মধ্যরাত
চাঁদটা আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে ।
নদীর পানিতে ঢেউয়ে চাঁদের অবয়ব ইচ্ছেমত নাচছে । রতন নদীতে জাল ফেলে চুপচাপ বসে আছে । নৌকা ভাসছে নিজের ইচ্ছে মত । একটুপর জাল টানা শুরু করলো রতন । মাছগুলো জাল থেকে ছাড়িয়ে পাত্রে রাখছে ও । মাছ ধরতে ধরতে ওর নৌকা একটা চরে এসে আটকায় । অনেক পরিশ্রম হয়েছে এতক্ষন ওর । নৌকার গুলইয়ে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল ও । তারপর নৌকা থেকে চরে নামলো । আগে কখনও আসে নি ও এখানে । পুরো চরটা ছোট ঝোপ ঝাড় আর ফসলের ক্ষেতে ভরা। শুধু চরের মাঝখানে ছোট একটা ঘর দেখা যাচ্ছে যেখানে আলো জ্বলছে ।
রতন হাটঁতে হাটঁতে ঘরের দিকে যেতে লাগলো । হঠাৎ ও দেখলো একটা গরু ক্ষেতে ঘাস খাচ্ছে ।
অবাক হল খুব । এই জনমানবহীন চরে গরু কোথা থেকে আসলো ? একটু সামনে এগিয়ে ও দেখলো গরুটাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না । হঠাৎই উধাও হয়ে গেছে যেন । থমকে দাড়াঁলো রতন । তখন ও দেখলো ওর সামনে সাদা কাপড় পড়া কিছু লোক হাটঁছে । রতনের মাথা যেন ঘুরছে । এতক্ষণ তো কাউকে দেখে নি ও । তাহলে এই লোকগুলো হঠাৎ কোথা থেকে আসলো? লোকগুলো রতনের দিকে ফিরে তাকালো । সবাই খুব বিষন্ন আর সবার মুখেই অসংখ্য ক্ষত যেখান থেকে অবিরত রক্ত ঝরছে ।
রতন ভয়ে ঘরের দিকে দৌঁড় দিল ; ও ভাবলো ঘরে হয়তো মানুষ আছে ।
ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘরের দিকে ছুটতে থাকলো । ওর কাছে মনে হল পিছন থেকে কে যেন বার বার ওকে বাধা দিচ্ছে । রতন কোন দিকে না তাকিঁয়ে সোজা ঘরের দিকে যেতে লাগলো । ঘরের সামনে গিয়ে দরজার ফুটো দিয়ে উঁকি দিল ও । তখন যা দেখলো
তাতে ওর রক্ত হিম হয়ে গেল । একটা লাশ ঝুলছে ঘরের ভিতর আর দুইজন লোক ছুরি দিয়ে কেটে কেটে মৃত লাশটার মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে । ভয়ে গায়ের লোম দাড়িঁয়ে গেল ওর । উল্টোদিকে দৌড়াতে শুরু করলো ও । আশেপাশে আর কাউকে দেখতে পেল না । দৌঁড়ে সোজা ও নৌকার কাছে চলে আসলো । কোন রকমে ঢেলে নৌকাটাকে পানিতে নামিয়ে জোরে জোরে দাঁড় বাইতে লাগলো । নদীর মাঝখানে এসে কিছুটা শান্ত হল ও । তবে বুক এখনও কাপঁছে ওর ।
হাত ব্যথা হয়ে গেছে দাঁড় বাইতে বাইতে ; তারপরও থামছে না ও । কিছুক্ষণপর তীর দেখতে পেল । খুশিমনে দাঁড় বাইতে লাগলো ও । তীরের কাছাকাছি আসতেই রতন লাফ দিয়ে নৌকা থেকে নামলো । তীরে এসে চোখ বন্ধ করে বালিতে শুয়ে পড়লো ও । একটুপর চোখ খুললো । চোখ খুলেই দেখলো সেই ঝুলন্ত লাশটা ওর পাশে পড়ে আছে । চোখগুলো খোলা ; জিহ্বা বাইরে বের হয়ে আছে । ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো ও । চারপাশে তাকিঁয়ে বুঝতে পারলো ঘুরে ফিরে ও আবার আগের চরেই এসে পড়েছে । দৌঁড়ে ও নৌকায় গেল । নৌকায় উল্টোদিকে ফিরে দুইজন লোক বসে আছে । রতন নৌকায় উঠতেই লোকগুলো ওর দিকে ফিরে তাকালো । লোকগুলোর মুখে একটুও চামড়া বা মাংস নেই; শুধু কোটরে চোখ দুটো রক্তের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে ; দাঁতগুলো বেয়ে রক্ত ঝরছে । চারপাশের বাতাসে তাজা মানুষের রক্ত আর মাংসের গন্ধ ভসে বেড়াচ্ছে ।
আর সহ্য হল না রতনের । জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো ও ।
কিছুক্ষণপর জ্ঞান ফিরলো ওর । চোখ খুলে তাকিঁয়ে দেখলো ও নৌকার গুলইয়ে শুয়ে আছে । আর একজন লোক ওর
পাশে বসে আছে । সকাল হতে শুরু করেছে তখন । অন্ধকার কাটছে ধীরে ধীরে । রতন উঠে বসলো ।
– আন্নে কে ?
– আমি কালু মাঝি । তুমি কেডা ??
এইহানে কি কর ?
রতন তখন এতক্ষণ ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনাগুলো সব বলল ।
সবশুনে কালু মাঝি বলল,
– এই চর তো খুব ভয়ানক । দুইডা পিচাশ প্রেতাত্মা থাহে এইহানে । ওরা মাইনষের গোশত খায় । তোমার কপাল তো ভালা মিয়া , বাইচ্যা গেছো । এই রাইত বিরাতে মাছ ধইরো না আর । রতন ঘাড় দুলালো ।
– তোমার বাড়ি কই ?
– কুসুমতলী গাঁ ।
– পাশের গাঁয়েই আমি থাহি । এই মাছ কয়ডা আমাগো বাড়িতে দিয়া আইবা ভাই ? আমি কামে আরেক জায়গায় যামু । দিয়া আসলে খুউব উপকার হইতো, এই বলে কালু মাঝি রতনকে বেশ কিছু মাছ দিলো ।
রতন বলল,”আইচছা দিয়া আমু নে ।”
কালু মাঝি খুশি হল খুব ।
রতন নৌকা নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল ।
সকাল হয়ে গছে তখন ।
সূর্য উঠেছে ।
রতন মাছ গুলো নিয়ে কালু মাঝির বাড়িতে গেল । একজন বুড়ো মহিলা উঠানে বসে ছিল । রতন মহিলাটকে জিজ্ঞাসা করলো,
– এইডা কি কালু মাঝির ঘর ।
– হ , তুমি কেডা ?
– আমি রতন । হেয় এই মাছ কয়ডা পাঠাইছে । হেয় কামে গেছে । পরে আইবো ।
রতনের কথা শুনে অবাক হল বুড়ো মহিলাটা ।
– কালু !! কালু পাঠাইছে এই মাছ !!
কেমতে ? আমার পোলা তো মেলা দিন আগে মইরা গেছে । ওর লাশ নদীতে ভাইস্যা আইছে । ওর লাশের হুদা মুখটাই চিনছি আমরা । পুরা শরীলে গোশত আছিলো না । আমরা এহনও জানি না কালু মরছে কেমতে ।
বুড়ো মহিলার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রতন মাছগুলো রেখে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো । ওর এখনও ঘোরের মাঝে আছে । বুড়ো মহিলার কথাগুলো ওর বুকে কাপুঁনি ধরিয়েছে আবার ।
ধীরে ধীরে ও বুঝতে পারলো কালু মাঝি কিভাবে মারা গেছে আর তার আত্মাই গতরাতে ওর প্রাণ বাচিঁয়েছে । মনে মনে ধন্যবাদ দিল তাকে । আর কালু মাঝির ঐ কথাটা ও হয়তো সারাজীবন মনে রাখবে,”এই রাইত বিরাতে মাছ ধইরো না আর ।”
সমাপ্ত।