ফুতুমিয়ার জীবন ঝড়

ফুতুমিয়ার জীবন ঝড়

ছিদ্দিক : ওই বশর চল চল, ফটিকতলায় বটের শিকড়ে নাকি লাশ পাওয়া গেছে।
বশর : কি বলিস চল চল!

২ মাস পূর্বে…

শ্বরের এই সৃষ্টি বড়ই অদ্ভুত। তার অদ্ভুত সৃষ্টি ঋতু বদল। ভাবা যায় প্রচন্ড ঠান্ডা হতে হঠাৎ প্রখর গরমে উতপ্ত হয়ে উঠে এই প্রকৃতি। আবার কখনও মৃদু হাওয়ায় দোলায়িত করে সকলের হৃদয়। এভাবে আসে একের পর এক ঋতু। নদীর বৃদ্ধ ফুতুমিয়া বয়স ৫০ কি অধিক তবে ভেঙ্গে পড়েছে। জন্মের কোনো ঠিকানা নেই এক বন্যায় মাটির হাড়িতে নাকি ভেসেঁ এসেছিল সর্দ্দার খাওয়া পানি দিয়ে বড় করে কিন্তু সর্দ্দারের মৃত্যুর পর মিথ্যা অভিযোগ, অপবাদ আর থাকতে দিল না গ্রামে।

বিবাহ করেনি মাটির নিচে ঠাঁই ছিল না বলে। গ্রামে থাকতো না কোথায় বা থাকবে! কিছুই তো নেই ছোট একটা ভেলা ছিল সেটা দিয়ে নদীর উপর এক পুরাতন চরে বসবাস করতো। একটি খড়ের ঘর, দু-চারটে মাটির বাসনপত্রই ছিল তার শেষ সম্ভল, ওহ্ একটি মাছ ধরার জাল ছিল যেটাও অনেক জোড়াতুনিতে রয়েছে শুধু। তবে তার অন্যতম সাথী ছিল পশি ও পারুল ছাগল হলেও এরাই ওর পরিবার। গতকিছুদিন আগে ওদের বাছুর হয়েছে। বেশ আনন্দিত ফুতু! কিন্তু ঋতু বদলের সাথে সাথে পাল্টে যায় ফুতু মিয়ার জীবন প্রকৃতি। প্রচন্ড হাড় কাপানোঁ শীতেও প্রতিটি রাত কাটিয়ে দেয় গুটিসুটি দিয়ে ধানের খড় মুড়িয়ে। রিলিফের একটা চাদর এর জন্য গিয়েছিল গ্রামের মেম্বারের কাছে দেয় নি কারন তার কোনো প্রয়োজন নেই মেম্বারের।

শীতের পর ঋতু রাজ বসন্তের আগমনে তো বেজায় খুশি সে। কিন্তু সেই খুশি আর বেশিদিন সহে না ঋতু বদল হয়ে আসে গ্রীষ্মের সকাল। কাজের সময় অসুবিধা হলে ঘরের ভিতর গ্রীষ্মের সময় প্রচন্ড রোদ্রে তার সমস্যা হয় না খড়ের জানালা খুলে দিয়ে শীতল বাতাস গায়ে মেখে বেশ ভালোই দিন কাটাই সে। এসময় সে কিছু ছোট মাছের শুটকিও বানাই এবং তা একটি জালি মুড়িয়ে ঝুলিয়ে রাখে জানালার পাশে, সারাবছর প্রয়োজনে খাবে বলে। প্রতিদিনের মত সকালে পান্তা খেয়েই বেরিয়ে পড়ে কাজের খোঁজে তার নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই কখনো ভেলায় ভেসে মাছ ধরে তা হাটুরে বিক্রি করা আবার কখনও কারো মাটি কাটার বদলি হওয়া আবার কখনও বা কারো বাড়ী বুননে বাশঁ দিয়ে বেড়ি তৈরি করা।

এভাবে দিন বদলের সাথে সাথে গ্রীষ্মের শেষের দিকে চলে আসে তখন সে মনির সওদাগরের গোয়াল ঘর তৈরির কাজ করছিল। কাজের শেষ দিন ছিল তাই সওদাগর সকলকে বিরানী খাওয়ালো। মনির সওদাগর ফুতুমিয়ার পরিশ্রমে বেশ তুষ্ট ছিল। তাই, সকলে যাওয়ার পর মনির সওদাগর ফুতুমিয়াকে ডেকে একটা লুঙ্গি দিল। তারপরও সে মনির সওদাগরকে একটি কথা বললো যা সে প্রত্যেক কাজের শেষে কর্তাদের বলে থাকে ;

ফুতুমিয়া : খোদা আমনেরে রহমত দওক। আর একখান আবদার আছে, আমনের আর কোনো কামকাজ থাইকলে এই ফুতুমিয়ারে ডাকিয়েন।

সওদাগর : হা হা হা! ফুতু, তুই মেলা খাটুনি করতে পারিস।তোর মত মানুষ কাজকামে বহুত দরকার। যা আজ যা কোনো কাম থাইকলে তোরে আমি ডাকামু।

ফুতু : আইচ্ছা। আজ বাড়ী যায়। কাল হাট থেইকা শন কিনছি,ঘরের খড় গুলো পইচাঁ গেছে বর্ষাও চইলা আইছে।

সওদাগর : আইচ্ছা, যা তাইলে।

এতটুকু কথার পর ফুতু আনন্দিত মনে বাড়ীর পথে রওনা দিল। হাটতে হাটতে যখন ফটিকতলায় আসে তখন সে ভাবলো “এহানে একটু শুয়োন যায় সইন্ধ্যা হইতে তো বেজায় সময় আছে ” সে ফটিকতলার বটগাছের মোটা শিকড়ে উপর উঠে শুয়ে পড়লো। তার নিদ্রাতুর মুখে আলোক ছড়া পড়ছে তাই তার অসস্থি লাগছে তাই সে নতুন লুঙ্গিটা মুখের উপর দিয়ে শুয়ে পড়লো। ভালোই ঘুমাচ্ছিল। প্রায় ঘন্টাখানেক পর সে আচমকা হকচকিয়ে উঠলো বজ্রপাতের এক বিকট শব্দে। উঠেই সে যেন কেমন বেদিশে হয়ে গেল। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। মূহূর্ত্বের মধ্যে বাতাস বইতে শুরু হয়ে গেল। সে তৎক্ষনাৎ দ্রত গতিতে হেটে নদীতটে পৌঁছায় এবং কেওড়া গাছের সাথে বাধা ভেলার দড়িটা খুলে ভেলায় চড়ে চরে পৌঁছে গেল। প্রচন্ড বাতাসে চরের বালিগুলো উড়ছে কোনোভাবে সে তার কুঁড়েঘর ডুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

এমন পরিস্থিতি সে আগে কখনও দেখেনি তাই বার বার প্রকৃতির এমন রুপের কথা ভাবছিল। হঠাৎ সে তার উরুঁতে ব্যাথা অনুভব করলো তার মনে পড়লো ভেলা থেকে নামার সময় হেচড়াঁ খেয়ে বৈঠার সাথে আঘাত লেগেছে কিন্তু জোশের বশে তখন তা অনুভব হয়নি। তবে এই কি! সে দাড়াতে পারছিল না! ব্যাথায় সে খাটের উপর শুয়ে পড়লো। বাইরে বাতাসের গতি বাড়তে শুরু করলো সে লক্ষ্য করলো বাইরে রান্না ঘরের ছানিটা উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে যেন পুরো অক্ষম হয়ে গেল, যেন তার একটি উঁরু কাজ করছে না। এবার প্রচন্ডের বাতাসের সাথে বৃষ্টিও শুরু হল নদীও হয়ে উঠলো উত্তাল।

বৃষ্টির পানি তার কুঁড়েঘরের পচাঁ শন বেয়ে বেয়ে তার গায়ে পড়ছে সাথে পচাঁ শনগুলোও পড়ছে। তার মনেপড়ে পশি ও পারুলের কথা সে কখনও ওদের গলায় দড়ি বাঁধেনি সে আর নিজেকে ধমিয়ে রাখতে পারলো না একপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে কোনোভাবে দরজাটা খুলল সে দেখলো পশি, পারুল ও তাদের বাছুর দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে ভীত চোখে। সে পশির গলায় জড়িয়ে ধরলো আর বলতে লাগলো ” হে খোদা এই নিষ্পাপদের উপর রহমত কইরো” বলেই সে ভেলার দিকে তাকালো পানি অনেক উপরে উঠে গেছে চরের যা আগে কখনও হয় নি। সে বুঝতে পারলো ফুতুমিয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। সে একটি বাঁশের উপর ভর করে পশি, পারুল ও তাদের বাচ্চাদের নিয়ে ভেলার দিকে যেতে লাগলো। ভেলাও অনেক কাছে চলে এসেছে পানির সাথে।

সে ভেলার কাছে পৌছিয়ে পশি,পারুল এবং তাদের ছানাকে ভেলায় তুলে দেয় কিন্ত সে নিজে উঠে না কিভাবে উঠবে একটি ভেলায় তো এর ভার সয়বে না। সে একটি ঠোট বাঁকানো হাসি দিল আর ভেলার দড়ি ছেড়ে দিল। এরপর যা দেখাগেল তা ছিল অভূতপূর্ব পশি ও পারুল হঠাৎ ভেলার উপর কেমন যেন উদ্ভুত ব্যবহার করতে লাগলো যেন তারা ফুতুমিয়াকে ছেড়ে যেতেই চাই না। ফুতু হেসেঁ হেসেঁ চিৎকার করে করে বলছিল ” ওরে যা যা আমার তো কেউ নাই তোরা যা” হঠাৎ সে হাঁসতে হাঁসতে কেঁদে উঠে আবার নম্রভাবে বলে ” আমার তো কেউ নাই ” বলে সে আবার তার কুঁড়েঘরের ঢিলায় গিয়ে বসলো পানি ঘরের কাছেই চলে এসেছে।

পানি দ্রত উঠতে থাকে তার পা ছুঁয়ে যায় সে এদিক ওদিক তাকাই তারপর পানিতে হাত রেখে বলে ” তুই ঝড় অভিশপ্ত শত বছরের পুরানো চরটারেও ছাড়লি না ” বলতে বলতে জল তার কোমরে এসে পৌঁছায়। সে অনুভব করতে পারে পানি আর উপরে উঠছে না তবে চরটা তলিয়ে যাচ্ছে। পানি তার গলায় গলায় এবার তার ইতি হবে সে আবারও একটু হাঁসে আর মুখ ডুবার মূহুর্ত্বে সে বলে ” আহা মোর খোদা তোমার কত লীলা “।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত