গতরাতে সিডরের ঝড়ে পুরো দেশ তছনছ। এমন কোথাও অবশিষ্ট নেই যেখানে ঝড়ের প্রকোপ লাগেনি। কিছু কিছু ঘরের টিন কোথায় উড়ে গেছে কে জানে। বিশাল গাছগুলো কোথাও কোথাও শবযাত্রা শুরু করেছে। সকালবেলা খুব ভোরে উঠে নন্দিতা দেখে পুরো পৃথিবী একদম থমথমে। যেন কোথাও কোনো কোলাহল নেই। নেই কোনো প্রাণের অস্তিত্ব। কেউ যেন জীবনযাত্রার হিমাঙ্ককে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসে এনে দিয়েছে।
কিন্তু এমন শান্ত করে দেয়া পরিবেশেও নন্দিতার কর্মের ঝড় থামেনি। মাকে একটু গুছিয়ে রেখে হাতের কাজগুলো দ্রুত সেরে নেয়। বিসিএসের কোচিং করতে সপ্তাহে তিনদিন সে ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে যায়। সকালবেলা সবকিছু সেরে অফিসের টাইমে রাস্তায় নামা মানে একধরনের হর্সরেসে নামা। মায়ের খুব ইচ্ছা তাকে বিসিএস অফিসার হিসেবে দেখা। তার অসুস্থ মায়ের জন্য সম্প্রতি সে একটা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, তবে নতুন একটা পার্টটাইমের চাকরি জোটাতে তার বেশি সময় লাগেনি। মায়ের আবদার রাখতেই সে কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে। ক্লাস শেষে নতুন চাকরির অফিসে যাবে। সপ্তাহে এ তিনদিন তার উপরে ছোটখাটো একটা ঝড় চলে যায়। বাকি চারদিন পুরোপুরি সে মায়ের দেখাশোনা করে।
বরাবরের মতো আজও তীব্র যানজট। ঠিকমতো ক্লাস ধরা যাবে কি না কে জানে! দৌড়ঝাঁপ দিয়ে বাসে কোনোরকম ঠেলেঠুলে উঠেছে নন্দিতা। এদেশের দু-চারটা খারাপ রাস্তার মধ্যে পাগলা-মুন্সীখোলার রাস্তাটা অন্যতম।
কোনোরকমে বাসে ওঠা গেলেও সিট পাওয়া মুশকিল। বারোরকমের মানুষের ঘর্ষণে নন্দিতার মেজাজ খিঁচড়ে যায়। কিন্তু কী আর করা, খিঁচড়ানো মেজাজ নিয়ে সকালটা আস্তে আস্তে বিকেলের দিকে হামাগুড়ি দেয়।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সিট পাওয়া গেল পোস্তগোলাতে এসে। রং উঠে যাওয়া লক্কড়ঝক্কড় যানটাতে নন্দিতা দুলে দুলে যাচ্ছে আর ভাবছে। একি বেহাল দশা! মানুষের চাপ কী ভয়ানক হয়ে উঠছে দিনে দিনে। এ যেন চলন্ত মাংসপি-ের মিছিল। জীবনানন্দ দাশের মতো এখন তারও ইচ্ছা করছে ঘাস হয়ে জন্মাই ঘাসের ভিতরে। বিপুল জনস্রোতের ভিড়ে নিজেকেই না-হারিয়ে ফেলি। সম্পদের বিশাল অংশ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে মুঠোবন্দি। বিত্তহীনদের জীবন চরম দুর্বিষহ। প্লুটোক্রেসি চলছে ডেমোক্রেসির নামে। ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রে সাধারণ জীবনগুলো ওষ্ঠাগত। ধনীরা আরও ধনী। দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে দিন দিন।
গুলিস্তান নেমে নন্দিতাকে আরেকটা বাসে চড়তে হয়। অবশেষে সময়ের অল্পকিছু আগেই ক্লাসে পৌঁছাতে সক্ষম হয় শেষ করেই নন্দিতা কটকটে ক্লাস। রোদে বের হয়ে এল। বর্ণিল জনস্রোত লেগেই থাকে ফার্মগেটে। থেমে থেমে গাড়িগুলো এগিয়ে যাচ্ছে ট্র্যাফিক সার্জনের নির্দেশে। তীব্র হর্ন বাজিয়ে আটকে থাকা অ্যাম্বুলেন্সের বুকে আর্তনাদ চলছে একটানা। সেদিকে কারো কান নেই। মনে হয় শুনতে শুনতে বধির হয়ে গেছে কানের দরজা। রাস্তার শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ট্র্যাফিক পুলিশ প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। তার ওপরে যেমন বাড়ছে গাড়ি, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্টিয়ারিং মালিকদের নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা। এই দুইয়ে পিষে সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। নিরীহভাবে নন্দিতা তার নতুন কর্মক্ষেত্র, পত্রিকা অফিসের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেছে। নন্দিতা নিজেকে বিনয়ী ভাবতেই পছন্দ করে; কিন্তু অন্যদের মতো নুয়েপড়া ভাবটা নিজের করে রাখতে চায় না।
কিছুদিন আগেও নন্দিতার একটা ভালো মানের চাকরি ছিল, কিন্তু মায়ের কথা ভেবে সে চাকরিটা বাদ দিয়েছে। এখন একটা ত্রৈমাসিক পত্রিকার সাব-এডিটর হিসেবে চাকরি নিয়েছে। তাতে ধরাবাঁধা সময় দিতে হয় না। কাজ নিয়ে বাসায় ল্যাপটপেও করে নেয়া যায়। এ কাজটা তার ইউনিভার্সিটির প্রিয় ম্যাডাম নিশি রিমা ঠিক করে দিয়েছেন। নন্দিতার সাথে তার কৃতজ্ঞতা জানানোর সম্পর্ক নয়, সেটা শুধু অনুভবের। আজ এ চাকরির কারণেই মাকে সে আগের চেয়ে অধিক সময় দিতে পারছে।
মুন্সীখোলার এলাকাতে মাকে নিয়ে নন্দিতা থাকে। অল্প ভাড়ার মধ্যে একটা খোলামেলা বাড়িতে মাকে তুলতে পেরেছে। প্রথমে বাসাটাকে দেখে নন্দিতার খুব রাগ উঠেছিল কিন্তু ধীরে ধীরে তা ভালো লাগতে শুরু করেছে। নন্দিতার গায়ের রঙের মতো ঘরটার রং অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝাপসা। নিজের কালো রঙে নন্দিতার কিছু যায় আসে না। এ ব্যাপারে সে নিজেকে মোটেও অবহেলা করে না। বুকে হাত দিয়ে সবসময় বলেÑ ঝধু রঃ খড়ঁফ, ও’স নষধপশ ও’স চৎড়ঁফ.
কিন্তু দিলু ভাই নন্দিতাকে নিয়ে প্রাউড হতে পারেনি। সে শুধু নন্দিতার কালো রংটুকুই দেখেছে। ভিতরের আভাটুকু দেখেনি। নন্দিতা বাস্তবে খুব গোছানো স্বভাবের মেয়ে। কারো ঘরের ঘরনি হলে খুব গুছিয়েই সংসার করতে পারত। কিন্তু দিলু ভাই উচ্চাভিলাষী। তার জীবনে অনেক কিছুই চাই। গাড়িবাড়ি, অর্থসম্পদ সবকিছু। সংসার করতে গেলে দুজনকেই সমমনা হতে হয়, তা না হলে পৃথিবীর সৌন্দর্যে ঘাটতি পড়ে। নন্দিতা যখন দিলু ভাইয়ের কাছে তার মূল্য বুঝতে পেরেছে তখন নিজ থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
নন্দিতা খুব ছোটোবেলা থেকেই যৌতুকবিরোধী ছিল। দিলু ভাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যখন তার মনোভাব এক হচ্ছিল না, তখন ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। কারণ দিনে দিনে দিলু ভাইয়ের চাহিদাগুলো ফুলের পাপড়ির মতো মেলতে শুরু করেছিল। সেটা বুঝতে পেরেই নন্দিতা নিজেকে আলগোছে তুলে নিয়েছে সম্পর্কের মায়াজাল থেকে। সম্পর্কের জন্য নন্দিতার খারাপ লাগেনি; কিন্তু ভালোবাসার জন্য কষ্ট হয়েছে। নিজের ভিতর পাথরচাপা দিয়ে রেখেছে, বুঝতে দেয়নি কাউকে।
আশপাশের মানুষগুলোর দৈনন্দিন কলহ, বিবাদ দেখে নন্দিতা নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে। মাকে নিয়ে আজ তার পুরোদস্তুর সংসার, সাথে আছে টুসি। মেয়েটা পাশের বাড়িতে থাকে কিন্তু নন্দিতার মনেই হয় না মেয়েটি তার ঘরের সদস্য নয়। টুসির মায়াতেই নন্দিতা এই মুন্সীখোলার ধুলো ছাড়তে পারেনি। নন্দিতা বাসায় না থাকলে অকারণেই এসে নন্দিতার মায়ের যতœ করে। এত ছোটো বয়সের এমন নির্লোভ মেয়ে নন্দিতা আর জীবনেও দেখেনি।
নন্দিতার জীবন কঠিন সংগ্রামের। ক্লাস শেষ করেই পত্রিকা অফিসে পৌঁছে যায়। নিজের লেখা দেয়া ছাড়াও অন্যান্য লেখকদের দিয়ে লিখিয়ে নেয় সে। সম্পাদনা, প্রেসে দেয়া এবং ডেলিভারি নেয়া পর্যন্ত সম্পাদককে সব কাজে সহযোগিতা করে। এ-ধরনের কাজগুলো নন্দিতা খুব আনন্দ নিয়েই করে। তাই এতে তার ক্লান্তি আসে না। লিখিয়ে স্বভাবটা এমনি এমনি আসেনি।
নন্দিতার মা-বাবা, দুজনেই শিল্প-সাহিত্যের লোক, উদার সংস্কৃতিমনা। তবে মায়ের মূল্যবোধের সাথে বাবার মনোভাবের রকমফের হতে থাকে বিয়ের ক’বছর পর থেকেই। কোনো কর্মক্ষেত্রেই বাবা বেশিদিন মন ভিজিয়ে রাখতে পারত না। সেই কারণে সংসারে টানাপড়েন লেগেই থাকত। বাবা সাংসারিক ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও খুব বন্ধুপ্রতিম ছিল। কথা নেই বার্তা নেই একজোড়া বন্ধু হুট করে নিয়ে হাজির হতো। এদিকে সংসারে সারামাসজুড়েই থাকত টানাটানি। বাবার একথাটা একবারও মনে হতো না, খাবারটা আসবে কোথা থেকে। মা বনেদি পরিবারের হওয়ায় মুখ থেকে এসব অভাববোধ ফুটে বের করতো না। একটা স্কুলের চাকরি করে টেনে নিতে চাইত সাংসারিক খরচ। বাবার এহেন আচরণে পেরে উঠত না। এসব ব্যাপারগুলোই ধীরে ধীরে ব্যাপক হতে লাগল। একসময় মা হাঁপিয়ে উঠল। বাবার এই গা-ছাড়া ভাবের উপর এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে যে একদিন নন্দিতার কচি হাতখানা ধরে বাবার সংসার ত্যাগ করে। অবশ্য নন্দিতার নানুবাড়ি সবসময় মায়ের পাশে ছিল।
নন্দিতা বাসায় ফিরে দেখে মা চোখ বুজে আছে। টুসি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা দেখছে। ছেলে হয়ে জন্ম নিলে অনেক স্বাধীনতা জন্মগতভাবেই এসে যায়। কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্ম নিলেই সাথে জন্মায় একঝাঁক অনুশাসন, বাধা আর অপরাগতা। টুসি সামনের প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। মাঝে মাঝে তাকে খাতা-কলম কিনে দিয়ে শৈশবের আনন্দ উপভোগ করে নন্দিতা।
খুব সামান্য উপহারেই টুসির আনন্দ আকাশ ডিঙাতে চায়। নন্দিতার তখন খুব ভালো লাগে। কারণ নন্দিতা হাই থিঙ্কিং অ্যান্ড সিম্পল লিভিং-এ বিশ্বাসী। নন্দিতা কল্পনা করে, কত অল্প জিনিস নিয়েই মানব জীবন অনায়াসে কাটানো যেতে পারে। অথচ এই একটা জীবনে মানুষের চাওয়ার সীমা-পরিসীমা নেই, লোভের শেষ নেই, চাহিদার অন্ত নেই, হুলুস্থুলের শেষ নেই, গন্তব্যের ঠিকঠিকানা নেই, জীবনটা যেন একটা অশ্বডিম্ব। বেঁচে থাকা মানুষদের জন্য এক ধরনের অতৃপ্তিবোধ করে নন্দিতা। এক জীবনে তার কত কিছু চাই!
একবার ছোটোবেলাতে বাবা-মায়ের সাথে গ্রামে গিয়েছিল নন্দিতা। বয়স তখন খুব বেশি না। কিন্তু আজও সেই অমলিন স্মৃতিটুকু নন্দিতাকে স্নেহের আবেশে জড়িয়ে রাখে। বাবা যখন তাকে থ্রি মাসকেটিয়ার্স, রবিনসন ক্রুশো বা সিনড্রেলার গল্প শোনাত তখন বাবার কোলে বসে বসে আপ্লুত হয়ে গল্প শুনত সে। হাসপাতালে গিয়ে আজও সে বাবাকে চুপচাপ দেখে আসে, মা যাতে পাছে কষ্ট না পায়। বাবাকে বিভিন্ন রোগ অক্টোপাসের মতো জেঁকে ধরেছে। সাথে বার্ধক্যজনিত স্মৃতিহীনতা তো আছেই। আজকাল নন্দিতাকে চিনতে পারে না। কিন্তু তারপরেও নন্দিতা বাবার হাতটা স্কুলে যাবার প্রথম দিনের মতো ধরে বসে থাকে চুপটি করে। রক্তে রক্তে এক প্রস্তর কথা হয়ে যায়। না-বলা কথাগুলো নন্দিতা অনুভব করে নেয়।
নন্দিতা বোঝে দুটি মানুষের চেতনা একরকম না হলে সংসার টিকে থাকে কচুপাতার পানির মতো। টুপ করে কখনো-বা ঝরে যায়। বর্তমানে মানুষের সহনশীলতার মাত্রা আরও কমছে। আর তাতে মহামারি আকারে রূপ নিয়েছে ব্রোকেন ফ্যামিলির প্রকোপ। মানুষ আজ স্টার জলসা বা জিটিভি দেখে পারিবারিক কূটনীতির চর্চা করে। কিঞ্চিৎ সময় যদি নিজস্ব ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি চেনার জন্য দিত তাহলে সামাজিক গতি আরও সহিষ্ণু হয়ে উঠত। একটা পরিবারে বাবা-মা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু সেটা হয়তো বর্তমান সমাজের চোখ গলে ফসকে যাচ্ছে ভিন্ন অজুহাতে।
নন্দিতা ছোটোবেলা থেকে মেধাবী হলেও নারী হিসেবে বাহ্যিক সৌন্দর্যের বিশ্বাসী নয়। একবার এক বান্ধবীর খালা তার জন্য প্রস্তাব এনেছিল। কিন্তু নন্দিতা তাদের কাছে এমনভাবে অপদস্ত হয়েছিল যা আজও তাকে নীরবে কাঁদায়। তাই সে ঠিক করেছে, সমমনা মানুষটির জন্য আমরণ প্রতীক্ষা করবে, নচেৎ সে-ও একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির প্রতিনিধিত্ব করবে না।
মায়ের পাংশু মুখটা দেখে নিয়ে কাঁথাটা আলতো করে টেনে দিতেই মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। মা খুব জানালাপ্রিয় মানুষ। নন্দিতা পোকামাকড়ের ভয়ে সন্ধ্যার আগেই জানালা লাগিয়ে দেয়। মা জেগে উঠে জানালা বন্ধ পেয়ে চেঁচামেচি শুরু করে। জানালা বন্ধ পেলে তার দম আটকে যায়, নন্দিতার কোনো বাহাদুরি সেক্ষেত্রে চলে না। সে জানালাটাকে আবার বইয়ের পাতার মতো খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেÑকেন এমন করো মা?
তুই জানিস না, জানালা খোলা না থাকলে আমার অস্থির লাগে। জানালা দিয়ে মা দূরের আকাশকে দেখার চেষ্টা করছে। যেন কেউ শত-আলোকবর্ষ দূরে দাঁড়িয়ে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্যের ছটা তার গায়ে এসে লাগে। মা খুব আদরে তা মেখে নেয়।
নন্দিতা মায়ের ছেলেমানুষি উপভোগ করছে। টুসি না বলে কখন যে চলে যায় নন্দিতা বলতে পারে না। মেয়েটা সব দিক দিয়েই ভালো কিন্তু পাখির ডানার মতো অস্থির। ফুড়–তফুড়–ত করে এ বাড়ি আসে আর যায়।
মায়ের বালিশের পাশে সঞ্চয়িতা আর জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র পড়ে আছে। ছোটোবেলা থেকেই মায়ের সাহিত্য পছন্দ। নন্দিতা দুদিন আগে বাবাকে দেখে এসেছে তা ভুল করেও তোলে না। রাতের খাবার খেয়ে নীরবে চোখ বুজে ঘুমাবার চেষ্টা করে নন্দিতা। কিন্তু সে বিছানাতে গেলেই যেন মায়ের হাজারো অতীত এসে কড়া নাড়ে। মা একা একা সেখানে হেঁটে বেড়ায়। মাঝে মাঝে বাবার ওপর ক্রোধে ফেটে পড়ে। তার কথাতে নন্দিতা বুঝে নেয় বাবা উড়নচ-ী মানুষ। রাগ উঠলে ছোটোবড়ো কাউকেই তোয়াক্কা করত না।
সবার ওপরেই চালাত খিস্তিখেউড়ের রোলার। মা সেগুলো কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারত না। ফলে অদৃশ্য দেয়ালটা বড়ো হচ্ছিল একটু একটু করে। মাকে গালিগালাজ করে পরে ফুলচন্দন দিলেও সে সহজে স্বাভাবিক হতে পারত না। তৎকালীন সময়ে মায়ের মতো রূপে গুণে পারদর্শী নারী সব পুরুষের কাক্সিক্ষত ছিল। কিন্তু মা বাবাকেই নির্বাচন করেছিল, এই ব্যথাটাই তার হৃদয়ে বাজত খুব।
নন্দিতা মায়ের গুণ পেলেও রূপের কিছু অংশও পায়নি। নন্দিতার কবে সংসার হবে, এ নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। শুধু আফসোস, একটিবার যদি দেখে যেতে পারতাম! তখন সে ব্যাপারে নন্দিতা চুপ থাকে। মাকে যা-খুশি তা বলার স্বাধীনতা দেয়।
নন্দিতা নিজেকে কালো হওয়াতে ভাগ্যবতী মনে করে। কারণ সৌন্দর্য পুরুষকে হিংস্র করে তোলে। ফেলে থাকা বুনো ঝোপের মতোই তার শরীর পরিণত হয়েছে এতদিন। কালো ব্যাপারটা নিয়ে সে নিজেকে মোটেও মূল্যহীন ভাবে না। তাই কামুক পুরুষগুলো যদি প্রিডেটর এনিমেলদের মতো এগিয়েও আসে, তাতে বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না। বাবার প্রতি নন্দিতার অভিমানের সুপ্ত বীজটা রয়েই গেছে। সেখানে আলো-বাতাস পড়তেই বীজ থেকে ডালপালা ছাড়তে শুরু করে। কিন্তু বাবা এখন অসুস্থ সেকথা ভাবতেই নন্দিতার অভিমানগুলো কাচের টুকরোর মতো খানখান হয়ে ভেঙে যায়।
মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চায়ের তাড়নায় নন্দিতা লেখা থেকে উঠে রান্নাঘরে যায়। রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি। ভেতরে ঢুকতেই দেখে টুসি হেলান দিয়ে ঝিমাচ্ছে।
কিরে তুই আবার কখন এলি! নন্দিতার মাঝে মাঝে টুসিকে ভুতুড়ে শিশু বলে মনে হয়। এই আছে তো এই নেই। এ কিরে বাবা! নন্দিতা একে নিজের সংসারের একজন করে নিয়েছে। মেয়েটির বাড়তি কোনো চাহিদা নেই। দেখতেও নন্দিতার মতো, যেন একটা চকচকে তরুণী ভ্রমর। সাথে একটা হুলও আছে, ঘনঘন অভিমানের বিষ তোলে। একটু পর মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। আবার সেই আর্তনাদÑ নন্দিতা, নন্দিতা।
আসছি মা, কী হয়েছে বলো, চা খাবে?
শুকনো কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, তুই আমাকে ফেলে দূরে যাবি না তো বাপু?
নন্দিতা চমকে ওঠে, এ কী প্রশ্ন মায়ের! সে কি মায়ের মনে অজান্তে কোনো কষ্ট দিয়ে ফেলেছে! ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের বুকে নন্দিতা। মা, কী মা, এমন বলছ কেন? আমি কি তোমার মনখারাপের কারণ হয়েছি? আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।
হঠাৎ মা ফিক করে হেসে বলেÑহুম্ দেখিস না, আমাতে যমেরও অরুচি। অসুখ একটার-পর-একটা দিয়ে দূরে সরে যায় মজা দেখার জন্য।
ছি! মা এগুলো কেন বলছ?
নন্দিতার বুকের ভিতরের পেন্ডুলামটা ধকধক করতে থাকে।
জানি মা, তুই মনে-মনে আমাকে অনেক বকা দিস। একমাত্র মেয়ে হবার পরেও আমি তোর বাবার কাছ থেকে তোকে বঞ্চিত করেছি। আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস মা।
মা, প্লিজ তুমি এভাবে বোলো না। মায়ের কথাতে নন্দিতার স্মৃতির উঠানের ধুলোবালি উড়ে যায় বাউরি বাতাসে।
নন্দিতা আর তার বাবার সম্পর্কটাও যেন সেই রবিঠাকুরের কাবুলিওয়ালার মতো মনের গহিনে এঁটে আছে।
বাবার অসুস্থ মুখটা নন্দিতার চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায়।