বৈশাখের একেকটা রাতে চারদিক আঁধার করে ঝড় নামে। দরজা জানালা বন্ধ করে সবাই প্রমাদ গুনে। একেকটা বজ্রপাতের শব্দে মনে হয় আকাশটা ছিঁড়ে যায় যায়। রাস্তার কুকুরটা পর্যন্ত ঘাপটি মেরে থাকে বস্তির গলিতে। আর তখনই কিনা মেয়েটা একলা ছাদে চলে যায়। অন্ধকার ভেদ করে যখন বজ্রপাত হয়, আর সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য দৃশ্যমান হয়ে উঠে এই শহর, শহরের ক্লান্ত, উচ্ছিষ্ট রাতের সড়ক, সেই সড়কে জমে ওঠা নোংরা কাদাজল, তখন আমরাও দেখতে পাই একজোড়া নয়ন। আহা, কি অপূর্ব সেই দুটি নয়ন। সেই নয়ন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বৃষ্টির জল। বোকারা অশ্রু বলে ভুল করে। ফোলা ফোলা লাল চোখ যখন শূন্যের দিকে তাকিয়ে, বিকৃত মুখের অবয়বের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চিৎকার করে ওঠে, যেই চিৎকার শুনতে পায় না এই গ্রহের কোন শ্রবণেন্দ্রিয়, ওপারে একজন ঠিকই জানেন এই কান্নার রহস্য।
২।
‘চাচা, সন্ধ্যার আগে চলে আসব’ বলে যখন মেয়েটা চলে গেল, শহরের একটা মেয়ে, এই গ্রামের রাস্তা ঘাট কিছু জানে না, সাথে শুধু দুই চাচাতো বোন, আর হাফপ্যান্ট পরা ভাই, উচিত ছিল সাথে যাওয়া। দুপুর গড়াতেই আকাশ কালো করে আগাম জানান দিবে বৈশাখের ঝড়, চাচা কি আর জানবেন? চাচার বাড়িতে এসেছে মেলা দেখবে বলে। মেলা বসে খালের ওপারের মাঠটায়। ডিঙি নৌকা দিয়ে যেতে হয় ওপারে। মেয়েটা সাঁতার জানে কিনা তাও জানা নেই। বেরুবো বেরুবো করে, ছাতাটা খুঁজি খুঁজি করতে হঠাতই শুরু হল দমকা হাওয়া। অমাবস্যার রাত নেমে এল এই পড়ন্ত দুপুরে। তাকানোর জো নেই, পাগলা হাওয়ায় ভাসছে বর্শা ফলা। মনির ছেলেটাকেও দেখা যাচ্ছে না। পাশের চৌধুরীদের বাড়িতে জায়গির থাকে বোকা বোকা ছেলেটা। দরকারের সময় কাওকে পাওয়া যায়না।
৩।
কাল আকাশ দেখেই ফিরতে হবে বুঝতে পারে মেয়েটা। খালের পারে আসতেই চারদিক ওলট পালট করে ঝড় নামবে, আর খালটা লাফাতে থাকবে, আর দেখবে একটাও ডিঙি নেই, কে জানত! ভয়ে যখন চিৎকারও বের হচ্ছেনা গলা দিয়ে, আর আশেপাশে দুই তিনটা অচেনা ছোকরা ছাড়া কেও নেই, তখন ঝড়ের মাঝে অসহায় চারজন জড়াজড়ি করে কাঁপতে থাকে। কেয়ামত নেমে আসে ছোট্ট পৃথিবীটায়, আর ইসরাফিলের শিঙায় সব তছনছ, তখন যেন মাটি ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসে ছেলেটা। মনির ভাই, পাশের বাসার জায়গির ছেলেটা যেন আশীর্বাদের মত হাজির হয়। সহজ সরল, বোকামত ছেলেটা যে একটা ছাতা হয়ে আগলে রাখবে, সাহস দিবে, অভয় দিবে, উড়িয়ে দিবে পাথরের মত বোঝা হয়ে লটকে থাকা ঘণ্টা খানেক সময়, মেয়েটা এখনো ভেবে পায়না কি করে সম্ভব! সন্ধ্যার আগেই ঝড় থেমে যায়। কিন্তু খাল পার হবে কিভাবে, ডিঙি যে নেই? ‘আমি সাঁতার জানি না, মনির ভাই’ বলে যখন ফ্যালফ্যাল করে থাকে মেয়েটা, আর টুম্পাটা ফস করে বলে ফেলে, ‘তুমি কাঁধে চড়িয়ে পার করে দাও আপুকে, মনির ভাই’, তখন ইচ্ছে করছিল একটা চড় লাগিয়ে দিতে গালে। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে, ছেলেটার কাঁধে করে সেদিনের খালটার মত সারাটা জীবন যদি পার করে দেওয়া যেত, মন্দ হত না। একটা সুখস্বপ্নের মত চট করে খালটা শেষ হয়ে গেল। বিপদের আরও বাকি। গ্রামের আম বাগানটা ঝড়ের পরে সন্ধ্যায় ঘন অরণ্য মনে হয়। নিকষ অন্ধকার সেই অরণ্যে। হাতদুটো তখন কাঁধ ছেড়ে হাতে। ছাড়তে ইচ্ছে করে না। ভয় করে যে! সেই অরণ্যে যখন বজ্রপাতের আলো চমকে উঠে, আর এক মুহূর্তের জন্য দৃশ্যমান হয়ে উঠে সেই কঠিন অথচ উষ্ণ হাতের সেই মানুষটি, ইচ্ছে করে, বজ্রপাতে বজ্রপাতে যদি কেটে যেত একটা সারা জীবন, আর সেই মানুষটি বুকে টেনে নিয়ে বলত, ভয় নেই, আমি আছি, তাহলে কেমন হত?
৪।
ঘোরলাগা একটা নির্ঘুম রাত পেরিয়ে মেয়েটা পরেরদিনই চলে আসে শহরে। যাওয়ার সময় খুব ইচ্ছে করছিল ছেলেটাকে দেখতে। শহরের গ্রীষ্মটা যেন অচেনা মনে হচ্ছিল। অনেক কষ্টে বর্ষা পড়তেই আবার গ্রামে আসে মেয়েটা। প্রেমে পড়া মেয়েটা দেখে গ্রামে আর নেই ছেলেটা। কেও জানে না, কোথায় চলে গেছে। চোখ ভেঙে কান্না পায় মেয়েটার। তবু শহরে ফিরতে হয়। মাঝে চলে যায় আটটা বছর। মেয়েটার হাতে মুঠোফোন আসে। ফেসবুক নামের জাদুর পৃথিবী আসে। সেই পৃথিবীতে হাজার হাজার মনির। কিন্তু একটাও সেই ‘মনির’ নেই। একটা সময় আট বছরের মনমরা মেয়েটা মুখে রঙ মেখে, লাল শাড়ি পড়ে, পুতুল সেজে বসে থাকে মঞ্চে। সেই পুতুলকে আমরা ‘নতুন বউ’ বলি। তার সাথে ছবি তুলি, সেলফি তুলি। মেয়েটা মরার মত চেয়ে থাকে। হঠাৎ দেখে একটা ছেলে, পেশাদার ছবিওয়ালা হবে হয়ত, লেন্স হাতে তুলে অবাক চেয়ে আছে। মনির ভাই! মেয়েটার মাথা ঘুরতে থাকে।
৫।
বাসর রাত। আর এমন কালবৈশাখী ঝড়! নতুন বর খুশিই মনে হয়। কিন্তু বউ তার ‘একটু আসি’ বলে কোথায় গেল? ছাদে নাকি? ছাদেই তো। পাগল নাকি! মেয়েটা এই ঝড়ে একা ভিজছে কেন? ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো! ঝড়, বজ্রপাত পেরিয়ে ডাক শুনতে পারছে না মেয়েটা।
এই ঝড় যদি না থামে, পৌনঃপুনিক বজ্রপাত নেমে আসে হৃদয়ে, একটা জীবন কি করে কাটাবে ‘বধির’ মেয়েটা!