প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়

প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়

মেয়ে বুনির বয়স এখন পনের বছর। পুরনো টিনের বাক্সে রাখা জিনিষগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে দেখতে,রিজিয়ার হাতে উঠে আসে একটা লাল রঙের ফাইল। বুনি আর কিছু না পারুক নিজের নামটা বানান করে ঠিকই পড়তে পারে! ফাইলটার উপরে বড়বড় অক্ষরে নিজের নামটা দেখে ড্যাবড্যাব করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে! রিজিয়া যখন কিছু না বলেই ফাইলটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে-ফট করে বুনি জিজ্ঞাসা করে-

-মা এটা আমার ফাইল? হঠাৎ প্রশ্নে চমকে উঠে রিজিয়া! মেয়ের কথায় রিজিয়ার বুকটা থিরথির করে কেঁপে উঠে। বুনি আবার জিজ্ঞাসা করে-

-মা আমি তোমার পেটের ভীতরে থাকতে,আব্বা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল? মেয়ের কথা শুনে আশ্চর্য হয় রিজিয়া। সে তো সেইসব ঘটনা কাউকেই বলেনি! তাহলে বুনি কীভাবে জানলো? ওর মাথায় হাত বুলিয়ে রিজিয়া জিজ্ঞাসা করে-

-তোকে এসব ফালতু কথা কে বলেছে? কাঁপা কাঁপা মাথাটা পিছনের দিকে দিয়ে সব দাঁত বের করে খলখলিয়ে হাসে বুনি। ওকে ঘটনাটা কে বলেছে সেইটা মা জানে না দেখে বেশ মজা পেয়েছে। হাতে তালি দিয়ে বলে-

-মা তুমি অনেক বোকা হিঃ হিঃ! রিজিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে

-হ্যাঁরে মা আমি বোকা। এখন বল সোনা কে বলেছে তোকে? শুধু মা না,বিনু এই একটু আদর পেলে সবকিছু করতে পারে। মুখের হাসি ধরে রেখেই বলে-

-বড় বুবু।

-ঝুমু?

-হ্যাঁ

-কী বলেছে?

-বুবু বলেছে আমি তোমার পেটে থাকতেই আব্বা নাকি আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কারণ আমি তোমাকে মেরে ফেলতে ছিলাম! বড় বুবু বলেছে আমি মরে গেলেই ভালো হত! এইটুকু কথা বলতেই হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়েটা! কথা বলতে বলতে বিনু ঠোঁট ফুলায়! ব্যস্ত হয়ে রিজিয়া বলে-

-না না মা,এসব তো মিথ্যে কথা! বানানো গল্প! ভাইবোন এভাবে মজা করে সোনা!

কথাগুলো বলতে বলতে মেয়ের মাথাটা রিজিয়া বুকের সাথে চেপে ধরে। বিনু অঝোরে কেঁদে যায়! রিজিয়া ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলে-

– ধুর পাগলি! তুই কীভাবে আমাকে মারবি?

-তাহলে তুমিই বল না মা সত্যিটা কী? আব্বা নাকি আমাকে কোনদিন কোলে নিয়ে আদর করেনি? আমি যেন মরে যাই তাই আব্বা শীতের রাতে ঠাণ্ডা মেঝেতে ফেলে রাখত? তুমিই নাকি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছ?

কথাটা বলেই রিজিয়াকে জড়িয়ে ধরে শুকনো লিকলিকে দু’হাতে। খুব কষ্টে ঘাড়টা সোজা করে রাখে বুনি। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। আর সেই সাথে চোখ ভরে পানি পড়ছে। রিজিয়ার বুকটা ব্যথায় ভেঙ্গে যেতে চায়। নিশ্চয় ঝুমু এসব কাহিনী ওর ফুফু নাজুর কাছ থেকে জেনেছে। মহিলার বয়স যেন বাতাসেই বেড়েছে! এসব বলার কী দরকার ছিল তার! রিজিয়ার মনে হচ্ছে ওর ফুফুকে গিয়ে চার কথা শুনিয়ে আসে। কিন্তু সে তা করলো না। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়-‘একদিন না একদিন সত্যিটা তো জানতোই বিনু।’ রিজিয়া অনুভব করে-মা হয়েও যেভাবে গুছিয়ে বলতে পারবে। আর কেউ সেভাবে পারবে না। অন্যের কাছ থেকে জানার চেয়ে বিনু ওর মায়ের কাছ থেকে জানুক আসল সত্যটা। তাতে করে ও কষ্ট পাবে ঠিকই,কিন্তু অন্যের কাছ থেকে রঙ মাখানো গালগল্প শুনতে হবে না। কিন্তু ওকী বুঝবে রিজিয়া যা বলতে চায়ছে? আল্লাহ কী সেই বুঝার মত মনটা ওকে দিয়েছেন?

-মা সত্যি করে বল না ঐটা আমার ফাইল? বুনির কথায় ভাবনার তার ছিঁড়ে যায়। রিজিয়া অনেক চেষ্টা করেও দীর্ঘশ্বাসটা চেপে রাখতে পারে না। গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলে

-হ্যাঁ মা এটা তোর ফাইল।

-আমি একটু দেখি? খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠে পুতুলের মত গোলগাল ফর্সা মুখটাতে। রিজিয়া ঐ মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে

-কী দেখবি সোনা? এটাতে তো শুধু কিছু প্রেসক্রিপশন,এক্সরে কপি আর কিছু রিপোর্ট আছে।

-মা আমি একটু ছুঁয়ে দেখি হিঃ হিঃ

রিজিয়া ফাইলটা বুনির দিকে বাড়িয়ে ধরে। বুনি ফাইলটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে, চুমু খায়। মাথাটা উপর নীচে করে ইশারায় মাকে কাছে ডাকে। রিজিয়া বুনির এই ইশারা চেনে…। সে জানে মেয়ে কখন মুখে তালা লাগিয়ে সব কথা ভুলে গিয়ে ইশারায় ডাকে। মুখটা বাড়িয়ে ধরে মেয়ের দিকে! বুনি মায়ের কপালে চুমু দিয়ে বলে- “তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছ মা। আমি তোমাকে অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি। আমি কোনদিন তোমাকে কষ্ট দেব না। তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব মা!” রিজিয়া চুমুতে চুমুতে ভরে দেয় বুনির কপাল মুখ। ‘মেয়েটার বুদ্ধি কম কিন্তু মাশাআল্লাহ কষ্ট কীভাবে হজম করতে হয় তা খুব ভালো করেই জানে। হয়ত সৃষ্টিকর্তা একদিকে নিয়ে নিয়ে নিলে আরেকদিকে দিকে পুষিয়ে দিয়ে ওকে ধৈর্য দিয়েছে!’ আবারও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়ের দিকে তাকায়। বুনি কাঁদতে কাঁদতে এক সময় মুখের ভীতরে বুড়ো আঙুলটা দিয়ে চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে যায়। মেয়েটা একটু কেঁদেই ক্লান্ত হয়ে গেছে! রিজিয়া বুনিকে কিছুই বলতে পারে না। ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবনার অতলে ডুবে যায় সে-

!!দুই!!

মনে পড়ে জীবনের স্মরণীয় সেইসব উত্তাল দমকা হাওয়ার দিনগুলোর কথা। একদিন দুপুর বেলা খাবারের পর রিজিয়া প্রচণ্ড রক্তবমি করে। সাথে সাথে স্বামী স্বপন স্ত্রীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সেদিনই প্রথম ওরা দুটো খবর জানতে পারে। রিজিয়া তিন মাসের গর্ভবতী এবং তার ক্ষয় রোগ বা যক্ষ্মা হয়েছে। যেহেতু সে গর্ভবতী তাই তাকে কোন ধরণের ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা যাবে না। এতে করে রিজিয়ার জীবনের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে। তবে যদি গর্ভপাত করা যায়। তাহলে হয়ত ক্ষয়রোগও ভালো হয়ে যাবে। আর ভালো না হলেও চিকিৎসা করা যাবে। রিজিয়া নিজের কষ্ট সব ভুলে গেলো। সে আবারও মা হবে? দুই মেয়ে আর এক ছেলে তার। প্রায় পাঁচ বছর পর সে আবার মা হবে? এই আনন্দে স্বামীকে বলে-

– বাসায় চলেন!

-বাসায় যাবা মানে? ডাক্তার কী বলল তুমি শুনলে না? মৃদ্যু রাগ দেখায় স্বপন। কিন্তু রিজিয়া কোনকিছুই শুনতে রাজি নয়। সে এখন বাসায় যাবে। আর কিছু না বলে ওরা বাসায় চলে আসে। রিজিয়া অনেক অসুস্থ হয়ে যায়। রক্তবমি করতে করতে সে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বপন বকাবকি করতে থাকে গর্ভপাত করানোর জন্য। স্ত্রীর জেদ দেখে বারবার গর্ভপাতের কথা বলতে থাকে। রিজিয়ারও একটাই কথা-

-আমি আমার সন্তানকে হত্যা করতে পারব না।

-আরে আগে তো নিজে বাঁচো!

-বাঁচলে দু’জনে বাঁচব,মরলেও দু’জনে মরব!

-এইটা কোন কথা হল? তোমার আরও তিনটা বাচ্চা আছে। তাদের চিন্তা করবা না?

রিজিয়া আর কোন কথা বলে না। এভাবে আরও দুইমাস যেতেই রিজিয়া অনুভব করে তার বাম পাশটা অবশ হয়ে আসছে। আবার ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার পরীক্ষা করে সেই একই কথা বলে। আরও বলে

-আপনি যে জেদ করে গর্ভপাত করাচ্ছেন না। আপনার বাচ্চা সে ওতো স্বাভাবিক নাও হতে পারে।

ডাক্তারের কথায় কিছুটা ভয় পায় রিজিয়া। আলতো করে পেটটা ছুঁয়ে অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে

-ডাক্তার বাচ্চা স্বাভাবিক নাও হতে পারে মানে?

– মানে হল আপনার বাচ্চা পঙ্গু হতে পারে। দেখা গেলো মৃত শিশুও জন্ম দিলেন।

রিজিয়া আর কিছুই শুনতে পারেনি সেদিন। স্বপন সারা রাস্তা ওকে বুঝিয়েছে

– একবার ভাবো- একটা বাচ্চা সারা জীবন খুড়াই খুড়াই হাঁটবে! না হয় হাত ছাড়া জন্মাবে। এমন অতো হতে পারে হাত পা কোনটাই নাই!

-আপনি থামেন। যা হয় হবে। আগে তো বাচ্চা জন্ম নিতে দেন…!

-যদি সত্যি সত্যি এমন বিকলাঙ্গ একটা বাচ্চা হয়! সমাজে মুখ দেখাতে পারব না…! স্বামীর বিড়বিড় করে বলা কথাটা রিজিয়া ঠিকই শুনে ফেলে।

-সবকিছুতে সমাজকে কেন টানেন?

-টানব না? তুমি ভেবে দেখছ সবার কত খোঁচা হজম করতে হবে?

-সমাজের মানুষরে ভয় পান। আল্লাহকে ভয় পান না?

-তোমার এইসব ভারী ভারী জ্ঞান কথার কোন মূল্য নাই বুঝেছো? শুধু একটা শিশুকে দুনিয়াতে এনে কষ্ট দেয়া! একবার ভেবে দেখ সে খেতে পারবে না, হাঁটতে পারবে না। কথা বলতে পারবে না… আর…

-এখন থামেন। আর ভয় দিয়েন না। যা হয় হবে এইটা আমার সন্তান…আপনি ভুলে গেলেও আমি মা ভুলতে পারব না। ক্যামন বাপ হইছেন আপনি!

রিজিয়ার সুখের জীবনে নেমে আসে এক দুর্বিষহ যন্ত্রণার আকস্মিক বিপর্যয়! যে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কোনদিন সে কথা বলেনি। আজ সে তার সাথে রীতিমত ঝগড়া করছে! যা মুখে আসছে তাই বলে তাকে অপমান করছে! রিজিয়ার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ে। ওর চোখের পানি দেখে হয়ত স্বপন আর কথা বলল না। কিন্তু রিজিয়ার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে! তা কেউ কোনদিন দেখতে পাবে না।

রিজিয়ার প্রার্থনা বেড়ে যায়। সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। সে জানে ‘আল্লাহ যা করবেন নিশ্চয় আমার ভালোর জন্য করবেন!’ সে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যেতে থাকে। এই সন্তানকে বাঁচাতে সে অন্য সন্তানদেরকেও ঠিকমত নজর দিতে পারে না! এদিকে স্বপন ধরেই নিয়েছে প্রিয়তমা স্ত্রীর জেদ সবকিছু কেড়ে নেবে। সে অনাগত এক শিশুর জন্য স্ত্রীকে হারাবে। স্বপন স্মৃতি ধরে রাখতে একজন ফটোগ্রাফারকে বাসায় নিয়ে আসে। বাসার সবার সাথে রিজিয়াকে নিয়ে ছবি তোলে।

একদিন সন্ধ্যায় কাজের মেয়েটা ধরে এনে রিজিয়াকে দাওয়ায় বসায়। সে খুব একটা হাঁটাহাঁটিও করতে পারে না। ডাক্তার শুধু আয়রনের ওষুধ দিয়েছে। বাচ্চার জন্য আর কোন ওষুধ দিতে পারছে না। তিনি ভয় পাচ্ছেন কারণ সম্ভবত বাচ্চা খুব একতা বড় হচ্ছে না। রিজিয়ার ওজন আগের থেকে বরং অনেক কমে গেছে। রিজিয়ার শরীরটা ভীষণ খারাপ। বাম হাত আর মুখ অবশ হয়ে গেছে। হাত দিয়ে কিছু করতে পারে না। ভীষণ পিপাসা লেগেছে। ইশারায় কাজের মেয়েকে বলে পানি আনতে। উফঃ সে কী গরম সেদিন। হঠাৎ অনুভব করে পেটের ভীতরে খুব আস্তে কিছু নড়ে উঠলো! বাচ্চার নড়াচড়া,সাড়াশব্দ না পেয়ে ও ধরেই নিয়েছিল ওর মৃত বাচ্চা হবে। কিন্তু এই প্রথম বাচ্চা নড়েছে! চিৎকার দিয়ে বাড়ির সবাইকে জানাতে ইচ্ছে হল রিজিয়ার। কিন্তু দুর্বল শরীর কণ্ঠ থেকে কোন শব্দ বের হল না। তারপর…

!!তিন!!

গর্ভের বয়স আঁট মাস পাঁচদিন হতেই রিজিয়া নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। সেই সাথে প্রচুর রক্ত বমি, খিঁচুনি। এ্যাম্বুলেন্স ডেকে সাথে সাথে নেয়া হয় হাসপাতালে। বাচ্চার কারণে কোন ওষুধই দিতে পারছে না। ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেয় গর্ভের বাচ্চা অপারেশন করে বের করে আনবে। কিন্তু তার জন্যও খিঁচুনি বন্ধ হওয়া জরুরী। রিজিয়ার হাত পা হাসপাতালের বেডের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখল খিঁচুনির জন্য। ডাক্তার নার্স সবাই অপারেশনের জন্য রেডি হচ্ছে। এমন সময় একজন নার্স চিৎকার দিয়ে উঠে…”বাচ্চা আসছে বাচ্চা আসছে!” আর অপারেশন করতে হয়নি। রিজিয়ার স্বাভাবিক ডেলিভারি হয়েছে।

প্রায় নিথর নিস্তেজ একটা ছোট্ট কন্যা শিশুর জন্ম হয়। তুলার প্যাডে রাখা হয় তাকে। তবে শিশুটি জীবিত। রিজিয়াকে ইনজেকশন দেয়া হয়। কন্যা শিশুটি জন্ম নেবার কয়েক ঘণ্টা পরই রিজিয়ার খিঁচুনি বন্ধ হয়ে যায়। শিশুটিকে রাখা হয় নিবিড় পরিচর্যায়। কুড়ি দিন হাসপাতালে থাকার পর রিজিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। ওর অবশ হওয়া হাত মুখ রক্তবমি সব যেন জাদুর কোন মন্ত্রে উড়ে গেছে! তবুও ছয়মাস ওষুধ খেয়ে জেতে হবে। স্ত্রীর সুস্থ্যতায় স্বপনের যে সেকী আনন্দ। সারা মহল্লায় মিষ্টি বিলি করে। মসজিদে মিলাদ দেয়। ফকির মিসকিনকে খাওয়ায়। কিন্তু একবারও শিশুটির খোঁজ করে না। রিজিয়া সুস্থ হয়েই ছুটে যায় সন্তানের কাছে। জানতে পারে শিশুটির শরীর সম্পূর্ণ প্যারালাইজড। সে শুধু ঘাড় থেকে উপরের অংশ-মানে মাথা ঠোঁট জিভ নাড়াতে পারে। তার পুরো শরীর একেবারেই নিথর। রিজিয়া বুঝতে পারে তার সব কষ্ট এই স্বর্গদূত শিশুটি আপন করে নিয়ে তাকে সুস্থ করে দিয়েছে। সে শিশুটিকে কোলে তুলে নেয়। ডাক্তার শিশুটিকে বাড়িতে নিতে নিষেধ করা স্বত্বেও সে বাড়িতে নিয়ে আসে। ডাক্তারের পরামর্শ আর ওষুধ ঠিকই চলবে। রিজিয়া নিজেই শিশুটির পরিচর্যা করে যায়। সে যেন প্রতিজ্ঞা করে এই শিশুকে যেভাবেই হোক সে বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু ঐ উপরে যিনি বসে আছেন তার চাওয়াটাই যে একমাত্র সত্যি।

শিশুটি সারা দিন রাত কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হলে দশ মিনিট ঘুমায়। তারপর আবার সেই কান্না…! রিজিয়া একদণ্ড কোল থেকে নামাতে পারে না। নীচে রাখলেই যেন শিশুটির কষ্ট বাড়ে। ওর শরীরে শুধুই হাড়। পাতলা চামড়ার আবরণের উপর দিয়ে বুকের খাঁচার হাড্ডিগুলোও গণনা করা যায়। বুকের উপর থেকে “ধাক ধাক” হৃদ স্পন্দন গণনা করা যায়! ছোট্ট একটা মাথা,কালো চুলে ভরা। ফর্সা মাংসল মুখ। সেই তুলনায় চোখগুলো বড় বড়। ছোট্ট পাখির মত লাল ঠোঁট। রিজিয়া একটু পরপর নিজের বুকের দুধ খাওয়ায়। সেই দুধ টেনে খাবার শক্তিটুকুও শিশুটির নাই। রিজিয়া হার মানে না! চেপে চেপে বাটিতে দুধ বের করে পরিষ্কার কাপড় দুধে ভিজিয়ে শিশুটিকে খাওয়ায়। চুকচুক করে শিশুটা খায়। আর খুশিতে রিজিয়া শিশুর মত খিলখিল করে হাসে। শিশুটিকে নিয়ে আশার আলোর সলতে আরও দাউদাউ করে জ্বলে। আদর করে মেয়ের নাম রাখে “বুনি” । নিজের কাঁধের উপর বুনির মাথা রেখে বুকে অবশ দেহটা জাপটে ধরে সবকিছু করে যায়। বুনির মুখ থেকে সারাক্ষণ লালা ঝরে। আর দুই মিনিট পরপর বমি করে। একটু দুধ খেয়ে হড়হড় করে সবটুকু তুলে দেয়! রিজিয়া সারাক্ষণ বুনির আর নিজের কাপড় পরিষ্কার আর পালটানোর কাজে ব্যস্ত। কোলে নিতে নিতে রিজিয়ার কাঁধের কাছে ঘা হয়ে গেছে। ওর অন্য বাচ্চাদের প্রতি ওর যেন কোন খেয়াল নেই। ওদের ফুফু কাজের মেয়ে ওরাই তাদের দেখাশুনা করে।

একদিন ভীষণ ঠাণ্ডার রাত। রিজিয়া বুকের ভীতরে বুনিকে নিয়েও ওর কান্না থামাতে পারছে না। এমন করে এই দুই মাসেও বিনু কাঁদেনি। স্বপন ঘুমাতে পারছে না। চিৎকার দিয়ে রিজিয়াকেই বকা দেয়-

-আরে ওটারে মেঝেতে রেখে দাও।

-মেঝেতে রাখব মানে? অবাক হয়ে রিজিয়া জিজ্ঞাসা করে।

-মেঝেতে রেখে দাও মানে বুঝো না?

-যে ঠাণ্ডা,মেয়ে তো মরে যাবে!

-যায় যাক। প্রতি মুহূর্তে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে মরেই যাক!

-এ আপনি কী বলেন? আপনার ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে বলে আপনি…

রিজিয়ার কথা শেষ হয়না। স্বপন খপ করে একটানে মেয়েটাকে রিজিয়ার কোল থেকে নামিয়ে সত্যিই ঠাণ্ডা মেঝেতে রাখে! স্বপনের নিষ্ঠুরতা দেখে এক বাঘিনী মা যেন জেগে উঠে রিজিয়ার অন্তরে। নিজের গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে বিনুকে মেঝে থেকে তুলে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে-
-খবরদার! আর কোনদিন যদি আপনি আমার মেয়ের সাথে এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন! আমি ভুলে যাব আপনার সাথে আমার কী সম্পর্ক। আমার মেয়ের ধারে কাছেও আপনার ছায়া দেখতে চাই না।
কথাটা বলে হুহু করে কেঁদে যায় রিজিয়া। সেদিন হয়ত বুনি কিছু বুঝেছিল। নাকী ভীষণ ভয় পেয়েছিল? এক সময় সে সত্যিই কান্না থামিয়ে মায়ের বুকে চুপ করে পড়েছিল।

স্বপন ঐদিনের জন্য অনেক অনুতপ্ত হয়। কেন যে অমন আচরণ করেছে সে নিজেও জানে না। অনুতপ্ততায় নিজের সামর্থ্য মত হোমিওপ্যাথিক,এলোপ্যাথিক ডাক্তার কবিরাজ সবকিছুই বুনিকে দেখাতে থাকে। একমাত্র আল্লাহই জানেন বুনি কীসে সুস্থ হবে। যে যা বলে ওরা তাই করে। স্বপন নিজেই রিজিয়া আর বুনিকে নিয়ে যায় গ্রাম থেকে গ্রামে, নানা শহরে। ডাক্তার কবিরাজের পরামর্শ মেনে বুনিকে দেখভাল করতে থাকে। একদিন একজন বলল কালীবাড়ি মন্দিরে নিয়ে যেতে। সেখানেও বুনিকে নিয়ে যাওয়া হল। এভাবেই ধীরে ধীরে সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। ওর বয়স নয় মাস। ছোট্ট বুনির হাত পা পাটকাঠির মত লিকলিকে। সারাক্ষণ ঘাড়টা থিরথির করে কাঁপে। কোনো ভাবেই সোজা করে রাখতে পারে না। মেয়েটার জেদও সাংঘাতিক! সাধারণতঃ এই বয়সী বাচ্চাদের জেদ,রাগ এসব থাকে না। কিন্তু বুনির আছে। সে যা বলবে শুনতে হবে। যা চাইবে করতে হবে। না হলে সারা বাড়ি মহল্লা চিৎকার করে কেঁদে কেটে মাথায় নেবে। ওর চিৎকারে যে এত জোর কোত্থেকে আসে? বুনি এখন চামুচে করে দুধ,সুজি, পানি খেতে পারে। হজম শক্তি আগের মতই। ওর বয়স যখন দশমাস তখন সে বিছানায় শুতে পারে। রিজিয়ার মনের সাহসও আগের থেকে অনেক বেড়েছে। প্রতিদিন নানা ধরণের ওষুধ,ইনজেকশন দিতে হয়। তার আদরের বুনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে।

!!চার!!

এগারো মাস বয়স হতেই একদিন ঘটে গেলো আশ্চর্য এক ঘটনা। সেদিন রিজিয়ার অন্য ছেলে মেয়েরা তাদের বাবার সাথে খেলা করছে। স্বপন বাচ্চাদের জন্য পুতুল এনেছে। কারো পুতুল শুধু হাসে,কারোটা শুধুই কাঁদে। বুনির জন্য যে পুতুলটা এনেছে সে বোবা! কিন্তু সেই পুতুলটা বুনি নেবে না। সে নেবে যে পুতুলটা চাবি দিলেই খিলখিল করে হাসছে। যখন সে ঐ পুতুলটা পেলো না মেঝেতে গড়াতে গড়াতে চলে গেলো ঐ পুতুলের কাছে। ঘরের সবাই অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখল। তারপর থেকে প্রতিদিন রিজিয়া অথবা স্বপন ঐ পুতুলটা নিয়েই বুনির সামনে ধরে। আর তা নিজের করে পেতে বুনি নিজের গায়ের সবটুকু জোর ব্যয় করে সেদিকে যায়। এভাবেই ওর বয়স যখন দেড় বছর একদিন বুনি দু এক পা হাঁটতে শেখে! কিন্তু এতে ওর হার্টবিট বেড়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ডাক্তার প্রেসার দিতে নিষেধ করে। যে বুনি সারাক্ষণ কেঁদে কেটে মানুষের ঘুম হারাম করত। সেই বুনি এখন শুধু খিলখিল করে হাসে। ওর হাসি দেখে বুঝার উপায় নেই এই কদিন আগেও ওর কষ্ট দেখে ওকে ওর জন্মদাতাই মেরে ফেলতে চেয়েছিল!

ধীরে ধীরে বুনির বয়স বাড়ে,খাওয়ার আইটেমগুলোও বাড়ে। কিন্তু হজম শক্তি বাড়ে না। খেয়ে সব বমি করে দেয়। বুনি এখন হুইল চেয়ারে বসে। রিজিয়া কিছুটা স্বস্তি পায়। মাঝে মাঝে বুনি গেইটের বাইরে যাবার জন্য জেদ ধরে। ওর জেদ পূরণ করতে গিয়ে রিজিয়া আরেক নতুন ঝঞ্ঝাটের মুখোমুখি হয়!

– ঈশ কী একটা মেয়ে! দেখলেই ভয় লাগে!

-এ দেখি মানুষের কংকাল!

-ঈশ! কী দুর্গন্ধ মেয়েটার গা দিয়ে! ইয়াক… !

এসব বলে দৌড়ে পালায় কেউ কেউ। রিজিয়াকে আশে পাশের প্রতিবেশীরা কেউ কেউ খোঁচা মেরে কথা বলতেও ছাড়ল না। রিজিয়া এসব শুনে শুনে আর কঠিন হয়। মনের ভীতটাকে আর মজবুত করে যেন কোনভাবেই দমকা হাওয়া ভেঙ্গে দিতে না পারে। যেখানে একটু সহমর্মিতা,সাহস দেবার দরকার। সেখানে আত্মীয় স্বজন আর আশে পাশে থাকা মানুষগুলো রিজিয়া আর বুনিকে ঘৃণা করতে থাকে! যে ঘৃণার আঘাত রিজিয়াকে কষ্ট দেয়। স্বপন বুনিকে নিয়ে বাইরে যেতে একেবারেই নিষেধ করে দেয়।

এগারো বছর যেতেই বুনি একটু একটু হাঁটে! স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো নয়। শুকনো লিকলিকে শরীরের গড়ন। কিন্তু কথা…! ওর কথায় যেন ঠাস ঠাস খৈ ফোটে! স্বপন দূর থেকে বুনিকে আদর করে। বুনি দুই হাত প্রসারিত করে ”আব্বা আব্বা” বলে ডাকে। স্বপন ওর হাতটা শুধু ছুঁয়ে দেয়। সেই হাত আবার সেভলন পানিতে ধুয়ে ফেলে! একদিন যারা রিজিয়াকে খোঁচা মেরে কথা বলত তারাই কেউ কেউ এখন বলে-“ভাবি আপনার মেয়েটার মুখটা একেবারে পুতুলের মত দেখতে।”ওর মুখটা সত্যিই পুতুলের মত সুন্দর। ওদের কথা শুনে রিজিয়া হাসে। সে হাসিতে একজন মায়ের বিজয়ী হবার কৃতিত্ব কেউ দেখে না। রিজিয়ার মুখের ডান পাশটা এখনও কিঞ্চিত বাঁকা! যা আয়নার সামনে গেলেই রিজিয়ার চোখে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে। ওর কাঁধের ঘা শুকিয়ে গেছে। কিন্তু জীবনে বয়ে যাওয়া তাণ্ডবের ক্ষত ওর হৃদয়ের পরতে পরতে যে ঘা তৈরি করেছে,তা রয়ে যাবে আজীবন! রাতের বেলা বুনিকে কাঁদিয়ে স্বামীকে সন্তুষ্ট করা! স্বামীর ঘুমের ব্যঘাতে বুনিকে মেঝেতে রেখে দেওয়া! পরিবারের সবাইকে বঞ্চিত করে বুনিকে আগলে রাখার জন্য,ঘরের মানুষদের অতিরিক্ত গালমন্দ শোনা! সে গর্ভবতী হলে কোন আত্মীয় স্বজন ভাই বোন এমন কী স্বামীর সাপোর্ট না পাওয়া! সব এখনও জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে।

বুনি বেশ বড় হয়েছে! ও এখন বিশেষ স্কুলেও যায়। বয়স পনের বছর হলেও বুদ্ধি বাড়েনি একটুও। ওর আচরণ ছোট্ট শিশুর মতই। বমি করা কমে গেছে। স্বাস্থ্যটাও একটু ভালো হয়েছে! রিজিয়া সব সময় ওর সাথে সাথে থাকে। সবকিছুই অনেকটাই স্বাভাবিক মনে হলেও,সত্যিই কী স্বাভাবিক? রিজিয়ার বোবা কান্না এখনও বাতাসে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায়। এ কান্না ভয়ের…। ডাক্তার বলেছিল বুনির যখন পনের ষোল বছর বয়স হবে- তখন আবার হয়ত অসুখটা ফিরে আসবে। লাল ফাইলে রাখা প্রেসক্রিপশনে ডাক্তার রোগের নাম,ওষুধ সবকিছু লেখা আছে! ফাইলটা খুব যত্ন করে রেখেছে রিজিয়া। তবুও ভয় যদি বুনির কিছু হয়ে যায়! যদি ঐ মেডিসিনগুলো না পাওয়া যায়! আসলেই কী ডাক্তারের ওষুধে সুস্থ্য হয়েছে বুনি? নাকী কোন ভেষজ ওষুধে? নাকি কোন উপাসনালয়ের সাধু সন্ন্যাসীর চেষ্টায়? রিজিয়া কিছুই জানে না। ওর নিজেরই এখন বয়স হয়েছে। বেশি চিন্তাও করতে পারে না। ওর স্বামী কী এবার ওকে সহযোগিতা করবে বুনিকে বাঁচাতে? নাকী আবারও বুনি মরে যাক তাই চাইবে! ওর অন্য ছেলে মেয়েরা বুনিকে তেমন কেউ আদরও করে না। রিজিয়া দেখেছে বড় দুই মেয়ে সব সময় বুনির কাছ থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখে। একমাত্র ভাইটাও ঐ বোনদেরকেই যা করতে দেখে,তাই করে। বরং মাঝে মাঝে ওদের মাকেও দুইকথা শুনিয়ে দেয়। বিশেষ করে বড় মেয়ে ঝুমু। মেয়েটা কলেজে পড়ে। স্বভাবটা পেয়েছে একদম ফুফুর মত। চটাং চটাং কথা বলে-

-“এক মেয়ের পিছনে আব্বার সব টাকা খরচ করে দিছো মা। আমাদের জন্য তো কিছুই রাখো নাই?”

-‘তোদের জন্য কিছু নাই মানে? তোদের বাপ মা কী তোদেরকে ফেলে দিয়েছে?’

-“তা কি আর বাকি রেখেছো? আব্বার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তো রাস্তায় গিয়ে থাকতে হবে!”

-‘থাকলে থাকবি!’রিজিয়ার ভীষণ রাগ হয়। বোন হয়ে বোনের প্রতি এতো ঘৃণা,রাগ ভালো নয়।

-“মা তুমি আসলে বুনিকেই ভালোবাস। আমরা তিন ভাইবোন যেন তোমার কেউ না!”

রিজিয়া জানে হাজার বুঝালেও এই মেয়ে বুঝবে না। ওদের ব্রেন ওয়াশ করার জন্য ওর ফুফুই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে মনে হয় মহিলাকে বলি-‘তিনটা বাচ্চা আমার আর তার ভাইয়ের। বুনিকে কী আমি বাবার বাড়ি থেকে এনেছি?’ কিন্তু না তা রিজিয়া বলতে পারে না। তাতে নিজের চরিত্রের উপরই দাগ পড়বে। যে মানুষ একটা অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে তারই ভাইবোনদের মাথায় বাজে ধারণা দিতে পারে। সে অনেক কিছুই করতে পারে।

আজ বংশের একটা মেয়ে অস্বাভাবিক হয়ে জন্ম নিয়েছে বলে রিজিয়াকেই সবাই দায়ী করছে। সেই সন্তানের চিকিৎসায় অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে সবাই “দূরছাই দূরছাই” ব্যবহার করছে। রিজিয়ার যেন কোন অবদান নেই এই বাড়ির মানুষদের প্রতি,সংসারের প্রতি। সারাক্ষণ সবাই বুনিকে বদদোয়া দিচ্ছে। সবাই বুনিকে অকেস্টিক,বিকলাঙ্গ বলে বলে আড়ালে আবডালে কানাঘুষা করছে।

“এই মেয়েকে দিয়ে কী কাজে লাগবে?”

” কারো ঘর জিনিষে ভরেও যদি দেয়? কেউ তো বিয়েও করবে না!” এইসব কথা বলে রিজিয়াকে খোঁচা দিতেও কেউ কেউ ভুল করে না। কিন্তু রিজিয়া জানে এটা তার গড গিফটেট বাচ্চা। যে বাচ্চা মায়ের কষ্ট নিজের করে নিতে জানে। সে অবশ্যই স্পেশাল সন্তান।

শ্বশুর বাড়ির সবাই আসলে ভুলে গেছে। রিজিয়া এই বাড়িতে বউ হয়ে এসে অসুস্থ শ্বশুর শাশুড়িকে তাঁদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কতটা সেবা শুশ্রুষা করেছে। গ্রাম থেকে আসা আত্মীয় স্বজন সবার দেখভাল করেছে। যার ধারাবাহিকতায় আজ অব্দি একটুও ভাঁটা পড়েনি!

!!শেষ!!

আজ সকাল থেকেই গ্রাম থেকে আসা মেহমানদের জন্য রিজিয়া ভীষণ ব্যস্ত। বুনিকেও ঠিক মত খেয়াল করতে পারছে না। বাসার সবাই মেহমানদের নিয়ে শহর ঘুরে দেখাতে গেছে। এসে খাওয়া দাওয়া করবে। রিজিয়ার ছেলে মেয়েরাও সাথে গেছে। কাজের মেয়ে শেফালিকে নিয়ে সে রান্নায় ব্যস্ত। তবুও শত ব্যস্ততায় মাঝে মাঝে দেখেছে বুনি শোবার ঘরের বিছানায় ঘুমুচ্ছে। ওর ফুফু নাজুর শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন! ফুফা ফারুকও এসেছে। সে বৈঠকখানায় বসে বসে পেপার পড়ছে! গরুর গোস্ত ভুনা, সর্ষে ইলিশ, নারিকেলের দুধ দিয়ে গলদা চিংড়ি, ডিমের কোরমা,মুরগির রোস্ট,বেগুন ভাঁজি,আরও দুই রকম মাছের তরকারী দিয়ে আজকের আয়োজন। ঝামেলা কী কম? নাজুও রিজিয়াকে রান্নাঘরে সাহায্য করতে ব্যস্ত। রিজিয়ার মন পড়ে আছে বুনির কাছে। ঘুম থেকে উঠে ওকে না দেখলে মেয়েটা হয়ত চিৎকার জুড়ে দেবে।

হঠাৎ কালবৈশাখী ঘন মেঘ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজে মেঘেরা গর্জন তোলে। বিনুর চিন্তায় রিজিয়ার বুক ধড়ফড় করে। চুলার রান্নায় পানি না দিয়ে সে উঠতে পারছে না! অচেনা আশঙ্কায় মন ছটফট করে! ব্যস্ত হয়ে বলে-

-ও শেফালি যা তো বুনিকে দেখে আয়।

শেফালি সালাদ কাটছিল। হাত ধুয়ে যায় বুনিকে দেখতে। ভীষণ ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। প্রচণ্ড দমকা হাওয়ায় হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে বাড়ির দেয়াল! সোঁ সোঁ শব্দ তুলে উড়িয়ে নিয়ে যায় উঠোনের কলতলার টিনের চালা! প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের বেগেই যেন শেফালি ছুটে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে-

– ও খালা বুনি তো ঘরে নাই!

-কী বলিস! ও একা তো কোথাও যেতে পারে না! আর এই ঝড় বৃষ্টির ভীতর তো ও…

রিজিয়ার কণ্ঠ ভিজে যায়। সবকিছু ফেলে সে ছুটে যায় বুনি যে ঘরে ঘুমিয়ে ছিল সেই ঘরে। দেখে সত্যিই বুনি ঘরে নেই…! ওর চেয়ারটা আছে! বুনি চেয়ার ছাড়া একা একা তো হাঁটতে পারে না! তাহলে?

– বুনি…! ও বুনি…! রিজিয়া উম্মাদের মত ছুটাছুটি করে মেয়েকে খুঁজে যায়। মেয়েটা গেলো কোথায়? তাও এই ঝড় বৃষ্টি ভীতর? বেশ খোঁজাখুঁজির পর দেখে বারান্দায় ফারুক বসে বসে পিঠা খাচ্ছে। রিজিয়া ছুটে যায়

– ভাই বুনিকে কী দেখেছেন? রিজিয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে ফারুক! বলে

-কী বলেন ভাবি! আমি তো কাউরে দেখি নাই! আমি তো সেই কখন থেকে এখানে বসে আছি।

রিজিয়া কিছু না বলে ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সারা উঠোন ঘর খুঁজে চলে। ছাঁদে গিয়েও খুঁজে আসে। বুনিকে কোথাও পায় না। এমন সময় পাশের বাড়ির ছোট্ট ছেলে কামাল বাড়ির পিছন দিক থেকে ছুটে আসে-

– চাচী চাচী বুনি…!

-কোথায় বুনি?

– আপনাদের বাগানের আম গাছের নীচে পড়ে আছে।

রিজিয়া ছুটে বাড়ির পিছনের দিকে যায়। যেখানে বড় একটা আম গাছ আছে। রিজিয়া দেখে বুনি মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। রিজিয়া দৌড়ে ওকে কোলে নিতেই বুনি কুঁকড়ে যায়। আলুথালু চুল! এলোমেলো পরনের কাপড়! মনে হয়ে অনেক বড় কোন ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে! ওর শরীরটা থরথর করে কেঁপেই যাচ্ছে! রিজিয়া কোলে করে ঘরের বারান্দায় নিয়ে আসে। মুখে পানির ছিটা দিতেই বিনুর জ্ঞান ফেরে। বহু কষ্টে দুর্বল কণ্ঠে কেঁদে উঠে-

– মা ব্যথা! ভয় আর প্রচণ্ড ব্যথায় ছটফট করছে। সেই ছোট্ট বেলার মত মায়ের বুকে লেপ্টে থাকে বুনি। রিজিয়া জিজ্ঞাসা করে-

-মা কে নিয়ে গেছে তোকে ওখানে? বুনি মায়ের কথার জবাব না দিয়ে শুধুই বলতে থাকে

-মা ব্যথা ব্যথা! নাজু বুনিকে দেখে আঁতকে উঠে বলে-

-এই মাইয়া কার সাথে নষ্টামি করছিস… ! রিজিয়া কী করবে বুঝে পায় না! হঠাৎ চোখ যায় বুনির কাপড়ের দিকে! রক্ত! রিজিয়ার বুঝতে বাকি থাকে না কী ঘটেছে মেয়ের সাথে! ব্যস্ত হয়ে আবার বুনিকে জিজ্ঞাসা করে

-মা কে করলো তোর এত বড় সর্বনাশ?

এবার বুনি মায়ের বুক থেকে মাথাটা একটু উঁচু করে। ভয়ার্ত চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায় চেয়ারে বসা ফারুকের দিকে। রিজিয়া বুনির চোখ অনুসরণ করে বুঝে যায় সব। ভয়ঙ্কর ঘৃণা নিয়ে তাকায় ফারুকের দিকে! নাজুও যেন সব বুঝতে পেরেই হুঙ্কার ছাড়ে-

-এই অসভ্য মেয়ে মিথ্যে কেন বলিস? তুই কার সাথে নষ্টামি করছিস তাই বল! কোন নাগরের সাথে ঢলাঢলি করছিস…?

কথাটা বলে বুনির হাত ধরে টেনে তুলতে যায়। রিজিয়া হুঙ্কার ছাড়ে-

-ব্যস নাজু…আর না!

– আরে তুমি পাগল ছাগল মেয়েকে বিশ্বাস করে আমার স্বামীকে সন্দেহ করবা আর আমি কিছু বলব না?

– পাগল ছাগল অস্বাভাবিক অসুস্থ আসলে বুনি না…! তুমি,ফারুক,এই তোমরা!

রিজিয়া আর কিছু না বলে চোয়াল শক্ত করে। বুনির প্রচণ্ড জ্বর উঠে গেছে। সে আবার জ্ঞান হারিয়ে রিজিয়ার কোলের উপর পড়ে থাকে। রিজিয়া ওকে নিয়ে ঘরের ভিতরে যায়। ততক্ষণে মেহমানদেরকে নিয়ে বাড়ির সবাই চলে আসে। স্বপন সব শুনে রিজিয়াকেই শাসাতে থাকে-

-এই নিয়ে যেন কোন পুলিশি ঝামেলা করবা না। আর গ্রামের কেউ যেন কিছু টের না পায়। খবরদার…। তাহলে পরিণতি খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।

রিজিয়া বুঝে পায় না সে এখন কী করবে,কোথায় যাবে…? এমন কী স্বপন বুনিকে হাসপাতালেও নিতে দেয় না। রিজিয়া আজ প্রতিবাদের ভাষাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে। ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ে। নানা কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হয়-‘বুনি যদি আর আমার বুকে ফিরে না আসে? যদি সবার চাওয়া ঠিক হয়ে যায়? আচ্ছা বুনি যদি বেঁচেও যায়-এই সমাজে কী ওর জীবনটা আরও বেশি কঠিন হয়ে যাবে না?’ যে সমাজকে তোয়াক্কা না করে বুনিকে নিয়ে গর্ব করেছে! আজ সেই সমাজ নিয়ে এখন ওকেই ভাবতে হচ্ছে! কী করবে এখন রিজিয়া…? হু হু করে বয়ে যায় হৃদয়ের ঝড় হাওয়ার ঢেউ…। যে ঢেউ প্রতি মুহূর্ত জন্ম দিচ্ছে ভয় আর অনাকাঙ্ক্ষিত এক জীবনের গল্প। যে গল্পের প্রতিটি অধ্যায়-এ,প্রচণ্ড ঝড় ঝাপটা মেয়েকে সইতে হবে!’

মেয়েটার কী হবে রিজিয়া জানে না। ওভাবে কতক্ষণ বসে বসে কেঁদেছে সে তাও জানে না। ধাম করে ডান হাতের চেটোয় চোখের পানি মুছে ফেলে। আজও সে বুনিকে হারাবে না।কোন ভাবেই সে এই অবুঝ মেয়েটাকে পশুর কাছে পরাজিত হতে দেবে না। ‘আজ যদি বুনির মা হয়ে আমি চুপ করে থাকি। তাহলে হাজারো বুনির মা সারা জীবন চুপই করে থাকবে! আমি বুনিদের জন্যই আজ সোজা হয়ে দাঁড়াব। লজ্জা ভয় সব কিছুকে পিছনে ফেলে আমাকে সামনে এগোতে হবে। কোনো ভাবে আমি ভেঙে পড়ব না! প্রয়োজনে আমি একাই বুনির জন্য লড়াই করব!’ কথাগুলো ভাবতেই রিজিয়া অন্যরকম শক্তি পায়। বুনিকে পাঁজাকোলা করে বাড়ির বাইরে আসে। ঝড়টা তখনও প্রচণ্ড শক্তিতে বড় বড় গাছগুলোকে মাটিতে নুয়ে দিচ্ছে! মনে হচ্ছে রিজিয়া আর বুনিকেও উড়িয়ে নিয়ে যাবে! রিজিয়া নিস্তেজ বুনিকে বুকের সাথে লেপটে ধরে। মনে মনে ভাবে “অতীতের বজ্রাঘাতের ক্ষত নিয়ে চলতে চলতে আজ আবার এক নতুন ক্ষত-বুনিকে হারাব নাতো?” প্রচণ্ড ঝড় সবকিছু আজ উড়িয়ে নিয়ে যাবে! শাঁ শাঁ বাতাস কেটে সিএঞ্জি ছুটে চলে বাড়ির কাছেই হাসপাতালের দিকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত