আমি ওর বয়ফ্রেন্ড ছিলাম না। কিংবা আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নও ও কখনো দেখেনি। তবু আমাকে না দেখে, আমার সাথে কথা না বলে ও থাকতে পারত না। ওর সাথে কথা বলতে আমারও ভালো লাগত। বলতাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ছিল না। আসলে সম্পর্ক ছিল কিন্তু সম্পর্কের নাম ছিল না। স্রেফ বলার জন্য বলা আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। আর কিছু নাহ্।
কলেজ শেষে প্রতিদিন যখন মোড়ের দোকানটা থেকে ফুচকা খেতাম, আমরা প্রায়ই একে অপরকে খাইয়ে দিতাম। ওর বান্ধবীগুলো চোখ নাচিয়ে বলত, কিরে কি চলছে তোদের মধ্যে? শিলা একদিন বলেই ফেলল, ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে নাকি?
তনিমা ওদের কথা একদমই গায়ে মাখত না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিত,
No. We r just friends…
আমি কিছু বলতাম না। কেবলই শুনতাম।
আমরা প্রায় বিকালে নদীর ধারে হাঁটতে যেতাম। পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটেছি কতটা পথ। প্রচন্ড বাতাসে উড়তে থাকা ওর এলোচুলগুলো আমায় ছুঁয়ে দিত। আমার চারপাশের হাওয়া ভরে থাকত ওর চুলের তীব্র মাদকতাময় ঘ্রানে। আমি আসক্তের মত সেই হাওয়ায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতাম। আমার নিঃশ্বাস নেবার ব্যাকুলতা দেখে ঈষৎ হেসে ও আরও নিবিড় ভাবে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরত। ওর চুলে মাখামাখি হয়ে যেত আমার চোখ মুখ। তবু আমরা ছিলাম জাস্ট ফ্রেন্ড।
ওর জন্মদিনে প্রথম উইশ করব বলে কতটা রিস্ক নিয়ে গেইট টপকে ওদের বাসায় ঢুকেছি। পোষা কুকুরটার দৌঁড়ানি পর্যন্ত খেয়েছি। তবু রাত ১২টা ১ মিনিটে আমি কিন্তু ঠিক ওর জানালার ধারেই হাজির হয়ে গিয়েছিলাম “শুভ জন্মদিন” বলার জন্য। ওর চোখে মুখে সেকি আনন্দ দেখেছিলাম! ভালোবাসি বলব বলেও বলতে পারিনি। ততক্ষনে আমি ওর বাবার হাতে ধরা পড়ে গেছি। ভয়ে বক্ষ আমার দুরু দুরু। কিন্তু ও নিরুদ্বিগ্ন।স্বভাবিকভাবেই বাবাকে বলল,
“ওকে যেতে দাও, বাবা। আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড। ও আমাকে বার্থডে উইশ করতে এসেছিল। আর কিছু নাহ্।”
ওর বাবাও আমাকে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু এই বাবা-মেয়ের কান্ড আমার একদমই ভালো লাগছিল না। ওর উত্তরটা যদি অন্যরকম হত, ওর বাবা যদি আমায় ধরে বেদম পেটাতেন কিংবা বাসায় বিচার দিতেন সেটাই কি ভালো হত? বুক ভরা অভিমান নিয়ে আমি ফিরে আসি। কিন্তু পরের দিনটাও শুরু হয় ওকে ভেবেই।
একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছিল। ছাতা নেই কারো কাছেই। তনিমা বলল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই আজ বাসায় যাব আমরা। আমি আবার বৃষ্টিতে ভিজতে পারি না। একটু ভিজলেই ঠান্ডা লেগে যায়। তারপর জ্বর সর্দি কাশির বিশ্রী ঝামেলা। কিন্তু তনিমার কথার বিপরীতে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। বৃষ্টি মাথায় পথে নামলাম আমরা। অল্প সময়ের ভেতরেই ভিজে একাকার আমরা দু’জন। পাশাপাশিই হাঁটছিলাম। মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকিয়ে দেখছিলাম বৃষ্টিস্নাত এলোমেলো মেয়েটাকে।
এরমধ্যে একটা কান্ড ঘটল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে বিকট শব্দে কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। তনিমা ভয়ে চিৎকার করে পাংশুবর্ন হয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল। বাজ্রপাতের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। কিন্তু আমি তখনও তনিমার আলিঙ্গনে বন্দি। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ আমি। কিন্তু পরম নির্ভরতায় ও আমার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। ও আমার দেহের সাথে এতটাই সেপ্টে আছে মনে হচ্ছে যেন ও আমার ভেতরে মিশে যাবে। সেদিন আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল মেয়েটা হয়ত আমাকে ভালোবাসে। আর সেই ভাবনা থেকেই আমি একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। মাথা নিচু করে ওর কাঁপতে থাকা অধরে অধর ছুঁইয়ে দিয়েছিলাম। সত্যি তখন আমার মনে ছিল না আমরা কেবলই ফ্রেন্ড । জাস্ট ফ্রেন্ড। অবশ্য ও সেদিন আমাকে একবারও মনে করিয়ে দেয় নি যে আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড।
এরপর থেকে ওর ওপর আমার অধিকারটা যেন বেড়ে গিয়েছিল। ভালো তো আমি আগেই বাসতাম। মনে হত জাস্ট ফ্রেন্ডের গন্ডিটা আমরা পেরিয়ে গেছি। কিন্তু আমি যে কতটা ভুল ভেবেছিলাম সেটা উপলব্ধি করতে আমায় বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নি। এক রাতে ফেসবুকে ওর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দেখে আমি চমকে উঠি। ছেলেটা আমার অপরিচিত নয়। এলাকারই এক সিনিয়র ভাই। প্রচন্ড রাগ হয়।
কোন কিছু না ভেবেই ওকে সাথে সাথে ফোন করি। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই ও বলতে শুরু করে। নিজের প্রথম প্রেমের অনুভূতি। বলায় এতটাই নিমগ্ন হয়ে যায় যে খেয়ালও করে না ফোনের ওপাশের মানুষটা একেবারে নিশ্চুপ। আর অভিযোগ করা হয় না। আমার আর বলার কিছুই থাকে না। বরং সারারাত একটানা কথা বলে যায় মেয়েটা। আর সারারাত নিঃশব্দে বৃষ্টি ঝড়ে আমার চোখে। মাঝখানে দু’একটা হু হা বলে বোঝাই যে আমি জেগে আছি। তুমি বলো, শুনছি আমি। আর আমাকে বলবে না তো কাকে বলবে ও? একটা মাত্র জাস্ট ফ্রেন্ড আমি!
এই ঘটনার পর যে আমাদের দিনগুলো থেমে গিয়েছিল তা কিন্তু নয়। আগেরই মত দিন কাটাচ্ছিলাম আমরা। কিন্তু মাঝে মাঝে অসহ্য বোধ হয়। ওকে নাহ্। আমাদের মধ্যকার এই জাস্ট ফ্রেন্ড নামক সম্পর্কটাকে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে যে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব হয় না সেটা আমি জানি। কিন্তু ও জানে না। জানলেও হয়ত মানে না। তাই জাস্ট ফ্রেন্ড যদি ভালোবেসে থাকে সে দায় তো ওর নয়! আমিও আর নিজের ভালোবাসার দাবি জানিয়ে ওর জীবনে ঝড় তুলতে চাই নি কিংবা ওকে ছেড়েও আসিনি। সম্পর্কটা স্বাভাবিক রেখেছিলাম।
আগেরই মত। ওর যে বান্ধবীগুলো আমাদের নিয়ে সন্দিহান ছিল তারাও এখন নিশ্চিত যে আমরা শুধুই ফ্রেন্ড। এরপরও আমাদের বাড়াবাড়ি রকমের আচরনগুলো বন্ধ হয় না। আমরা এখনও রাতভর ফোনে কথা বলি কিংবা এখানে ওখানে ঘুরতে যাই। দিনের বেশিরভাগ সময় আমরা একসাথে থাকি। একটা ব্যাপার আমি মাঝে মধ্যেই ভাবি। ও যখন আমার সাথেই এতটা সময় কাটায় তবে ওর বয়ফ্রেন্ড বেচারা কি করে? কে জানে তারও হয়ত একটা জাস্ট ফ্রেন্ড আছে! আবার কখনো ভাবি এতটা সময় ওর সাথে থেকে কি লাভ। দিনশেষে আমি তো জাস্টফ্রেন্ডই থেকে গেলাম। ভালোবাসার মানুষ তো হতে পারলাম না। তবু ওকে ছাড়তে পারি না।
তনিমা আমাদের নামের সাথে মিলিয়ে ওর ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের নাম রাখে। অভ্রর অ আর তনিমার ত আর একটা অক্ষর যদি ধার করে আনি তো বেশ চমৎকার নাম হয়ে যায়। অতনু! তনিমা হবে অতনুর মা। আমি কেউ না। আনমনেই হেসে ফেললাম। তনিমা অবাক হয়ে জানতে চায়,
: হাসছ কেন?
–তুমি তো অতনুর মা হবে। তো আমি কে?
তনিমা এমন একটা মুখভঙ্গি করল যার মানে “ও এই ব্যাপার? তো এতে হাসির কি আছে?” তারপর অপেক্ষাকৃত একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
: তুমি আমার ফ্রেন্ড।
আমি এক টুকরো অবজ্ঞার হাসি উপহার দিয়ে বললাম,
–একটা শব্দ মিস করে গেছো।
: মানে?
–আমি তোমার জাস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু তুমি কি কখনো জানতে চেয়েছ, তুমি আমার কে?
তনিমা একটু যেন আহত হল আবার অবাকও।
আমার কথারই প্রতিধ্বনি তুলল।
: আমি তোমার কে?
আমার কি হয়েছে জানি না। এতদিনের না বলা কথাটা শত আঘাতেও যেটা লুকিয়ে রেখেছিলাম এবং ভবিষ্যতেও কখনো বলব না ভেবেছিলাম সেটাই বলে দিলাম।
–তুমি আমার ভালোবাসা।
: আমি তোমাকে কখনো সেভাবে দেখিনি। স্রেফ বন্ধুই ভেবেছি।
–আর কি করলে আমি তোমার জাস্ট ফ্রেন্ড থেকে বয়ফ্রেন্ড হতে পারতাম বলতে পারো, তনিমা?
তনিমা বজ্রাহতের মত তাকিয়ে থাকে। আমার কথা যেন আজ আর থামতেই চায় না। আমি বলেই চলেছি।
–তোমার সাথে পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার ধারনা ছিল তুমিও ভালোবাসবে। মনে হত ভালোবাসো। কিন্তু আজ পর্যন্ত জাস্ট ফ্রেন্ডের সীমানাটাই পেরোতে পারলাম না। এখন তো তোমার বয়ফ্রেন্ডও আছে। তবে আমাকে আর কেন কাছে ডাকছ, তনিমা?
এবার তো মুক্তি দাও,প্লিজ!
: এসব কি বলছ, অভ্র?
–ঠিকই বলছি। জাস্ট ফ্রেন্ডের আড়ালে থাকা একজন প্রেমিকের ভালোবাসা তুমি দেখলে না। অথচ তোমার নিজের আচরনও তো একজন প্রেমিকার মতই ছিল।
: চুপ কর, অভ্র।
–নাহ্। আজকে বলতে দাও।
বাইরে থেকে দেখলে যে কেউ বলত যে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। কিন্তু সেই ভালোবাসাকে তুমি জাস্ট ফ্রেন্ড নামক একটা ফালতু শব্দের আড়ালে ঢেকে দিয়েছ। আজ থেকে তুমি আর আমাকে জাস্ট ফ্রেন্ড বলে পরিচয় দেবে না, তনিমা।
তনিমা মাথা নিচু করে বসে রইল। হয়ত ওর চোখ জলে টলমল করছে। কিন্তু সেটা ভেবে আমার একটুও কষ্ট হল না। তবে গলার স্বর অপেক্ষাকৃত নরম করে বললাম,
–জাস্ট ফ্রেন্ড বলে কিছু হয় না, তনিমা। এটা স্রেফ একটা অর্থহীন মিথ্যা শব্দ। আমার ভালোবাসা তোমার কাছে স্বীকৃতি পাবে না জানি। কিন্তু জাস্ট ফ্রেন্ড বলে আর অপমান করো না।
আমার বলা শেষ। তাই তনিমার জবাবের অপেক্ষা না করেই আমি চলে এলাম। এরপর আর কখনো ওর সাথে যোগাযোগ করিনি। দু’জনের কেউই না। আমার ধারনা ছিল বাকি জীবনটা তনিমা অনুতপ্ত হবে। অভ্র নামের যে ছেলেটা তাকে ভালোবাসতো তার প্রতি সামান্যতম সমবেদনা অন্তত অনুভব করবে। কিন্তু এবারে আমার ভুল ধারনা ভাঙতে বেশ অনেকটা সময় লাগলো। প্রায় চার বছর পর এক শপিংমলে তনিমার সাথে দেখা। সাথে সম্ভবত ওর হাজবেন্ড। তনিমা হাসিমুখে এগিয়ে এল।
: অভ্র না? কেমন আছ তুমি?
আমিও কথা না বলে পারলাম না।
–ভালো। তুমি?
: এইতো ভালোই আছি। Avro, meet my husband Tanim.
তানিম, এ হচ্ছে অভ্র। we were just friends..
তনিমার কথা শুনে আমি একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। সত্যি এই তনিমাগুলো কখনো শোধরাবে না! কখনোই না..