একুশ বছর পর অথবা একুশ বছর আগে, কথা কিন্তু একই থাকে। অর্থ কি একই বহন করে? আগে ও পরের এই মধ্যখানে যেন মধ্যবর্তী সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। দুটো হাত দু’পাড় থেকে বাড়িয়ে দেয়- ছুঁতে পায়, পায় না। পাওয়া না-পাওয়ার মাঝে যে সুর বাজে সেই সুর প্রেম হয়, কাব্য হয়, চিত্রকলা হয়, বিরহ-মিলনের মালা পরে- তারপর লীন হয়। আবার একদিন ‘কোকিলের রাগতস্বরে’ বুকের ভেতর শিহরণ জাগে। মনে পড়ে জীবনের এতগুলো দিন আগে যে পা ভিজেছিল ঘাসের শিশিরে, ঘুরেছিল মৌবন। যে হাত ছুঁয়েছিল যৌবনের ভেতরে যৌবন। উত্তাপে, শিহরণে, কামনায় ঘন হয়েছিল শ্বাস-প্রশ্বাস বুকের ভেতর। তা কি আর মনে থাকে একুশ বছর পর। নাকি থাকতেও পারে? নাকি প্রতিদিন একটার পর একটা একুশ, একটার পর একটা বসন্ত দিন এসে দ্বারে কড়া নাড়ে। আমি তার সহযাত্রী, সমগোত্রীয়- গমনে, সঙ্গমে।
একুশ বছর পরে অন্তত একুশ শতবার আমি কত স্থানে ঘুরেছি। কত হাতের স্পর্শে শিহরিত হয়েছি। ভুলে গেছি ভুলে যাব না বলে। মনে রেখেছি মনে রাখব না ভেবে। একটি সাঁকো পার হতে হতে আরেকটি সাঁকো পেরিয়ে অন্য গাঁ। একটি পথের ভেতর যেতে যেতে আরেকটি পথের সন্ধান।
না, এভাবে ঠিক হলো না। এসব তো স্মৃতির কথা। সে কি প্রেম? সে কি বিরহ? সে কি দেহ? সে কি শুধু কামনা? কিন্তু কে সে? কেন তাকে প্রশ্ন করি! কেন তাকে ভুলে যাই! কেন সে অজান্তে এসে দরজা খুলতে বলে। আদতে কেউ কি? নাকি শুধু বিভ্রম। নাকি দেহের আকাঙ্ক্ষাগুলো নানান অলিন্দ খুঁজে ফেরে সন্ধ্যার পাখির মতো ডানা ঝাপটায়। হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয় মনে, সে কি এমনি!
এই যে ১৪২৪-এর শেষ ফাল্কগ্দুনে বসে আছি আরণ্যকের ধু-ধু বারান্দায়। কাল চৈত্র আসবে। চারপাশ থেকে হু হু করে পাতা ঝরছে। মৃদু আর মধুর বাতাসে পাতাগুলো ঝরে পড়ছে গাছের গা থেকে। ফাল্কগ্দুনে তারা জড়িয়ে ছিল, ভরিয়ে ছিল, ফুল ফুটিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঝরে পড়ছে, চলে যাচ্ছে। এই পাতাদের নিয়ে কত ইশারা, কত হাতছানি, রূপ-রস-গন্ধে মেতে ছিল। রচিত হয়েছে প্রেমে, মিলনে-বিরহে। ফাল্কগ্দুন অন্তে চৈত্রের দ্বারপ্রান্তে যৌবনের পাতারা খসে পড়ছে। এই ঝরাপাতা জানান দেয় নতুন পাতার আগমনী। যেমন করে মদির সন্ধ্যার শেষ ফাল্কগ্দুনে বুকের ভেতর হা হা করে। আবার চৈত্রে তার বিরহ বাসর সাজায় মিলনের উদ্বেল আকাঙ্ক্ষায়। প্রৌঢ় পাতা ঝরার সঙ্গে নতুন পাতার জন্মের যে সম্বন্ধ রচিত, আগে এমনটি আমার মনে হতো না। মনে হতো, ঝরাপাতার পতন মানে ঝরে যাওয়া। কিন্তু এখন আর তা মনে তো হয়ই না বরং মনে হয় প্রত্যেকটি ঝরাপাতার সঙ্গে একটি নতুন পাতার সম্বন্ধ রচিত। প্রত্যেকটি পাতার বোঁটার সঙ্গে আবার যৌবনের কষ লেগে সঞ্চারিত হবে নতুন পাতারা। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়- ‘আমি চলে যাব বলে চালতে ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে…’।
ফলে কাল যার হাত ছুঁয়ে বলেছিলাম, তোমাকে ছাড়া মিথ্যে ত্রিভুবন। আজ আবার নতুন করস্পর্শে আরেকজনকে বলেছি তুমিই সত্য, তুমিই ত্রেতা, তুমিই দ্বাপর- এসো, করো আলিঙ্গন!
গত ফাল্কগ্দুনে যার ওষ্ঠ ছুঁয়েছিলাম, আজ চৈত্রে সে ঝরাপাতা হলে, আবার নতুন পাতার স্বাদ নেবে না এই ওষ্ঠযুগল, তা কি হয়? মনে পড়ে- ‘চোখের দাবী মিটলে পরে তখন খোঁজে মন/তাইতো প্রভু সবার আগে রূপের আকিঞ্চন (সত্যেন দত্ত)।’ মনে আসে, ‘আমি চুমোয় চুমোয় ডুবাব তোমার সকল দেহ মম’ (কাজী নজরুল ইসলাম)। আসলে বাতাস যখন শরীরকে ঝাঁকুনি দেয়, তখন গাছের পাতা ঝরে নতুন পাতার আশায়। আবার পুরাতনকে ঝরিয়ে দিয়ে দেহ-মনে তো নতুন শক্তির সঞ্চয় করতেই হবে। নইলে নতুনের উত্তাপ সইবে কেমন করে? মনে পড়ে প্রিয় প্রসঙ্গে আমরা কতই না মিথ্যাচার করি- তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। অধিকাংশ প্রেমিক-প্রেমিকার এই মধুর উচ্চারণ আসলে একটি মিথ্যে কথা; অবশ্য সুন্দর মিথ্যে!
সুন্দর মিথ্যের মধ্যে রয়েছে আকুলতা, রয়েছে কামনা আর উদগ্র বাসনার নানান অভিপ্রায়, রয়েছে নতুনের হাতছানি এবং রয়েছে হারাই হারাই। রয়েছে যেন না হারাই। যেন নতুনকে পাই, নতুন করে পাই। পুরাতনকেও নতুন করে পাওয়ার কামনা তো আছেই। সে জন্য অবশ্য প্রতিদিন সম্পর্কের চাষ করতে হয়। এই চাষাবাদের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক বিকশিত হতে থাকে। বিকশিত সম্পর্ক প্রতিদিনই আনন্দের, আরাধনার, উপভোগের। সে জন্য এক ফাল্কগ্দুন চলে গেলে চৈত্রেই তার পতন নয়। জীবনে প্রতিদিনই ফাল্কগ্দুন আসে। দেহ-মনের ফাল্কগ্দুনের কোনো শীত-গ্রীষ্ফ্ম, শরৎ-হেমন্ত কিংবা বর্ষার বাঁধন নেই।
‘সেই মেয়েটি এর থেকে নিকটতর হলো না!
কেবল সে দূর থেকে একবার আমার দিকে তাকাল’ (জীবনানন্দ দাশ)। এই যে নিকটতর না হয়ে দূর থেকে একবার তাকাল, এই তাকানোর মানে নিয়ে কেন আমি যেতে চাই কাছে? কেন আমি পেতে চাই নিকটে? নিকটতর না হওয়া সে চিরকাল নতুনের নাম। ফলে নতুনকে পেতে চাওয়া কোনোদিনই ফুরোয় না।
জীবনকে যেমন প্রতিদিন ভালোবাসি বলে প্রতিদিন বাঁচি। প্রতিদিন কাছে আসতে চাই বলে সম্পর্কে জড়াই। বাসনার নিকটতর হতে চেয়ে প্রত্যহ কামনাকুসুম প্রস্টম্ফুটিত হয়। কেউ সেই কামনাকুসুম বাগানের মালি। কেউ সে বাগানে ফুলের গায়ে হাত রাখে। কেউ একটা ফুল ছিঁড়ে হাতে নেয়, খোঁপায় পরে। কেউ নাকের কাছে নেয় গন্ধ-নির্যাস। আবার কেউ এর কিছুই না নিয়ে দূর থেকে চেয়ে দেখে, দূর থেকে নিকটে আসে, নিকটতর হয়। নিকটতর হতে গেলে কারও না কারোর নিকটে আসতে হয়। নৈকট্য এক উভয় ব্যাপার। ‘দোঁহে দোঁহা দরশিল উপজিল প্রেম/দারিদ পাইল যেন ঘট-ভরা হেম’ (জ্ঞানদাস)। শরীর দিয়ে হতে পারে, মন দিয়ে হতে পারে। মন যদি কল্পনায় তাকে রূপ দেয়- তাতে কার কি ক্ষতি?
দেহ যদি প্রতিদিন দেহকে না চাইত, তাহলে তো দেহের বিস্তার হতো না। মন যদি প্রতিদিন মনকে না চাইত, তবে তো মনের বিকাশ অসমাপ্ত থেকে যেত।
এই যে আমি মন নিয়ে, দেহ নিয়ে, হারানোর ভয় নিয়ে কতভাবে আকুল হয়েছি। তার মর্মার্থ কী? কাউকে তো মনে রেখেই। কাউকে তো ভুলে না যেতে চেয়েই। তবে না পাওয়া থেকে পাওয়ার জন্ম দ্বিগুণ। নিকটতর হতে না পারা থেকে নৈকট্যের উদগ্র বাসনা প্রবল- এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
আমরা যে বিরহের বাগান বানাই। সেখানে কত রকম বাসনার চাষ! প্রতি বিরহে কেউ না কেউ নেপথ্যে রহে। নিকটতর হতে না পারার বেদনাই বিরহের আঁতুড়ঘর। যেমন একুশ বছর আগে আমি যার নিকটতর হয়েছিলাম। যদিও সে জীবনানন্দের পঙ্ক্তির শুমত দূর থেকে তাকিয়ে আরও দূরে গেল। ফলে তাকে আমি প্রতিদিন চাষ করি মনে। এক ফাল্কগ্দুনে যার সঙ্গে দ্বিগুণ হয়েছিলাম, তার সঙ্গে চৈত্রে কি একা হয়ে যাই? নাকি চৈত্রে আরও তিন গুণ হওয়ার বাসনায় বিরহের গীত রচনা করি- এই প্রশ্ন আমার মনে একুশ বছর ধরে তোলপাড় করে। আমি তাকে ফাল্কগ্দুনে কি চৈত্রে- কোনো ঋতুতেই পারি না এড়াতে!
জগতে মানবের জন্যই সব ঋতু দেহের বিস্তারে বসন্ত আনে। কোনো প্রাণীর বেলায় এই কথার অন্যথা দেখতে পাওয়া যায়। অনেক প্রাণীর দেহ ঋতুর ওপর ভরসা করে চলে। কিন্তু মানুষের তা লাগে না। মানব-মানবী প্রতিদিন ঋতুর জন্ম দেয়- ঋতুবতী হয়।
আজকের এই ফাল্কগ্দুন একুশ বছর পর আমার কাছে হয়তো আজকের ফাল্কগ্দুন থাকবে না। অন্য এক ফাল্কগ্দুনের আঙিনায় বসে চুম্বনে সিক্ত হবো। আবার একুশ বছর আগে, যার সঙ্গে আমার ফাল্কগ্দুন ধরা দিয়েছিল দেহের বৈভবে, সেও এখন আরও বেশি তীব্র হয়ে আসে; চৈত্রে বিরহগীতি- সেও প্রেম। ফাল্কগ্দুনে প্রেমারতি- সেও প্রেম।
যেমন অনেকেই আছেন কপালে টিপ পরে রবীন্দ্রনাথের নামে কিন্তু ঘর করেন অন্যের সঙ্গে- প্রেম। আছে পুরুষও, বাগদানের আংটি যার নামে শোভা পায় অনামিকায়, তাকে গোপন করে অন্যের খোঁপায় জিনিয়ার চাষ করে সংসারের কত মালি, মিলিত হয় অন্যের সঙ্গে- প্রেম। শুধু এখানেই নয়, আছে অন্য দেশেও।
একবার ডাউকি সীমান্ত দিয়ে মেঘালয় যাবার পথে দেখা হয় স্পেনের এক যুবতীর সঙ্গে। তার সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে যখন বললাম, ‘টোয়েন্টি লাভ পোয়েমস অ্যান্ড এ সংস অব এ ডিসপেয়ার’-এর কবির দেশের মেয়ে তুমি। মুহূর্তেই তার মুখ গোলাপি আভায় বিকশিত হলো। আমি পাবলো নেরুদার নাম জানি, এতেই সে ফড়িং হয়ে উঠল। তার ভ্রমণের গন্তব্য পর্যন্ত পরিবর্তন করল। তার যাবার কথা ছিল শিলং হয়ে আসামের গৌহাটি। কিন্তু আমার সঙ্গে সে চেরাপুঞ্জিতে যাওয়র মনস্থির করল। শুধু তাই নয়, পাবলো নেরুদাকে আমি চিনি এ জন্য সে আমাকে ‘ওয়াইন রাত্রি’ নিবেদন করল। সেই রাতের গল্প অনেক। অনেক গল্প সংক্ষেপিত দেহে (পরিসরে) হবে না। তবে গল্প কিন্তু আমাকে ঘিরে নয়। পাবলো নেরুদাকে ঘিরে। যদিও আমার উত্তাপ ক্যারোলিনকে ঘিরে (ওর নাম ক্যারোলিন), আর ওর উত্তাপ পাবলো নেরুদাকে ঘিরে- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সে আরও জানাল, দুই বছর হয়েছে অ্যালকোহল এবং ধূমপান দুটোই পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু আজকের রাত অন্যরকম, পাবলো নেরুদার সৌজন্যে সে তার এই সংযম এক রাতের জন্য বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। সেই রাত আমরা দু’জনে জেগে পার করে দিলাম। আজ অনেক বছর হলো, সেই রাত, রাতের গন্ধ, স্পর্শসহ ক্যারোলিন আমার কাছে তেমনই জেগে আছে; তাই তো দেখি দেহ সর্বদাই জেগে থাকে, মনে কাঁটাতার। বসন্তের কোনো ফাল্কগ্দুন-চৈত্র নেই। দেহের স্পর্শে নেই কোনো আপন-পর। এটা যেমন সত্য, তেমনি এও তো সত্য যে, এই কাঁটাতার ঘেরা মন যদি শেষ পর্যন্ত জেগে থাকা দেহকে স্পর্শ না করতে দেয়, তবে দেহ ঘুমিয়েও পড়ে। আমাদের মনে আছে রূপকথার গল্পের কাজলরেখা একলা ঘরে রাজপুত্রের দেহ থেকে একটি একটি করে সুচ তুলে তাকে জীবন্ত করেছিল!
মন আর দেহ যদি এক তারে বাঁধা না যায়, তবেই বিপত্তি। দেহ যতই জেগে থাকুক, মনকেও জাগতে হবে। এই জাগা না জাগায় অনেক বেদনা নিয়ে ফিরেছি বহুদিন। সেই কিশোরদিনেও যেমন সত্য, তেমনি যৌবনবেলায়ও।
আমার বন্ধু মারজুক রাসেলের একটি কবিতা আছে- ‘যার কেউ নাই তার হাত আছে’। এই পঙ্ক্তিটি দুষ্টুমিতে যেমন ভরা, তেমনি বাস্তবতার নিরিখে পরখ করা। সব কথা গ্রহণ করতে পারা মানবসমাজ এখনও প্রস্তুত হয়নি। তাই আমাদের এত চিত্রকল্পের ব্যবহার, এত ইশারা- ইঙ্গিত। সেই কৈশোরে যাকে যাকে মনে করে, একলা একলা ভালোবেসে হেঁটেছি দস্যিদুপুর। আবার এও দেখেছি, কিছুটা আড়ালে-আবডালে পরস্পর প্রকাশের ভার নিয়ে কৃষ্ণচূড়ার ডাল নড়ছে। যদিও তাকে, তাদের অনেককেই ছুঁতে পারিনি এখনও। কিন্তু ফুরোয়নি কিছুই- সম্ভাবনায় জেগেই আছে, খোলা আছে আট কুঠুরি নয় দরজা। যৌবনে তো কথাই নেই। তবে যৌবনের চেয়ে দেহের কৈশোরিক জাগরণ আরও বেশি, আরও প্রবল। উপায়হীনতা এর জন্য কারণ হতে পারে। যৌবনে উপায় খুঁজে একটা না একটা পাওয়াই যায়। কিন্তু কিশোরবেলা ভয়ঙ্কর, উপায়হীন হয়ে একা একা অব্যক্ত ঘুরে বেড়ায়। কিশোরবেলায় যার জন্য দেহ জেগেছিল, তাকে পাবার কী প্রবল স্পৃহা! সেই প্রবল এখন হয়তো আরও বেশি পরিণত, আরও বেশি উদ্বাহু- কিন্তু ফুরোয়নি তার কিছুই।
তবু এই চৈত্রে, অনতিদূরে পাতার পতন দেখে ব্যথা জাগে বুকে। মনে হয়, দেহ একদিন বুড়িয়ে যাবে, ফুরিয়েও যাবে। কিন্তু এ পৃথিবীতে দেহের ফাল্কগ্দুন, ফাল্কগ্দুনের দেহ চিরকাল যৌবন যাপন করবে। সে চৈত্রে কি আর গ্রীষ্ফ্মেই কি- যৌবনের আছে অনিদ্র জাগরণ।