হঠাৎ করেই সুবিমল মারা যাওয়াতে কেমন যেন থমকে গেছিলাম আমি। তখন সোনিয়া মাত্র আট মাসের। তিন বছরেই আমার বিবাহিত জীবনের আয়ু। আমার যখন বাবা মারা গেছিলেন তখন আমি ক্লাস টেনে উঠেছি মাত্র,আমার পরে আরো এক ভাই এক বোন। নিজেদের মাথা গোঁজার একটা আস্থানা ছিলো আর আয় বলতে বাবার একটা মুদিখানা দোকান। দোকানটা মা যাই হোক করে টিকিয়ে রেখেছিলেন। দাদু ছোট ভাইকে নিজের কাছে নিয়ে গেছিলেন। আমরা দুই বোন রয়ে গেছিলাম মায়ের কাছে।
দাদু সুবিমলের সাথে আমার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলেন। মায়ের ক্ষমতা ছিলোনা আমায় লেখাপড়া করানোর, শুধুমাত্র আমার জোরাজুরিতে মাধ্যমিক পাশ করতে না করতেই আমার বিয়ে হয়ে যায়।
সুবিমলের মৃত্যুর পর ,সবাই যখন কান্নাকাটিতে ব্যাস্ত, আমি তখন মেয়ে কোলে নিয়ে পাথর প্রতিমার মতো বসে ছিলাম।
শরীর ভাঙতে থাকলো দিন দিন,শাশুড়ি মা বুকে টেনে নিয়ে বললেন কতদিন বুকে পাথর নিয়ে চেপে থাকবি,মেয়েটাকে তো মানুষ করতে হবে!
পাশে শ্বশুর, শাশুড়ি ছিলো বলেই হয়তো নিজেকে সামলাতে পেরেছিলাম সে সময়ে।
মাঝে মাঝে মনে হতো আমার মতো এতো পোড়া কপালের মেয়েদের ঠাকুর কেন বাঁচিয়ে রাখে, ছোট থেকে অভাব অনটন, পড়াশোনা অল্প, যা হোক যখনই একটু সুখের মুখ দেখলাম তখনই…
মরতে গিয়েও মরতে পারিনি, সোনিয়া আর সুবিমলের বৃদ্ধ বাবা মায়ের কথা ভেবে।
যেহেতু সুবিমল একটা সরকারী স্কুলে চাকরি করতো তার মৃত্যুর পর আমি চাকরি পেলাম সেখানে।
শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকার জন্য নন্ টিচিং স্টাফ হিসাবে নিযুক্ত হোলাম । সে যাই হোক, খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অভাব রইলো না।
স্কুলের স্টাফদের সহায়তায় একটা কাজের লোক পেলাম, যে সোনিয়ার সাথে সাথে বাবা মায়ের ও খেয়াল রাখতে পারে।
মালতী বহাল হলো আমার বাড়িতে, ছোট খাটো, শ্যামলা, রোগা পাতলা গড়ন, মুখখানা খুব মায়াবী। দেখেই পছন্দ হলো।
দুদিন কাজ করার পর বুঝলাম সত্যি খুব ভালো মানুষ, বাবা মা ও ওর প্রশংসা করতো। কয়েকদিন বাদে ও আমায় বললো দিদি আমার মেয়েটাকে নিয়ে আসবো এখানে? রোজ যেখানে রেখে আসি, তারা আর রাখতে চাইছেনা ।ওর বর ওদের ছেড়ে গেছে আগেই শুনেছিলাম।
বললাম নিয়েই এসো তবে! খুশিতে ও আমায় জড়িয়ে ধরলো, পরে লজ্জা পেয়েছিলো তার আচরণে।
বুঝতে পেরেছিলাম মা তো! তাই সন্তানকে কোথাও রেখে এসো শান্তি পায় না।
পরের দিন বছর দুয়েকের গুড্ডিকে নিয়ে এসেছিলো। রোগা হাড় সর্বস্ব চেহেরা,টুকটুক করে হেঁটে বেড়ায়।
মালতীকে বললাম, কাল থেকে সোনিয়ার রান্নার সাথে ওর জন্যও একটু রান্না করে নিও, সে বললো, অতো যত্ন করতে পারিনি জন্য ও সব খেতে শিখেছে, আমার খাবার থেকে না হয় একটু খাবে। ওর জন্য দুধের ব্যাবস্থা করলাম, মালতী বললো দিদি আমায় এ মাস থেকে কিছু টাকা কম করে দেবেন, আমরা তো দুজনেই তো এখানে খাই!
মুগ্ধ হয়েছিলাম ওর সততা দেখে, আমার এটুকু উপকারের জন্য ও সংসারের সব কিছু সামলাচ্ছিলো।
একটু বড় হতেই প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করে দিলাম গুড্ডি কে। ওকে স্কুলে দিয়ে মালতী কাজে আসতো, ছুটি হলে নিয়ে আসতো মেয়েকে, আমি ফেরার পর ওরা বাড়ি ফিরতো।
সোনিয়া ভালো স্কুলে পড়তো, একটু বড় হতেই দেখলাম ও মোটেই গুড্ডিকে পছন্দ করেনা, ওর জুতো লুকিয়ে রাখে, জামা ছিঁড়ে দেয়, পেন ফেলে দেয়, শাস্তি দিতে গেলে মালতী বলতো ছোটো তো, তাই একটু… বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। মালতীর মেয়েটাও তো ছোটো, তবে আমার মেয়েটা কেমন এ রকম!
শ্বশুর মশাই মারা গেছেন ইতিমধ্যে, মেয়েটা আমার খুব দাদুর নেওটা ছিলো, মুষড়ে পড়ে ছিলো খুব। কথা বিশেষ বলতো না।
বাড়িতে ওদের দুজনের জন্য একটা মাষ্টার রাখলাম,কদিন পর সোনিয়া জানালো সে গুড্ডির সাথে পড়বে না, কাজের লোকের মেয়ের সাথে পড়তে ওর লজ্জা করে !অবাক হয়ে গেছিলাম ওর কথা শুনে, আমরা ফারাক না করলেও ও শিখেছে, কাজের লোক কাকে বলে।
মালতী বুদ্ধিমতী, তাই একদিন বললো দিদি সারাদিন তো ওরা স্কুলে থাকে, গুড্ডি ফেরার পর একটা দিদিমনি যদি আমার বাড়িতে রাখি তবে পড়াও হবে আর আমার ঘর পাহারাও হবে, যা দিনকাল পড়েছে বেশিক্ষণ ঘর খালি রাখা যায় না।
মরমে মরে গেছিলাম আমি, যে সময় মালতী এসে যদি সংসারের হাল না ধরত তো… কিন্তু নিরুপায় আমি, কি করতাম!
হাইস্কুলে ভর্তি হলো গুড্ডি ভালো নাম্বার নিয়ে, একটা টিউটোরিয়ালে ভর্তি করে দিলাম তাকে। শাশুড়ী মা মারা যাওয়ার পর মালতী বললো একজন রান্না করার জন্য বলছে, ভালো টাকাও দেবে, সোনিয়া আর তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার কোনো কাজ থাকেনা, সে সময়টা যদি আমি এই কাজটা করি, টাকাও আসবে, মেয়েটাকে যত দিন চায় পড়তে, পড়াবো, টাকার তো দরকার ।
রাজি হওয়ায় ও খুশি হয়েছিলো, বলেছিলো আমি বেঁচে থাকতে তোমার কাজ কোনদিন ছাড়বোনা, সোনিয়া স্কুল থেকে ফিরলে, ওর খাবার রেডি করে, রাতের খাবার তৈরী করে রাখতো। আমি ফেরার পর নিজের বাড়ি ফিরতো।
সারাদিন এতো পরিশ্রম করার শক্তি দেখে অবাক হয়ে যেতাম, একটুও বিশ্রাম করতো না। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তন হয়। সোনিয়া সব সময় রাগ রাগ করে থাকতো, ভাবতাম আমার সংগ পায়না বলে হয়তো এমন। ছুটির দিনে সব সময় ওর সাথে থাকার চেষ্টা করতাম, ওকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে যেতাম তবু কেমন যেন আমাদের মধ্যে দুরত্ব বাড়ছিলো। চিন্তায় ছিলাম কি করবো।
সোনিয়া খাওয়া নিয়েও খুত্খুত করতো, প্রায় মালতীর রান্নার ভূল ত্রুটি বের করে ওর ওপর মেজাজ করতো। ও সবকিছু ভুলে সোনিয়ার পছন্দ মতো খাবার বানিয়ে দিতো।
গুড্ডি সচরাচর আমাদের বাড়ি আসতো না, পরীক্ষার রেজাল্ট বা নিজের জন্মদিনে প্রণাম করতে আসতো। কোনোকিছু দিলে খুব সংকোচ করতো নিতে। মালতী বলতো, আশীর্বাদ করুন দিদি ওকে, ও যেন মানুষ হতে পারে। আপনার হাত ওর মাথায় না থাকলে, আজ এমন দিন আসতো না ওর জীবনে।
মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বেশ ভালো রেজাল্ট করলো গুড্ডি। কাছাকাছি একটা কলেজে কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে ভর্তি হলো। এখানেও গার্ডিয়ান সিগনেচার আমিই করলাম।
সোনিয়া ইলেভেনে পড়ে, ইংলিশে বন্ধুদের সাথে কথা বলে, ফোন দরকার তার, ঐ নিয়ে আমার সাথে অশান্তি। কথা বলার জন্য ফোন তো আছেই, সেটা তার বন্ধুদের সামনে বের করতে লজ্জা করে, স্মার্ট ফোন দরকার, বাধ্য হলাম কিনে দিতে ।তুলনা দিয়ে বলেছিলাম গুড্ডি কলেজে যাচ্ছে তার ফোন লাগেনা আর তোমার এখনি?
সোনিয়া চিৎকার করে বলে উঠেছিলো, তুমি আর তুলনা করার লোক পেলেনা, কাজের লোকের মেয়ের সাথে আমার তুলনা করছো, আমায় তবে বস্তির স্কুলে ভর্তি করতে পারতে! রাগে আরো অনেক কিছু বলতে বলতে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো।
কি বলছিলো সে, আমার মাথায় তখন ঢোকেনি, মালতী কাজ করছিলো, সে সোনিয়ার সব কথা শুনতে পেয়েছিলো, ওর মুখোমুখি হতে আমার লজ্জা করছিলো তখন।
হঠাৎ করেই মালতী অসুস্থ হয়ে পড়লো, কয়েকদিন আগে থেকে জ্বর হচ্ছিলো, হালকা কাশিও ছিলো। বলেছিলাম একটু ডাক্তার দেখিয়ে নাও, হয়তো জোর করে নিয়ে গেলে যেতো, সব আমারি গাফিলতি, আমি ওর প্রতি একটু কেয়ারিং হতে পারতাম।
হসপিটালে ভর্তি করে, জানা গেলো ওর লাং এ খুব ভালো ধরণের ইনফেকশন, সারা জীবনের মতো ভারী কাজ বন্ধ, পুষ্টিকর খাবার, দামী ওষুধ ও প্রচুর বিশ্রামের দরকার।
সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিলাম, মালতীর জমানো টাকা গুড্ডি আমার কাছে দিয়ে গেছিলো, সে আর কতটুকু! বলেছিলাম থাক না গুড্ডি আমি যেভাবে পারি ব্যাবস্থা করবো। সে বলেছিলো তোমাকে তো করতে হবে মামনি, এই কটা টাকায় মায়ের চিকিৎসা হবেনা। তুমি আমার মাকে বাঁচিয়ে দাও, কথা দিচ্ছি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত শোধ করে দেবো, শুধু তোমার ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবোনা।
বুকে টেনে নিয়েছিলাম মেয়েটাকে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো সে।
মালতীর বদলে গুড্ডি আসতো সকাল সকাল, কাজ সেরে চলে যেতো আমার সাথে, অনেকবার না বলেছি শোনেনি মেয়েটা, মায়ের ওষুধ তো তোমার দেওয়া টাকায় কিনি, আমার টিউশুনির টাকায় পড়ার খরচ ও টুকটাক কিছু হয়। আমি না এলে মা আসতে চাইবে, মাকে ভাল রাখতে আমাকে আসতেই হবে।
দেখে অবাক লাগছিলো চোখের সামনে বেড়ে ওঠা মেয়েটা হঠাৎ যেন বড় হয়ে গেছিলো।
ওকে কাজে আসতে দেখে সোনিয়া আবার নতুন করে ঝামেলা শুরু করলো, অযথা অপমান করতো, বলতো মায়ের পর মেয়ে কাজে আসছে, এর পর কি ওর মেয়েকে রাখবে নাকি?
প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, তুমি দামী স্কুলে পড়াশোনা করে এই শিখছো নাকি? ওকে দেখো, মায়ের ওষুধপত্র কেনার জন্য, জোর করে আমাদের সাহায্য করতে আসে, মায়ের খেয়াল রাখে, পড়াশোনা করে, টিউশনি পড়ায়। শেখো ওর কাছ থেকে তুমি!
আমার দরকার নেই ওসবের, তুমি শেখো, আর তোল্লাই দাও ওদের দেখো, একদিন তোমার ঠিক ক্ষতি করবে। দুমদাম করে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো সে।
একদিন গুড্ডি বললো মামনি, আজ সোনিয়া স্কুলে যায়নি, কিছু ছেলে বন্ধুদের সাথে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোতে দেখেছি। তুমি ওকে আমার কথা কিছু বোলোনা, তাহলে সে আমায় আর এ বাড়িতে ঢুকতে দেবে না, তুমি একটু খেয়াল রেখো শুধু।
ভয় পেয়েছিলাম আমি, সোনিয়া যদি কিছু ভূল করে ফেলে বাঁচবো কি করে, নাহ্ আমায় শক্ত হতে হবে!
দুদিন ছুটি নিলাম, ও বেরোনোর পর কোথায় যায় দেখবো বলে, ঠিক বলেছিলো গুড্ডি, ও একটা কুসঙ্গে পড়েছে। দ্বিতীয় দিন ওকে হাতে নাতে ধরে, ঐ ছেলেগুলোর সামনে এক চড় মারলাম, হাত ধরে টেনে বাড়ি নিয়ে এলাম। সেদিন রাতে ও আমার ঘুমের ওষুধ বেশ কয়েকটা খেয়ে ফেলেছিলো।
উফফ্ আমার সবকিছু যেন শেষ হয়ে গেছিলো, সে মুহুর্তে, কেঁপে উঠছিলো আমার পৃথিবী। সেই সময় একা হাতে দু দুটো ঘর সামলে নিয়ে ছিলো মেয়েটি।
অসম্ভব রকমের শান্ত হয়ে গেছিলো হাসপাতাল থেকে ফিরে সোনিয়া। আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে ছিলো আরো বেশী করে। অজানা একটা ঝড় আসছে আমার জীবনে বেশ বুঝতে পারছিলাম। বেশী করে আগলে রাখতে চাইছিলাম সোনিয়াকে।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলো কোনো রকমে ।আজ ওর জন্মদিন।ছুটি নিয়ে ওর পছন্দের রান্না করে ওর মন ভালো রাখার চেষ্টা করছি, ও বেরিয়ে গেলো। জানতে চাইলে বললো দরকার আছে, একটু পরেই ফিরবে। দুপুর গড়িয়ে গেলো ফিরলোনা। ফোন করলাম বার বার, কয়েকবার বেজে বেজে থেমেগেল, ও ফোন তুললো না। পরে ওর ফোন সুইচ অফ পেলাম। খুব ভয় পেয়েগেছিলাম। গুড্ডিকে ফোন করলাম ও একটু পরই চলে এলো। সব শুনে বললো, আজ সোনিয়ার আঠেরো তম জন্মদিন, হয়তো বন্ধু বান্ধবের সাথে সময় কাটাচ্ছে, ঠিক ফিরে আসবে, ভয় পেওনা মামনি।
সোনিয়া ফিরেছিলো সন্ধের সময়, ততক্ষণে পাগলের মতো ওর বন্ধুবান্ধবকে ফোন করে গেছি আমি।
গলায় মালা, সিঁথিতে সিঁদুর পরে একটা ছেলের সাথে ফিরলো। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। সে বললো,, আজ আমার আঠেরো বছর বয়স হলো, তোমার হাতের পুতুল হয়ে থাকার দিন শেষ আমার। আমি চাই না, তোমার সাথে থাকতে, আমার কিছু জিনিস নিতে এসেছি, নিয়েই চলে যাবো।নিজের ঘরে গিয়ে কিছু জিনিস গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো, বললো চললাম, আমাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করোনা, ফিরবোনা কোনোদিন।
পাগলের মতো কেঁদে কেটে হাতে পায়ে ধরে থামানোর চেষ্টা করলাম। ও আমাকে ঠেলে ফেলে বিজয়ীনির মতো ছেলেটির হাত ধরে বেরিয়ে গেলো। চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেছিলো, পড়ে যেতে যেতে বুঝলাম গুড্ডি তার মামনিকে সামলে নিচ্ছে শক্ত হাতে।