জীবনের ধ্রুবতারা

জীবনের ধ্রুবতারা

সকাল সকালই একপ্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেলো বিতানের সাথে, আজকাল খুব সাধারণ কিছু কথাতেই আমাদের মধ্যে বাদ বিবাদ শুরু হয় যায়! আগে তো এমন ছিল না আমাদের সম্পর্ক টা, দিনে দিনে কোথায় পরিপক্ব হবে তা না শুধু অভিমান জমছে যেনো। আজ সকালে খুব সামান্য কারণে বিতান রেগে যাওয়ায় আমিও খুব ক্ষুব্ধ হয়ে যাই, এক কথা দশ কথাতে পরিণত হতে থাকে ফলস্বরূপ জলখাবার না খেয়েই বিতান বেরিয়ে পরে। এরম নয় যে আজ প্রথমবার বিতানের সাথে কথা কাটাকাটি হলো, কিন্তু এত রাগান্বিত হতে বিতান কে প্রথম দেখলাম… টেবিলে রাখা জলখাবারের দিকে চেয়ে আরো মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। রাগে দুঃখে আমিও খাওয়া ছেড়ে বেডরুমে চলে আসি। বারবার মনে হচ্ছিল এই সামান্য কিছু কথায় বিতান না খেয়ে চলে গেলো। বিতান পারলো এমনটা করতে?

অভিমান গুলো অশ্রু রূপে নেবে আসছে, অংকে মেলাতে পারছিনা কেনো এতো জটিলতা সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে আমাদের দুজনার মধ্যে। অশ্রুসিক্ত নয়নে পাড়ি দিলাম অতীতে… ইউনিভার্সিটিতেই প্রথম পরিচয় বিতানের সাথে, আমাদের বিভাগেরই ছাত্র। নিপাট ছিমছাম সাদাসিধা একটি ছেলে। খুব লাজুক, মুখচোরা, ‘কমকথা বলা দলের’ সেনাপতি বিতান রায়চৌধুরী। যেখানে অফ পিরিয়ডে আমরা হই-হই, চই-চই করতাম, বিতান আমাদের এড়িয়ে বই-খাতায় ডুবে থাকতো। আমরা সহপাঠীরা মজা করে ওকে ডাকতাম ‘বইমাছি’, বইপত্র দেখলেই যে গুনগুন করে বইয়ের চারপাশে ঘোরা শুরু করে দেয়। যদিও এরূপ নামকরণ করা হয়েছে জেনেও বিতানের কোনো হেলদোল ছিল না, সে বইময় জীবন যাপনেই রপ্ত ছিল। আমার এবং আমাদের পুরো বন্ধুগুষ্টির যেখানে মূলমন্ত্র ছিল পড়ালেখার পাশাপাশি ক্লাসে হইচই আর ধিঙ্গিপনা করা, সেখানে বিতান ছিল ‘চুপরাম সর্দার’। ছেলেটা শুধু জানত ক্লাসরুম, লাইব্রেরী আর পড়ালেখা।

না বিতানের সঙ্গে আমার কোনো প্রেম ভালোবাসা হয়নি ইউনিভার্সিটিতে পড়া কালীন, কিন্তু পরবর্তীতে হয়েছে এবং যথেষ্ট গাঢ় প্রেমই হয়েছে। ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে বেড়িয়েছি সে প্রায় অনেকদিন হলো, বিতানের সঙ্গে ক্লাশেও তেমন কথা হতো না আর মাস্টার্স শেষ হাওয়ার পর তো কথাই নেই যোগাযোগ রাখার, এরকম বে-রসিক আর পড়ালেখা-খোর ছেলের সাথে যোগাযোগ রাখার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু বিধি বাম! একদিন দেখা হয়ে গেল রাস্তায় বিতানের সাথে। দেখলাম একই আছে, শান্ত, লাজুক, চুপচাপ… আমিই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছিস রে ?”

স্মিত হেসে বললো, “ভালো”।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ” কি করিস এখন
বিতান?”
সে বললো, “কলেজে পড়াই, তুই?”
আমি এক গাল হেসে বললাম, “আমিও পরাই, তবে পড়ার বই না! শাড়ি পরাই, আমার বুটিক আছে একটা”
বিতান বললো, “ঠিকানা টা দে, দিদি কে নিয়ে যাবো তোর বুটিকে”। ঠিকানা দিয়ে তো দিয়েছিলাম ঠিকই, তবে ভাবিনি যে সত্যি সত্যি বিতান আসবে ওর দিদি কে নিয়ে। বিতান এলো একদিন, সঙ্গে দিদি আর দিদির ছোট্ট বাচ্চা। দিদি প্রায়শই আসতেন আমার বুটিকে, কখনো কখনো জামাইবাবুও আসতেন দিদির সাথে।

দিদির তরফ থেকেই আসে আমার জন্য বিতানের বিয়ের সম্বন্ধ টা। বিতানের এই দিদি জামাইবাবুই সব, মা বাবা আগেই গত হয়েছিলেন, তাই দিদির উৎসাহেই একরকম…. যদিও আমি মনেমনে স্থির করে নিয়েছিলাম নাকচ করে দেবো এই প্রস্তাব টি, বিতানের মত বিদ্যাধর কি আর বৌপ্রেমী হতে পারবে? কিন্তু নাকচ করতে পারলাম না…পারলাম না বললে ভুল হবে বিতান পারতে দিল না! আমার বাড়িতে বিতান কে সবাই খুব পছন্দ করলো ওর সরলতার জন্য, বিশেষত বাবা। বাবা যেনো হাতে চাঁদ পেলেন। বিয়ের পাকা কথা হওয়ার আগে যেদিন বিতান এসেছিল আমাদের বাড়ি সেদিন খুব গোমড়া মুখে বসেছিলাম আমি। একান্তে কথা বলার সুযোগ হলো যখন, তখন সে বললো, “তোর বোধহয় আমায় পছন্দ না, তাই না?”

আমি ঝট করে বলে দেই, “কি করে পছন্দ করি? ক্লাসে তো কথাই হতো না, এমন চুপচাপ, নিস্পৃহ, লাজুক, ভাবুক ছেলেকে বিয়ে করবো কি করে?” আমি ভাবলাম বিতান চলে যাবে বোধহয় দুঃখ পেয়ে, কিন্তু না! আমায় অবাক করে দিয়ে বিতান বললো “তা তো বটেই, তুই স্রোতস্বিনী প্রবাহমান নদী…আর আমি যেনো স্থির জলেভরা এক হ্রদ। কিন্তু সামান্য পাথরও যদি হ্রদের জলে পরে তাহলে যেরূপ কম্পনের সৃষ্টি হয়, হয়ত তোর চপলতায় আমার জীবনেও কম্পন আর শিহরণ জাগবে, কি বলিস?”। আমি অবাক হয় গেছিলাম!

কি বলবো… কোনো উত্তরও যেনো মুখে আসছিল না, পড়ালেখা নিয়ে ব্যাস্ত থাকা ছেলেটা এত গভীর প্রেম-ভালোবাসার কথাও বলতে পারে বিশ্বাস হচ্ছিলো না যেনো। প্রায়শই দেখা করতে লাগলাম আমরা, ধীরে ধীরে আমার তরুণ মনেও তখন বিতানের জন্যে রং লাগা শুরু, ভালোলাগা আর ভালোবাসা উভয়েরই যাত্রা আরম্ভ। শুভ সময়ে শুভদৃষ্টি ও মালাবদলও হয়ে গেলো। এই ধীর-স্থির, স্বল্প কথার মানুষটি কখন এত আপন হয়ে গেলো বুঝতেও পারলাম না, ওর সান্নিধ্যে আমার ধিঙ্গিপনাও যেনো হ্রাস পাচ্ছিল।

কিন্তু হঠাৎ আজকের ব্যাপারটা এতো কেনো চরম সীমায় পৌঁছলো যে বিতান রেগে গিয়ে না খেয়েই চলে গেলো! হটাৎ ফোন বেজে ওঠায় তাল কাটলো, দেখলাম পল্লবী দির ফোন।

পল্লবী দি আমাদের অ্যাপার্টমেন্টই থাকেন, অন্য ব্লকে। সময় দেখেই বুঝলাম আমি আজ পার্কে যাবো কিনা তা জানার জন্য ফোন করছেন। আমি বুটিকের কাজ সামলে সুযোগ পেলে মাঝেসাঝে বিকেলের দিকে পার্কে যাই। পল্লবী দি, সোনালী, জয়া দি, সৌমী সবাই মিলে বেশ কিছুটা সময় কাটাই আমরা পার্কে। কিন্তু আজ পুরোনো দিনের স্মৃতির পাতায় কখন হারিয়ে গেছি যে বিকেল হয়ে এলো তা বুঝতেই পারলাম না। পল্লবী দির সাথে কথা বলে ক্ষুণ্ণ মনে পার্কে পৌঁছলাম।

দি একা বসে আছে, বাকিদের দেখতে পেলাম না। আমার কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দি বললো, “আজ কেউ আসেনি রে, সোনালী আর জয়া অতিথি আপ্যায়নে ব্যাস্ত আর সৌমী মার্কেটে, যাক তুই এলি, তোর সাথেই আড্ডা দেবো। কিন্তু তোর মুখটা অমন শুকিয়ে আছে কেনো রে? তুই ঠিক আছিস?” আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না, সকালের সব কথা বললাম। পল্লবী দি চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষন। তারপর বললেন, “একটা কথা বলি, রাগ করিস না! জানিস, তোরা দুজনাতেই প্রেমে গ্রেপ্তার হয়ে আছিস বলেই না এত রাগ অভিমান হয়। হ্যাঁ, বলতে পারিস আগে কম হতো ইদানিং রাগ অভিমানটা একটু বেশি হচ্ছে, তাই বলে বিতান তোকে কম ভালোবাসে না রে পাগলি। মুখ ফুটে বলে না হয়ত, যখন তখন তোকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে না হয়ত, তোর প্রশংসায় পঞ্চমুখও হয় না হয়ত, তবুও তোকে ভালবাসে খুব। আমরা মেয়েরা আমাদের রাগ, অভিমান, আনন্দ, ভালো লাগা, মন্দ লাগা কত সহজে প্রকাশ করতে পারি, ছেলেরা সেটা পারেনা রে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুই অপাংক্তেয় হয়ে গেছিস, তোর কদর আর তোর জন্য অগাধ ভালোবাসা ঠিকিই আছে বিতানের হৃদ-কুঠুরি তে”।

পল্লবী দির কথা গুলো ভাবতে ভাবতে উপরে ওঠে দেখি ফ্ল্যাটের দরজার সামনে বিতান দাঁড়িয়ে, চমকে উঠি একদম। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে যে, তোমার চাবি টা?” বিতানের কাছে একটা চাবি থাকে, আমি বাইরে থাকলে বিতান কে আমার অপেক্ষা করতে হয় না তাহলে, তাই ভাবছিলাম বিতান আজ বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো!!বিতান খুব সংক্ষেপে বললো, “ভেতরে চল”। ভেতরে আসতেই বিতান বল্লো, ” আসলে…ওই সময় রাগারাগি তে, ঘরের চাবি টা নিতে ভুলে গেছিলাম”।

আমি বলি, “একটা ফোন তো করতে পারতে বিতান, আমি চলে আসতাম, এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলে।” বিতান আবার চুপ করে রইলো… আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, আমার হাতটা ধরে বললো

“সকালের ব্যাপারটার জন্য আমি…”
এবার আমি বিতানের ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁইয়ে বললাম

“তোমার মৌন ভালোবাসার আবেশে ভেসে যেতে দাও বিতান, আমারও উচিত হয়নি তিল কে তাল করা, সকাল থেকে খুব বিমর্ষ ছিলাম এখন তোমার সান্নিধ্যে সুখের রেশ পাচ্ছি বিতান, ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক এবার।”
বিতানের বাহুবেষ্টনী তে আমি, প্রানবন্ত সীমাহীন ভালোবাসার উষ্ণতায় সজীব হয়ে উঠছে প্রতিটা মুহূর্ত আর কোথা হতে যেনো ভেসে আসছে “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা” গানের ঝংকার…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত