বাঘের বউ

বাঘের বউ

‘খু লনা থেকে এক বেলার পথ জটিরামপুর। প্রথমে লঞ্চ‚ তারপর গয়নার নৌকো। তাও সে অনেক দিন আগের কথা। দেশ ভাগের পরে আর তো যাওয়া হয়নি দাদাবাবু। এখন কী অবস্থা‚ কে জানে। আমরা অবশ্য খুলনা হয়ে নয়। রায়মঙ্গলের জোয়ার–ভাটা ধরে মেরে দিতাম। বাঘের বউ ওই গাঁয়েই বাস করত কিনা। দেখাও হয়েছে বার কয়েক। বাড়ির দাওয়ায় বসে কেউ হত্যে দিয়ে পড়ে থাকলে যদি ইচ্ছে হত‚ বেরিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া দিতেন। ব্যস‚ আর চিন্তা ছিল না। বাদার যেখানে খুশি‚ যেমন খুশি চলে যাও ভাবতে হবে না।’
‘বাঘের বউ! তার মানে?’ নড়ে উঠলাম আমি।

‘কেউ কেউ অবশ্য জটিবুড়িও বলত তেনাকে। মাথা ভরতি বড় বড় জট ছিল কিনা। কোনও দিন কেউ তাঁকে চান করতে দেখেনি। সেকথা বললেই আঁতকে উঠতেন
‚ ‘বালাই ষাট‚ বাঘের বউ নিত্যদিন চান করবে কী!’

এই পর্যন্ত বলে হঠাৎই থামল রসুল মিয়া। মাথা নামিয়ে হাতের হুঁকোয় মন দিতে আমি খানিক গুছিয়ে বসে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম বুড়োর দিকে। বাউলে রসুল মিয়ার গল্প‚ সুন্দরবনের সেরা খলশে মধুর মতোই মিষ্টি। কিন্তু বুড়ো কখন যে মুখ খুলবে‚ বোঝা মুশকিল। বাউলের নৌকোয় সওয়ার গত কাল থেকে। কিন্তু মুখ খোলাতে পারা যায়নি। অথচ সুযোগ হলেই বাউলের নৌকোয় সওয়ার শুধু জঙ্গল দেখা নয়‚ ওই গল্পের খোঁজেও।

আমাদের নৌকো সেদিন দুপুরে রান্না খাওয়ার জন্য নোঙ্গর হয়েছে কালীরচরে। সুন্দরবনে এই কালীরচরের জুড়ি দুটি নেই। তিন দিকে বিশাল নদী। যেদিকে তাকাও শুধু জল আর জল। চোখ জুড়িয়ে যায়। তার উপর জায়গাটাকে সুন্দরবনের জংশনও বলা যায়। দক্ষিণে গোসাবা গাঙ ধরো‚ কেঁদো হয়ে সোজা পৌঁছে যাবে বঙ্গোপসাগরে‚ উত্তরে দত্তর গাঙ ধরলে বাসন্তী হয়ে একদম ক্যানিং। আর পূবে গাড়াল গাঙ ধরলে রায়মঙ্গল হয়ে বাংলাদেশ।

ওই প্রসঙ্গেই বুড়োকে শুধিয়েছিলাম
‚ ‘ওদিকে যাওনি চাচা?’

‘গিয়েছি বাপু জটিরামপুরে। বার কয়েক।’ এরপর সেই প্রসঙ্গেই মুখ খুলেছিল বুড়ো।

রসুল মিয়া একবার গল্প শুরু করলে বড়ো একটা থামে না। দরকারে একটু উসকে দিলেই যথেষ্ট। বুড়ো হাতের হুঁকোয় মন দিতে ছোট্ট করে বললাম‚ ‘বাঘের বউয়ের কথা তোমার কাছে তো আগে শুনিনি চাচা!’
‘শুনবেন কী দাদাবাবু। সে কী আজকের কথা। ওদেশের কথা তুললেন‚ তাই মনে পড়ে গেল।’ হুঁকো থেকে মুখ তুলে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ল বুড়ো। পাশে নামিয়ে রেখে বলল‚ ‘সেবার মহাজন সফদর সাহেবের নৌকোয় গোনা দ্বীপে কাঠ কাটতে যাব। বড্ড বাঘের উৎপাত ওদিকে। আমাদের নৌকোয় বাউলে ছিল জগন্নাথদা। রওনা হবার দিন কয়েক আগে বলল‚ চল রসুল। জটিরামপুরে বাঘের বউয়ের দোয়া নিয়ে আসি। হাজার হোক এতগুলো মানুষ। জঙ্গলে থাকতেও হবে বেশ কয়েকটা দিন।

‘বাঘের বউয়ের কথা সেই প্রথম শুনলাম। তা জগন্নাথদা সেবার দলের কাউকেই ছাড়েনি। প্রায় টেনে–হিঁচড়ে সবাইকে নৌকোয় তুলে রওনা হয়েছিল জটিরামপুরের দিকে। ভোরে রওনা হয়ে
‚ জোয়ার–ভাটা হিসেব করেও পৌঁছোতে রাত হয়ে গেল। জগন্নাথদা আগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিল‚ ভোরেই যাওয়া হবে বাঘের বউয়ের বাড়ি। বুড়ি ওই সময় নাকি বাইরে আসেন। শুধু তাই নয়
‚ তাড়াতাড়ি কাজটা মিটে গেলে সেই দণ্ডেই ফেরার পথ ধরা হবে।

‘দিনভর দাঁড় টেনে চারটি সেদ্ধ-ভাত পেটে দিয়ে সবাই প্রায় মড়ার মতোই ঘুমচ্ছিল। সমানে তাগাদা দিয়ে জগন্নাথদা যখন অন্যদের ঠেলে তুলেছে
‚ পশুপতি সবে আড়মোড়া ভাঙছে। মোষের মতো শরীর পশুপতির। সাহসও খুব। বাঘের বউয়ের কথা শুনে আসতেই চায়নি। জগন্নাথদা তবু প্রায় জোর করেই ধরে এনেছে। তাগাদার উত্তরে বলল‚ তোমরা এগোও জগন্নাথদা। আমি চোখে জল দিয়ে আসছি।

‘বাঘের বউয়ের বাড়ি এদিকে সবাই চেনে। অসুবিধা নেই। জগন্নাথদা ফের একবার তাকে তাগাদা দিয়ে আমাদের নিয়ে রওনা হয়ে পড়ল।
‘গ্রামের প্রান্তে ফাঁকায় বাঘের বউয়ের মাটির বাড়ি। চারদিকে অযত্নের ছাপ। চারপাশে পুরোনো ভ্যাপসা গন্ধ। পা দিলেই গা ছমছম করে ওঠে। সে যাই হোক
‚ গিয়ে দেখি বাঘের বউ তখন বারান্দায় বসে আছে। মাথা ভরতি বড় বড় জট। বয়স বোঝা দায়। চল্লিশও হতে পারে‚ আবার আশি হওয়ায় অসম্ভব নয়। পরনে আধময়লা হলুদ ডুরে শাড়ি। কপালে মেটে সিঁদুরের বড় টিপ। সিঁথিতেও অনেকটা সিঁদুর। আমরা গিয়ে দাওয়ায় মাথা ঠেকিয়ে নমস্কার করতে একে একে সবার মাথায় হাত ঠেকিয়ে দোয়া করলেন। শুধু জগন্নাথদার মাথায় অতিরিক্ত ফুঁ দিলেন দু’বার। গায়েও হাত বুলিয়ে দিলেন বার কয়েক। অনেকটা সময় ছিলেন আমাদের সঙ্গে। কিন্তু একটি কথাও বলেননি। সবাই উশখুশ করছিলাম পশুপতির জন্য। এরপর একসময় হঠাৎই উঠে পড়লেন তিনি। তখনও বারান্দা ছাড়েননি‚ হাজির হল পশুপতি। জগন্নাথদা তাড়াতাড়ি বলল‚ মাগো‚ আমাদের পশুপতিকে দোয়া করে যাও।
‘শুনে একবার পিছন ফিরে তাকালেন তিনি। এক পলক তাকিয়ে দেখলেন। তারপর ঘুরে চলে গেলেন ঘরের ভিতর। জগন্নাথ বার কয়েক ডাকল। সাড়া এল না। কিন্তু জগন্নাথ ছাড়বার পাত্র নয়। প্রায় হত্যে দেওয়ার মতো ডাকতে থাকল। খানিক ডাকার পরে ভিতর থেকে উত্তর এল‚ এবার তোমরা যাও বাছারা। আমার অন্য কাজ রয়েছে।

‘জগন্নাথদা চেষ্টার কসুর করেনি। সেদিন অনেকটা সময় হত্যে দিয়ে থাকা হল বাড়ির বারান্দায়। কিন্তু বাঘের বউ ঘর থেকে আর বের হলেন না। সেই দিন রাতের মধ্যেই গাঁয়ে ফেরার কথা। মহাজনের কাঠের নৌকো পরের দিনই বের হবে। কিন্তু জগন্নাথদা ঠিক করল‚ রাতটা জটিপুরেই থেকে যাবে। জানা ছিল
‚ বাঘের বউ সারাদিনে অন্তত সকালের দিকে একবার বারান্দায় এসে বসে। এছাড়া ঘর থেকে তেমন বের হয় না। রান্নাবান্নাও তাকে কোনও দিন করতে দেখা যায়নি। গ্রামের মানুষই পালা করে দুপুরে খাবার দিয়ে যায়। সেই খাবারও তিনি কখনো ফিরিয়ে দেন। খাবার নিয়ে গেলেই সেদিন জানিয়ে দেন‚ আজ আর খিদে নেই গো। অযথা নষ্ট হবে। নিয়ে যাও।

‘রাতটা থেকে যাওয়া হল বটে‚ কিন্তু উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল না। পরের দিন ভোরেই জগন্নাথদা পশুপতিকে নিয়ে হাজির হয়েছিল বাঘের বউয়ের বাড়ি। গিয়ে দেখে‚ ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। বাঘের বউ কোথাও গেছেন। এমন নাকি মাঝে–মধ্যেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কবে ফিরবেন‚ ঠিক থাকে না।

‘সেবার এই দেরির জন্য জগন্নাথদাকে কম কথা শুনতে হয়নি। মহাজন সফদর আলি কড়া মানুষ। তায় এসবে একেবারেই বিশ্বাস নেই। অযথা একটা দিন নষ্ট হবার জন্য জগন্নাথদার গায়ে শুধু হাত তুলতে বাকি রেখেছিলেন। তা কী আর করা যাবে। বাদায় মহাজন মানুষ বলে কথা! মাথা নিচু করে সারাটা সময় দাঁড়িয়ে ছিল জগন্নাথদা। মহাজন কিছু ঠাণ্ডা হলে শুধু বলেছিল‚ ভাববেন না চাচা‚ একটা দিন লোকসান হলেও কথা দিচ্ছি‚ পুষিয়ে দেব।

‘তা জগন্নাথদার কথা রেখেছিলাম। মেয়াদ শেষ হবার দু’দিন আগেই আপ্রাণ খেটে মহাজনের কোটার কাঠ তুলে দিয়েছিলাম সেবার। কিন্তু তারপরে যা ঘটেছিল‚ ভাবতে গেলে…।’

বলতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল বুড়ো। সামান্য দম নিয়ে বলল‚ ‘সেকথা পরে হবে দাদাবাবু। বরং বাঘের বউয়ের কথাই আগে বলি। সেই প্রথম বারের পর বাঘের বউয়ের ব্যাপারটা মাথা থেকে আর ঝেড়ে ফেলা যায়নি। বরং কৌতূহল আরও বেড়েছিল। জগন্নাথদাকে একদিন শুধিয়েছিলাম‚ দাদা উনি কী সত্যিই বাঘের বউ? তাই ওনার দোয়া পেলে বাঘ তার কোনও ক্ষতি করে না?

‘উত্তরে জগন্নাথদা শুধু বলেছিল
‚ সেসব জেনে কী দরকার রসুল? অনেকে অনেক কথা বলে। জটিপুরে খোঁজ নিলেই জানতে পারবি। কেউ মানে‚ কেউ মানে না। কিন্তু দরকারে বাদার জঙ্গলে যাবার আগে সবাই ছুটে যায় বাঘের বউয়ের কাছে। জানে‚ বাঘের বউয়ের দোয়া পেলে…।

‘সে তো নিজের চোখেই দেখলাম জগন্নাথদা। বাধা দিয়ে মাঝপথে বললাম
‚ কিন্তু সত্যিই কী কোনও মানুষ বাঘের বউ হতে পারে! সে তো রূপকথা‚ হুরি–পরিদের গল্পে পাওয়া যায়।

‘কিন্তু জগন্নাথদা আর ভাঙেননি কিছু। তবে মাথায় ছিলই ব্যাপারটা। জটিরামপুর অনেকটা পথ। সবসময় যাওয়া সম্ভব হত না। কিন্তু বাদা–জঙ্গলে বেশি দিনের কাজ থাকলে বাঘের বউয়ের দোয়া নিতে যেতাম। জগন্নাথদা ছাড়া অন্যদের নিয়েও বেশ কয়েকবার গেছি। এক একদিন বুড়িকে বেজায় খোশমেজাজেও দেখা যেত। অনেকটা সময় সমানে গল্প করে যেতেন। একদিন হঠাৎই বলে ফেলেছিলাম
‚ বুড়িমা‚ সবাই তোমায় বাঘের বউ বলে কেন?

‘ও মা! অবাক হয়ে উনি বললেন‚ আমি তো বাঘেরই বউ রে। বলবে না?

‘বাঘের বউয়ের মন সেদিন খুব ভাল ছিল নিশ্চয়। একে একে নিজেই বলে গিয়েছিলেন অনেক কথা। কিছুই জিজ্ঞাসা করতে হয়নি। কতদিন আগের কথা‚ বাঘের বউ বলতে পারেনি। তবে তখন তাঁর বয়স এক কুড়ির বেশি নয়। বাড়ির একমাত্র মেয়ে। তায় আবার গায়ের রং টুকটুকে ফরসা। বাবা—মা তাই আদর করেই নাম রেখেছিল গোলাপি। দেশ–গ্রাম
‚ মেয়ে বড় হতেই বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করল। বাবা–মায়েরও ইচ্ছে তাই। কিন্তু গোলাপি বিয়ের নামে খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। বাড়িতে ধর্মঠাকুরের পাট। ধুমধাম করে গাজন উৎসব হয় চত্তির মাসে। মেয়ে সেই ঠাকুরের পাট নিয়ে সারা বছর পড়ে থাকে। পুজো দেয়। কেমন খ্যাপাটে স্বভাব। বাবা–মা তাই আর বিয়ের জন্য জোর করেনি। তার মধ্যেই ঘটে গেল এক ব্যাপার।

‘সেবার বাড়িতে চত্তির সংক্রান্তির গাজন উৎসব চলছে। গোলাপি দিন শেষে নদীর ঘাটে একাই নাইতে গিয়েছিল। নদীর ঘটে গোলাপি এমন হামেশাই নাইতে যায়। কেউ গা করেনি। তখন শেষ বিকেল। নির্জন নদীর ঘাটে অন্য কোনও জনমানুষ নেই। এমন আগেও হয়েছে। নির্ভাবনায় ঘাটে বসে চান করছিল গোলাপি। হঠাৎ বাতাসে এক ঝলক বোটকা গন্ধে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে অদূরে থাবা গেড়ে বসে বিরাট এক কেঁদো বাঘ। জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জটিরামপুর গ্রাম বাদার বেশি দূরে নয়। তবু গ্রামে বাঘ ঢুকেছে‚ কোনও দিন শোনা যায়নি। চোখের সামনে ওই ভয়ানক দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব নয়। গোলাপিও পারেনি। তবু চেষ্টা করেছিল
‚ ছুটে পালাবার। তৎক্ষণাৎ গাঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল সেই বাঘটাও। তারপর আর কিছুই মনে নেই তার।

‘গোলাপির জ্ঞান যখন ফিরল

‚ চারপাশে দিনের আলো। ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে যা দেখল‚ মাথাটা বোঁ করে ঘুরে উঠল ফের। ঘন বনের ভিতর এক ভাঙা ইটের স্তূপ। চারপাশে ছড়ানো কত কালের নোনাধরা পুরোনো ইট। তার মাঝে শুয়ে ছিল এতক্ষণ। পাশেই থাবা ছড়িয়ে শুয়ে রয়েছে সেই বাঘ। উঠে বসতেই বাঘটা চোখ মেলে তাকাল। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে গোলাপির মনে হল‚ বাঘটা বোধ হয় ওকে মেরে খাবে না। তেমন হলে এতটা সময় বাঁচিয়ে রাখত না। গোলাপি যখন এসব ভাবছে‚ বাঘটা মানুষের গলায় কথা বলে উঠল‚ ও বউ‚ মিছে ভয় পেয়ো না।

‘বউ! কার বউ? আমি তো বিয়েই করিনি। অবাক হয়ে গোলাপি বলল।
‘আমার বউ গো তুমি। আমার বউ। কাল রাতে বড়িতে তুলে এনে বিয়ে করেছি তোমাকে।

‘খবদ্দার! ওকথা বললে বাবা ধম্মঠাকুর তোমার মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলবেন।
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল গোলাপি‚ আমি বাবার পায়ে জীবন সঁপে দিয়ে ঠিক করেছি কোনও দিন বিয়ে করব না। বাবার সেবায় কাটিয়ে দেব। কাল চত্তির সংক্রান্তির দিনে বাবার পারণ সেরে ঘাটে নাইতে এসেছি‚ আর তুলে এনেছ আমাকে! শিগগির রেখে এস সেখানে।
বাঘকে মানুষের গলায় কথা বলতে শুনে গোলাপির ভয় তখন কেটে গেছে।

‘সেই কথায় বাঘটা কিছুমাত্র না দমে বলল‚ আমি কিন্তু ধর্মঠাকুরের অনুমতি নিয়েই তোমাকে বিয়ে করেছি বউ।

‘ধম্মঠাকুরের অনুমতি!

‘হ্যাঁগো বউ। ধর্মঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়ে লাউসেনের সেনাপতি কালুরায় যখন সুন্দরবন জয় করতে এসেছিলেন‚ একদিন বাঘের হাতে তাঁর প্রাণ যাবার উপক্রম। ঠাকুরের আদেশে তাঁকে রক্ষা করেছিলাম। সেই থেকে তিনি আমার কোনও আকাঙ্ক্ষাই অপূর্ণ রাখেন না। এই যে ভাঙা বাড়ি‚ বিশাল রাজপ্রাসাদ ছিল একসময়। লাউসেনের আদেশে স্বয়ং কালুরায় তৈরি করেছিলেন। কিছুদিন কাটিয়েও গেছেন এখানে। সেই থেকে আমি এই বাড়ির প্রহরী। লাউসেন‚ কালুরায় কেউ আর বেঁচে নেই। দেখতেই পারছ‚ সেই রাজপ্রাসাদও আজ নেই। তবু ধর্মঠাকুরের নির্দেশে আজও সেই ভাঙা প্রাসাদ পাহারা দিয়ে চলেছি। এই দিনে ধর্মঠাকুরের সঙ্গে দেবী মুক্তির বিয়ে হয়েছিল। শিবের বিয়ে হয়েছিল‚ দেবী হরকালীর সঙ্গে। আমার অন্যায় কোথায়?

‘ধর্মমঙ্গলের পাঁচালি গোলাপির কণ্ঠস্থ। লাউসেন‚ কালুরায়‚ দেবী হরকালীর কথা‚ কিছুই অজানা নয়। বাঘের কথা তাই আর অবিশ্বাস করতে পারল না। কিন্তু এই জঙ্গলের ভিতর বাঘের বউ হয়ে থাকতে হবে‚ ভেবে কান্না পেতে লাগল। ঠিক করে ফেলল‚ যেমন করে হোক‚ এখান থেকে পালিয়ে যাবে একদিন।

‘কী আশ্চর্য! বাঘ তার মনের কথা টের পেয়ে বলল‚ ও বউ‚ ধর্মঠাকুরের সম্মতি নিয়েই তোমাকে বিয়ে করেছি আমি। তুমি ইচ্ছে করলেও আর আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।

‘বাঘ বললেও গোলাপি তার মতলব ছাড়েনি। একদিন সুযোগও এসে গেল। বাঘ তখন খাবারের খোঁজে বের হয়েছে। কাছে অন্য কেউ নেই। সুযোগ পেয়ে গোলাপি ছুটতে সুরু করল। খানিক ছুটে আসার পরেই সামনে এক নদী। গোলাপি ঝাঁপ দিতে যাবে‚ জলের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। জলে মানুষ কোথায়‚ এক বাঘিনীর প্রতিচ্ছায়া! বাঘের ইচ্ছে পূরণে ধর্মঠাকুর কখন যে তাকে বাঘিনী করে দিয়েছেন
‚ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। এই অবস্থায় কী আর গ্রামে বাবা–মায়ের কাছে ফিরে যাওয়া যায়? মনের কষ্ট মনে চেপে গোলাপি ফের সেই বাঘের আস্তানায় ফিরে এল।

‘এভাবে একে একে কেটে গেল বিশ
‚ বিশটা বর্ষা। মানে কিনা কুড়িটা বছর। একদিন বাঘ বলল‚ বউ আমি জানি‚ তোর মনের কষ্ট রয়েই গেছে। তাই ঠিক করেছি তোকে ফের বাপের বাড়িতেই রেখে আসব।

‘বাঘের কথায় গোলাপি একটুও খুশি হল না। ফুঁসে উঠল‚ এতদিন বাদে হুঁশ হল বাবুর! তারা কী আর বেঁচে আছে! বলতে বলতে দু’চোখে জল গড়াল গোলাপির। তারপর চোখ মুছে বলল‚ আর যদি বেঁচে থাকেও‚ আমার এই রূপ দেখলে তো ভয়েই মরে যাবে।

‘বাঘ সান্ত্বনা দিয়ে বলল‚ ভাবিসনে বউ। তুই যখন চাইছিস‚ সবাইকে সেই আগের অবস্থাতেই দেখতে পাবি। তুইও মানুষের রূপ ফিরে পাবি। তবে…।

‘বাঘ আরও কী বলতে যাচ্ছিল। গোলাপি খুশিতে কলকলিয়ে উঠল‚ তাহলে আমাকে এখনি মানুষ করে দাও। গ্রামে গিয়ে সবাইকে যেন আগের মতোই দেখতে পাই।

‘তো তাই হল। বাঘ সেই দিনই তাকে পিঠে করে অনেক নদী সাঁতরে সেই জটিরামপুরের ঘাটে নামিয়ে দিয়ে গেল
‚ তখন শেষ বিকেল। বাড়ি এসে গোলাপি দেখল‚ সেই আগের মতোই বাড়িতে চোত সংক্রান্তির গাজন উৎসব শেষে গোছগাছ চলছে। গোলাপি ছুটে গিয়ে খুশিতে মাকে জড়িয়ে ধরেছে‚ মা চমকে উঠে বলল
‚ মাগো‚ নাইতে গিয়েছিলি‚ গায়ে এত গন্ধ কেন রে? এই পুজোর দিনে কোন আস্তাকুঁড় ঘেঁটে এলি!

‘বাঘের গায়ের গন্ধ মা! মাকে জড়িয়ে ধরেই গোলাপি বলল‚ বাঘের বউ যে আমি। কুড়ি বছর বাঘের ঘর করে এলাম!

‘গোলাপির কথায় গোড়ায় সবার মনে হয়েছিল‚ বুঝি মাথার ঠিক নেই মেয়েটার। এই একটু আগে যে ঘাটে নাইতে গিয়েছিল
‚ সে কিনা কুড়ি বছর বাঘের ঘর করে এসেছে! কিন্তু ক্রমে রহস্য আরও ঘন হয়েছিল‚ সমাধান হয়নি।’

হাঁ করে গল্প গিলছিলাম। লোককথা দিয়ে শুরু হলেও গল্পের শেষটা প্রায় আধুনিক কল্পবিজ্ঞান বা সাইন্স ফিকশনকেও যেন হার মানায়। রসুল মিয়া থামতেই বললাম‚ ‘একটা কথা চাচা। গাজন উৎসবের দিনে ভাঙ বা সিদ্ধি খাওয়ার চল রয়েছে জানি। বাঘের বউ‚ কুড়ি বছর পরে ফিরে আসা‚ এসব অলীক ব্যাপার সেই সিদ্ধির ঘোরেও তো হতে পারে?’

‘হতেই পারে দাদাবাবু।’ রসুল মিয়া হাতের হুঁকোয় ফের গোটা কয়েক টান দিয়ে বলল‚ ‘অন্যদের সঙ্গে গোলাপিও সেদিন হয়তো সিদ্ধি খেয়েছিল। গোলাপির গায়ের সেই উৎকট গন্ধও পরের দিকে অনেকটাই কমে গিয়েছিল‚ যদিও বিশেষ চান করতে চাইতো না। তবু অনেক কিছুরই কোনও সমাধান হয়নি।’

‘কী?’ নড়ে উঠে বললাম।

‘যেমন‚ বাড়িতে গোলাপির পোষা দুটো কুকুর আর বেড়াল ছিল। সব সময় পাশে পাশে থাকত। সেই দিনের পরে তারা আর বাড়ির ধারেকাছে মাড়ায়নি। গ্রামের অন্য বাড়ির দোর গোড়ায় খাবারের জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত‚ তবু মনিবের বাড়িতে নয়। ওর বাবা–মাও এরপর কেমন হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বেশিদিন বাঁচেওনি তারপর। শুধু তাই নয়
‚ এরপর ওদের প্রতিবেশী যারা ছিল‚ সবাই একে একে ঘর ভেঙে অন্য পাড়ায় চলে যেতে শুরু করল। তাই দেখে গ্রামের সবাই ব্যবস্থা করে বাঘের বউয়ের জন্য গ্রামের প্রান্তে প্রায় ফাঁকায় নতুন একটা ঘর করে দেয়। বাঘের বউও নতুন বাড়িতে যেতে আপত্তি করেনি। বাঘের বউয়ের সেই বাড়িতেই আমরা বার কয়েক গেছি। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে কোনও দিন গ্রামের কোনও কুকুর বিড়াল তো দূরের কথা‚ একটা পাখ–পাখালিও দেখিনি।’

রসুল মিয়ার কথায় এবার হেসে ফেললাম আমি। অবশ্য মুখে কিছুই বলিনি। কিন্তু বুড়ো আমার মনোভাব টের পেয়ে বলল‚ ‘সে আপনি যাই ভাবেন দাদাবাবু। বাদাবনে বাউলের কাজ কিন্তু শুধু মন্ত্রে হয় না। অন্য অনেক দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। তারমধ্যে ওটাও একটা লক্ষণ। বাদার বেশিরভাগ গ্রামের লাগোয়া নদীর ওপারে জঙ্গল। সামশেরনগরের মতো এমন গ্রামও আছে‚ মাঝে সরু এক খাল। ভাটায় এক ফোঁটা জল থাকে না। থকথকে কাদা। গ্রামের বেশিরভাগ গেরস্তেরই পোষা কুকুর আছে। আধ মাইল দূরে গ্রামে বাঘ ঢুকলেও ঠিক টের পেয়ে যায়। ভিতু কুকুর হলে এক লাফে ঘরে তক্তপোষের তলায় ঢুকে কুঁই–কুঁই জুড়ে দেবে। আর তেমন তেজিয়ান হলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। তাই দেখে হুঁশিয়ার হয়ে যায় মানুষ। এবার বলি‚ বাদাবনে এতবার তো এলেন। মাছ শিকারি পাখি ছাড়া অন্য কোনও পাখি‚ যেমন‚ কাক‚ শালিক‚ দোয়েল
‚ ফিঙে‚ এসব তেমন দেখেছেন? অথচ এত গাছপালা‚ ফলপাকুড়‚ পোকামাকড়। খাবারের তো অভাব নেই।’

বুড়োর কথায় ঘাড় নাড়তেই হল। একদম সত্যি‚ গ্রাম বাঙলার সাধারণ পাখি সুন্দরবনে প্রায় দেখাই যায় না। শোনা যায়‚ বাদাবনের নরখাদক বাঘে বেজায় ভয় এসব পাখির। তাই দূরে থাকে। নিঃশব্দে সেই কথাই ভাবছিলাম। হঠাৎ আবদুলের তাগাদা‚ ‘চাচা‚ রান্না হয়ে গেছে। এবার খেতে বসতে পারো সবাই।’

আবদুল বেজায় বেরসিক মানুষ। এখন গল্প থামিয়ে খেতে বলা মানে‚ গল্পের বাকি অংশ মাঠে মারা যাবার উপক্রম। তাড়াতাড়ি বললাম‚ ‘গল্প কিন্তু এখনো শেষ হয়নি চাচা। অযথা অন্য কথা হল।’

হাতের হুঁকোয় শেষ টান দিয়ে রসুল মিয়া বলল‚ ‘এ গল্পের আর তো কিছু বাকি নেই দাদাবাবু! আমি বাইরের মানুষ‚ ছেড়ে দাও।

জটিরামপুর গ্রামের মানুষও কেউ সমাধান করতে পারেনি। তবে গ্রামে বাঘের বউয়ের খাতির যত্ন যে ছিল‚ সে তো নিজের চোখেই দেখেছি। দূর দূর থেকে মানুষ আসত। গ্রামের তাই নামডাকও ছড়িয়েছিল। দেশ ভাগের পরে আমি অবশ্য আর যাইনি। আবদুল‚ দাদাবাবুর খাবার লাগিয়ে দে এবার।’

‘বা রে!’ আমি তাড়াতাড়ি বললাম
‚ ‘যে গল্প দিয়ে শুরু করেছিলে‚ তার কী হল?

মহাজন সফদর আলির নৌকোয় কাঠ কাটতে যাওয়ার গল্প।’

‘ওহ‚ তাইতো!’ রসুল মিয়া বলল‚ ‘তবে সে এমন লম্বা কিছু ব্যাপার নয় দাদাবাবু। আগেই বলেছি‚ কোটার কাঠ আমরা দু’দিন আগেই নৌকোয় বোঝাই করে দিয়েছিলাম। কিন্তু মহাজনের সাধ হল
‚ দিন যখন আছে‚ নৌকোতেও যখন কিছু জায়গা আছে‚ আরও কিছু কাঠ কেটে তুলে নেওয়া হোক।

‘লম্বা–চওড়া মস্ত মহাজনী নৌকো। কাঠের পারমিট বন্ধ হয়ে যেতে সেসব নৌকো আজকাল আর দেখা যায় না। বিশাল নৌকোর পিছন দিকে থাকত কর্মচারীদের জন্য মজবুত ছোট এক ঘর। সামনে ফাঁকা জায়গায় দরজার দু’পাশে কাঠ সাজানো হতো। দরজা দিয়ে বেরিয়ে উবু হয়ে চলার মতো উঁচু হলেই মাথার উপরেও কাঠ চাপিয়ে দেওয়া হত। ঘর থেকে বেরিয়ে তখন সেই সুড়ঙ্গ পথ ধরে আসতে হত বাইরে। পিছন দিকটা খালিই থাকত অবশ্য। তা মহাজন নির্দেশ করল‚ ওই পিছন দিকেও যতটা সম্ভব কাঠ বোঝাই করা হোক।

‘ব্যাপারটা ঘটল সেই দিনই। ভোরে ছোট ডিঙি নৌকোয় কাঠ কাটতে বেরিয়েছিলাম। জঙ্গলে নৌকো ভিড়িয়ে প্রথমে নামার কথা বাউলের। সেইমতো নৌকো থেকে লাফিয়ে নেমে জগন্নাথদা মাটিতে হাত রেখে বাঘবন্দি মন্ত্র পড়ে নামতে বলল সবাইকে। কুড়ুল
‚ দড়িদড়া হাতে একে একে নেমে এগিয়ে চললাম সবাই। দলের আগে কুড়ুল হাতে জগন্নাথদা। সবার পিছনে কুড়ুল হাতে আমি। চারপাশে নজর রেখে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ মনে হল‚ পাশে হেঁতালঝোপ থেকে হলদে হয়ে যাওয়া একটা পাতা ছিটকে উঠল। আমার খানিক আগে পশুপতি। লম্বাচওড়া জোয়ান মানুষ। গাঁয়ের পথে একবার খেপে যাওয়া এক তাগড়াই দামড়া গরু তাকে গুঁতিয়ে ফেলতে পারেনি। সুযোগ পেলেই যে পশুপতি সেই গল্প শোনায়। সেই মানুষ নিমেষে উপুড় হয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। পর মুহূর্তেই দেখি সামনে বিশাল এক বাঘ তার উপর দাঁড়িয়ে ঘাড়ের কাছে কামড়ে ধরেছে। ওই দৃশ্য দেখে শরীরটা গোড়ায় প্রায় অসাড় হয়ে গিয়েছিল। কোনওমতে শুধু বলতে পেরেছিলাম‚ ‘জ–জগন্নাথদা।’ তারপরেই ছুটে গিয়ে কুড়ুলের এক কোপ বসিয়ে দিয়েছিলাম শয়তানটার পিঠে। তখন বয়স কম‚ অভিজ্ঞতাও কম। সেই কোপ প্রাণীটার ঢলঢলে চামড়ায় পড়ে পদ্মপাতায় জলের মতো পিছলে গিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে ছুটে এসেছে জগন্নাথদা। ফের কুড়ুল তুলে কোপ বসাতে যাব‚ হেঁকে উঠল‚ সরে যা রসুল। হারামজাদার কত তেজ একবার দেখি।
বলতে বলতে জগন্নাথদা মুহূর্তে বাঘটার মাথায় মস্ত এক কোপ বসিয়ে দিল।

‘সেই কোপে বাঘের মাথার খুলি দু’ফাঁক হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। তবে প্রাণীটা পশুপতিকে ছেড়ে দিয়ে মস্ত এক লাফে জঙ্গলের আড়ালে চলে গেল। আর দেখা গেল না।

‘পশুপতি ইতিমধ্যে উঠে বসেছে। পিঠে ঘাড়ের কাছে দাঁতের হালকা দাগ ছাড়া অন্য কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। জুতমতো কামড়ে ধরার সুযোগ পায়নি শয়তানটা। তেমন হলে এত সহজে আর উঠে বসতে হত না তাকে।

‘যাই হোক‚ জঙ্গল থেকে লতাপাতা জোগাড় করে পশুপতির ক্ষতয় লাগিয়ে দেওয়া হল। কাজ বন্ধ করে ফিরে যাওয়া হল নৌকোয়। সবাই ভেবেছিলাম‚ এই অবস্থায় মহাজন সেই দিনই নৌকো ছাড়তে বলবে। পশুপতির আঘাত গুরুতর নয় বটে‚ তবে বাঘের লালায় বিষ থাকে। ক্ষতস্থান বিষিয়ে উঠতে পারে। ভাল চিকিৎসা দরকার। কিন্তু সফদর আলি রাজি হলেন না। আরও একটা দিন যখন বাকি আছে‚ নষ্ট করতে রাজি নন।

‘জগন্নাথদা বোঝাবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু কান দেননি তিনি। অগত্যা পরের দিন বেরোতেই হল কাঠের জন্য। পশুপতিকে অবশ্য নেওয়া হয়নি। মহাজন সফদর আলির সঙ্গে তাকেও রেখে যাওয়া হয়েছিল নৌকোয়। জগন্নাথদা দু’জনকেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল‚ কেউ কোনও অবস্থাতেই যেন ঘরের বাইরে বের না হয়। এমনকী অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে নৌকোর সামনের দিকে কাঠ সাজিয়ে তৈরি সেই সুড়ঙ্গের মুখে অনেকগুলো কাঠের গুঁড়ি সাজিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

‘সাবধানে কাজ করার দরুণ সেদিন সময় একটু বেশিই লাগল। দুপুরের মধ্যে ডিঙি নৌকো কাঠে ভরতি হয়ে যায়‚ আজ বিকেল হয়ে গেল। বড় নৌকোয় ফিরতে
আরও প্রায় ঘণ্টা খানেক। কাছে এসে সবাই তো হতভম্ব হবার জোগাড়। সুড়ঙ্গের মুখে সাজিয়ে রাখা কাঠ লণ্ডভণ্ড হয়ে রয়েছে! জগন্নাথদা ডিঙি থামিয়ে দূর থেকে পশুপতি আর মহাজনকে বার কয়েক ডাকল। কিন্তু ওদিক থেকে কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। মাঝ নদীতে নোঙর ফেলা কাঠ বোঝাই নৌকো নিস্তব্ধ। শুধু জল আছড়ে পড়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। বাতাসের সোঁ–সোঁ আওয়াজ।’

রসুল মিয়া থামল। আমার মুখে কথা নেই। হাঁ করে তাকিয়ে আছি। বুড়ো সামান্য দম নিয়ে বলল‚ ‘বেলা পড়ে আসছিল। হুঁশিয়ার জগন্নাথদা আমাদের নিয়ে সেই রাতে আর নৌকোয় ওঠেনি। সারারাত শুধু নজর রেখে গেছে। শেষে যখন বোঝা গেল নৌকোয় জীবিত প্রাণী কেউ নেই‚ পরদিন সকালে ওঠা হল নৌকোয়। কাঠের সুড়ঙ্গের সেই পথে শুধু চাপ চাপ রক্তের দাগ। নৌকোর কুঠুরির দুই দিকের দরজাই খোলা।’

‘বাঘ নৌকোয় উঠে দু’জনকেই তুলে নিয়ে গেছে!’ অবাক হয়ে বললাম আমি।

‘তাই যদি হয়‚’ অল্প দম নিয়ে রসুল মিয়া বলল‚ ‘তাহলে একসাথে জোড়া বাঘ উঠেছিল নৌকোয়। কিন্তু তেমন কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে আর একটা সম্ভাবনাই বাকি থাকে। আগের দিনের বাঘটা পশুপতিকে লক্ষ করেই নৌকায় উঠেছিল। বাদার বাঘের শিকার একবার নির্দিষ্ট হয়ে গেলে ওরা বড়ো একটা আর শিকার বদলায় না। বাঘ কোনও উপায়ে নৌকার সামনের দিকে উঠে সুড়ঙ্গের মুখের কাঠ যখন সরাতে সুরু করে তখনই নৌকোর দুই আরোহী টের পেয়েছিল ব্যাপারটা। পশুপতি সাহসী মানুষ হলেও আহত। তায় আগের দিনের ওই ঘটনায় ঘাবড়ে গিয়েছিল অবশ্যই। তাই কোনও ব্যবস্থা হয়তো নিতে পারেনি। হয়তো ভীত অনভিজ্ঞ সফদর আলিও তাকে কিছু ব্যবস্থা নিতে দেয়নি। তারপর বাঘটা সুড়ঙ্গে ঢুকে যখন কুঠুরির দরজা আঁচড়ে ভেঙে ফেলার উপক্রম করেছে‚ ভীষণ ভয় পেয়ে সফদর আলি পিছনের দরজা খুলে লাফ দিয়েছিল জলে। তারপর নৌকোয় পশুপতি যখন বাঘের মুখে‚ মহাজন সফদর আলির জন্যও বরাদ্দ হয়ে গিয়েছিল কুমিরের পেট। কদিন ধরে মস্ত এক কুমিরকে মাঝেমধ্যে নৌকোর কাছে জলে ভেসে থাকতে দেখা গেছে। সম্ভবত কাছেই আস্তানা। সে যাই হোক‚ জলজ্যান্ত দু’দুটো মানুষের সন্ধান আর মেলেনি।’

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত