একটা হাতের ধাক্কা, তারপর ঠান্ডা সবুজ জলরাশির ভেতর তলিয়ে যেতে যেতে দম বন্ধ হয়ে যাবার একেবারে শেষ মুহূর্তে ঘুম ভেঙে গেল মুকুলের। এত জীবন্ত স্বপ্ন গত তিন মাসে একবারও দেখেনি সে। দেখলে ঘুমোতে পারতো কি? ঘুম এখনও লেগে আছে চোখের কোণে। প্রথমইে মোবাইল খুঁজলো বালিশের চারপাশে। এই যা! ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। মুকুলের যেন সত্যি নিঃশ্বাস আটকে যাবার দশা হলো এবার। উঠে তড়িঘড়ি করে দ্রুত ফোনটা চার্জ দিলো। আর তখুনি ধাক্কা খেল দেয়ালের কোণায় রাখা সাইড টেবিলে। একটুর জন্য মেঝেতে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল ও। এই ভয়টিই তাড়া করে মুকুলকে সর্বক্ষণ। এই বুঝি পড়ে গেল!
সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে নাকি আকাশে মেঘ- বোঝা যাচ্ছে না। ভ্যাঁপসা গরম যা তাতে বৃষ্টি হলেই সুবিধা। বিকেলের দিকে ঘুমোলে সেই ছোটবেলা থেকে মুকুলের কেমন খালি খালি লাগে। তার ওপর অমন স্বপ্ন মুকুলের কেবল মনে হলো স্বপ্নে দেখা নদীটিকে ও চেনে। সবুজ সবুজ তার দু’ধারে বুঝি ও আগেও একবার গিয়েছিল। আবছা ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া স্মৃতির পাতা ওল্টাতে গিয়েও হোঁচট খেল। মনে পড়ছে না কিছু। মুকুলের জোড় খিদে পেল। এই খিদে পাওয়া দেখে মনে মনে সাহস পেল ও। তার মানে সত্যি ও বাঁচতে চায়। শক্তি পেতে চায় ওর শরীর। এই বোধটুকু ফিরে পেতে সবটুকু কৃতিত্ব যার সে হলো মিলি হোসেন। মুকুলের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের রুমমেট। একটি ইংরেজি পত্রিকায় কাজ করে পাশাপাশি মডেল। শহরে একনামে পরিচিত। বাবা-মা-ভাই সবাই বলতে গেলে প্রবাসী। নিকুঞ্জের এই ফ্ল্যাট, এই উন্মুক্ত জীবন সবটাই মিলি হোসেনের নিজস্ব উপার্জন। মুকুলের এই অতল অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে মিলিই তো হাত ধরে তাকে টেনে তুলেছে।
আজ পনেরো দিন হলো মিলির এখানে উঠেছে ও। এর আগে জীবন্ত ফসিল হয়ে যাচ্ছিল যেন। কিন্তু এনাম, এনাম এখন কোথায়? কী অবস্থায় আছে? কারা এই কাজ করতে পারে? মুকুলের গলা দিয়ে জলটুকু নেমে যেতে কি নিদারুন যন্ত্রণা! রেফ্রিজারেটরে খাবার রাখা আছে। গরম করে খেয়ে নিলেই হলো। কিন্তু তাতেও যেন এক অসম লড়াই মুকুলের। আজ তবু খিদে পেয়েছে। খাবারের বক্স একটা ওভেনে দিতেই মিলি এসে হাজির। সেই চিরচেনা তুমুল কলরবে ওর ঘরে ফেরা। যেন বাঁশবনে একসাথে হাজার পাখি ঘরে ফিরল। ওভেনে খাবার গরম হতে দেখেই মিলির মুখে দিগ্বিজয়ী হাসি দিয়ে বলল, গাল তো ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলেছিস। এবার খেয়ে-দেয়ে ফুলিয়ে অফিসে জয়েন কর।
মুকুল মলিন হাসলো। কিছু বলল না। মিলি ঝটপট ব্যাগ থেকে প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট বের করলো দু’টো। তারপর মুকুলের দিকে ফিরে বলল, একটা তোর, একটা আমার। বুঝলি তোকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে আমিও প্রেগন্যান্ট। তোকে বলতে তো কিছু বাকি নেই। গতমাসে জাফর আর আমি পাড় মাতাল ছিলাম। এমনিতে জাফরের ব্যাগে কনডম থাকে। সেদিন আমিই খুব এগ্রেসিভ ছিলাম বুঝলি। এখন দেখি সকালে কার পজিটিভ আসে- তোর না আমার।
মুকুল অবিশ্বাস্য গলায় বলল, কেন? আমার পজেটিভ হবে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ তোর?
সিগারেট ধরাতে ধরাতে মিলি বলে উঠলো নির্বিকার ভঙ্গিতে- এনাম ভাই মিসিং হবার কতদিন আগে তোরা শুয়েছিলি, আই মিন হ্যাভিং সেক্স?
মুকুল জানে মিলির স্বভাব এ রকমই। তাছাড়া এটা প্রয়োজনীয় আলোচনা। তাই খুটিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো ও; ঠিক কবে ওরা শেষ… না, মনে করতে পারছে না। তাছাড়া অনেকদিন থেকেই তো ওদের বাচ্চা নেবার পরিকল্পনা চলছিল। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় এসে দেখলো কি নিঃসঙ্গ জীবন ওদের। দুজনেই কর্মজীবি। এনামের চাকরিটাই এমন, ঘরে ফেরার ঠিক-ঠিকানা ছিল না। পত্রিকা অফিস, তার ওপর সারাক্ষণ ল্যাপটপে মুখ গুঁজে থাকতে থাকতে এনামের ইরেকশনই হতো না প্রায়। ডক্টর দেখিয়ে জানা গেল বাচ্চা নেয়া সহজ কোনো কম্য নয় মোটেই। সবকিছু মানিয়ে নিয়েছিল দাম্পত্য জীবনে মুকুল। বাচ্চা নেবে বলে নিজে সময় বের করে জিমে যাওয়াও শুরু করেছিল। সুইট ড্রিমে গিয়ে পছন্দ করে নাইটি, ব্রা, প্যান্টি কিনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল যখন আবার পুনরায়, ঠিক তখনই তো এনাম উধাও হয়ে গেল।
পরদিন মিলির বিলাসবহুল টয়লেটে দু’টি স্টিকই নেগেটিভ এলো। মিলি আনন্দের ফোয়ারায় নেচে উঠে বলল, বাঁচলাম বাব্বা! ঐ গাধাটার বাচ্চা জন্ম দিতে হলো না আর।
ওদিকে মুকুলের মুখে বিষাদ কালো মেঘের আবরণ। কমোডের ওপর ধপ করে বসে পড়ল মুকুল। মিলি হাত ধরে বলল, শোন, তুই খুব স্ট্রেসের ভেতর দিয়ে গেছিস তাই পিরিয়ড মিস করেছিস। আর ঐ মাথা ঘোরা, না খেয়ে থাকলে তো হবেই এসব। এনাম ভাই যদি বেঁচে থাকেন আর আমরা যদি তাঁকে খুঁজে পাই তাহলে মা তো তুই হতে পারবি মুকুল। কিন্তু আগে তো নিজেকে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, বল।
বাস্তবের মুখোমুখিই তো দাঁড়িয়ে আজ মুকুল। গত তিনমাস ধরে এনাম নিখোঁজ। সেদিন অফিস থেকে ফিরছিল ও। ফোনে কথাও হয়েছিল মুকুলের সাথে। এরপর থেকে ফোন বন্ধ। কারা যে ওকে তুলে নিয়ে গেছে মাইক্রোবাসে করে। কেউ বলছে সাদা পোশাকের লোক, কেউ বলছে রাজনৈতিক অপহরণ, আবার কেউ বা বলছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের কাজ। এনাম একদল লোকের পেছনে লেগেছিল সত্যি। মাঝে মাঝে রাত জেগে ল্যাপটপে লিখতো সেসব রিপোর্ট। কিন্তু রিপোর্ট তো কত জনই লিখেছে। তাই বলে এমন করে উধাও করে দিতে হবে? নকল ওষুধে বাজার সয়লাব। কোথায় যেন নকল ওষুধ খেয়ে শিশুও মারা গেছে। তাই নিয়ে এনামের মনে সে কি বিক্ষোভের ঝড়! মুকুল ভেবে ভেবে কিনারা খুঁজে পায় না। দিনের পর দিন এনামের অফিসে ধর্ণা দিয়েছে নিজের কাজ ফেলে। কিন্তু কেউ কোনো খবর দিতে পারেনি। বরং বেশিরভাগই সাহায্য করার নাম করে মুকুলের ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে। মর্গের লোকদের টাকা দিয়ে রেখেছে নতুন কোনো লাশ এলেই যেন ওকে ফোন করে। ফোন এলেই ছিটকে গিয়েছে বরফের ধোঁয়া ওঠা ট্রে থেকে। অচেনা মানুষের লাশ দেখতে দেখতে একদিন তো কাকে যেন এনাম ভেবেই আঁকড়ে ধরেছিল। মুহূর্তে মর্গের লোকেদের উৎসাহ বেড়ে সেই লাশটিকে ওর ঘারে গছিয়ে দেবার উপক্রম। অল্পের জন্য সে যাত্রা মুকুল সামলে নিয়েছিল নিজেকে। দিনগুলো যেন লাফিয়ে লাফিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ক্যালেন্ডারের শেষ পাতার দিকে। এখন নামকরা সুপার শপে গুঁড়ো দুধের কর্ণারে দাঁড়িয়ে কোম্পানির কনসেপ্ট বলে আগত ক্রেতাদের। যাদের সাথে বাচ্চা থাকে ওদের দেখলেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। ওর আগের অফিসের কলিগরাও আসে মাঝে মাঝে। ট্রলি ভর্তি বাজার ঠেলতে ঠেলতে ওর সামনে এসে বলে, কেমন আছো মুকুল আপু?
এনাম ভাইয়ের খোঁজ পেলে?
কেউ কেউ আবার পরামর্শ দেয়- আরে ধুর! নিজে নিজে হারিয়ে গেলে তাঁকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়! দেখ কোথায় কোন প্রবাসী মেয়ে টেয়ে ধরে ফুট মেরেছে। তুমিও বিয়ে করে নাও একটা। আর কদিন পরে তো কেউ ফিরেও তাকাবে না। মুকুলের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে ওঠে কোম্পানির নীল ইউনিফর্মের পকেটের ভেতর।
মিলির বাসা থেকে চলে এসেছে ও অনেক আগেই। মিলির বন্ধুদের ভেতর অতি উৎসাহী মানুষের পোশাকে ঢাকা মাংসলোভী দু’একজন ছিল। কুকুর যেমন কসাইয়ের দোকানের সামনে জিহ্বা বের করে বসে থাকে তেমনি ওরাও আসতো। সোফায়, ডিভানে কাত হয়ে লালা ঝড়াত। মিলির উদ্দাম জীবন দেখে ওর প্রতি ঈর্ষাও বেড়ে যাচ্ছিল খুব। এরপর আর বন্ধুত্ব এগিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ছিল। এনামের হারিয়ে যাওয়া ওদের কাছে সামান্য একটি ব্যাপার। কি মিডিয়া, কি থানা-পুলিশ, কি এনামের অফিস কোথাও কোনো উদ্বেগ নেই। এনাম ভাই-ভাবির কাছে মানুষ হয়েছিল। বাবা-মা বেঁচে নেই বলে এই অপরিসীম যন্ত্রণা থেকে তাঁরা রেহাই পেয়েছে। প্রথম দিকে ভাসুর খুব ফোন করতো। এখন তাঁরাও নীরব। আর এই সব সমস্যা দেখার সময়ই বা কোথায় তাঁদের। সমস্ত কিছু থেকে সম্পর্কও এমন করে বাণিজ্যিক হয়ে উঠবে কে জানতো। এর ভেতর একদিন মিলির আত্মহত্যার প্রচেষ্টার খবর পেয়ে ছুটে গেল মুকুল। ফর্সা মুখটা কেমন নিস্প্রভ হয়ে আছে মিলির। প্রথমে কারুর মুখেই কোনো কথা ফুটলো না। মিলিই প্রথম কথা বললো- জানতাম তুই আসবি। গতকাল আমার মতো আরো দু’জন ছিল নাকি এখানে। ওদের খবর কোথাও ছাপা হয়নি। নার্সের কাছে জানলাম রোজ এরকম সব কেস ঘটে। সবাই নাকি বাঁচে না।
কথা বলিস না তো এতো।
মিলি সামান্য হাসলো। কথা বলার জন্যই তো ফিরে এলাম বল। এরপরের ক’টা দিন মিলির জন্য সমস্ত ভালোবাসা উজার করে দিলো মুকুল। অদ্ভুত ভালো লাগায় ওর মন আচ্ছন্ন হয়ে গেলে। দু’জনে মিলে টিভিতে টম এন্ড জেরি দেখতে দেখতে হেসে কুটিপাটি। আবার চাকরিটা গেল ওর। অবশ্য তাতে মন্দের ভালো হয়েছে মুকুলের। এই যে মিলির সাথে নতুন জীবন ফিরে পওয়াটা কেবল একা মিলিরই প্রাণ ফিরে পাওয়া ঘটেনি, মুকুলেরও যেন জীবন ফিরে এসেছে।
মিলি শুধু দেখতে ভালো তাই নয়, অসম্ভব প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর। সেই ও কেন আত্মহত্যার দিকে নিজেকে ঠেলে দিল সে প্রশ্ন মুকুলকে খোঁচায় না। বরং রোজ মিডিয়ার হরেক রকম খবরে রীতিমত অবাক হয় ও। মিলিও সেসব দেখে নিঃশব্দে হাসে। আচমকা ও যেন একটা শিশুতে পরিণত হয়েছে। সারাক্ষণ হাসি লেগে আছে মুখে। এমনকি রান্নাও করছে নতুন নতুন। মুকুল চাকরির বিজ্ঞাপন দেখছিল সেদিন বিকেলে চুপচাপ। মিলি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো- তোর কি ঢাকা শহর ভালো লাগে মুকুল?
উত্তর না দিয়ে মুকুল পাল্টা প্রশ্ন করল- তোর ভালো লাগে?
ফাক অফ দিস সিটি!
পুরোপুরি নিজের মাঝে ফিরে এসেছে মিলি। বুঝলো মুকুল। দেয়ালে বেশ বড় ছবি ঝুলছে মিলির। ঘন সবুজ পাহাড় পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে ঝলমলে মিলি হোসেন। চোখে রোদ চশমা। ঠোঁটে অর্থপূর্ণ হাসি। ঐ ছবির পাহাড়টা নাকি মিলির খুব প্রিয়। সিকিমে কোনো এক আশ্রমে গিয়ে তোলা ছবিটা। ঠিক এমন ছবির মত জায়গা নাকি পঞ্চগড়ে। করতোয়া নদীর ধারে। খুব বেশি লোকজন নাকি জানে না সে জায়গার খবর। খানিকটা রিসোর্টের মত। মিলির দাদুর নাকি ওটা। মিলির অদ্ভুত সব সিদ্ধান্ত শুনে মুকুলের প্রায় পাগল হবার দশা। এই বলছে ফ্ল্যাট বিক্রি করে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যাবে। আবার বলছে ওর দাদুর কাছে গিয়ে রিসোর্টের ব্যবসা দাঁড় করাবে। অবশেষে সত্যি সত্যি মিলি একদিন ওর ক্যারিয়ার, খ্যাতি, পার্টির হই-হুল্লোর থেকে নিজেকে ইস্তফা দিয়ে দিলো।
চমৎকার সব প্ল্যান নোট করে যাচ্ছে আর এখনে ওখানে ফান্ড ডোনেশন অ্যাপ্লাই করে যাচ্ছে। মুকুলের মনের ভেতর এনাম এখন কিছুটা মরচে ধরা চাকুর মতো চুপচাপ পড়ে আছে। আগের মতো এনামের জন্য মনের ভেতর কুচি কুচি হয়ো যাওয়া ক্ষত না থাকলেও একটা ভোঁতা শূন্যতা রয়ে গেছে। দেখতে দেখতে আড়াইটা বছর পার হয়ে গেছে অনায়াসে। মুকুলের কপালে কিঞ্চিৎ কুঞ্চন রেখা আর চেহারায় কঠোর একটা ভাব ছাড়া কিছুর আর বদল ঘটেনি। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির শরীরটা থেকে ওজন ঝড়ে গেলেও মুখের কঠোর ভাবটির জন্য মুকুলকে অনেক প্রাপ্তবয়স্ক লাগে এই যা। এই নিয়ে বেশ মজা করে মিলি। ওরা দু’জনেই মনে মনে জানে অনেক কিছুই কিন্তু না জানার ভান করে থাকে বলেই এনামের নাম উচ্চারণ করা তো দূর, এ অক্ষরের কাছাকাছি নামগুলোও মুখে আনে না। এইটুকু দূরত্ব ছাড়া ওদের ভেতর আর কোনো ফাঁক নেই। মিলির অতীত, অর্থ বৈভব ছাড়াও নির্মম কিছু ঘটনা দিয়ে ঠাঁসা। হোস্টেলের দিনগুলোতেই বলে দিয়েছিল সব মুকুলকে। মিলির বাবা নামকরা ব্যবসায়ী, কিন্তু মা ছিল চির রোগা। ফলে যা হবার তাই হয়েছিল। নিত্য নতুন মেয়ে নিয়ে যখন বাসায় ফূর্তি করতো মিলির বাবা তখন মেয়েকে নিয়ে মিলির মা ঘর বন্ধ করে কাঁদত। এই সব ঘটনার পর ঘটে যেত আরও নিমর্ম ঘটনা। মিলির বাবার এক বন্ধু ওর মায়ের সাথে গড়ে তোলে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিন্তু সবার অগোচরে আদরের কৌশলে মিলির শরীরে তার হাত আগ্রাসী হয়ে উঠতো। শুধু সেই একজনই না আরও অনেকেই মিলির শৈশব, কৈশোর যন্ত্রণায় ঢেকে দিয়েছে। বাবা-মায়ের তীব্র অবহেলার শিকার হতে হতে মিলিও তাঁদের থেকে দূরে সরে আসতে গিয়ে হয়ে গেছে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ।
এরপর ভালোবাসা খুঁজতে যেয়ে বার বার হোঁচট খেয়েছে মিলি। জাফরকে যতটা গাধা ভেবেছিল আসলে ততটা সে ছিল না। শেষদিকে ফ্ল্যাটটা লিখে নেবার জন্য চুড়ান্ত চালটি চেলেছিল বটে। ওদের ইন্টারকোর্সের ভিডিও ফাঁস করে দেবার হুমকি দিয়ে থেমে থাকেনি বরং পাঠিয়ে দিয়েছিল আমেরিকায় বাবার কাছে। মিলির বাবা এক কথায় জবাব দিয়েছেন- She is not my child.
মিলি ভেবেছিল মৃত্যুই বুঝি মুক্তির সহজ পথ। কিন্তু না, সেদিনের ঐ বেঁচে ফিরে আসাটাই ওর জন্য মুক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। যে মানুষ ঘড়ি পরতে এত পছন্দ করতো, সেই হাত এখন খালি। ইচ্ছে করেই মিলি এখন ঘড়ি বাদ দিয়েছে জীবন থেকে। হাতের ঐ কাটা চিহ্ন ওর জন্য বলে দেবে কখন কি করতে হবে। ওদের ট্রেন কমলাপুর থেকে ছেড়ে অনেকদূর ছেড়ে এসেছে। বাইরে হালকা বৃষ্টির চাদর। ট্রেনের জানালা তাই বন্ধ। অন্য সময় হলে মিলি কেবিন নিত। কিন্তু এখন ওর মানুষের মুখ খুব প্রিয়। যতদিন বাঁচবে, দেখবে শুধু জীবনের চলমান আনন্দই নয়, দুঃখ, যন্ত্রণা, হাসি সবটুকু উপভোগ করবে ও। মুকুলের মনের ভেতর চলছে আবার গুছিয়ে ওঠার গড়ন। করোতোয়া নদীর ঠান্ডা জলে গিয়ে খুব সাঁতার দেবে ও। নিজ হাতে গুছিয়ে তুলবে মিলির স্বপ্নের বৃদ্ধাশ্রম। দেবীগঞ্জের ঐ সবুজে ঢাকা রিসোর্টের এমন আপডেট ভার্সনের চিন্তা মিলিকে যেন উত্তেজিত করে রেখেছে, মুকুলকেও তাই। বাইরে ক্রমান্বয়ে পালটে যাচ্ছে দৃশ্যপট। ছুটে চলছে তীব্র বেগে একতা এক্সপ্রেস দিনাজপুরের দিকে। তার চেয়েও দ্রুততম গতিতে গাছপালা, ধানক্ষেত, বাজার, নদী সমস্ত পেছনে ধাবমান। এই একটি কারণেই মুকুলের ট্রেন খুব ভালো লাগে। বঙ্গবন্ধু সেতু পাবার আগেই মিলি আর ও ডাইনিং কারে গিয়ে কফি নিয়ে বসলো। এক টুকরো স্যান্ডউইচ মুখে তুলেই মিলি কফিতে মনোনিবেশ করলো।
ট্রেন এসে থেমেছে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশনে। বাইরে হকারদের চিৎকার চেঁচামেচি। বাদাম, সিগারেট, পানি নিয়ে ছুটছে একেবারে দশ বছর থেকে শুরু করে পঞ্চাশোর্ধ হকারটিও। মুকুল সেদিকে তাকিয়ে দেখল সামান্য এই বিরতিটুকুই ওদের জন্য কত মূল্যবান সময়! হঠাৎ একটু ডানে তাকাতেই দেখলো দু’হাতে ভর দিয়ে প্লাটফর্মে অনেকটা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে একজন বিক্রি করে চলেছে খবরের কাগজ। অদ্ভুত! ঐ অর্ধেক শরীরের পেছনে বাঁধা ব্যাগ। তাতে কাগজগুলো রোল করে সাজানো। ঠিক যেমনটি কলমদানিতে কলম রাখা থাকে অবিকল সেই ভঙ্গি। মুকুলের মনোযোগ অন্য কারণে আটকে আছে। দাড়ির জন্য মুখ দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু সমস্ত অবয়বের ভেতর পরিচিত এক ছাঁয়া নড়ে উঠলো কি? নাকি ঐ রকম মুখাকৃতির যে কেউ ওকে এখনও ধোঁকা দেয় সেই মর্গের অচেনা লাশটির মতো। মুকুলের তাকিয়ে থাকা দেখে মিলিও তাকালো। দেখলো তবে তেমন বিশেষ কিছু দৃষ্টিগোচর হলো না।
কি রে, ওমন করে কী দেখছিস?
মুকুলের মুখে অল্প অল্প ঘাম। কিছু শুনছে না সে। মনে হচ্ছে সেই! নেমে দেখবে কি! নাকি ডাক দেবে। কিনবে কি একটা কাগজ! গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে! দু’হাতে ভর দিয়ে পা-হীন হকারটি সামনে এগিয়ে যায়। মুকুল যে ওভাবে তাকিয়ে দেখছে তাঁকে হকারটি বুঝল না। অন্যান্য আরও সব মানুষের ভীড় মুকুলের দৃষ্টিপথ দখল করে নিয়েছে ততক্ষণে। ট্রেনের শরীর দুলে উঠলো। মিলি বেশ আলাপ জুড়ে দিয়েছে একজনের সাথে এরই ভেতর। এখনও জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যাবে হকারটিকে। কিন্তু মুকুল ওদিকে তাকাবে না আর। চোখ বন্ধ করে কফিতে চুমুক দিল ও। যেন এই ওর শেষ কাপ। কিছুতেই আর ধোঁকা খাবে না সে। কিছুতেই না। যদি মানুষটি সেই হয় তবুও না। চোখ বন্ধ করে ফেললো মুকুল। হয়তো নিঃশ্বাসও। যখন চোখ খুললো, বাহিরে জানালার ওপারে উদার, উন্মুক্ত, ভরাট যমুনা।