অন্তঃসলিলা

অন্তঃসলিলা

ঘরে ঢুকে দেখলাম খামটা আমার স্টাডিরুমের টেবিলে পেপারওয়েট দিয়ে চাপা অবস্থায় রাখা। খামটা আমার নামে নয়; এসেছে শর্বাণী ঘোষালের নামে। খামের উপর একটা বিশেষ লোগোও আছে দেখলাম। বেশ চেনা চেনা লাগল লোগোটা। একটু আশ্চর্যই হলাম। সারাজীবনে যার নামে কালেভদ্রে দু-একটা পোস্টকার্ড বৈ কিছুই আসেনি তার নামে কিনা খামে পোরা চিঠি! চিঠিটা খুললাম; প্রাপকের নামে সবিনয় নিবেদন পূর্বক জানানো হয়েছে এইবছরে তিনি অকাদেমি পুরস্কার পাচ্ছেন তার লেখা ‘অন্তঃসলিলা’ উপন্যাসের জন্য। লোগোটা চিঠিতেও আছে।এবার আর সেটা চিনতে অসুবিধা হল না।

ডাকলাম সুপ্রীতিকে। সুপ্রীতি সারাদিন এই বাড়িতেই থাকে। সকাল সাতটার মধ্যে ও এখানে চলে আসে। ছ-টা অবধি ওর ডিউটি। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আমি চলে এলেই ওকে ছেড়ে দিই। বেচারিকে অনেকটা পথ বাসে ফিরতে হয়। এরপর আসে মায়াদি। তাও একেকদিন তো ওনার ছ-টার বদলে সাড়ে ছটা বা সাতটাও বেজে যায়। তবু ওকে খুব একটা কিছু বলি না। আসলে ওরা দুজনেই কাজটা করে খুব ভালো। এরা না থাকলে পাশের ঘরের ঐ শয্যাবন্দী মানুষটাকে নিয়ে যে আমি কিই করতাম কে জানে। প্রায় দশমাস একরকম চেতনাহীন অবস্থাতেই পড়ে আছে মানুষটা। আমার মা শর্বাণী ঘোষাল।

-আমাকে ডাকছিলে বউদি?
-হ্যাঁ তুমি তো এবার বেরোবে নাকি ? মা কেমন আছে আজ?
-একই রকম!
– কিছু বলছিল নাকি আজ?
-বলে তো রোজই, কিন্তু আমি বড়মার কথা কিচ্ছু বুঝতে পারি না।
আমিও পারি না, কেউই পারে না। শুধু একজন ছাড়া। সে হল আমার হাজবেন্ড অরণ্য।
সুপ্রীতি বেরিয়ে যাচ্ছিল, বললাম,
-এই চিঠিটা কখন এল?
-দুপুরে। তখন আমি সবে বড়মাকে খাওয়ানো শেষ করেছি। সে পিওন তো আমার হাতে কিছুতেই চিঠি দেবেনা ; বলে দরকারি রেজিস্ট্রি চিঠি, যার নামে আছে তার হাতে ছাড়া কাউকে দেবে না।

-তা তুমি কি বললে?
-বললাম যার নামে চিঠি সে নেবার মত অবস্থায় নেই। বিশ্বাস না হলে ঘরে এসে দেখে যাও।
-তারপর?
-জিজ্ঞাসা করল আমি কে হই? বললাম ওনার মেয়ে হই। তখন সই করিয়ে নিয়ে চিঠি দিল।
-বাঃ বেশ করেছ।
-আমি তাহলে আসি বৌদি?
-একটু বোসো; আমি স্নানটা সেরে আসি।– বললাম আমি।
সাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে সেই দিনটা যেন চোখের উপর ভেসে উঠল। সেদিনটা ছিল রবিবার। মাত্র কয়েক মাস আগে এই ফ্ল্যাটটায় শিফট করেছি। আসলে শ্বশুর মশাই মারা যাবার পর খুড়শ্বশুরদের শরিকি ঝামেলায় আর পুরনো বাড়িতে থাকা যাচ্ছিল না। শিক্ষিত পরিবার হলে কি হবে সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার লোভ ষোলআনা।
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি যত বেলাই হোক মা স্নান করে ঠাকুরকে জল-মিষ্টি না দিয়ে এককনা খাবারও দাঁতে কাটত না। সেদিন প্রায় দেড়ঘণ্টা হয়ে গেল মা পূজোর ঘর থেকে বেরোয় না। প্রথমে আমি ব্যাপারটায় অত আমল দিই নি। অরণ্যই বারবার তাগাদা দিচ্ছিল ,-

-মা কি করছে এতক্ষণ ধরে একবার দেখো গিয়ে। এত দেরী তো করে না।
শেষে অধৈর্য হয়ে ঠাকুর ঘরে উঁকি দিলাম। মা নিশ্চল পাথরের মতো ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তারপর হসপিটাল, আই. সি. ইউ. প্রায় যমে মানুষে টানাটানি । মা বেঁচে গেল। কিন্তু পরিণত হল এক জড়পদার্থে। সেরিব্রাল অ্যাটাকটা ছিল বেশ বড়সর। সেই থেকে ঐ পাঁচ-সাত খাটটাই মায়ের জগৎ। শুধু মাঝে নিজের মনে কিসব যেন বলে।

মাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনবার দিন অরণ্য একটা কথাও বলছিল না। অ্যাম্বুলেন্সে জিজ্ঞাসা করলাম,-

-তোমার আবার কি হল?
-তোমাদের পুরনো বাড়ি বিক্রির জন্য মা’কে এতটা ফোর্স করা তোমার ঠিক হয়নি। আমি তো বলেছিলাম বাড়িটা কিছুটা সারিয়ে দিচ্ছি মা ওখানেই থাকুক। কাজের লোকও রেখে দিচ্ছি। আমরা প্রতি সপ্তাহে নাহয় ওখানে যেতাম। তুমি এমন চাপাচাপি শুরু করলে মা-কে….

-দেখো হপ্তায় একটা দিন ছুটি, তোমারও আমারও। ঐদিন ঐ পোড়ো বাড়িতে মায়ের মুখের সামনে গিয়ে বসে থাকতে আমি পারবো না…. ব্যাস। আর তাছাড়া বাড়িটার আর কিছু আছে নাকি। হাত দিলেই একগাদা টাকা খরচ।
-খরচ হলে হত… এই বয়সে একটা মানুষের শিকড় ছিঁড়লে অন্য জায়গায় সে আর লালিত হতে পারে না অঙ্গনা। তুমি বুঝবে না, ওটা ওনার শ্বশুরবাড়ি ,কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেখানে…. মা শকটা জাস্ট নিতে পারল না।
-কি আমার বোদ্ধা এলেন! আর কিসের স্মৃতি ! বাবা তো মা-কে সহ্যই করতে পারত না।
-সেটা আমি পুরোটাই জানি।
-কি করে জানলে?
-কথাটার কোন উত্তর দেয় নি অরণ্য।

— [দুই] —
বাবার সঙ্গে মায়ের বিয়েটা কোনদিনই ক্লিক করেনি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার সময় ঠাকুর্দা বাবার বিয়ে ঠিক করে বসলেন। মেয়ে সুন্দরী, গৃহকর্মনিপুণা তায় আবার পালটি ঘর। প্রথমে তো বাবা একদমই বেঁকে বসেছিলেন। এসব কথা আমি বাবার মুখেই সুনেছি। বাবার এক বন্ধু শ্যামল কাকুর খুড়তুতো বোনকে বাবার খুবই পছন্দ ছিল। আমি বেশ বড় হবার পরেও অনেকবার শ্যামল কাকু আমাদের বাড়িতে এসেছেন।

তার বোনের সঙ্গে বাবার বিয়েটা না হওয়ায় তিনি মাঝে মাঝে আক্ষেপও করতেন। মেয়েটির সঙ্গে বাবার বেশ ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল। শ্যামল কাকুর ম্যানেজমেন্টে ওরা দুজন দু-তিনবার একসঙ্গে সিনেমা দেখতেও গিয়েছে। সে মেয়েটি নাকি কলেজে পড়ত তখন। তবে পড়াশোনায় ভালো হলেও দেখতে শুনতে যা ছিল টা নাকি ঠাকুর্দা-ঠাকুমার একদমই পছন্দ হতো না; তার উপর মেয়েরা আবার জাতে তেলি। বাবা ঠিক করেছিল পড়া শেষ করে একবার চাকরি শুরু করলে বাড়িতে তার কথারও একটা গুরুত্ব থাকবে। ঠাকুর্দা সেই সুযোগই দেয়নি বাবাকে। সোজা বলে দিয়েছিল,-

-এই মেয়েকে বিয়ে করে হয় সংসারী হও নয়তো নিজের পথ নিজে দেখে নাও। আমি নিজে মেয়ে দেখে কথা দিয়ে এসেছি।

ঠাকুমাও সেদিন নিজের একমাত্র ছেলের পক্ষ না নিয়ে স্বামীর কথাতেই সায় দিয়েছিলেন। বিয়ের কয়েকদিন আগে বাবা জানতে পারে তার হবু স্ত্রীর বিদ্যের দৌড় মাত্র ক্লাস এইট অবধি। তার মনটা আরও বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। আমি একটু বড় হবার পরে এই বিতৃষ্ণাটা বাবা আমার মধ্যেও সঞ্চারিত ক’রে দিয়েছিল। আমি বাবার খুব নেওটা ছিলাম বলে আমিও মায়ের খুঁত খুজে বেড়াতাম সারাদিন।

মায়ের গাঁয়ের রঙ ছিল দুধসাদা। চেহারা একটু মোটার দিকেই, মুখটা কিছুটা লম্বাটে, লক্ষ্মীঠাকুরের মতো টানা টানা চোখ। বাবার কিন্তু মাকে ভীষণই সাধারণ দেখতে বলে মনে হত। বরং কিছুটা সেকেলে। মায়ের রান্নার হাত ছিল খুবই ভালো কিন্তু মায়ের কোন রান্নাই বাবার পছন্দ হতো না। কোনোদিন মাছের ঝোলে ঝাল বেশী, কোনোদিন মিষ্টি বেশী, কোনোদিন বা রান্নায় তেল-মশলা বেশী হয়েছে এইসব মন্তব্য খেতে বসে লেগেই থাকত। আমার নিজের রান্না ভালো লাগলেও বাবাকে সমর্থন করতে আমিও বাবার কথায় সায় দিতাম। পরের দিকে মা আর খাবার দেবার পরে এইসব দারুন কমপ্লিমেন্ট শোনার জন্য খাওয়ার পাশে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত না।

যখন থেকে স্কুলে আমার ঠিকঠাক যাতায়াত শুরু হল তখন আর এক উপসর্গ দেখা দিল আমার। মায়ের করে দেওয়া কোন টিফিনই আমার মুখে রুচত না। আমার যাতে ভালো লাগে তাই মা পাড়ার বিভিন্ন পরিচিত জনের কাছ থেকে রান্নার বই জোগাড় করে আনত। নিউজপেপারে রেসিপি দিলে সেটা সযত্নে কেটে রাখত। কিন্তু আমার প্রশংসা কখনও মায়ের ভাগ্যে জোটেনি।

ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠার সময় আমি প্রথমবার অ্যানুয়ালে ফার্স্ট হলাম। মা আমার মার্কসিটটা হাতে নিয়ে দেখছিল। বাবা এক ঝটকায় সেটা মায়ের হাত থেকে কেড়ে নিল, বলল,-

-কাকে দেখাচ্ছিস মার্কসিট? জিজ্ঞেস করে দেখত সাবজেক্ট গুলোর নামও ঠিকঠাক পড়তে পেরেছে কি-না?
আমারও যেন মনে হল বাবার কথাটাই ঠিক। এরপর থেকে মাকে আর কখনো মার্কসিট দেখাই নি; মাও দেখতে চায়নি।

নেহাত দায়ে না পড়লে বাবা কখনোই মা-কে নিয়ে বেরত না। কখনো বিয়ে-থা লাগলে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাওয়া ছাড়া সিনেমা-থিয়েটার বা রেস্তোরায় খেতে যাওয়া- এসব কখনো করতে দেখিনি বাবাকে। মা অবশ্য এসব নিয়ে কখনো অভিযোগও করেনি। আমিও বাবার মতোই মাকে টেকেন-ফর-গ্রান্টেড-ই ধরে নিয়েছিলাম। বাবার মতই আমারও মামার বাড়ির তরফটা একদমই পছন্দ ছিল না। মায়েরা ছিল পাঁচবোন চারভাই। বাবা বিদ্রুপ করে বলত তার শ্বশুর সারাটা জীবন সন্তান উৎপাদনেই ব্যয় করেছে। দিদা বলত যে মা নাকি ছোট থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল কিন্তু বড় মেয়ে হয়ে সংসার সামলাতে গিয়েই নাকি লেখাপড়াটা ঠিকঠাক হল না। অ্যাজ ইউজুয়াল বাবার এই কথাটা বিশ্বাস হত না, আমারও না। যে সত্যিই পড়াশোনা ভালবাসবে তাকে কোনভাবেই আটকানো যাবে না-এই ছিল আমার বিশ্বাস।

রিটায়ারমেন্টের পর বাবা ভীষণ খিটখিটে হয়ে গেল। মাকে প্রায়ই অকথ্য গালিগালাজ করত। বাবার এই অভ্যাসটা আগে ছিল না। হয়তো সারাটা জীবন নষ্ট হয়ে যাবার যন্ত্রণাটা আর সহ্য হত না তার।

আমার সঙ্গে অরণ্যের সম্পর্কটা প্রথমে বাবা মেনে নেয় নি। অরণ্যের প্রাইভেট চাকরি। বাবার ভীষণ অপছন্দ ছিল। কিন্তু মা-র ভীষণ পছন্দ হয়েছিল অরণ্যকে। আমি খুব ডিস্টার্ব থাকতাম এই সময়টায় বাবাকে কনভিন্স করতে পারছিলাম না বলে, মা বলেছিল,-

-দেখিস তোর বাবা ঠিক সব মেনে নেবে। মানুষটা আদপে তো খারাপ নয়। বাইরেটা হয়তো কঠিন কিন্তু ভেতরে ভেতরে ….

আমি মাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলেছিলাম,-
-সেই সার্টিফিকেটটা তোমার কাছ থেকে আমার নিতে হবে না মা, আমি জানি……..
বিয়ের দিন সবসময় তটস্থ হয়ে ছিলাম আমি। অরণ্যদের ফ্যামিলি মেম্বাররা সবাই ভীষণ এডুকেটেড। সেখানে আমার স্বল্পশিক্ষিত মা কি যে ব্যবহার করে বসবে কে জানে! স্কুল- কলেজের বন্ধু-বান্ধবীরা বাড়িতে এলে যে ভয়টা পেতাম বিয়ের দিন সেটাই আমায় পেয়ে বসেছিল।

— [তিন] —-
খুব ছোটবেলায় মা-কে হারিয়েছিল অরণ্য। তখন ওর ক্লাস ফাইভ। নিজের মা কে নিয়ে ওর একটা ফ্যান্টাসির জগৎ তৈরী হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। আমার মাকে প্রথম দিনই খুব ভাল লেগেছিল ওর।

আমার বিয়ের এক বছরের মাথায় বাবা চলে গেল হঠাৎ করেই। তারপর থেকে অরণ্য যেন আরও বেশী কাছের হয়ে উঠেছিল মায়ের। ছুটির দিন হলেই একগাদা বাজার করে মায়ের কাছে উপস্থিত হতো ও। বলত,-

-মা , জমিয়ে রান্না কর তো, দুপুরে আমরা আসছি।

দুপুরে আমাকে বাধ্য হয়েই ওর সঙ্গে আসতে হতো এ বাড়িতে। মেঝেতে আসন পেতে খেতে দিত মা। তাতেই অরণ্য কি-খুশী! মাঝে মাঝে ভাবতাম কে মায়ের আসল সন্তান, আমি না অরণ্য!

মা-কে এ বাড়িতে নিয়ে আসবার সময় মা-র সঙ্গে পুরোনো বাড়ির আরো কয়েকটা জিনিস এখানে এসেছিল, ঠাকুরের সিংহাসন, পিতলের রাধাকৃষ্ণ আর গুচ্ছের ছবি তো ছিলই; সঙ্গে ছিল দুটো পেল্লাই ট্রাঙ্ক আর মেহগিনি কাঠের কাজ করা বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না বসানো বিরাট একটা আলমারি। মায়ের সমস্ত বাসনপত্র এমনকি জামাকাপড়ও ট্রাঙ্কেই থাকত। কাঠের আলমারিটায় থাকত আমার আর বাবার যাবতীয় জামাকাপড় আর জিনিসপত্র। আলমারিটা দুটো ভাগে খুলে আলাদা করে ভাগ করা যেত। অতো বড় একটা আলমারি এই মর্ডান ফ্ল্যাটে ভীষণ বেমানান। আমি ছেয়েছিলাম বাকি সব জিনিসপত্রের সঙ্গে এটাও বিক্রি করে দিতে। একজন মারোয়াড়ী ভদ্রলোক ওটা কিনতে চেয়েছিলেন, ভালো দামও অফার করেছিলেন, কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের আলমারি মা হাতছাড়া করবে না…….. তার উপর অরণ্যও মায়ের কথায় সায় দিতে লাগল। কাজেকাজেই… জিনিসটা ঢোকাতে হল ফ্ল্যাটে।

সেদিনটার কথাও বেশ মনে আছে। শনিবার। আমার স্কুলে হাফছুটি। অরণ্যও তাড়াতাড়ি বাড়ি এসেছে। মা সন্ধ্যেবেলায় নিজের ঘরে বসে ট্রাঙ্ক গোচাচ্ছিল বোধহয়। অরণ্য গিয়ে হাজির হল মায়ের ঘরে। আমি টিভিতে নিউজ দেখছিলাম। রাতে শোবার সময় দেখি তেবিল ল্যাম্পের আলোয় অরণ্য কি-যেন একটা পড়ছে। অন্যদিন ল্যাপটপ নয়তো ট্যাব ঘাটাঘাটি করে। জিজ্ঞাসা করলাম,-

-কিই ওটা? এত মন দিয়ে পড়ছ?
অরণ্য দেখাল হাতে বাঁধাই করা একটা মোটা দিস্তা খাতা
-হুম, কিসের খাতা?

অরণ্য এবার খাতার প্রথম পাতাটা দেখাল; সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একটা নাম ‘অন্তঃসলিলা’। লেখাটা মায়ের হাতের। বললাম,-

-নামটা তো পড়লাম। তা কিই ওটা মায়ের হিসাব-পত্র।
অরণ্য বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল আমার মুখের দিকে। তারপর বলল,-
-হিসেব-পত্রই বটে। তুমি জানতে না মা লেখালেখি করে?
আমি আকাশ থেকে পড়লাম!
-কিই লিখেছে মা? কবিতা-টবিতা নাকি!
-নাহ; সম্ভবত উপন্যাস।
-উপন্যাস! পারিনা! মা এইট পাশের বিদ্যেতে আস্ত একটা উপন্যাস লিখে ফেলেছে! অ্যামেজিং! পড়ে দেখ বুড়ি হয়তো যাত্রাপালা লিখেছে। কিন্তু সেটাই বা লিখল কখন আমি তো কোনোদিন মাকে লিখতে দেখিনি।
-তুমি মা-কে কতটুকু চেন বলতো?
-নাহ তুমিই একমাত্র চেন। আমি তো বানের জলে ভেসে এসেছি কি-না!

অরণ্য আর কিছু বলল না। তবে এরপর বেশ কয়েকদিন ওই খাতাটাই ওর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে থাকল। অফিসেও ব্যাগে করে নিয়ে যেত খাতাটা। একদিন আমি নিজেই জিজ্ঞাসা করলাম,-

-মায়ের মেলোড্রামা পড়ে কেমন লাগল কেমন লাগল কিছু বললে না তো? অরণ্য বলল,-
-লেখাটা নিয়ে একটা বই বের করা যায় কি না সেটা চেষ্টা করে দেখব।
এবার আমার ভীষণ রাগ হল, বললাম,-

-আদিখ্যেতা করারও একটা সীমা আছে অরণ্য! একদম বাজে খরচা করবে না তুমি, বলে দিলাম। লোকে আজকাল ভালো ভালো লেখক-লেখিকাদের বইই পড়ে না তারপর আবার কোথাকার কে বই লিখেছে তার বই পড়বে! এইসব ভাবনা এখনই মন থেকে বের কর।

অরণ্য কোন উত্তর দিল না। কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হল না যে ও আমার কথায় খুব একটা কনভিন্সড হয়েছে। শেষপর্যন্ত মা-র লেখাটা বই আকারে বেরোল। বেশ বড় একটা পাবলিশার্স-ই ওটা বই করেছিল। খরচের কথা অরণ্য আমাকে কিছু বলেনি। আর আমিও ওকে ঘাঁটাই নি কারন তাতে ফালতু ঝগড়াই বাড়ত। অরণ্য যেদিন মায়ের হাতে বইটা এনে দিল মা সেদিন বইয়ের মলাটের উপর বারবার হাত বলাচ্ছিল। তার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা। তাকিয়ে দেখি অরণ্যরও চোখে জল। আমার কিন্তু শাশুড়ি- জামাইয়ের নাটকটা দেখতে বেশ মজাই লাগছিল।
আজ মায়ের সেই বইই অকাদেমি পুরস্কারের জন্য সিলেক্টেড-বেশ আশ্চর্যই হলাম।

মায়ের উপন্যাসটা এখনো পড়া হয়নি। তবে এবার পড়ে নিতে হবে। কয়েকদিন ধরে আমাকে বেশ কয়েকটা টি.ভি. চ্যানেলের অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছে; কারণ মা- যে আর সাক্ষাৎকার দেবার অবস্থায় নেই সেটা আর কারো অজানা নয়। আজই অনুষ্ঠান শেষে বেরবার সময় এক চ্যানেল কতৃপক্ষের অফিসে ডাক পেলাম। তারা মায়ের উপর একটা তথ্যচিত্র করতে চায়। সে জন্য একটা চেকও দিয়েছে আমার নামে। তারা আমদের বাড়িতে মাকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মুভি সুট করবে। ক্যাবে ফিরতে ফিরতে ব্যাপারটা অরণ্যকে জানাব ভাবছিলাম। কয়েকদিন ধরেই মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।

অরণ্য তাই যতটা পারে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি ফেরে। আজও নিশ্চই এতক্ষণ বাড়ি ফিরে গেছে। ভাবতে ভাবতেই দেখি আমার ফোনটা বেজে উঠল। অরণ্যের ফোন। সঙ্গে সঙ্গে ধরে বললাম,-

-জানো, মাকে নিয়ে একটা ডকুমেণ্টারি করার কথা বলেছে চ্যানেল থেকে। আমাদের বাড়িতে ওরা কালই আসবে। সব ঠিকঠাক করে রেখে যাবে। পরশু থেকে কয়েক দিনের জন্যে শুটিং হবে।। মায়ের কিছু শট নেবে ওরা। তুমি আবার বাগড়া দিয়ো না। আমি কিন্তু হ্যাঁ করে দিয়েছি। আর ওরা এজন্য একটা চেকও…
-তুমি কতক্ষণে বাড়ি আসছ? কতটা দূরে আছ?
-এই ধর মিনিট কুড়ি। কেন কিছু হয়েছে?
অরণ্যের গলাটা একটু কেপে গেল,-
-হুম! তাড়াতাড়ি এসো। মা আর নেই!

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত