কিংকর্তব‌্যবিমূঢ়

কিংকর্তব‌্যবিমূঢ়

ইমরান খুবই দায়িত্ববান ছেলে। সবকিছুতেই ওর খেয়াল খুব বেশি।আর সবার মতো সে কাজে অবহেলা করে না। আর এ কারণেই নাজমা বেগম ওকে খুব পছন্দ করে। সাধারণ পুলিশ হলেও ওর জ্ঞান বুদ্ধি একটু বেশি বলেই মনে হয়। সে কারণে যে কোনো দায়িত্ব ইমরানের ওপরে দিতে ই বেশি পছন্দ করেন নাজমা বেগম।যদিও ওদের দায়িত্ব শুধু নিরাপত্তা প্রদান করা তবুও ইমরানের ওপরে বেশিই নির্ভর করে থাকেন নাজমা বেগম।

ছেলে মেয়েকে সাথে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল নাজমা বেগম।সে তার স্বামীকে সাথে নিতে পারবে না । কারণ সে খুব ব্যস্ত।সরকারি দায়িত্ব পালনেই তার সময় কেটে যায়।অতএব তাকে সাথে নিয়ে যাওয়া নাজমা বেগমের পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না।সুতরাং নাজমা বেগম তাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার তেমন একটা চেষ্টা করলো না। সে মোবাইলে তার স্বামীকে জানিয়ে দিল যে বাচ্চাদের নিয়ে সে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে।
নাজমা বেগম গ্রামের বাড়ী রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ইমরানকে ডেকে পাঠালো। ইমরান ভিতরে গিয়ে হাজির হলো এবং নাজমা বেগমের কাছে জানতে চাইল, আপা ডেকেছেন ?

জবাবে নাজমা বেগম বলল, হুম। ইমরান যদিও তুমি সরকারি দায়িত্ব পালন করছো তারপরেও আমি তোমাকে একটু বেশি দায়িত্ব দিতে চাই।কেননা আমি তোমাকে ছেলের মতোই স্নেহ করি।
আপনি বলুন আপা আমাকে কি করতে হবে ? ইমরান জানতে চাইল।

এবার নাজমা বেগম বলল,শোনো আমি বাচ্চাদেরকে নিয়ে এখন গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি । এক সপ্তাহ থাকবো।আর এ সময়ে তুমি সবকিছু দেখে রাখবে।তোমার স্যার এর দিকে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখবে। কি পারবে না।

জ্বি আপা কেন পারবো না আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আমি সবকিছু দেখে রাখবো।ইমরান নাজমা বেগমকে নিশ্চিন্ত করে বলল।

ইমরান পুলিশ কনষ্টেবল।আর তার স্যার কোরবান আলী দেশের একজন নামকরা মন্ত্রী। নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে ইমরান কোরবান আলীর বাসায় দায়িত্ব পালন করছে । নাজমা বেগম ,কোরবান আলীর স্ত্রী আজকে তাকে আরো একটু বেশি দায়িত্ব পালন করার জন্য বলে গেল।

নাজমা বেগম গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। ইমরান ব্যাগ গাড়ীতে উঠাতে উঠাতে ভাবলো স্যার এর হুকুম আর আপার হুকুম তো একই সুতরাং সবকিছু সঠিকভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

ইমরানকে ভাবতে দেখে তার সহকর্মী আরশাদ খোঁচা দিয়ে তাকে বলল, কি রে অত কি ভাবছিস ,তুই তো দেখছি দিন দিন এই পরিবারের খাস লোক হয়ে উঠেছিস।
কি যে বলিস না। এতটুকু বলে ইমরান অন্যদিকে চলে গেল।

এদিকে নাজমা বেগম চলে যেতে কোরবান আলী র ভিতরের মানুষ বের হয়ে পড়লো। ইমরান সবকিছু দেখে বিস্মিত হয়ে গেল।এ কারণেই কি আপা তাকে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে বলে গেছে।কিন্তু সে কি করতে পারবে,সে তো হুকুমের গোলাম।তাই বাধ্য হয়েই তাকে কোরবান আলীর সব কথা মেনে নিতে হবে। বিকেল বেলা একটি গাড়িতে করে কোরবান আলীর কাছে পাচজন লোক এলো।দুইজন পুরুষ আর তিনজন অল্প বয়েসি মেয়ে।
ইমরান তাদেরকে ভিতরে নিয়ে গেল।

কোরবান আলী ইমরানকে বলল,গাড়িতে কিছু বোতল আছে ওগুলো ভিতরে দিয়ে যাও।
ইমরান মদের বোতলগুলো ভিতরে নিয়ে যেতে যেতে ভাবলো,এত খারাপ কোরবান আলী । এখন সে বাসায় মদের আড্ডা বসাবে আর সেই কাজে ইমরান ই তাকে সাহায্য করছে।কি বলেছিল তার আপা তাকে ।সে তাকে নিজের ছেলের মতোই দেখে। তাহলে কি করতে পারে ইমরান এখন। না সে আর ভাবতে পারছে না।

বোতলগুলো নিয়ে সে ভিতরে প্রবেশ করে টেবিলে রেখে দিল।কোরবান আলী ঘনিষ্টভাবে একটি মেয়ের সঙ্গে বসে তার হাত টিপছিল,ইমরান এক নজর দেখল।আর তার পরই সে নিজের চোখ ফিরিয়ে নিল।

কোরবান আলী ইমরানকে হুকুম দিয়ে বলল,শোনো ইমরান এখন থেকে কাউকে আর ভিতরে আসতে দেবে না।বলবে আমি মিটিং এ আছি। আর আমি না ডাকলে তোমরাও কেউ আর ভিতরে আসবে না।

জ্বি আচ্ছা বলে ইমরান রুমের বাইরে চলে এলো।
মনে মনে হাজার বার গালি দিল সে কোরবান আলী কে।সে সহজ সরল।তার ধারনা ছিল না এত অপকর্ম করতে পারে কোরবান আলীর মতো লোকেরা।তার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

পরদিন ভোরবেলা সবাই চলে গেল। কোরবান আলী ও বের হয়ে গেল।
বিকেল বেলা ফিরেই কোরবান আলী ইমরানকে ডেকে পাঠালো।ইমরান ভিতরে প্রবেশ করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।কোনো কথা বলল না।

কোরবান আলী তাকে বলল, শোনো ইমরান গতকালকের বিষয়টা তোমার আপাকে আবার বলবে না যেন,ঠিক আছে ।আর শোনো আজকে সন্ধ্যায় হারাধন নামে একটা লোক আসবেতার মেয়েকে সাথে নিয়ে। শুধু ওদেরকে ই ঢুকতে দেবে আজকে বুঝেছ। ওরা আমার এলাকার লোক। আর কোনো লোক এলে কোনো অভিযোগ বা সুপারিশ নিয়ে তাদেরকে বাসায় ঢুকতে দেবে না বলবে আমি বাসায় নেই।ঠিক আছে।

জ্বি আচ্ছা । এতটুকু বলে ইমরান বাইরে চলে এলো । মনে তার প্রচুর ঘৃণা।তার আপাকে দেয়া কোনো কথাই সে রাখতে পারেনি।জীবনে কতো কতো অপকর্ম যে করে যাচ্ছে এই কোরবান আলী তা ইমরান এখন বুঝতে পারল।
চোখের জল মুছে কত লোক যে কোরবান আলীর বাড়ী থেকে বেড়িয়ে গেছে এতোদিন তা সে শুধু দাঁড়িয়ে দেখেছে।কিন্তু বুঝতে পারেনি।আজ বুঝতে পারল ইমরান কোরবান আলীর মতো লোকেরা কতটা ভয়ংকর আর কতটা অমানুষ।

আঁধার ঘনাতেই হারাধন নামে লোকটি তার মেয়েকে নিয়ে এলো।ইমরান তার কাছে জানতে চাইল, কেন কি দরকারে এখানে এসেছেন?

হারাধন জবাবে বলল,বাবারে এই আমার সুন্দরী মেয়েটা কুড়ি বছর বয়েস মাত্র। আর এই বয়েসেই আমার মেয়েটার সর্বনাশ করেছে কোরবান আলীর খাস লোক কালীপদ। আমি এর বিচার চেয়েছি এবং কালীপদকে আমার মেয়ের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছি স্যারকে। আমি গরীব মানুষ,স্যার আমাকে আসতে বলেছেন,একটা ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন।

হারাধনের কথা শুনে দুঃখ হলো ইমরানের।মনে মনে সে ভাবলো,কোরবান আলী তো অমানুষ তারপরেও দেখি কি ব্যবস্থা করে।একটু পরে ইমরান আবার ভাবলো যদি কালীপদ এর সাথে বিয়ে ই দিয়ে দেবে তাহলে সেই শুয়োরটাকে আসতে বলেনি কেন !

ইমরান মনে সংশয় নিয়েই হারাধন আর তার মেয়েকে ভিতরে নিয়ে গেল।
ভিতরে যেতেই কোরবান আলী হারাধনকে বলল,তুমি বাইরে ইমরানদের সাথে থেক। আর তোমার মেয়েকে আমাদের গেষ্ট রুমে থাকতে বলো।রাতে তো তোমরা আর যেতে পারবে না।কালকে কালীপদ এলে একটা ফয়সালা করে দেব।

ইমরানের মনে একটা সন্দেহ থেকেই গেল।আদৌ কি কোরবান আলী কালীপদকে আসতে বলেছে না কি তার মনে অন্য কিছু।পাপীটা কে আর বিশ্বাস করতে পারে না ইমরানের মন। তাই সে হারাধনকে সাথে নিয়ে বের হয়ে এলো ঠিকই কিন্তু হারাধনকে তাদের থাকার রুমে রেখে আবার সে কোরবান আলীর বাসার চারপাশে চুপিসারে পায়চারি করতে লাগল।রাতে খেতেও গেল না সে।এভাবে তার মনের সন্দেহ র কারণে সে সময় পার করে দিয়ে পাহারা দিতে লাগল।

সহসা মাঝরাতে মেয়ে কন্ঠের চিৎকার শুনতে পেল ইমরান।তার সন্দেহ সঠিক হলো। সে বুঝতে পারলো হারাধনের মেয়েকে আবারো সর্বনাশ করার চেষ্টা করছে হয়তো পাপিষ্ট কোরবান আলী।ইমরান মনে মনে সন্দেহ করেছিল তাই সে তৈরি হয়েই ছিল।জানালা বেয়ে উপরে উঠে গেল সে।ছাদের নড়বড়ে দরজা ভেঙ্গে ফেলল সে।দ্রুত ভিতরে ঢুকে গেষ্ট রুমে গিয়ে হাজির হলো সে।

কোরবান আলীর নিচে ছটফট করছে হারাধনের মেয়েটি।শুয়োরের বাচ্চা তবু ছাড়ছে না মেয়েটিকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ইমরান উত্তেজিত হয়ে উঠল।আর হাতের অস্ত্র দিয়ে জোড়ে আঘাত করলো কোরবান আলীর মাথায়।

মাথা ফেটে রক্ত বের হলো।নিস্তেজ হয়ে অল্পতেই কোরবান আলী মৃতু্যমুখে পতিত হলো।
কি করে ফেলেছে ইমরান নিজেই বুঝতে পারছে না।তবু ও নিজেকে স্থির রেখে সে হারাধনের মেয়েকে তার কাছে নিয়ে গেল আর বলল,বোনতুমি তোমার বাবাকে নিয়ে এক্ষুণি এ বাড়ি থেকে চলে যাও।আমিও পালিয়ে যাব তবে বাঁচতে পারবো কিনা জানিনা।

কুলসুম বারবার বলতে লাগল,আপনাকে এত অস্থির লাগছে কেন।এতোদিন পরে বাড়ীতে এলেন কই আমার সঙ্গে একটু মন খুলে কথা বলবেন তা না।শুধু কাটা মুরগির মতো এদিক ওদিক ছটফট করছেন।কি হয়েছে আপনার।
বউয়ের কথা শুনে ইমরান নিশ্চুপ হয়ে রইল। সেও গরীব মানুষ পেটের দায়ে চাকুরী করতে গেছে।আর এক অমানুষকে খুন করে সে সবকিছু শেষ করে ফেলল।সে খুনী হিসেবে পরিচিত হবে হয়তো।কিন্তু কেউ জানবে না তার খুনী হওয়ার কারণ।দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইমরান।

রাতে সবকিছু বউকে খুঁলে বলল ইমরান।তার হঠাৎ বাড়ী আসার কারণ।তার বউ তার কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে উঠল।কিন্তু ইমরান নিশ্চুপ হয়ে রইল।

বউয়ের কান্না কিছুতেই থামছে না দেখে ইমরান তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, শত শত মানুষের জীবন নষ্ট করে চলছিল যে অমানুষটা তাকে খুন করেছে তোমার স্বামী । আর সে ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাই তার বিচার নিজ হাতে করেছি আমি।হয়তো আমার বিচার হবে সাজা হবে,কিন্তু তুমি এই ভেবে সান্ত্বনা নিও যে ঐ পশুটার খুনের মাধ্যমে অনেক মানুষের জীবন বেঁচে গেল।

সকাল বেলা দরজা খুলতেই কুলসুম দেখলো তাদের বাড়ী পুলিশ ঘিরে রেখেছে। কুলসুম নিজেই ইমরানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। ইমরান স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে ধরা দিল।

পুলিশ ইমরানকে নিয়ে সকালের মিষ্টি সোনারোদ দিয়ে হেঁটে সম্মুখে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে চলল।পিছন থেকে অভাগী কুলসুম দু’চোখ নীরবে মুছে নিল।আর তাকিয়ে তাকিয়ে স্বামীর চলে যাওয়া দেখল।আর মনে মনে ভাবলো আমার স্বামী খুনি ,তবে মানুষের কল্যাণে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত