ আর সো বিউটিফুল। আমি এতো সুন্দরী কাউকে এই প্রথম দেখলাম।
– আচ্ছা আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে? সরি ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করে ফেললাম। আসলে আমি একটু এক্সাইটেড।
– হাহাহা গার্লফ্রেন্ড জোটানোর সময় নাই ম্যাডাম। পড়াশোনার যা চাপ চলছে।
– কোথায় পড়েন আপনি?
– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এতবড় ডাহা মিথ্যা শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সে পড়তো তিতুমীর কলেজে। তাও এইরকম বাজে ছাত্র আমি জীবনে দেখিনি। বই কোনদিন পড়তেও শুনি নাই। চাকরি একটা তার মামার রেফারেন্সে পাইছে বলে করছে। আর এখানে! উফফ আল্লাহ আমি কি দেখছি!
– কই বায়োতে দেয়া নাই তো!
– আমি শো অফ করিনা!
– বাহ্ এইনা হলো আমার লেখক!
– আমার কিউটি পাঠিকা।
– আমি আপনার মতোই একটা মানুষ খুঁজি।
– খুঁজতে থাকলেই চলবে না। পেয়ে গেলে বলে ফেলবেন ডিরেক্ট।
– পেয়েছি তো!
– কোথায়?
– এইযে আপনি! আই লাভ ইউ।
– ওয়াও! আমি এতো হ্যান্ডসাম না কিন্তু, ভেবে দেখেন। আমার লজ্জা করতেছে। ঢং করছেন নাতো?
– তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা বলো?
– আই লাভ ইউ টু।
এবার মাথাটা ঘুরছে খুব। এ আমি কাকে বিয়ে করলাম? এতো বড় ঠকবাজ! ভন্ড! সেদিন অফিস থেকে এসেই চেঞ্জ করে বারান্দায় ফোন নিয়ে চলে গেছে। বসে বসে সিগারেটও ফুঁকছে। আমি টেক্সট করলাম ফেক আইডি থেকে;
– কোথায় আমার লেখক সাহেব?
এইতো ছাদে বসে আকাশ দেখছি। আকাশে একটা চাঁদ আছে ভাবছি এটার চেয়ে সুন্দর আমার আরেকটা চাঁদ আছে। সেটা তুমি। আসোনা সোনা কথা বলি।
– আম্মু পাশে সোনা। বকবে, আমি ফোনে কথা বললেই সমস্যা। ফোন নিয়ে নিবে। তখন আর পাবানা কিন্তু।
– আচ্ছা আচ্ছা বাবু ঠিক আছে।
– এই শুনো একটা কিসি দাওনা।
– উম্মাহ্
– আচ্ছা সিগারেট খাওনা তো! এসব কিন্তু আমি পছন্দ করিনা।
– নাহ্ বাবু, আমি এটা ঘৃণা করি। এলার্জি আছে এটাতে অনেক। ছি! মানুষ কিভাবে খায়?
– ওয়াওও!!! আই লাভ ইউ।
– আই লাভ ইউ টু।
বিশ্বাস ধুয়ে মুছে শেষ। সিগারেট মুখে নিয়ে বলে সে সিগারেট খায়না। বারান্দা থেকে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বারান্দায় সারারাত কাঁদলাম। এই ছিল কপালে। না জানি কতো মেয়ের জীবন নিয়ে খেলেছে। পরেরদিন আমার বার্থডে ছিলো। অনেক আগে কথা দিয়েছিল একটা নীল শাড়ি আমাকে গিফট করবে। আমিও ওর জন্য একটা নীল পাঞ্জাবী কিনেছিলাম লুকিয়ে। কিছুই হলোনা। পাঞ্জাবী ছুড়ে ফেলে দিলাম খাটের নীচে। জীবনটা পানসে লাগছে আজ। বলবো না কিছুই তাকে। কারণ আমিই বিশ্বাস করে বিয়েটা করেছিলাম। সারাদিন অপেক্ষা করেছিলাম এটলিস্ট অফিস থেকে ফিরে এসে বলুক “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ আনি” নাহ্ এসে সেই আগের মতোই বারান্দায়। ভুলেই গেছে আজকের দিনটার কথা। সারাদিন মেসেঞ্জারে থাকে। আজকাল নিজেকেই নিজে ঘৃণা করছি। নিজের অপরিচিত চরিত্রটার কারণে আজ আমার স্বামী আমার থেকে বঞ্চিত। উফফ পারছিনা আর, তাও নক করলাম;
– কি অবস্থা লেখক সোনা?
– শুয়ে আছি, তুমি কি করছো? আজকের ছবিটা সুন্দর ছিলো। ফেসবুকে যে দিলা বেগুনী রঙের শাড়ী পরা ওটা।
– ওটা বেগুনি না। ওটা গাঢ় নীল। আমরা দেখা করি চলো কাল। আম্মু নানুর বাসায় যাবে।
– ওয়াও সত্যি! কোথায় আসবা বলো?
– উত্তরা দিয়াবাড়ি?
– ঠিক আছে। কি পড়ে আসবা?
– শাড়ী পরে আসবো। তুমি পাঞ্জাবী।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
পরেরদিন রবিন সকাল সকাল উঠেই শেভ করা, ফেইস ওয়াশ মুখে লাগানো। ঠোঁট সতেজ দেখানোর জন্য কি একটা লাগিয়ে পাঞ্জাবী ইস্ত্রি করছে। সেই পাঞ্জাবীটা, যে পাঞ্জাবীটা পরে আমাকে প্রপোজ করেছিল। আমার কলিজাটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। একটা চাকু দিয়ে নিজেকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে। রেডি হয়ে চলে গেল। এর ভেতরে আমাদের সম্পর্কটা খাওয়া আর ঘুম আর ব্যাস্ততা দেখানোর মতোই ছিল। ও অফিস চলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে আমিও রেডি হচ্ছি। সেই প্রথম দিন যে শাড়ীটা পরেছিলাম সেটাই পরেছি। প্রথম দিনের মতোই সেজেছি কারণ আজকেই শেষদিন। কালকে চলে যাবো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স দিতে হবে।
রবিনকে নক করলাম;
– বাবু কোথায় তুমি? আমিতো এসে গেছি।
– একটা জিনিস প্যাক করছি সোনা। পাঁচ মিনিট লাগবে।
আমি ঘুরে তাকিয়ে আছি। রবিন আসছে আমার পেছনে। একটা গলা কাশি দিলো। আমি ঘুরে ফিরে তাকালাম। তাকাতেই দেখি চোখমুখ উল্টে যাচ্ছে ওর। যেন ভূত দেখে শকড্ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পরবে। আমি খুব সিম্পলি বললাম;
– কেমন আছো লেখক সোনা?
ওর মুখ থেকে কথাই বের হচ্ছে না। ঘেমে একাকার। অ্যা..ব্যা…বু..তু… এসব করতেছে। কি বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা। হঠাৎ বলে উঠলো;
– আরে বাবু সারপ্রাইজ দিলাম তোমাকে। হাহাহা… দেখলা, আমি জানতাম তুমি ভুল বুঝবা।
ভন্ড! ইতর! বাটপার! বলেই গায়ে যত জোর ছিলো ততটা জোরে হাত টানিয়ে দিলাম এক থাপ্পড়। আমার হাত জ্বলছে খুব। গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিনমিন করে বলছে আ’ম সরি। আরেকটা থাপ্পড় দিলাম। অসভ্যটাকে মনের যা ক্ষোভ ছিলো সেভাবেই ঝেড়ে দিলাম। সম্পর্কটা শেষ করে দিলাম। ঘুরে চলে যাচ্ছে। কি যেনো একটা প্যাক করে এনেছিল। লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, টেনে কেড়ে নিয়ে এসেছি। লুইচ্চা কি কি কিনে মেয়েদের দেয় এটা তো দেখা উচিত। বাসায় চলে আসলাম। ইচ্ছে মতো ওয়াশরুমে শাওয়ার ছেড়ে কেঁদেছি। বের হয়ে সব প্যাক করে রেডি হলাম। স্মৃতিগুলো খুব কষ্ট দিচ্ছে। ওর বক্সটা খাটের উপর রাখা। খুলতে ইচ্ছে করছে না ঘৃণায়, তাও খুললাম।
খুলে দেখি একটা নীল শাড়ী যেটাকে ও বেগুনী রঙের বলতো। যেরকম শাড়ী আমাকে কিনে দেয়ার কথা ছিল কোন এক জন্মদিনে। এক জোড়া কানের দুল। অনেকদিন আগে ওকে নিয়ে শপিং করতে গিয়ে পছন্দ হইছিল। ওর কাছে ক্যাশ না থাকায় কিনতে পারেনি। একজোড়া জুতা, এক রাতে ওর বুকে শুয়ে শুয়ে অনলাইনে দেখে বলেছিলাম অর্ডার করে দিয়ো, এই জুতা জোড়া। এক ডজন চুড়ি। আমি শাড়ীর সাথে ম্যাচিং করে পরবো, বলেছিলাম চুড়িও লাগবে। কিন্তু এসব তো ঐ মেয়েকে মানে ফেক আইডি এই আমাকে দেয়ার কথা না। আমি তো এসব ব্যাপারে কোনদিন কথাই বলিনি। এটা কি করে সম্ভব? খুঁজলাম আর কিছু আছে কিনা। একটা খাম। ওঠার মধ্যে একটা চিঠি। চিঠিটা খুললাম;
প্রিয় আনি, ফেক আইডি ফেক মানুষ খেলাখেলিটা আর কতো বলো? নিতে পারছিলাম না সোনা। অসহ্য যন্ত্রণার অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার শক্তি আর নেই। তোমার কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিলাম না তবে তোমার কষ্ট আমি ভাগ করে নিয়েছি প্রতি রাতে। আমিও যে ঘুমের ভান করে কেঁদেছি তা কখনো দেখোনি। আমার একটাই কষ্ট, কি করে ভাবলা যাকে এতো ভালবাসি, যে এতো বিশ্বাস করলো আমাকে, তাকেই ঠকাবো? কি করে ভাবলা বলো আমাকে? আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি বোঝাতে পারিনি এটা আমার ব্যর্থতা, তাই দুঃখিত। আমি এমনটাই তুমি জানতে। মানতে পারোনি ক্যান বলো? তুমিনা লেখিকা! তাও সন্দেহ হলো আমাকে? জানো কতো বড় রিস্কের খেলা আমরা খেললাম? আজ বড় কিছু একটা ক্ষতি যদি হতো? আমি কাকে নিয়ে বাঁচতাম। কতটা টেনশনে থাকতাম প্রতিনিয়ত জানো তুমি? খাটের নীচে পাঞ্জাবী ফেলে দিলা ছুড়ে।
ওটা বের করে আনতে গিয়ে আমার পিঠ ছিলে গেছে এ খবর রাখছো? ব্যাথা নিয়ে আজকে বের হয়েছি। প্রতিদিন তোমার চাওয়াগুলো খুঁজে খুঁজে কিনে রেখেছি আজ দিবো বলে। তবে এখানেও একটা রিস্ক ছিলো। হয়তো আজ আমাকে ইচ্ছে মতো বকাবকি করে সব ছুড়ে ফেলে চলে যাবা। নতুবা ইমোশনাললি কথা বলে চলে যাবা। নতুবা ইচ্ছে মতো মারবা তারপর বকবা তারপর ইমোশনাল কথাবার্তা শুনিয়ে চলে যাবা। এজন্য গিফট বক্সটা এমন ভাবে আগলে রাখছিলাম যেনো ওটা দেখে সন্দেহ করো। তুমি না নাও যেন এমন করে আগলে রেখেছিলাম। তা না হলে তো নিবানা, রাগে ছুড়ে ফেলে দিতা। দেখি কাজে আসে কিনা। হাই রিস্ক। এখন যদি আমার চিঠিটা তোমার হাতে থাকে তাহলে আর চিন্তা করো না। আমি এতটা খারাপ না। একটু বিশ্বাস দরকার শুধু। আমি ছাদেই আছি তোমার দেয়া নীল পাঞ্জাবীটা পরে। চলে আসো।
সেদিন নিজেকে এতো ছোটলোক মনে হলো বলে বুঝাতে পারব না। এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে ছাদে উঠে গিয়ে দেখি পুরো ছাদ ঝিলমিল বাতি দিয়ে আর রংবেরং এর বেলুনে সাজানো। একটা টেবিলে মোমবাতি আর কেক। একটা কার্ডে বড় করে লিখা “সরি ফর লেট সেলিব্রেশন”।
রবিন পেছন ফিরে দাড়িয়ে আছে, পেছন থেকে জাপটে ধরলাম। সেদিন চিৎকার করে কেঁদেছি ওকে জড়িয়ে। ইচ্ছে করছিল ওর পায়ে ধরে ক্ষমা চাই। কিন্তু সে আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমি ভুল মানুষকে ভালোবাসি নি। কেঁদে কেঁদে বললাম এই দুষ্ট পাঞ্জাবী খুলো তো। ফাজিলটা কি মনে করছে কে জানে। বলে, ছাদেই!? মানুষ কি ভাববে? ঘরে চলো নাহয়! তখন আরেকটা থাপ্পড় দিয়ে বললাম, পাঞ্জাবী খাটের নীচ থেকে আনতে যে ছিলে গেছিলো পিঠ সে খবর আছে?
ভালবাসি অদ্ভুত এই পাগলটাকে।