মেঘময়ী দাঁড়িয়ে আছে। কাঠমান্ডু টিচিং হাসপাতালের ইমারজেন্সি ঘরের আশপাশে খুব দৌড়াদৌড়ি। এই হাসপাতালে সে এর আগেও এসেছে একবার। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি বলে ট্যুরিস্টদের স্বাস্থ্যসেবা এখানেই দেয়া হয়। তবে হাসপাতালে এতটা দৌড়াদৌড়ি দেখেনি কখনও। মেঘময়ী আজ এসেছে অজানা এক উৎকণ্ঠা নিয়ে।
একজন স্বেচ্ছাসেবী তার কাছে জানতে চাইল,
‘তোমার কে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে?’
মেঘময়ী কোনো জবাব দিতে পারেনি। কী জবাব দেবে, বুঝে উঠতে পারছে না! আবারও জানতে চাইল ছেলেটি।
‘দুর্ঘটনায় তার কেউ মারা গেছে?’
মেঘময়ী এবার বলল- ‘হুমম, আমার হাজবেন্ড!’
এরপর …’ না- মানে’; ‘না মানে’ বলে কিছু একটা ব্যাখ্যা করতে যাবে, ওমনিই ‘আমি এক্ষুণি আসছি’ বলে ছেলেটি চলে গেল।
মায়ের বারণ ছিল এখানে আসার।
মা বলছিলেন, ‘যাওয়ার কী দরকার? ছেলেটার সাথে মৌখিক কথাই হয়েছে দু’দিন। আর তো কিছু হয়নি। বিয়ে তো হওয়ার কথাও ছিল না। এখন ওর জন্য অমন মায়া করে কী হবে!’
এ রকম কথা শোনার পর মায়ের সাথে খুব চেঁচামেচি করে ঘর থেকে বেরিয়েছে মেঘময়ী।
নেপালেই জন্ম মেঘময়ীর। দাদুবাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে। কিন্তু জন্মের পর ওই একবারই গেছে ঢাকায়। বাবা-মা দু’জনেই ব্যবসার কাজে নেপালেই থিতু হয়েছে। এরপর কাগজপত্রে এখন ওরা নেপালের নাগরিক।
শীতের এক ভোরে নাগরকোট-এর ছোট্ট এক ক্লিনিকে মেঘের কোলাহলে জন্মেছিল বলে বাবা নাম রেখেছিল ‘মেঘময়ী’। নামটা তার খুব পছন্দের। তার সাথে যে কোনো ট্যুরিস্টের দেখা হলেই সবার আগে স্বপ্রণোদিত হয়েই নামটা বলে দেয় সে।
‘ওয়াও! হোয়াট এ নাইস নেম!’- এ রকম কমপ্লিমেন্ট কত শত মানুষ তাকে বলেছে, হিসেব নেই!
ছেলেটার নাম আহসান। ওর সাথে কথা হয়েছে মাত্র কয়েক মাস। ইমো, ভাইবার আর ফেসবুক মেসেঞ্জারেই যোগাযোগ। এর ভেতরে অনেক ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে আহসানকে। নিশ্চয় ওর মোবাইলে সেই ছবিগুলো দেখা যাবে। তাতেই প্রমাণ মিলবে যে, সে আহসানের পরিবারের লোক। কিন্তু মোবাইলটা কি পেয়েছে উদ্ধারকর্মীরা?
মেঘময়ী নেপালের থামেল এলাকায় হ্যান্ডিক্রাফ্টসের একটি দোকান দেখাশোনা করে। নিজেদেরই দোকান। মায়ের গড়া এই দোকান মেঘময়ী আরও বড় করেছে নিজের চেষ্টায়। গোটা মার্কেটের ভেতরে সবচেয়ে জনপ্রিয় দোকানি সে। ট্যুরিস্টরাও খুব পছন্দ করে মেঘময়ীকে।
নানান রকম শোপিস বিক্রির পাশাপাশি কিছু ইন্সট্রুমেন্ট আর পেইন্টিংও বিক্রি করে। মেঘময়ীর আরও একটি দারুণ গুণ রয়েছে। তা হলো চমৎকার ইউকিলিলি বাজায়। ইউটিউব দেখে আর স্থানীয় এক মিউজিশিয়ানের কাছ থেকে শিখেছে এই বাদ্যটি বাজানো।
রোজ সন্ধ্যায় থামেলের একটি কফি শপে কিছুক্ষণ ইউকিলিলি বাজিয়েও টাকা পায় মেঘ। এ রকম জীবনের প্রায় সব গল্পই সে আহসানের সাথে শেয়ার করেছিল। ভালো লাগা-ভালোবাসার তো কোনো ব্যাকরণ হয় না। মেঘময়ী তাই যুক্তিহীনভাবে আহসান নামের এক ট্যুরিস্ট গাইডকে ভালোবেসে ফেলেছিল।
আহসান করিম ঢাকার এক সাধারণ ছেলে। ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করে ওরা ৩ বন্ধু মিলে। বাবার সাথে মেঘময়ী ঢাকায় যাওয়ার পর আহসানদের ট্রাভেল কোম্পানির হয়ে তারা কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিল। সেখানেই পরিচয়। প্রথম দেখা।
প্রেমসূত্র বাঁধতে যা যা প্রয়োজন হয়; তার সবকিছুই মিলেমিশে একাকার হয়েছিল সমূদ্রপাড়ে। কক্সবাজারের সাঁঝবেলার ভাটির সময় দু’জন দু’জনার হাত ধরে শপথ করেছিল- ‘এই পৃথিবীপৃষ্ঠে তারা একে অপরের হয়ে থাকবে আমৃত্যু।’ আহা! মৃত্যু কত সহজ! কত কঠিন?
অথচ কী অবাক কাণ্ড! কক্সবাজারে সেদিন ছিল তাদের দেখা-সাক্ষাতের মাত্র তৃতীয় সন্ধ্যা। এর পর নেপালে দেখা তাদের। মেঘময়ীর বাবা তার বন্ধুর মতো। মেঘ তাই বাবাকে দিয়েই মাকে বোঝানোর আশ্রয় নেয়। বাবা বুঝেছিল সব। মা মেনে নেয়নি।
নেপালে আহসান আসার পর বাড়িতে এনে দেখা করিয়েছিল মাকে। মায়ের মোটেই পছন্দ না। এর অবশ্য একটি কারণও রয়েছে।
মেঘময়ীকে সে থামেলের থ্রিস্টার কান্তিপুর টেম্পল হাউসের এমডির সাথে বিয়ে দিতে চায়। এমডি মেঘময়ীকে পছন্দ করে খুব। বেশ ক’জনার মাধ্যমে সে খবর মেঘময়ীর মাকেও জানিয়েছিল। গত ক্রিসমাস ডে’তে তাদের হোটেল পার্টিতে পুরো পরিবারকে সামান্য কারণে এক লটারিতে জিতিয়েছিল মেঘময়ীর উসিলায়। পুরো পরিবারকে ডিনারসহ সুইটে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করেছিল। মেঘময়ীর মায়ের মন এর পর থেকেই যেন অকারণে বাঁধা। মেয়েকে সে ওই এমডির সাথেই …
সকালে যখন এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল মেঘ; ওর মা বারবার বারণ করে।
এর পর মাকে ফোন করে এয়ারপোর্ট থেকেই খুব চিৎকার-চেঁচামেচি করেছে মেঘময়ী। যখন সে চোখের সামনে আহসানকে বহন করা এয়ারক্রাফ্টটিতে আগুন ধরে যেতে দেখে। অবাক কষ্টের দু’চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না মেঘময়ী।
ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের বেশ ক’জন অফিসার তার পরিচিত। সেই সূত্রেই একেবারে ইমিগ্রেশন পার করেই সকাল থেকে দাঁড়িয়ে ছিল ফুলের বুকি হাতে। আশপাশের সকলে কী রকম মিটমিট করে হাসছিল মেঘময়ীকে দেখে। খুব বেশি সাজেনি। লাল-রঙা একটি সালোয়ার-কামিজ পরে বাঙালি বেশ নেওয়ার জন্য মাঝারি সাইজের একটি টিপ পরেছিল। আশপাশের লোভাতুর চোখগুলো সুন্দরীকে বারবার ঘুরে ঘুরে দেখানোর যন্ত্রণা তো ছিলই! এসব যদিও গায়ে মাখে না মেঘময়ী। দুর্বল কাপুরুষোচিত সমাজে তার এসব অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজার মানুষকে চষে বেড়ায় বলে চোখ দেখেই চিনে ফেলে পুরুষ নামের প্রাণীদের মন!
আহসানকে চিনেছিল। সহজ-সরল অংকের মতো দুটি চোখ ওর ! সব পড়া যায় তা সাবলীলতায়! ভালো লেগেছিল। ভালোবেসেছিল খুব।
অথচ সেই দুর্ঘটনা স্বচক্ষে দেখার পর দুপুর থেকে টিচিং হাসপাতালেই পায়চারি করছে। তার কাছে তো আহসানের কোনো পাসপোর্ট নাম্বারও নেই। ৪৭ জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছে, এমন খবর পেয়েছে সে, যাদের অনেককেই চেনা মুশকিল। এ ছাড়া বিকল্প আর কোনোভাবে শনাক্ত করা যায় কি-না, জানতে চাইলে মেঘময়ী কিছু বলতে পারে না।
কালো কয়লার মতো লাশের সারি! বুকটা হু-হু করে কেঁদে ওঠে মেঘময়ীর।
বাংলাদেশের অনেকটি অনলাইনে খবর এসেছে। সেখানে আহসানের ফেসবুকে লেখা- ‘যাচ্ছি মেঘের দেশে! মেঘের কাছে যাই।’ আর সেলফিতে হাসিমুখ। এই হাসিমুখ আহসান যে মেঘময়ীর জন্যই পোস্ট করেছিল!
এটাই ওর শেষ স্ট্যাটাস। বারবার সেল ফোন স্ট্ক্রিনে এই শেষ স্ট্যাটাসটি দেখে চোখের জলে মোবাইল স্ট্ক্রিন ভিজিয়ে ফেলছে মেঘময়ী।
বাংলাদেশি অনলাইন পত্রিকার তথ্য-
বাড়িতে বলে আসেনি আহসান। এমনকি তার ট্রাভেল অফিসেও বলে আসেনি নেপালে যাওয়ার কথা।
কাঠমান্ডুতে ওরা দু’জন নতুন ট্রাভেল অফিস চালু করার প্রস্তুতি নেবে, ঠিক করেছিল। আর পরিবার না মানলে নিজেরাই বিয়ের কাজটি সেরে নেবে। ট্রাভেল বিজনেস চলতে থাকলে তো যাতায়াত থাকবেই দু’দেশের।
কত শত স্বপ্ন মেঘময়ী আর আহসানের! হাসপাতালের একজন আবারও লাশ শনাক্তের ব্যাপারে মেঘময়ীকে ডাকে। কাগজে সই নেয় ওরা। কিছু না বুঝেই স্বাক্ষর করে মেঘময়ী। আহাজারির শব্দে হারিয়ে ফেলে উপস্থিত বুদ্ধি। পরদিন নিহতদের পরিবার আসবে।
দূর্ঘটনার রাত ১২ মার্চে ঘুম আসে না মেঘময়ীর। মেঘের সাথে মা কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ ফোনে খুব অকথ্য ভাষায় মেয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলেছে। মায়ের অভিশাপেই নাকি…
মেঘও রাতের খাবার টেবিলে প্লেটটি ঠেলে দিয়ে বলেছে, ‘মরে গেলেও তোমার ওই বুড়ো হোটেলবয়কে বিয়ে করব না। ‘
-মা আবারও তাকে সান্ত্বনা দেয়। সেই সান্ত্বনায় কোনো মানসিক পরিবর্তন হয় না মেঘের।
অথচ সারা-সন্ধ্যা কত রকম প্ল্যান করে রেখেছিল! ভেবেছিল, যেই ক্যাফেতে রোজ ইউকিলিলির সাথে ফোক গানে গুনগুন করে মেঘময়ী, সেই ক্যাফেতেও আজ আহসানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখবে। আহসানকে অবাক করতে সে এরই ভেতরে একটি বাংলা গানও রপ্ত করে ফেলেছিল!
অথচ পুরো থামেল আজ থমথমে। ‘মেঘময়ী স্টোর’ নামের দোকানটিও আজ বন্ধ। পর্যটকদের আনাগোনা তুলনামূলক অনেক কম। সারা রাত বাংলাদেশি নিউজফিড পড়তে পড়তে রাত পার করে দেয় মেঘময়ী।
হাসপাতালে পরদিন ভিড়টা বেশি। এলোমেলো পায়চারি করতে থাকে। আজও মেঘ একাই এসেছে। এই হাসপাতালের সম্মুখভাগে অনেকখানি প্রশস্ত উদ্যানের মতো রয়েছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল মেঘ।
হঠাৎ গতকালের স্বেচ্ছাসেবক দলের সেই ছেলেটা সামনে এসে বলে,
‘আপনাকেই খুঁজছিলাম। খুব মুশকিলে পড়া গেল বলুন তো। আপনি বললেন যে, আপনি আহসানের স্ত্রী। অথচ মৃতের স্ত্রী মারা গেছে ৪ বছর আগে। আহসানের ৪ বছরের এক মেয়ে তার দাদুকে নিয়ে এসেছে। একটু আসুন তো, আপনাকে খুঁজছে ওরা।’
মেঘময়ী হাত টেনে ধরে স্বেচ্ছাসেবী ছেলেটির। হাতজোড় করে বলে, ‘প্লিজ, ওদের কাছে নেবেন না আমাকে। আমাকে শুধু দূর থেকে ওর মেয়েটিকে দেখিয়ে দিন। আমি একটু দেখেই চলে যাব।’
নিরাপদ দূরত্বে থেকেই দাঁড়িয়ে দেখে মেঘময়ী আহসানের কন্যাকে। সে তার দাদুর হাত ধরে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। খবরে পড়েছে, ‘এক পরিবারের নাকি শুধু মা বেঁচে আছে। বাবা তার মেয়েকে খুঁজতে এয়ারক্রাফ্টের ভেতরে গিয়ে সেও নাকি মারা গেছে।’
চারদিকে আহাজারি আর বিলাপের সুর।
মেঘময়ী দূর থেকে আহসানের কন্যাকে দেখার চেষ্টা করছে। খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটিকে কোলে তুলে একটু আদর করতে। স্বেচ্ছাসেবক দলের ছেলেটি নিহত আহসানের নামের পাশে স্ত্রী হিসেবে মেঘময়ীর নাম লিখেই গণ্ডগোলটা পাকিয়েছে।
বেশিক্ষণ এখানে থাকাটা ঠিক হবে না মেঘময়ীর। দূরে গণমাধ্যমের ক্যামেরার জটলা। কেউ একজন ইশারায় মেঘময়ীর দিকে আঙুল তুলতেই মেঘময়ী দ্রুত পায়ে হাসপাতাল ছেড়ে মেইন রোডে চলে আসে। মেঘময়ী বুঝতে পারে, তার দিকে অনেক ক্যামেরা ধেয়ে আসছে।
রাস্তায় পাবলিক বাসও পেয়ে যায় সাথে সাথে।
বাসের জানালার বাইরে মাথা দিয়ে তবুও হাসপাতালের দিকে তাকিয়ে থাকে মেঘময়ী। আহসানের মেয়েটি অবিকল ওর মতোই হয়েছে। কী ফুটফুটে মেয়েটি! আহা! মেয়েটির কথা কেন লুকিয়েছিল আহসান? ওর বাবা নিশ্চয় ছেলের পোড়া শরীর দেখে চিনতে পারবে! একবার যদি দেখতে পারতাম! ছুঁতে পারতাম ওর পোড়া আঙুল! চোখ ভারী হয়ে আসে কান্নায়!
বাস পাহাড়-কাটা রাস্তায় মেঘময়ীর চিরচেনা শহরে চলতে থাকে নিজের গতিতে। আজও ‘মেঘময়ী স্টোর’ বন্ধ থাকবে। এখন সোজা প্রীতি নামে এক বন্ধুর বাড়িতে যাবে সে।
ওর ঘরের দরজা আটকে দিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদবে মেঘময়ী।